ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

নিষেধাজ্ঞা ঈদের ৪ দিন পর পর্যন্ত বহাল থাকবে

সুনির্দিষ্ট তথ্য ছাড়া যানবাহনে তল্লাশি নিষিদ্ধ

প্রকাশিত: ০৬:০৮, ২৩ জুন ২০১৫

সুনির্দিষ্ট তথ্য ছাড়া যানবাহনে তল্লাশি নিষিদ্ধ

গাফফার খান চৌধুরী/ওসমান হারুন মাহমুদ ॥ সুনির্দিষ্ট তথ্য ব্যতীত মহাসড়কে চলাচলরত যানবাহনে তল্লাশী চালানো নিষিদ্ধ করেছে হাইওয়ে পুলিশ। এমন নিষেধাজ্ঞা ঈদের চার দিন পর পর্যন্ত বহাল থাকবে। এরপর স্বাভাবিক নিয়মে তল্লাশি ও মামলা হবে। রোজা ও ঈদে যানজট নিরসনে এবং যানবাহনকে হয়রানিমুক্ত করতেই এমন উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এমন উদ্যোগের সুযোগটিই কাজে লাগানোর চেষ্টা করেছিল হাইওয়ে পুলিশের কর্মকর্তা উপ-পরিদর্শক আশিকুর রহমান। তার সার্বিক পরামর্শেই কক্সবাজার সদর থানার আরেক উপ-পরিদর্শকের সহায়তায় প্রায় সাত লাখ পিস ইয়াবার চালানটি ঢাকায় আনা হচ্ছিল। কিন্তু বিধি বাম। র‌্যাবের হাতে ধরা পড়ার পর সব ফাঁস হয়ে গেছে। গত শনিবার কক্সবাজার থেকে ঢাকা আনার পথে ফেনীর লালপুরে ধরা পড়ে ইয়াবার চালানটি। সেই সঙ্গে ধরা পড়ে পুলিশের এক কর্মকর্তা ও প্রাইভেটকারের চালক। তাদের তিন দিনের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করছে ফেনী সদর থানা পুলিশ। পুলিশ কর্মকর্তা গ্রেফতারের পর নাম প্রকাশ পাওয়া দুই পুলিশ কর্মকর্তাকে বরখাস্ত করা হয়েছে। সোমবার তাদের বরখাস্ত করার আনুষ্ঠানিক চিঠি ঢাকা থেকে সংশ্লিষ্ট ইউনিটে পাঠানো হয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে তদন্ত চলছে। অভিযুক্ত দুই পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা দায়ের হয়েছে। দুই পুলিশ কর্মকর্তাসহ অন্য আসামিদের গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে। হাইওয়ে ও পুলিশের অন্যান্য ইউনিটে কর্মরত পুলিশ সদস্যরা এ ধরনের অবৈধ কর্মকা-ে জড়িত কিনা, সে বিষয়ে গোয়েন্দা নজরদারি বাড়াতে পুলিশের প্রতিটি ইউনিটকে লিখিত নির্দেশ দিয়েছেন পুলিশ মহাপরিদর্শক একেএম শহীদুল হক। হাইওয়ে পুলিশের কুমিরা পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ উপ-পরিদর্শক (এসআই) আশিকুর রহমান ওরফে আশিককে বরখাস্ত করার সত্যতা নিশ্চিত করেছেন হাইওয়ে পুলিশ প্রধান উপ-মহাপরিদর্শক মল্লিক ফখরুল ইসলাম। তিনি জনকণ্ঠকে বলেন, সোমবার দুপুরে আশিককে বরখাস্ত করার চিঠি ফ্যাক্সযোগে কুমিল্লায় পাঠানো হয়েছে। তবে তাকে গ্রেফতার করা সম্ভব হয়নি। ঘটনার পর থেকে আশিক পলাতক রয়েছে। তাকে গ্রেফতারের চেষ্টা অব্যাহত আছে। অন্যদিকে কক্সবাজার পুলিশের ডিবিতে কর্মরত উপ-পরিদর্শক (এসআই) বেলাল হোসেনকেও বরখাস্ত করা হয়েছে। পুলিশ সদর দফতরের নির্দেশে তাকে গ্রেফতারেরও চেষ্টা চলছে। হাইওয়ে পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, সারাদেশের ১১ হাজার ৮০৬ কিলোমিটার মহাসড়কে রোজায় যানবাহনের চাপ স্বাভাবিক কারণেই অনেক বেশি থাকে। স্বাভাবিক কারণেই মহাসড়কে যানজট হয়। যানজটের মধ্যে মহাসড়কে যানবাহনে ঢালাও তল্লাশি শুরু করলে যানজট তীব্র আকার ধারণ করে। এছাড়া বিভিন্ন পরিবহন মালিক সমিতি, মোটরযান শ্রমিক সমিতি এবং ব্যবসায়ীদের তরফ থেকে পুলিশের বিরুদ্ধে তল্লাশির নামে চাঁদাবাজি, অহেতুক হয়রানিসহ নানা অভিযোগ তোলা হয়। অতীতের এমন তিক্ত অভিজ্ঞতা থেকে এবার হাইওয়ে পুলিশের তরফ থেকে নানা উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। বিশেষ করে যানজট নিরসনে এবং দ্রুত পণ্য মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছে দিতে সুনির্দিষ্ট তথ্য ব্যতীত মহাসড়কে সব ধরনের তল্লাশি চালানো নিষিদ্ধ করা হয়। প্রথম রোজা থেকেই হাইওয়ে পুলিশ এমন নির্দেশ দেয়। রোজা শুরুর দুই দিন আগে হাইওয়ে পুলিশের এমন সিদ্ধান্তের বিষয়টি হাইওয়ে পুলিশে চাকরি করার কারণে আগাম জানতে পারে ইয়াবার চালান ধরা পড়ার সঙ্গে নাম আসা উপ-পরিদর্শক আশিক। তিনি হাইওয়ে পুলিশের পূর্ব বিভাগের কুমিল্লা জেলার কুমিরা হাইওয়ে পুলিশ ফাঁড়িতে কর্মরত। হাইওয়ে পুলিশের এমন সিদ্ধান্তের সুযোগ নিতে মরিয়া হয়ে উঠেন তিনি। হাইওয়ে পুলিশ ও তদন্তকারী সংস্থা সূত্রে জানা গেছে, ধরা পড়া ইয়াবার চালানটির মূলহোতা হাইওয়ে পুলিশে কর্মরত উপ-পরিদর্শক আশিক। কারণ এবার হাইওয়ে পুলিশ মহাসড়কে যানবাহনে তলœাশি না চালানোর আগাম ঘোষণা দিয়েছে। এমন ঘোষণার অফিস আদেশও তার কাছে রয়েছে। অতএব মহাসড়কে যানবাহনে এমনিতেই তল্লাশি হবে না, তার ওপর তিনি যেহেতু হাইওয়ে পুলিশে কর্মরত, সেক্ষেত্রে বাড়তি সুবিধা পাওয়া কোন ঘটনাই না। এমন চিন্তাভাবনা থেকেই আশিক ইয়াবার একটি বড় চালান আনার প্রক্রিয়া শুরু করে। তারই ধারাবাহিকতায় আশিক তার ইয়াবা সিন্ডিকেটের সঙ্গে যোগাযোগ করে। পুরো চক্রটি তৎপর হয়ে উঠে। আশিকের পরামর্শে কক্সবাজার সদর থানায় কর্মরত উপ-পরিদর্শক বেলাল হোসেন ইয়াবা ব্যবসায়ীদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। ব্যবসায়ীরা বেলালের কাছে প্রায় সাত লাখ পিস ইয়াবা দিয়ে যায়। বেলাল যোগাযোগ করে ঢাকায় পুলিশের বিশেষ শাখার (এসবি) সহকারী উপ-পরিদর্শক মাহফুজুর রহমানের সঙ্গে। এএসআই মাহফুজুর রহমান কক্সবাজার চলে যায়। গত ২০ জুন কক্সবাজার থেকে ইয়াবাসহ ঢাকার উদ্দেশে রওনা হন। কিন্তু বিধি বাম। ফেনী পর্যন্ত আসতে তাদের কোন অসুবিধা হয়নি। রাস্তায় পুলিশ চেকও করেনি। কারণ গাড়ির সামনে পুলিশ লেখা স্টিকার রয়েছে। আর নিজেও যেহেতু আসল পুলিশ, সেক্ষেত্রে কোন সমস্যায়ই পড়তে হয়নি। কথায় বলে, পাপ বাপকেও ছাড়ে না। মাহফুজুর রহমান আর প্রাইভেটকারের চালকের অবস্থাও তাই হয়েছে। গত শনিবার রাত সাড়ে এগারোটার দিকে চালকের চোখে ক্লান্তি আসায় কালো রঙের ঢাকা মেট্রো গ-১৭-৭১৮১ নম্বরের দামী এলিয়ন প্রাইভেটকারটি একটি বাচ্চাকে ধাক্কা দেয়। স্থানীয়রা গাড়িটি আটকানোর চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়। খবর পেয়ে র‌্যাব-৭ এর একটি টহল দল ধাওয়া করে প্রাইভেটকারটি ধরে ফেলতে সক্ষম হয়। গাড়ির সামনে পুলিশ লেখা স্টিকার ছিল। গাড়িতে থাকা পুলিশ কর্মকর্তার পরিচয়ও নিশ্চিত হন র‌্যাব সদস্যরা। পুলিশ হয়ে একটি বাচ্চাকে ধাক্কা দিয়ে পালানোর ঘটনায় র‌্যাব সদস্যদের সন্দেহ বাড়তে থাকে। রাতেই র‌্যাব পুলিশ কর্মকর্তাসহ গাড়িটির চালককে ফেনীতে অবস্থিত র‌্যাবের ক্যাম্পে নিয়ে যায়। সেখানেই জিজ্ঞাসাবাদ চলতে থাকে। পুলিশ সদস্য হিসেবে মানুষকে সহায়তা করার কথা, কিন্তু তা না করে তারা পালিয়ে যাচ্ছিলেন কেন? র‌্যাব কর্মকর্তাদের এমন প্রশ্নের জবাবে সব গুলিয়ে যায় পুলিশ কর্মকর্তা ও প্রাইভেটকারের চালকের। সন্দেহ হয় গাড়িতে অবৈধ কিছু থাকতে পারে। এরপরই শুরু হয়, গাড়িতে তল্লাশি। তল্লাশিতে গাড়ি থেকে ৬ লাখ ৮০ হাজার ইয়াবা ট্যাবলেট উদ্ধার হয়। গ্রেফতার করা হয় পুলিশ কর্মকর্তা এএসআই মাহফুজুর রহমান (৩৫) ও চালক জাবেদ আলীকে (২৯)। তাদের কাছ থেকে ইয়াবা বিক্রির সাত লাখ টাকা, বিভিন্ন ব্যাংকের আটটি ক্রেডিট কার্ড এবং মাদকের টাকার হিসাব সংবলিত তিনটি নোটবুক উদ্ধার হয়। এরপরই বেরিয়ে আসতে থাকে থলের বিড়াল। র‌্যাবের জিজ্ঞাসাবাদে পুলিশ কর্মকর্তা জানান, কক্সবাজার জেলার টেকনাফ থানায় চাকরি করার সময় ইয়াবা ব্যবসায়ীদের সঙ্গে তার সর্ম্পক হয়। এছাড়া পুরো চক্রটির সঙ্গে কক্সবাজার জেলার ডিবি পুলিশের এসআই মোঃ বেলাল এবং চট্টগ্রাম বিভাগের হাইওয়ে পুলিশের পূর্ব বিভাগের কুমিল্লা জেলার কুমিরা হাইওয়ে পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ এসআই (উপপরিদর্শক) মোঃ আশিকুর রহমান আশিক জড়িত। তাদের নির্দেশেই ইয়াবার চালানটি ঢাকায় পৌঁছে দেয়া হচ্ছিল। জব্দকৃত নোটবুুকে ১৪ জনের সঙ্গে বিভিন্ন সময়ে ইয়াবা লেনদেনের ২৮ কোটি ৪৪ লাখ ১৩ হাজার টাকার হিসেবের ফিরিস্তি পাওয়া যায়। গত রবিবার রাতে ইয়াবাসহ গ্রেফতারকৃতদের ফেনী মডেল থানায় হস্তান্তর করে র‌্যাব। ফেনী থেকে আমাদের নিজস্ব সংবাদদাতা জানান, ইয়াবাসহ পুলিশ ও প্রাইভেটকারের চালক গ্রেফতারের ঘটনায় র‌্যাব ফেনী সিপিসি-১ এর ডিএডি মনিরুল ইসলাম বাদী হয়ে ফেনী মডেল থানায় মাদক আইনে মামলা দায়ের করেন। সোমবার দুপুরে ওই মামলায় গ্রেফতারকৃতদের ১০ দিনের রিমান্ডের আবেদন করে ফেনীর সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আলমগীর মোহাম্মদ ফারুকীর আদালতে হাজির করে পুলিশ। বিচারক শুনানি শেষে আসামিদের তিন দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। মামলাটির তদন্তকারী কর্মকর্তা ফেনী মডেল থানার পরিদর্শক (তদন্ত) শাহিনুজ্জামান জানান, এএসআই মাহফুজুর রহমানের স্বীকারোক্তি মোতাবেক তিন পুলিশ কর্মকর্তাসহ ১৭ জনের নাম উল্লেখ করা হয়েছে। অন্যরা হচ্ছে- কক্সবাজার জেলা ডিবি পুলিশের উপপরিদর্শক (এসআই) বেলাল হোসেন, ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের কুমিল্লা জেলার কুমিরা হাইওয়ে পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ উপ-পরিদর্শক (এসআই) আশিকুর রহমান ওরফে আশিক, ঢাকার উচ্চ আদালতের এ্যাডভোকেট তোফাজ্জল হোসেন, এ্যাডভোকেট জাকির হোসেন, মুহুরী মোতালেব, কাশেম, আজাদ, গিয়াস, মামা গিয়াস, সেলিম, শাহিন, বিল্লাল, মামা হান্নান ও গরিন্দ্র দা। আসামিদের গ্রেফতারে অভিযান চলছে বলে ফেনী মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মাহবুব মোর্শেদ জনকণ্ঠকে জানান। তবে সন্ধ্যা সাতটায় এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত র‌্যাবের তরফ থেকে হস্তান্তর করা পুলিশ কর্মকর্তা ও প্রাইভেটকারের চালক ব্যতীত অন্য কোন আসামি গ্রেফতার হয়নি।
×