ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

বর্ষণসন্ধ্যায় কবির জন্মোৎসব

প্রকাশিত: ০৩:৫৩, ২৩ জুন ২০১৫

বর্ষণসন্ধ্যায় কবির জন্মোৎসব

গৌতম পাণ্ডে ॥ সকাল থেকে গুমটবাধা গরম। বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যায় নামল বৃষ্টি। রাজধানীর জাতীয় গণগ্রন্থাগার চত্বরজুড়ে বইছিল মৃদুমন্দ বাতাস। প্রকৃতির মমতায় বিরাজ করছিল ভিন্ন এক পরিবেশ। কবিতার মিশেল দিয়ে তাই বুঝি কবি নির্মলেন্দু গুণ আপ্লুত কণ্ঠে বলে উঠলেন, ‘আমার জন্মদিনেও বৃষ্টি হয়, এ যেন এক অন্যরকম অনুভূতি’। গ্রন্থাগারের প্রধান ফটকে একটি ব্যানারে লেখা ‘কবি নির্মলেন্দু গুণের ৭১তম জন্মাৎসব’। রবিবার সেমিনার কক্ষে এ উৎসবের আয়োজন করে বাংলাদেশ ইকোলজি এ্যান্ড অটিজম ফিল্ম ফোরাম ও জাতীয় কবিসভা। সেমিনার কক্ষে প্রবেশ করে আবছা অন্ধকারে কারো চেহারা বোঝা গেল না। পর্দায় তখন দেখানো হচ্ছিল নির্মলেন্দু গুণের কবিতা অবলম্বনে মাসুদ পথিক পরিচালিত চলচ্চিত্র ‘নেকাব্বরের মহাপ্রয়াণ’। অনুকরণ ও অপসংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে নগর ও গ্রাম বাংলার প্রতিচ্ছবিকে শিল্পায়িত ও দর্শক নন্দিত করে তুলেছেন চলচ্চিত্রের নির্মাতা। এ যেন শুধুমাত্র চলচ্চিত্র নয়, গ্রাম্য ও নগর জীবনের স্মৃতির জানালা। বাস্তব কাহিনীকে কবিতার ফ্রেমে আবদ্ধ করা কঠিন। কবি নির্মলেন্দু গুণ ‘নেকাব্বরের মহাপ্রয়াণ’ কবিতা লিখে এই কঠিন কাজটিকে পাঠককূলে সহজ করে দিয়েছেন। সে কারণেই হয়ত কবিতাটি পাঠক নন্দিত হয়েছে। আর সে জন্যই কবিতার কেন্দ্রীয় চরিত্র ‘নেকাব্বর’ বাঙালী শিক্ষিত সমাজের প্রিয় চরিত্রে পরিণত হয়েছে। ‘নেকাব্বরের মহাপ্রয়াণ’ চলচ্চিত্রের প্রথমেই একটি ক্লোজ শট শিশির ভেজা ঘাসের এক মনোরম চিত্র। কবি নিজের বাড়ি যাবেন বলে রেল স্টেশন থেকে নেমে খানিক হেঁটে সামনে দেখতে পান মানুষের ভিড়। ভিড় ঠেলে দেখেন কৈশরের সতীর্থ নেকাব্বরের লাশ শিশির ভেজা ঘাসে বড় অযতেœ অবহেলায় পড়ে আছে। বেদনায় অন্তহীন ভাবনা নিয়ে রেল স্টেশনের পাশে বসে ডাইরিতে আবদ্ধ করতে থাকেন বন্ধু নেকাব্বরের জীবনগাঁথা। কবি মুহূর্তের ভাবনায় নেকাব্বরের সঙ্গে অতীতের স্মৃতিতে ফিরে যান। এরপরের কাহিনী দেখে মনে হতে পারে গ্রামের একজন কৃষকের সঙ্গে মাতব্বর কিংবা জমিদারের বিরোধ নতুন তেমন কোন ঘটনা নয়। কিন্তু ঘটনা এক হলেও এখানে দর্শন ভিন্ন। এখানে কৃষকরা নিজেদের ভাগ্য পরিবর্তনে বিশ্বাসী। স্বজনহারা কৃষক নেকাব্বর বুদ্ধিবৃত্তিসম্পন্ন প্রাণী ও প্রকৃতি প্রেমিক একজন মানুষ। মেধাবী ছাত্র হওয়া সত্ত্বেও কেন স্কুলে যায় না শিক্ষকের এমন প্রশ্নের উত্তরে নেকাব্বরের বুদ্ধিদীপ্ত উত্তর ‘শিক্ষার জন্যে কী স্কুলে যাওয়া লাগে? এই মাঠ আর বিস্তীর্ণ আকাশ থেকে কত শেখার আছে আমাদের!’ একজন হতদরিদ্র মানুষ হিসেবে অন্যের দারিদ্র সঙ্কট নিরসনে এগিয়ে আসা তার স্বভাব। অন্য দশজনের মতো জৈবিক চাহিদাকেও উপেক্ষা করতে পারেনি নেকাব্বর। সে গ্রামের আইনুদ্দিনের মা মরা মেয়ে ফাতেমার প্রেমে জড়িয়ে পড়ে। বিয়ের আগে তাদের একাধিকবার সঙ্গমও হয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তারা সামাজিক বন্ধনে আবদ্ধ হতে পারেনি। কারণ, মাতব্বরের ছেলের ড্রাইভারের সঙ্গে তার বিয়ে নিয়ে কথাবার্তা আর মাতবরের সঙ্গে কৃষকদের হাতাহাতিতে পুলিশী ঝামেলায় জড়িয়ে যায় নেকাব্বর। তার নামে হুলিয়া জারি হয়। এটা জানতে পেরে সে কবি নির্মলের শরণাপন্ন হয়। নির্মল তাকে পুরনো ঢাকার ঐতিহ্যবাহী বিউটি বডিংয়ের বিপ্লবী মামুনের কাছে তুলে দেয়। মামুন নেকাব্বরের কথা এর আগেই নির্মলের মুখে শুনেছে। নেকাব্বরের অনুপস্থিতিতে গ্রামে চলে অন্য কাহিনী। মাতব্বর ফাতেমাকে বিয়ে করতে চায়। কুনজরে পড়ে মাতব্বরের পৌষ্য মুন্সীর। কিন্তু মাতব্বর তাকে থামিয়ে দেয়। তার ভয়ে নীরব থাকলেও সুযোগের অপেক্ষায় থাকে মুন্সী। একদিন সন্ধ্যায় ছাগল নিয়ে হাওড় থেকে বাড়ি ফিরতে গেলে ফাতেমাকে ধর্ষণ করে মুন্সী। বাসায় ফিরে কাউকে না বলে নেকাব্বরকে গভীরভাবে অনুভব করতে থাকে ফাতেমা। নেকাব্বর ফাতেমার জন্য প্রচ- টান অনুভব করলে মামুন তাকে রাতের ট্রেনে বাড়ি আসতে বলে এবং সে তাই করে। বাড়ি এসে এসব জানার আগেই শুরু হয় যুদ্ধ, নেকাব্বর যুদ্ধে চলে যায়। যুদ্ধরত অবস্থায় পা হারায়। এরপর কেটে যায় ৪২ বছর। নেকাব্বর রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে নির্মলকে খুঁজতে থাকে। একদিন খুঁজে পায় সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে। নির্মল তাকে একান্ত সান্নিধ্যে পেয়ে নানা অবেগঘন কথা বলে বাড়ি যাওয়ার কথা বলে। নেকাব্বর বাড়ি আসে। এখানে এসে দেখে তার ভিটে মাটিও নেই। নেই তার ফাতেমা। হানাদারদের ঔরসজাত সন্তানকে জন্ম দিতে গিয়ে মারা যায় সে। ফাতেমা বেঁচে নেই, নেই তার বেঁচে থাকার অবলম্বন। ধীরে ধীরে মৃত্যুর দিকে এগুতে থাকে সে। মারা যায় নেকাব্বর। তারপর আবার নির্মল অর্থাৎ নির্মলেন্দু গুণ ফ্ল্যাশব্যাক থেকে ফিরে আসে। এবং দেখে নেকাব্বরের লাশ পুলিশ নিয়ে যাচ্ছে। গুণ পিছে পিছে যায়। যে নেকাব্বর যুদ্ধ করেছে। সে হয়ত প্রয়োজন মনে করেনি মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকায় নাম লেখানোর। ফলে মৃত্যু পরবর্তী সময়েও মুক্তিযোদ্ধার সম্মাননা পায়নি নেকাব্বর। তার সমাজ পরিবর্তনের চিন্তা আর বাস্তবায়িত হয়নি। চলচ্চিত্রটি দেখতে দেখতে বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা। স্বল্প সংখ্যক দর্শক উপভোগ করছিল এ দুটি চলচ্চিত্র। এর আগে দেখানো হয়েছে নির্মলেন্দু গুণের কবিতা অবলম্বনে তানভীর মোকাম্মেল পরিচালিত চলচ্চিত্র ‘হুলিয়া’। শুরু হলো কবির জন্মোৎসবের সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। ফুল দিয়ে কবির ৭১তম জন্মদিন লেখা হয়েছে। তার চার পাশ দিয়ে সাজানো হয়েছে একাত্তরটি মোমবাতি। মুহূর্তের মধ্যে কবির ভক্তদের ভিড়ে কক্ষ কানায় কানায় ভর্তি হয়ে গেল। উপস্থিত হলেন কবি তপন বাগচী, বিমল গুহ, সোহরাব হাসান, মাহবুব আজিজ, সৌমিত্র শেখর, ড. মোঃ সামাদ, ন্যূহ আলম লেলিন, মোঃ নুরুল হুদা, আয়েত আলী পাটোয়ারী, রবীন্দ্র গোপ, ড. রণজিৎ কুমার বিশ্বাস, চলচ্চিত্রকার দিলদার হোসেন, নাট্যজন মামুনুর রশীদসহ আরও অনেকে। উৎসব পরিণত হলো এক কবি মেলায়। যার জন্মদিনে এত লোকের উপস্থিতি সেই কাক্সিক্ষত নায়ক কবি নির্মলেন্দু গুণ সভামাঝে বিলম্বে উপস্থিত হলেন। সবাই অধীর আগ্রহে ছিল প্রিয় কবিকে শ্রদ্ধা জানানোর জন্য। শুরু হয়ে গেল উৎসবের প্রথম পর্ব। কবি মাসুদ পথিকের সভাপতিত্বে স্বাগত বক্তব্য রাখেন জাতীয় গীতিকবি পরিষদের সভাপতি এম আর মন্জু। উদ্বোধনী ঘোষণায় কবি আসলাম সানি বলেন, বাঙালী জাতিসত্তার এক স্বাত্বিক কবির জন্মদিন আজ। শিল্পের সঙ্গে বসবাসকারী এ কবির কবিতা আমাদের শাণিত করবে বার বার। কবি তপন বাগচী বলেন, কবির বয়স একাত্তর হলেই কি, বয়স তাঁকে ছোঁয়নি। মিলন সভ্যসাচীর কণ্ঠে নির্মলেন্দু গুণের ‘রক্তপোলাপ’ কবিতা পাঠের পর পরই উপস্থিত হলেন কবি। একের পর এক ভক্ত অনুরাগীর ফুলেল শুভেচ্ছায় শিক্ত হলেন কবি নির্মলেন্দু গুণ। অনুষ্ঠানে নির্মলেন্দু গুণের বিখ্যাত কবিতা ‘মানুষ’ অবলম্বনে নির্মিতব্য ‘দ্য পোয়েট্রি’ বা ‘কবি গাছ’ চলচ্চিত্র নির্মাণের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেন মাসুদ পথিক। তিনি বলেন, নরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর ‘অমলকান্তি’ আর নির্মলেন্দু গুণের ‘মানুষ’ কবিতা নানাভাবে গুরুত্বপূর্ণ। যান্ত্রিক এই ব্যক্তি জীবনে মানুষের কাছে এখন প্রকৃতিই একমাত্র সত্য আশ্রয়। অমলাকান্তির রোদ্দুর হোতে চাওয়া কিংবা নির্মলেন্দু গুণের সারাটা দিন গাছের মতো দাঁড়িয়ে থাকায় যে বোধ সেই বোধকে চলচ্চিত্রে ফুটিয়ে তুলতে ‘কবিগাছ’ নির্মাণ করতে যাচ্ছি। খুব শীঘ্রই এর কাজ শুরু হবে। এরপর কবি নির্মলেন্দু গুণ মোববাতি জ্বালিয়ে জন্মদিনের এ মুহূর্তকে আলোকিত করে তোলেন। অনুষ্ঠানে উপস্থিত বক্তারা বলেন, স্বাধীন বাংলাদেশের ইতিহাসে একাত্তর যেমন বিশেষ অর্থবহ, কবি নির্মলেন্দু গুণের একাত্তরতম জন্মদিনও তেমনি অর্থবহ। কারণ এ ইতিহাসের সঙ্গে কবির জীবন অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। তিনি কবিদের কবি, কবি সত্তার কবি। বাংলাদেশ তাঁর সংসার। সব শেষে জন্মদিনকে ঘিরে নিজের লেখা কবিতা পাঠ করে শোনান কবি নির্মলেন্দু গুণ। প্রতিক্রিয়ায় তিনি বলেন, ৭ আষাঢ় আমার জন্ম। বর্ষা আমার মাতা। দুদিন আগেও জানতাম না এভাবে আমার জন্মদিনকে মোকাবেলা করতে হবে। এটা স্নায়ুর ওপর চাপ সৃষ্টিকারী এক ঘটনা। আজ আমার জন্মদিনে বৃষ্টি হয়েছে, বুঝলাম আমার জন্মদিনেও বৃষ্টি হয়। আমার কবিতা নিয়ে ইতিপূর্বে চলচ্চিত্র তৈরি হয়েছে, এবারও মাসুদ পথিক নতুন চলচ্চিত্র তৈরির ঘোষণা দিল আমার কবিতাকে নিয়ে, আমি আনন্দিত। সবাইতে কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি। সংক্ষিপ্ত এ প্রতিক্রিয়ার পর তিনি নিজের লেখা ‘আবার এসেছে ফিরে ৭ আষাঢ়’ কবিতা পাঠ করে শোনান। কবি কণ্ঠে উচ্চারিত হলো ‘আবার এসেছে ফিরে ৭ই আষাঢ়/ কালো মেঘে আকাশ ভরিয়ে/প্রকৃতির চোখে কাজল পরিয়ে/সে এসে ডাক দিয়েছে আমাকে/ আমার জন্মদিনের উৎসবে...।
×