ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

জিম্মি করে মুক্তিপণ আদায়ে ৮ দেশের ১৭ চক্র সক্রিয়

প্রকাশিত: ০৫:৩০, ২২ জুন ২০১৫

জিম্মি করে মুক্তিপণ আদায়ে ৮ দেশের ১৭ চক্র সক্রিয়

তৌহিদুর রহমান ॥ ভাগ্য ফেরাতে চার বছর আগে সংযুক্ত আরব আমিরাতে গিয়েছিলেন খোকন শরীফ। সেখানে একটি দোকানে কাজ করতেন তিনি। আয়-রোজগার খারাপ ছিল না। তবে তিনি আরও ভাল আয়-রোজগারের আশায় সেখান থেকে যেতে চান গ্রীসে। প্রতারক চক্র তাকে গ্রীস নিয়ে যাওয়ার কথা বলে প্রথমে নিয়ে যায় তুরস্ক। এরপর তুরস্কে তাঁকে জিম্মি করে ৫ লাখ টাকা দাবি করা হয়। খোকন শরীফ মাদারীপুরের সদর থানার ঝাউদি এলাকায় তাঁর বড় ভাই লতিফ শরীফকে ফোন করে ৫ লাখ টাকা দিতে বলেন। এই টাকা না দিলে তাঁকে মেরে ফেলা হবে বলেও জানানো হয়। লতিফ শরীফ ৫ লাখ টাকা দিলেও মুক্তি মেলেনি তাঁর। প্রতারক চক্র আরও ৫ লাখ টাকা দাবি করে। অবশেষে লতিফ শরীফ স্থানীয় থানায় মামলা করলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এ বিষয়ে পদক্ষেপ নেয়। এদিকে দক্ষিণ আফ্রিকা যান মিঠুন ম-ল। তাঁকে বিদেশে পাঠাতে পেরে খুশি হয়েছিলেন তাঁর পরিবারের লোকজনও। কেননা বিদেশ থেকে টাকা পাঠানোর পর আর কোন অভাব থাকবে না। সেই রকমই আশা ছিল পরিবারের লোকজনদের। তবে এক মাস যেতে না যেতেই মিঠুন তাঁর বাবাকে দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে টেলিফোন করে জানান, ১০ লাখ টাকা না দিলে সেখানে তাঁকে কোন চাকরি দেয়া হবে না। তাঁকে দেশে ফিরে আসতে হবে। অবশেষে নিতান্ত বাধ্য হয়েই রাজবাড়ী জেলার পাংশা উপজেলার চরঝিকরি গ্রাম থেকে মিঠুনের বাবা ফিরোজ ম-ল ১০ লাখ টাকা পাঠাতে বাধ্য হন। প্রতারক চক্র দক্ষিণ আফ্রিকায় নিয়ে গিয়ে জিম্মি করে এই টাকা আদায় করে। এভাবে বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশী নাগরিকদের জিম্মি করে মুক্তিপণ আদায়ের ঘটনা ঘটে চলছেই। আগে দেশের মধ্যেই কোন ব্যক্তিকে জিম্মি করে মুক্তিপণ আদায় করা হতো। তবে এখন দেশের গ-ি ছাড়িয়ে বিদেশেও ছড়িয়ে পড়েছে জিম্মি ও মুক্তিপণ আদায়। আর এসব ঘটনায় জড়িত রয়েছেন প্রবাসের বাংলাদেশী প্রতারক চক্র। আবার মুক্তিপণ আদায় করা হচ্ছেও বাংলাদেশীদের কাছ থেকেই। একবার মুক্তিপণ পরিশোধের পরেও কোন কোন সময় জিম্মি ব্যক্তির মুক্তি মিলছে না। দফায় দফায় মুক্তিপণ আদায় করা হচ্ছে। আর অসহায় পরিবার একান্ত বাধ্য হয়েই জমানো টাকা, ঋণ, জমিজমা বিক্রি ইত্যাদির মাধ্যমে মুক্তিপণ পরিশোধ করে স্বজনকে ফিরিয়ে আনছে। আবার কখনওবা জিম্মি ব্যক্তিকে মেরে ফেলার ঘটনাও ঘটছে। মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, বিশ্বের ৮টি দেশে ১৭টি প্রতারক চক্র বাংলাদেশী নাগরিকদের জিম্মি করে মুক্তিপণ আদায়ে সক্রিয় রয়েছে। এসব দেশের মধ্যে রয়েছে সংযুক্ত আরব আমিরাত, তুরস্ক, ইরান, দক্ষিণ আফ্রিকা, মালয়েশিয়া, লিবিয়া, ওমান ও বাহরাইন। এর মধ্যে সংযুক্ত আরব আমিরাতে পাঁচটি, তুরস্কে চারটি, ইরানে দুইটি, দক্ষিণ আফ্রিকায় একটি, মালয়েশিয়ায় একটি, লিবিয়ায় দুইটি, ওমানে একটি ও বাহরাইনে একটি প্রতারক চক্র কাজ করছে। এসব প্রতারক চক্রের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার জন্য এসব দেশের দূতাবাস ও মিশনকে সরকারের পক্ষ থেকে ইতোমধ্যেই নির্দেশনাও দেয়া হয়েছে। এদিকে জানা গেছে, বিভিন্ন সময়ে প্রতারক চক্র প্রবাসী বাংলাদেশীকে জিম্মি করে দফায় দফায় মুক্তিপণ দাবি করে। একবার মুক্তিপণ দেয়ার পরেও না ছাড়লে কোন কোন স্বজন আইনের আশ্রয় নেন। থানায় মামলা করলেও বিষয়টি সহজেই সমাধান করা সম্ভব হয় না। কেননা বিদেশে থাকা কোন আসামিকে সরাসরি বাংলাদেশের পুলিশ গ্রেফতার করতে পারে না। এর জন্য ইন্টারপোলের সহায়তা নিতে হয়। আবার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে এ বিষয়ে অবহিত করলে, মন্ত্রণালয় সেদেশের দূতাবাস বা মিশনকে অবহিত করে। দূতাবাস বা মিশন থেকে সেদেশের সরকারের কাছে জানানো হয়। সেদেশের সরকার তাদের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মাধ্যমে প্রতারক চক্রের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়ে থাকে। তাই এসব পদক্ষেপ অনেক দীর্ঘ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে সম্পন্ন হয়। আর এরই মধ্যে জিম্মি করা ব্যক্তিকে মেরে ফেলার ঘটনাও ঘটে। সূত্র জানায়, মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশী অনেক শ্রমিকই কঠোর পরিশ্রম করে থাকে। সে তুলনায় পারিশ্রমিক পান কম। তাই প্রতারক চক্র অনেক শ্রমিককে ইউরোপে পাঠানোর স্বপ্ন দেখিয়ে খুব সহজেই জিম্মি করে ফেলে। আর মধ্যপ্রাচ্য থেকে ইউরোপে নিয়ে যাওয়ার রুট হিসেবে তুরস্ক-গ্রীস রুটকেই ব্যবহার করে পাচারকারীরা। মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে প্রতারক চক্র এসব শ্রমিককে তুরস্কে নিয়ে যায়। একাধিক দেশ থেকে তাদের তুরস্কে নিয়ে গিয়ে দফায় দফায় মুক্তিপণ আদায় করে থাকে। কেউ কেউ মুক্তিপণের টাকা দিতে ব্যর্থ হলে তাদের মেরে ফেলা হয়। এদিকে মধ্যপ্রাচ্যের আরেক দেশ লিবিয়ায়ও গড়ে উঠেছে শক্তিশালী প্রতারক চক্র। লিবিয়া থেকে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইতালিতে নিয়ে যায় প্রতারক চক্র। তবে তাদের নিয়ে যাওয়ার সময় দফায় দফায় মুক্তিপণ আদায় করে থাকে। আর মুক্তিপণ আদায়ে ব্যর্থ হলে নিশ্চিত মৃত্যু। আবার কখনও কখনও বাংলাদেশ থেকে বিভিন্ন দেশে শ্রমিক নিয়ে গিয়েই জিম্মি করে ফেলে প্রতারক চক্র। দেশ থেকে অনেক সময় কম টাকায় নিয়ে যায়। তবে বিদেশে নিয়ে গিয়েই তাদের বলা হয়, আরও টাকা দিতে হবে। তা না হলে ভাল চাকরি দেয়া হবে না। আর এই টাকার পরিমাণ হয়ে থাকে আরও ৫ থেকে ১০ লাখ টাকা। একান্ত বাধ্য হয়েই পরিবারের লোকদের এই টাকা গুনতে হয়। কখনওবা তাদের আটকিয়ে রাখা হয়। আবার কখনও কখনও তাদের ওপর শারীরিক নির্যাতনও চালানো হয়। তবে টাকা না দিলে কোন মুক্তি নেই। টাকা দিলেই মুক্তি মেলে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা জানান, বিদেশে কোন প্রবাসী বাংলাদেশীকে জিম্মি করা হলে, তার খুব বেশি কিছু করার উপায় থাকে না। কেননা কোন ব্যক্তিকে একটি ঘরে আটকে রেখে জিম্মি করা হয়। অনেক সময় জিম্মি ব্যক্তি নিজে কোথায়, কোন্ এলাকায় অবস্থান করছেন ঠিকমতো তিনি জানতে পারেন না। আবার জিম্মি ব্যক্তি অন্য দেশে গিয়ে নিজেই অবৈধ হয়ে যান। সে কারণে তিনি সেখানের স্থানীয় পুলিশের কাছে সাহায্য চাইতেও পারেন না। বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ থেকে তুরস্কে কোন ব্যক্তিকে আনা হলে, সেই ব্যক্তি সেখানে অবৈধ হয়ে যান। আর এই অবৈধ হওয়ার কারণে তিনি কোথাও যেতে পারেন না। একান্ত বাধ্য হয়েই প্রতারক চক্রের আশ্রয়েই তাকে থাকতে হয়। সূত্র জানায়, বিদেশী প্রতারক চক্রের সঙ্গে দেশের প্রতারক চক্রও জড়িত। বিভিন্ন দেশে যখন কোন ব্যক্তিকে জিম্মি করা হয়, তখন মুক্তিপণ আদায়ে অনেক সময় দেশীয় এজেন্টদের ব্যবহার করা হয়। বিদেশে আটকে রেখে মুক্তিপণের টাকা দেশের কোন ব্যক্তির কাছে পরিশোধ করতে হয়। এখানে টাকা পরিশোধের পরেই বিদেশ থেকে মুক্তি মেলে। আবার কখনও কখনও এখানে প্রতারকচক্রের কোন এজেন্টকে আটক করা সম্ভব হলেও বিদেশের প্রতারক চক্রদের আটক করা সম্ভব হয় না। সে কারণে এসব প্রতারক চক্র ধরাছোঁয়ার বাইরেই থেকে যাচ্ছে।
×