ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

ঢাবিতে স্মৃতি চিরন্তন

পোড়ামাটির ফলকে লেখা আত্মদানের ইতিহাস অনন্য উপস্থাপনা

প্রকাশিত: ০৬:২২, ২৫ জুন ২০১৫

পোড়ামাটির ফলকে লেখা আত্মদানের ইতিহাস অনন্য উপস্থাপনা

দাম দিয়ে কিনেছি বাংলা কারও দানে পাওয়া নয়...। একাত্তর সালে দাম দিতে হয়েছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কেও। এ ক্যাম্পাসে গৌরবের ইতিহাস যেমন রচিত হয়েছে, তেমনি আছে প্রাণ বলিদানের বেদনাবিধূর স্মৃতি। ২৫ মার্চ কালো রাতে এখানে শিক্ষক শিক্ষার্থী থেকে শুরু করে কর্মকর্তা কর্মচারীদের নির্বিচারে হত্যা করেছিল পাকিস্তান বাহিনী। দীর্ঘদিন ধরে সেই কালোরাত্রির, সেই গণহত্যার সাক্ষ্য দিচ্ছে ভিসি চত্বরে নির্মিত পোড়ামাটির ফলক। তবে এখন এটি আরও সমৃদ্ধ। আরও সুন্দর। সংস্কারের মাধ্যমে মন্যুমেন্টটিকে নতুন চেহারা দেয়া হয়েছে। নামকরণ করা হয়েছে। এখন নাম- স্মৃতি চিরন্তন। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী থেকে শুরু করে সাধারণ পথচারীরাও আগ্রহ নিয়ে দেখছেন। পরিচিত হচ্ছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আত্মত্যাগের ইতিহাসটির সঙ্গে। জানা যায়, স্মৃতিফলকটি প্রথম নির্মাণ করা হয় ১৯৯৫ সালে। ওই বছরের ২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবসে আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করা হয়। স্থপতি ছিলেন মহিউদ্দীন শাকের। ড্রইংয়ের কাজ করেন শিল্পী আবু সাঈদ। ড্রইং অনুমোদন করেন রফিকুন্নবী। কংক্রিটের দেয়ালে বসানো পোড়ামাটির ফলক পাক বাহিনীর হত্যা নির্যাতনের ইতিহাস, যেটুকু সম্ভব, তুলে ধরেছিল। একাত্তরে বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় শহীদ শিক্ষকদের নামের একটি তালিকা খোদাই করা ছিল এখানে। জায়গাটি তাই শহীদ বুদ্ধিজীবী চত্বর নামে পরিচিতি পায়। তবে বিভিন্ন সময় অযতœ অবহেলার শিকার হয় স্মৃতিফলকটি। জীর্ণদশায় পতিত হয়। দেয়াল থেকে পলেস্তরা খসে পড়তে থাকে। টেরাকোটার শিল্পকর্ম ম্লান হয়ে যায়। ঘাস বড় হয়ে অনেকটা জঙ্গলের পরিণত হয়। এসবের বাইরে, নির্মাণের সময় মূল কাজেও কিছু সীমাবদ্ধতা ছিল। সব আমলে নিয়ে সম্প্রতি মন্যুমেন্টটি সংস্কারের উদ্যোগ নেয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। একে আরও সমৃদ্ধ করতে, দৃষ্টিনন্দন করতে চমৎকার পরিকল্পনা নিয়ে কাজ শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদ। মৃৎশিল্প বিভাগের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা টেরাকোটার কাজ করেন। তিন মাস ধরে চলে কাজ। এ সময় জায়গাটি টিন দিয়ে আড়াল করা ছিল। গত ১৭ জুন থেকে সকলের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া হয় স্মৃতি ফলকটি। সেদিন থেকেই এখানে মোটামুটি ভিড় লেগে আছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা যেমন নতুন করে দেখতে আসছেন, তেমনি আসছেন কৌতূহলী সাধারণ মানুষ। মঙ্গলবার সেখানে গিয়ে দেখা যায়, বদলে যাওয়া চারপাশ। গোটা এলাকার চেহারাটিকে নতুন মনে হয়। বিশাল রেইনট্রির বিপুল সবুজের নিচে আরও বেশি দৃষ্টিনন্দন হয়ে ধরা দেয় স্মৃতিফলকটি। খুব নীরবে তুলে ধরে একাত্তরের শোকগাথা। কালো সিঁড়ি ভেঙ্গে ওপরে উঠলে চোখের সামনে এসে দাঁড়ায় ছোট বড় ১৪টি দেয়াল। এবার গ্রানাইড পাথরের। নিকষ কালো দেয়াল বুকের ভেতরে কেমন যেন শোকের মাতম তুলে। বেদিতে ওঠার সময় বাম পাশে প্রথম যে দেয়ালটি, সেখানে যেন ভূমিকা লেখা। যাঁদের প্রাণের বিনিময়ে বাংলাদেশ পাওয়া সেই বীর শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা কৃতজ্ঞতা জানানো হয়েছে। রবীন্দ্রনাথের রচনা থেকে নিয়ে টেরাকোটা ফলকে লেখা হয়েছে- মরণসাগর পারে তোমরা অমর,/ তোমাদের স্মরি। নিখিলে রচিয়া গেলে আপনারি ঘর/ তোমাদের স্মরি।’ সমান দূরত্বের ডান পাশে নজরুল। কবির রচনা থেকে আশ্চর্য সুন্দর নির্বাচন। যেখানে তিনি বলছেন- ‘শহীদ ভাইদের মুখ মনে কর, আর গভীর বেদনায় মূক স্তব্ধ হইয়া যাও। মনে কর তোমাকে মুক্তি দিতেই সে এমন করিয়া অসময়ে বিদায় লইয়াছে।’ কথাগুলো পড়তে পড়তে মন বেদনায় পূর্ণ হয়ে ওঠে। চোখের সামনে যেন ভেসে ওঠে একাত্তরের দুঃসহ স্মৃতি। তার পর শুরু হয় হারানো স্বজনদের খোঁজা। প্রতিটি দেয়ালের গায়ে কালো। সেই কালোর গা চিরে সাদা রঙে লেখা শহীদ স্বজনদের নাম পরিচয়। শহীদ শিক্ষক শিক্ষার্থী কর্মকর্তা কর্মচারীদের তালিকাটি আগে শুধু বাংলায় লেখা ছিল। বাইরের দেশের মানুষের কাছে গণহত্যার চিত্রটি তুলে ধরতে এবার যোগ হয়েছে ইংরেজীও। প্রতিটি দেয়াল মনোযোগ দিয়ে পড়া গেলে মুক্তিযুদ্ধে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবদান কতখানি, তা কিছুটা হলেও অনুমান করা যায়। পাকিস্তান বাহিনী যে পরিকল্পিতভাবে গণহত্যা চালিয়েছিল, সে ইতিহাসও এখানে কথা বলে। স্মৃতি চিরন্তনের ভেতরের অংশে শুধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে তুলে ধরা হলেও, বাইরের অংশে গোটা বাংলাদেশ। বাঙালীর আন্দোলন সংগ্রামের দীর্ঘ ইতিহাস ধারাবাহিকভাবে তুলে ধরা হয়েছে এখানে। সবই অদ্ভুত সুন্দর পোড়ামাটির ফলকে। দক্ষ হাতে গড়া টেরাকোটার প্রথমটিতে সুজলা সুফলা শস্য শ্যামলা বাংলা মায়ের মুখ। ১৯৫২ সালে এ মায়ের ভাষাই আক্রান্ত হয়েছিল প্রথম। পোড়ামাটির ফলকে সে ইতিহাস। ভাষার জন্য বাঙালীর যে সংগ্রাম, যে আত্মত্যাগ, তুলে ধরা হয়েছে এখানে। ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ স্লোগানে মুখর তারুণ্য। টেরাকোটায় লেখা হয়েছে অমর সঙ্গীত- ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো/একুশে ফেব্রুয়ারি/আমি কি ভুলিতে পারি...।’ পাশেই মায়ের ভাষা বাংলা নিয়ে গৌরব- ‘মোদের গরব মোদের আশা আ-মরি বাংলা ভাষা...।’ একটি পোড়ামাটির ফলকে ১৯৭১ সালের উত্তাল মার্চ। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ। ফুঁসে ওঠা জনসমুদ্র। এরই ধারাবাহিকতায় আসে পাকিস্তানী বর্বর আক্রমণের ইতিহাস। নির্বিচার গণহত্যার চিত্র তুলে ধরেন মৃৎশিল্পীরা। মুক্তিযোদ্ধাদের নয় মাসের প্রতিরোধ সংগ্রাম মূর্ত হয়। সব শেষে বহু কাক্সিক্ষত স্বাধীনতা। সেই স্বাধীনতার পতাকা উড়িয়ে দিয়েই শিল্পীরা আজকের বাংলাদেশ পর্বে প্রবেশ করেন। এখানে মোট টেরাকোটা ৮টি। সবকটিই আগের তুলনায় বড় পরিসরে করা। নিখুঁত ও হাই রিলিফ কাজ। খুঁটিয়ে দেখার ইচ্ছে হয়। এ অংশের গ্রানাইড পাথরের রং ধূসর হওয়ায় টেরাকোটার কাজগুলো আরও সুন্দরভাবে দৃশ্যমান হয়। দেখে মুগ্ধ না হয়ে পারা যায় না। স্মৃতি চিরন্তরের বেদিতে ওঠার জন্য সিঁড়ি ছাড়াও রাখা হয়েছে বিকল্প একটি রাস্তা। এ রাস্তা দিয়ে অক্ষম ব্যক্তি ও প্রতিবন্ধীরা অনায়াসে ওপরে ওঠে যেতে পারছেন। মূল স্থাপনাটির সংস্কার ছাড়াও, এর চারপাশের জায়গাটুকু চমৎকারভাবে ব্যবহার করা হয়েছে। এক পাশে নির্মাণ করা হয়েছে দৃষ্টিনন্দন ফোয়ারা। আর রেইনট্রির কথা তো বলাই বাহুল্য, বিশাল গাছটির চোখ জুড়ানো সবুজ যেন স্মৃতি চিরন্তনের অংশ হয়ে ওঠেছে। এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক বলেন, বাঙালীর সবচেয়ে বড় অর্জন স্বাধীনতা। এ জন্য বাঙালীকে সাহসের সঙ্গে লড়তে হয়েছে। বহু প্রাণ বিসর্জন দিতে হয়েছে। একাত্তরে সারাদেশের মতো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকাতেও নির্মম হত্যাজ্ঞ চালিয়েছিল পাকবাহিনী। আমরা সেই বর্ববরতার ইতিহাস আগামী প্রজন্মের কাছে তুলে ধরতে চাই। স্মৃতি চিরন্তনে মুক্তিযুদ্ধের সময় শহীদ হওয়া বিশ্ববিদ্যালয় পরিবারের প্রায় সকল সদস্যের নাম রয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, ভবিষ্যতে আরও কোন নাম পাওয়া গেলে এখানে যুক্ত করা হবে। এ স্মৃতিফলক চলমান যুদ্ধাপরাধের বিচারের যৌক্তিকতাকে তুলে ধরে বলেও মত দেন তিনি। পুরো কাজ তত্ত্বাবধানের দায়িত্বে ছিলেন চারুকলা অনুষদের ডিন শিল্পী নিসার হোসেন। জনকণ্ঠকে তিনি বলেন, মূল নক্সা অক্ষুণœ রেখে আরও মজবুত ও শৈল্পিক উপাদানে সাজানো হয়েছে স্মৃতি চিরন্তন। আগের তুলনায় বর্তমানের কাজটি অনেক বেশি পরিকল্পিত।
×