ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

রাজশাহীতে ‘সবুজ বিপ্লব’

ক্ষেতের মাচান থেকে হাটবাজার, সর্বত্র সবজির ভাণ্ডার

প্রকাশিত: ০৬:১৪, ২৩ জুন ২০১৫

ক্ষেতের মাচান থেকে হাটবাজার, সর্বত্র সবজির ভাণ্ডার

মামুন-অর-রশিদ ॥ বাড়ির আঙিনা থেকে শুরু করে ফসলের সবুজ দীর্ঘ মাঠ- সর্বত্রই সবজি আর সবজি। ঢেড়স, উচ্ছে, লাউ, কুমড়া, পটল, ঝিঙা ও বেগুনসহ গ্রীষ্মকালীন সবজির উপস্থিতি রাজশাহীর প্রতিটি নগরীতে। বিশেষ করে, সবজিচাষে গত কয়েক বছর ধরে সবুজ বিপ্লব ঘটেছে রাজশাহীর পবা ও মোহনপুর উপজেলায়। শহর থেকে নওগাঁর পথ ধরে এগুলেই মহাসড়কের দু’পাশে চোখে পড়ে ফসলের বিস্তীর্ণ মাঠ। আর ক্ষেতের মাঝে মাঝে পাতানো সারি সারি লাউ কুমড়ার ছোট-বড় মাচান। পাশে মহাসড়কের কাছে রাখা হয়েছে মণকে মণ স্তূপাকার সবজি। স্থানীয় হাটবাজারগুলোতে এখন একচ্ছত্র রাজত্ব করছে সবুজ সবজি। গত কয়েক বছর থেকে শীত আর গ্রীষ্মকালীন সবজি চাষ করে আসছেন পবা ও মোহনপুর উপজেলার কৃষকারা। শীতে ফুলকপি, বাধাকপি, শীম, পালং, মুলা, বরবটি, গাজর আর গ্রীষ্মে লাউ, কুমড়া, বেগুন, পুঁই, পটল করলা প্রভৃতি চাষ করেন তারা। স্থানীয় বাজারের চাহিদা মিটিয়ে এ দুই উপজেলার সবজির কদর এখন রাজধানী ছাড়াও দেশের বিভিন্ন জেলায়। লাভের পরিমাণ তুলনামূলকভাবে বেশি হওয়ায় প্রতিবছর দুই উপজেলায় বাড়ছে সবজি চাষের প্রবণতা। বিপুল পরিমাণ সবজি চাষের কারণে ইতোমধ্যে পবা ও মোহনপুরের বিভিন্ন হাটে গড়ে উঠেছে বড় বড় আড়ৎ। দেশের বিভিন্ন প্রান্তের পাইকার ও ব্যবসায়ীদের তাই আনাগোনা চলে বছর জুড়েই। এক সময় এ দুই উপজেলার মধ্যে মোহনপুরে শুধু পানের বরজ আর পবায় বছরে একবার ধান-পাট আর আলু ছাড়া তেমন ফসল হতো না। এখন ধান পাটের পাশাপাশি সারা বছর চাষাবাদ হচ্ছে সবজি। এ দুই উপজেলায় রীতিমতো সবুজ বিপ্লব ঘটেছে সবজিতে। রাজশাহী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর জানায়, প্রতিবছর রাজশাহীতে বাড়ছে সবজি চাষের আওতা। পবা ও মোহনপুরের কৃষকরা সবজি চাষ করে বাড়তি আয়ও করছেন। কৃষি অফিস জানায়, এবার খরিপ-১ মৌসুমে এক লাখ ৭০ হাজার ৮২২ বিঘা (২২ হাজার ৯শ’ ৬০ হেক্টর) জমিতে সবজির আবাদ হয়েছে। যা গতবারের চেয়ে প্রায় ১৯ হাজার ১৫৮ বিঘা (২ হাজার ৫শ’ ৭৫ হেক্টর) বেশি। সম্প্রতি জেলার পবা ও মোহনপুরের বিভিন্ন ফসলের মাঠ সরেজমিন পরিদর্শন করে দেখা যায়, মাঠ থেকে কৃষকের আঙিনা সবখানেই যেন সবজির সমারোহ। মাঠের মাচানে ঝুলা লাউ, কুমড়ার পরিচর্যায় ব্যস্ত কৃষাণ-কৃষাণী। কেউ মাচানের সবজি তুলে নিয়ে আসছেন স্থানীয় হাটবাজারে। কেউ ক্ষেত থেকে ফসল তুলে স্তূপ করে রাখছেন মহাসড়কের দুই ধারে। কেউ দিচ্ছেন স্থানীয় আড়তে। আবার ক্ষেত থেকে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরাও কিনে নিচ্ছেন লাউ-কুমড়াসহ বিভিন্ন সবজি। এসব গ্রামের মধ্যে একমাত্র বড়গাছী গ্রামেই এ বছর প্রায় ৫০ হেক্টর জমিতে লতাজাতীয় সবজি চাষ হয়েছে। রাজশাহী জেলা কৃষি সমপ্রসারণ অধিদফতর সূত্র জানায়, দুই উপজেলার অধিকাংশ কৃষক এখন মাচায় লতাজাতীয় সবজিচাষে ঝুঁকে পড়েছেন। অন্তত ৯৫ ভাগ কৃষক এখন মাচায় সবজিচাষ করেন। আয় এবং ফলন দুটিই বেশি হওয়ায় সবজিচাষে কৃষকদের মাঝে আগ্রহ দিন দিন ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। তাদের দেখাদেখি জেলার মোহনপুর, দুর্গাপুর, বাগমারা, পুঠিয়া, বাঘা, তানোর, গোদাগাড়ী ও চারঘাট উপজেলাতেও মাচায় সবজিচাষে কৃষকরা এখন ঝুঁকছেন। পবার বড়গাছী গ্রামের ক্ষেতে নিজের লাউয়ের মাচায় পরিচর্যায় ব্যস্ত ছিলেন একই গ্রামের কৃষক রহিম বক্স। তিনি জানান, এ বছর তিনি ৫ বিঘা জমিতে লাউচাষ করেছেন। এখান থেকে তিনি প্রায় ৫০ হাজার টাকার লাউ বিক্রি করেছেন গেলো মাসে। আরও লাউ ঝুলে আছে মাচানের ডগায় ডগায়। শরিফুল ইসলাম নামের এক কৃষক জানান, গ্রামের অন্য কৃষকদের দেখে তিনি প্রায় দুই বছর আগে মাচায় সবজি চাষ শুরু করেন। প্রথম বছরেই এক বিঘা জমি থেকে তিনি প্রায় ৫০ হাজার টাকার করলা বিক্রি করেছিলেন। ওই করলা তুলে নিয়ে মাচা ভেঙে ফেলে সেই জমিতে মুলাচাষ করেছিলেন। এরপর সেই জমিতে মুলা বিক্রি করে তার আয় হয়েছিল আরও ৭০ হাজার টাকা। সব মিলিয়ে দুই ফসল বিক্রি করে আয় হয় ১ লাখ ২০ হাজার টাকা। এরপর থেকে তিনি এখন প্রতি বছরই মাচায় সবজি চাষ করে যাচ্ছেন। মোহনপুরের বুরুজঘাট এলাকার কৃষক সোনামিয়া জানান, মাচায় সবজিচাষে রোগ-বালাইয়ের আক্রমণ কম হওয়া ছাড়াও জমিতে আগাছার পরিমাণ কম হয় এবং সার ও কীটনাশকের ব্যবহার কমে যায়। মাচার নিচে বসে থেকে খুব সহজে ফসলের পরিচর্যাও করা যায়। এতে করে সবদিক থেকেই কৃষকরা লাভবান হন। পবার অপর কৃষক এরফান আলী জানান, রাস্তার পাশে জমি হলে জমি থেকে সবজি ফসল সংগ্রহ করার সঙ্গে সঙ্গে জমিতেই সেগুলো বিক্রি হয়ে যায়। গ্রামের বিভিন্ন মোড় বা হাট-বাজারে সবজি বেচাকেনা হয় ব্যাপক হারে। তবে তার চেয়ে বেশি বিক্রি হয় জমিতেই বা গ্রামের মধ্যেই। ঢাকা, সিলেট, চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্তের ব্যবসায়ীরা পবার গ্রামে গ্রামে ঘুরে এসব সবজি ফসল কিনেন কৃষকদের কাছ থেকে। অধিকাংশ কৃষককে সবজি বিক্রি করতে বাজারেও যেতে হয় না। জমি থেকে কোনোমতে সবজি সংগ্রহ করে রাস্তার ওপর নিয়ে এলেই হলো। সেখানেই বিক্রি হয়ে যাচ্ছে এসব ফসল। আর এসব সবজি কেনার জন্য বিভিন্ন গ্রাম চষে বেড়ান পাইকারি সবজি ব্যবসায়ীরা। কৃষকদের কাছ থেকে সবজি কিনে তারা ট্রাকে করে নিয়ে যান ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেটসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে। পবার খাপাড়া এলাকার কৃষক রেজাউল করিম জানান, এসএসসি পাস করার পর চাকরির আশায় আর না ঘুরে বাবার সম্পত্তিতে ফসল ফলানো শুরু করেন। প্রথম বছরেই মাচায় ঝিঙা চাষ করে বেশকিছু টাকা আয় হয় তার। এরপর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি রেজাউলকে। কৃষকরা জানায়, এবারও অনুকূল আবহাওয়ায় সব ধরনের সবজির উৎপাদন বেশি হওয়ায় এবং চাহিদার অনুযায়ী বাজারে আসায় সবজির দাম পাচ্ছেন চাষীরা। কথা হয় সবজিচাষী উপজেলা মৌগাছি গ্রামের আশরাফুল ইসলামের সঙ্গে। তিনি ক্ষেতের পটল নিয়ে এসেছেন হাটে। তিনি বলেন, আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় এবারও সব ধরনের সবজির বাম্পার ফলন হয়েছে এলাকায়। পবার চাষী ফজলুর রহমান বলেন, আপাতত বাজারে সবজির দাম কম। তবে সব ধরনের সবজির বাম্পার ফলনে খুশি কৃষকরা বলেন, সময়মতো বাজারজাত করতে পারলেই কৃষক উপকৃত হবে।
×