ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী

কুলদীপ নায়ার কাদের জন্য ফরমায়েশি এই লেখা লিখছেন?

প্রকাশিত: ০৪:১২, ২৪ জুন ২০১৫

কুলদীপ নায়ার কাদের জন্য ফরমায়েশি এই লেখা লিখছেন?

বিষয়টি পুরনো, তবু লিখতে হচ্ছে। নরেন্দ্র মোদির সাম্প্রতিক সফরের উচ্ছ্বাস এখন ঢাকায় নেই। এখন চলছে ক্রিকেট খেলার উচ্ছ্বাস। এই উচ্ছ্বাসের মধ্যেও পুরনো কথার জাবর কাটতে হয়। কারণ, বাংলাদেশ ও ভারতের সম্পর্ক নিয়ে পানি ঘোলা করার প্রচেষ্টা এখনো চলছে। তাতে ভারতের এক বুড়ো ভাম-কলামিস্ট কুলদীপ নায়ারও যোগ দিয়েছেন। অবশ্য বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও তার গণতান্ত্রিক সেকুলার সরকারের বিরুদ্ধে প্রচারণায় যোগ দেয়াটা তার নতুন কোন কাজ নয়। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকেই তিনি এ কাজটি করে এসেছেন। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর মুজিব সরকার যখন ক্ষমতায় এবং যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশটিকে পুনর্গঠনে ব্যস্ত, তখন কুলদীপ নায়ারের কাঁধে ভর করেছিলেন তখনকার কট্টর আওয়ামী লীগবিরোধী এবং ‘চীনপন্থী বাম’ নামে খ্যাত ‘হলিডে’ সাপ্তাহিকের সম্পাদক প্রয়াত এনায়েতুল্লা খান। তার মুজিব সরকারবিরোধী সকল অপপ্রচারের উদ্ধৃতি নিয়ে নায়ার তখন ঢাউস আকারের বাংলাদেশবিরোধী কলাম লিখতেন ভারতের কয়েকটি প্রধান কাগজে। বর্তমানে এনায়েতুল্লা খানের অবর্তমানে তার কাঁধে সম্ভবত ভর করেছেন নিরপেক্ষ বাংলা ও ইংরেজী দৈনিক দুটির দুই সম্পাদক। এনায়েতুল্লা খানের অসমাপ্ত দায়িত্ব তারাই এখন পালন করছেন। তাদের কাগজেই কুলদীপ নায়ার ইংরেজী ও বাংলা দুই ভাষাতেই আবির্ভূত হন বেশি। কুলদীপ নায়ার সম্প্রতি একটি সিন্ডিকেটেড আর্টিকেল লিখেছেন বাংলাদেশ ও ভারত দুই দেশের কয়েকটি কাগজেই। লেখাটি হাসিনা-বিদ্বেষী। অসত্য ও অর্ধসত্য বিশ্লেষণে ভর্তি। ফরমায়েশি লেখার গন্ধ রয়েছে লেখাটিতে। আমি ’৭২ সাল থেকে তার বহু লেখার জবাব দিয়েছি। লন্ডনে তার সঙ্গে মুখোমুখি তর্কবিতর্কও হয়েছে। তিনি নিজেকে অসাম্প্রদায়িক ও নিরপেক্ষ কলামিস্ট বলে দাবি করেন। কার্যত তার অবস্থান ভারতের কট্টর ডান প্রতিক্রিয়াশীল ও সাম্প্রদায়িক শিবিরে। বাংলাদেশের সেকুলার মুজিব সরকারের বিরুদ্ধে যেমন (পরবর্তীতে হাসিনা সরকারের) তেমনি ভারতে ইন্দিরা সরকারের (পরবর্তীতে রাজীব সরকারের) বিরুদ্ধে তিনি অবিরাম বিষোদ্গার করে চলেছেন। পাকিস্তানের সামরিক সরকারগুলোর সঙ্গেও তার ঘনিষ্ঠতা ছিল। পাকিস্তানের ‘ডন’ পত্রিকারও তিনি ছিলেন নিয়মিত কলামিস্ট। সম্ভবত এখনো আছেন। কুলদীপ নায়ার ভারতের কোন্্ শিবিরের লোক তা স্পষ্টভাবে ধরা পড়ে ইন্দিরা গান্ধীর সরকারের পতনের পর যখন দেশটির সাম্প্রদায়িক শক্তিগুলোর সমর্থনপুষ্ট কট্টর ডানপন্থী মোরারজী দেশাই দিল্লীতে সরকার গঠন করেন। কুলদীপ নায়ার তাদের দ্বারা পুরস্কৃত হন এবং ব্রিটেনে ভারতের হাইকমিশনার নিযুক্ত হন। লন্ডনেই বাংলাদেশ ও মুজিব সরকার সম্পর্কে তার একটি বিতর্কিত মন্তব্য নিয়ে তার সঙ্গে আমার তর্কবিতর্ক হয়। তিনি স্বীকার করেছিলেন, বাংলাদেশ সম্পর্কে তার তখনকার মতামত গঠিত হয় এনায়েতুল্লা খানের লেখা পড়ে এবং তার পরামর্শ শুনে। বর্তমানে নায়ার ঢাকার দুটি নিরপেক্ষ পত্রিকার সম্পাদকদ্বয়ের কাছ থেকে কি ব্রিফিং পান তা আমি জানি না। কুলদীপ নায়ার বেশিদিন লন্ডনে ভারতের হাইকমিশনার পদে থাকতে পারেননি। ভারতে ইন্দিরা গান্ধী ক্ষমতায় প্রত্যাবর্তন করতেই তার চাকরি যায় এবং সেই ক্ষোভে তিনি দেশে ফিরে নতুন উদ্যমে তার লেখায় ইন্দিরা ও কংগ্রেস-বিদ্বেষ ছড়াতে থাকেন। বর্তমানে তিনি এমজে আকবর বা নীতিভ্রষ্ট কোন কোন খ্যাতনামা ভারতীয় সাংবাদিকের মতো নতুন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির কৃপাদৃষ্টি লাভ করতে পারেননি। তাই মাঝে মাঝে তিনি মোদি সরকারকে খোঁচা দিয়ে লিখছেন বটে, কিন্তু তার লেখাগুলো পড়লেই বোঝা যায় তার আসল লক্ষ্য নরেন্দ্র মোদির দৃষ্টি আকর্ষণ এবং মোদি যাতে তার পূর্বসূরি অটলবিহারী বাজপেয়ীর মতো ভারতের গণতান্ত্রিক ঐতিহ্যের পথ অনুসরণ না করেন, সেজন্য গণতন্ত্রের অনুসারী সেজে কৌশলে তার রাশ টেনে ধরা। এজন্যই হাসিনা-মোদি সখ্য এবং বাংলাদেশ ও ভারতের সম্পর্কোন্নয়ন তার চক্ষুশূল ব্যাপার। এই সম্পর্কোন্নয়নের প্রচেষ্টা ভারতের সকল মহলে অভিনন্দিত হয়েছে। চতুর কুলদীপ নায়ার তাই এই ব্যাপারে সরাসরি মোদি ও তার সরকারকে আক্রমণ না করে তার ছুরি শানিত করছেন বাংলাদেশের হাসিনা সরকারের বিরুদ্ধে। শেখ হাসিনাকে যদি জনসমর্থনশূন্য ও অগণতান্ত্রিক নেত্রী হিসেবে ভারতের জনগণের কাছে তুলে ধরা যায়, তাহলে প্রকারান্তরে প্রধানমন্ত্রী মোদির ওপরেও এই চাপ সৃষ্টি করা যায় যে, অগণতান্ত্রিক হাসিনা সরকারের সঙ্গে ভারতের মৈত্রী শুভ নয় এবং তা কারও কাম্য নয়। এই প্রচারণাটি বাংলাদেশে বিএনপির। তাদের নেত্রী ভারতের প্রধানমন্ত্রীর কাছে এই নালিশটিই জানাতে গিয়েছিলেন যে, বাংলাদেশে গণতন্ত্র নেই এবং হাসিনা সরকার অবৈধ, অগণতান্ত্রিক ও অত্যাচারী সরকার। বিএনপির এই প্রচারণাটিই মোদি সরকার এবং ভারতের জনগণের কাছে আরও নিপুণভাবে তুলে ধরা এবং তাদের প্রভাবিত করার জন্য বৃদ্ধ বয়সে কুলদীপ নায়ারের এই অশুভ প্রচেষ্টা। এজন্য কাদের দ্বারা কিভাবে তিনি পুরস্কৃত হচ্ছেন বা হবেন তা আজ না হোক কাল জানা যাবে। সম্প্রতি প্রকাশিত কুলদীপ নায়ারের প্রবন্ধটির জবাব দেয়া আমার আজকের লেখার উদ্দেশ্য নয়। তিনি বাংলাদেশের একটি সুশীল সমাজের যে প্রচারণার পুনরুক্তি করেছেন তার জবাব আমি ইতোমধ্যে বহুবার দিয়েছি। এ সম্পর্কে বিশদভাবে আবারও লেখার ইচ্ছে আছে। আমার আজকের লেখার উদ্দেশ্য নরেন্দ্র মোদির সাম্প্রতিক বাংলাদেশ সফর সম্পর্কে একটি বিভ্রান্তিকর প্রচার। প্রচারণাটির শুরু বাংলাদেশে। এখন তা নতুনভাবে ছড়ানো হচ্ছে বিদেশে। তাই পুরনো বিষয় নিয়ে নতুনভাবে আলোচনা করতে হচ্ছে। ঢাকায় ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকের সময় খালেদা জিয়া বাংলাদেশে গণতন্ত্র নেই বলে নালিশ জানিয়েছেন, এটা সকলেরই জানা কথা। প্রায় এক ঘণ্টার এই সাক্ষাতকারে দশ মিনিট তারা একান্তে কথা বলেন। তারা কি বলেছেন তা জানা যায়নি। কিন্তু অনেক জল্পনা-কল্পনা আছে, কলকাতার দৈনিক স্টেটসম্যান পত্রিকার সম্পাদক মানস ঘোষ ১০ জুনের কাগজে এ সম্পর্কে একটি প্রতিবেদন ছেপেছিলেন। তাতে বলা হয়েছিলÑ নরেন্দ্র মোদির তিনটি প্রশ্নের কোন যথাযথ জবাব বেগম জিয়া দিতে পারেননি। ভারতের প্রধানমন্ত্রী বিএনপি নেত্রীকে জিজ্ঞাসা করেছেন, ভারতের রাষ্ট্রপতির ঢাকা সফরের সময় আপনি যে হরতালের জন্য তার সঙ্গে পূর্বনির্ধারিত সাক্ষাতে যেতে পারেননি সেই হরতাল ডেকেছিল কারা? বেগম জিয়াকে জবাব দিতে হয়েছে হরতাল ডেকেছিল তারই জোট। দ্বিতীয় প্রশ্ন ছিল ২০০৪ সালে চোরাগোপ্তাভাবে দশ ট্রাক অস্ত্র ভারতীয় সন্ত্রাসীদের কাছে পৌঁছে দেয়ার জন্য চট্টগ্রাম বন্দরে খালাস করা হয়েছিল। সেই অস্ত্র আমদানির সঙ্গে আপনার স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী ও শিল্পমন্ত্রী জড়িত ছিলেন বলে অভিযোগ ওঠে। আপনার সরকার ওই তদন্ত এগুতে দেয়নি। বিব্রত বেগম জিয়া এ সম্পর্কে কোনো কথা বলেননি। তৃতীয় প্রশ্ন, বর্ধমানের খাগড়াগড় বিস্ফোরণ কা-ে বিএনপির জোটসঙ্গী জামায়াতের যোগসাজশের কথা বাংলাদেশ-ভারত যৌথ তদন্তে উঠে এসেছে। ওই দোষীদের আড়াল না করে শাস্তিদানের জন্য তদন্তকারীদের সাহায্য দিতে বিএনপি আগ্রহী নয় কেন? এই প্রশ্নের জবাবেও বেগম খালেদা জিয়া নাকি নিরুত্তর ছিলেন। দৈনিক স্টেটসম্যানের এই রিপোর্টটি পুরনো। কিন্তু এর কোনো তেমন জোর প্রতিবাদ বিএনপি মহল থেকে উঠেছে বলে আমার জানা নেই। সেজন্যেই মানস ঘোষের প্রতিবেদনটি আবার তুলে ধরলাম। ওই প্রতিবেদনটি প্রকাশিত হওয়ার পরও দেশে-বিদেশে বিএনপি নতুন করে ছড়াচ্ছে দশ মিনিটের গোপন আলোচনায় নরেন্দ্র মোদি বিএনপি নেত্রীকে আশ্বাস দিয়ে গেছেন যে, ভারত গণতন্ত্রকে সমর্থন করে এবং বাংলাদেশে গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনার জন্য সকল প্রকার সাহায্য জোগাবে। এই প্রচারণাটি যদি সঠিক হবে তাহলে নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে সাক্ষাতের পর পরই এক সাংবাদিক সাক্ষাতকারে বেগম জিয়াকে এ কথা কেন এত দীর্ঘকাল পর বলতে হয় যে, তার প্রাণনাশের হুমকি ছিল বলে তিনি প্রণব মুখার্জির সঙ্গে সাক্ষাতের জন্য যাননি? কুলদীপ নায়ারকেইবা হাসিনার বিরুদ্ধে কলম ধরতে হয় কেন? বেগম খালেদা জিয়ার দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে তার শরীরে একটি ফুলের টোকাও কেউ দেয়নি। আর আওয়ামী লীগ সরকারের দ্বারা তার প্রাণনাশের চেষ্টাটাতো অকল্পনীয় ব্যাপার। বরং বেগম সাহেবার সরকারের আমলেই শেখ হাসিনাকে হত্যার জন্য আগস্টের (২০০৪) ভয়াবহ গ্রেনেড হামলা হয়েছিল। সেই হামলায় তার দল ও সরকারের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের (পুত্র তারেকসহ) যুক্ত থাকার অভিযোগ রয়েছে। বেগম খালেদা জিয়া এখন উদোর পি-ি বুধোর ঘাড়ে চাপাবার চেষ্টা করছেন। তবে এই প্রাণনাশের হুমকির গল্পটি আরও আগে ফাঁদা হলে ভালো হতো। এত দেরিতে তার ক্রেডিবিলিটি নষ্ট হয়ে গেছে। সন্ত্রাস দ্বারা দেশে সরকার পরিবর্তনে বিএনপি ব্যর্থ হয়েছে। এখন বিদেশী সাহায্যেও এই পরিবর্তন আনা যাবে না এই সত্যটি তাদের বোঝা উচিত। ভারতের সঙ্গে বিএনপি সদ্ভাব প্রতিষ্ঠা করতে চায় এটা ভালো কথা। এটা বাংলাদেশের মঙ্গল ও কল্যাণের জন্যও দরকার। কিন্তু বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে নাক গলাবার জন্য ভারতকে বা অন্য কোনো বিদেশী শক্তিকে ডেকে আনার চেষ্টা সুস্থ দেশপ্রেমের পরিচায়ক নয়। এই ব্যাপারে পশ্চিমা শক্তির কাছে ধরনা দিয়ে ড. কামাল হোসেন ও ড. ইউনূসেরা ব্যর্থ হয়েছেন। ভারতের কাছে ধরনা দিয়ে বেগম খালেদা জিয়াও ব্যর্থ হবেন। বাংলাদেশে গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করার জন্যই ভারত মৈত্রী ও সহযোগিতার হাত বাড়িয়েছে; ধ্বংস করার জন্য নয়। এক্ষেত্রে গুজব ছড়িয়ে বা কুলদীপ নায়ারদের দ্বারা ফরমায়েশি লেখা লিখিয়েও কোনো লাভ হবে মনে হয় না। বিশ শতকি বিশ্ব রাজনীতি এই একুশ শতকে এখন দারুণভাবে পাল্টে গেছে। [লন্ডন, ২৩ জুন মঙ্গলবার, ২০১৫]
×