ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

ওরা আপনাকে আটকে হাতুড়িপেটা করে মুক্তিপণ আদায় করবে, সাবধান

দামী গাড়ি দামী পোশাক... ডাকলেই কাছে যাবেন না, ওরা অপহরণকারী!

প্রকাশিত: ০৫:৪৭, ১৯ জুন ২০১৫

দামী গাড়ি দামী পোশাক... ডাকলেই কাছে যাবেন না, ওরা অপহরণকারী!

গাফফার খান চৌধুরী ॥ দামী গাড়ি। গায়ে দামী পোশাক। রাস্তার পাশে বিশেষ ভঙ্গিমায় দাঁড়িয়ে রয়েছেন ৩৫ থেকে ৪০ বছর বয়সী দুজন। স্বাভাবিকভাবেই যে কাউকে ডাকলে কাছে যাবেন, সেটিই স্বাভাবিক। কিন্তু যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই যে মস্তবড় বিপদে পড়বেন, তা কেউ ভাবতেও পারবে না। ডাকে সাড়া দিয়ে কাছে গেছেন, তো বিপদে পড়েছেন। যাওয়ার পর প্রথমেই ঘাড় ধরে খোলা দরজা দিয়ে গাড়িতে ঢোকানো হবে। এরপর চোখ মুখ বেঁধে মারধর শুরু করা হয়। গাড়ির সামনের আর পেছনের সিটের মাঝে ফেলে রাখা হবে। এরপর গাড়ি দ্রুত গতিতে ঢাকার বাইরের দিকে রওনা দেবে। নির্জন জায়গায় নিয়ে হাতুড়ি দিয়ে পেটাতে পেটাতে অপহৃত ব্যক্তির পরিবারের কাছে ফোন করা হবে। মুক্তিপণ হিসেবে মোটা অঙ্কের টাকা পাওয়ার পরেই মুক্তি মিলবে অপহৃত ব্যক্তির। অন্যথায় মারাত্মক জখম করে বা হত্যা করে লাশ ফেলা দেয়া হবে রাস্তার পাশের কোন খাদে বা নির্জন জায়গায়। দিনে দুপুরে খোদ রাজধানীর ব্যস্ত এলাকা থেকে পদস্থ চাকরিজীবী ও ব্যবসায়ী অপহরণকারী চক্রের হোতাসহ চারজনকে গ্রেফতারের পর জিজ্ঞাসাবাদে এমন লোমহর্ষক বর্ণনা দিয়েছে অপহরণ চক্রের মূল হোতা। সম্প্রতি রাজধানীতে এভাবেই চাকরিজীবী ও ব্যবসায়ীসহ ১৫ জনকে অপহরণ করে প্রায় কোটি টাকা মুক্তিপণ আদায় করেছে চক্রটি। বুধবার রাত থেকে বৃহস্পতিবার দুপুর পর্যন্ত পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) অর্গানাইজড ক্রাইম বিভাগ চারজনকে গ্রেফতার করে। মূল হোতাকে গ্রেফতার করা হয় যাত্রাবাড়ী থেকে। তার তথ্যমতে ঢাকা ও সিলেটের ছাতক থেকে আরও তিনজনকে গ্রেফতার করা হয়। তাদের জিজ্ঞাসাবাদ চলছে সিআইডির বিশেষ সেলে। সিআইডি সূত্রে জানা গেছে, মূল হোতার বাড়ি রবিশালে। প্রায় পাঁচ বছর ধরে সে এ কাজে জড়িত। তাদের ২০ জনের একটি গ্রুপ রয়েছে। বয়স ৩০ থেকে ৩৫ বছরের মধ্যে। এর মধ্যে কয়েকজনের বয়স খানিকটা বেশি। এরা রেন্টে কার থেকে দামী গাড়ি ভাড়া করে। এছাড়া তাদের নিজেদেরও কয়েকটি গাড়ি রয়েছে। প্রতি গাড়িতে চালকসহ চারজন থাকে। দামী পোশাক পরে মতিঝিল ব্যাংকপাড়া, গুলশান, উত্তরা, বারিধারা, ধানম-িসহ রাজধানীর বিভিন্ন অভিজাত ও ব্যবসায়ী এলাকায় অবস্থান নেয়। রাস্তার ফাঁকায় তারা গাড়ি এক পাশে দাঁড় করিয়ে অবস্থান করে। প্রথমেই তারা অফিস ছুটির পর পোশাক পরিচ্ছদসহ আনুষঙ্গিক সবকিছু ধারণা করে লোক টার্গেট করে। টার্গেট ব্যক্তিকে জরুরী কথা বলার অজুহাতে কাছে ডাকে। ওই ব্যক্তি বিশ্বাস করে কাছে যাওয়া মাত্রই তাকে ঘাড় ধরে চোখের পলকে গাড়িতে তুলে ফেলা হয়। এরপর তার হাত পা চোখ-মুখ বেঁধে ফেলা হয়। গাড়ির সামনের ও পেছনের সিটের মাঝে থাকা জায়গায় ফেলে রাখা হয়। গাড়ির জানালার কাঁচ লাগিয়ে উচ্চস্বরে গান বাজানো হয়। গাড়ি সোজা চলে যায় গাজীপুর, সাভার বা অন্য কোন ফাঁকা জায়গার দিকে। নিরিবিলি জায়গায় নিয়ে অপহৃত ব্যক্তির কাছে থাকা টাকা-পয়সা হাতিয়ে নেয়া হয়। তার কাছে এটিএম কার্ড থাকলে তার গোপন নম্বর নিয়ে পাশের কোন বুথ থেকে টাকা তুলে নেয়। এরপর অপহৃত ব্যক্তিকে হাতুড়ি দিয়ে নির্মমভাবে পেটাতে থাকে। আর মোবাইল ফোনে অপহৃত ব্যক্তির কান্নাকাটি শোনানো হয় তার পরিবারের লোকজনকে। মুক্তিপণ হিসেবে মোটা অঙ্কের টাকা বিকাশ করতে বলা হয়। বিকাশের মাধ্যমে টাকা পাওয়ার পর অপহৃত ব্যক্তিকে নিরিবিলি কোন জায়গায় ছেড়ে দেয়া হয়। অপহৃতদের গাজীপুরে নিয়ে যাওয়া হয় বেশি। কারণ ওদিকে নিরিবিলি জায়গা তুলনামূলক বেশি। এ ব্যাপারে সিআইডির অর্গানাইজড ক্রাইম বিভাগের বিশেষ পুলিশ সুপার মীর্জা আব্দুল্লাহেল বাকী ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করে জনকণ্ঠকে বলেন, তারা মূল হোতাসহ চারজনকে গ্রেফতার করেছে। দলটিতে ২০ জন সদস্য রয়েছে। অপর সদস্যদের গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে। গ্রেফতারকৃতরা সবাই ইয়াবায় আসক্ত। তারা ইয়াবাকে সাংকেতিক নাম রুটি বলে ডাকে। ইয়াবা সেবনের পরই তারা দিনে ও রাতে রাজধানীর বিভিন্ন পয়েন্টে গাড়ি নিয়ে অবস্থান করে। কেতাদুরস্ত কোন লোককে পেলেই গাড়িতে তুলে অমানুষিক নির্যাতন চালায়। এরপর অপহৃত ব্যক্তির কাছ থেকে মুক্তিপণ হিসেবে মোটা অঙ্কের টাকা আদায় করে। দলটির হাতে ১৫ জন অপহৃত হওয়ার ঘটনা ঘটেছে। অপহৃতদের মধ্যে কেউ মারা যায়নি। তবে অনেকেই মারাত্মকভাবে জখম হয়েছে। দুই থেকে তিনজন পঙ্গু হওয়ার পথে। গ্রেফতারকৃতরা রাতে বিভিন্ন এটিএম বুথের সামনেও অবস্থান করে। এটিএম বুথ থেকে কেতাদুরস্ত কেউ বের হলে তাকে গাড়ি কাছে কথা বলার ছলে ডেকে নিয়ে অপহরণ করে মুক্তিপণ আদায় করে থাকে। তবে এই কর্মকর্তা চারজনের নাম প্রকাশ করতে অপারগতা প্রকাশ করেছেন। গ্রেফতারকৃতদের নিয়ে অভিযান চলছে। প্রসঙ্গত, ২০১০ সালের ৫ মে রাতে এমন অপহরণকারীদের কথায় বিশ্বাস করে টাঙ্গাইল যাওয়ার জন্য প্রাইভেটকারে চড়ে বসেন রাজধানীর নয়াটোলা পুলিশ ফাঁড়ির এএসআই মিজানুর রহমান। তিনি গাড়িতে চড়ার পর গাড়িতে থাকা অপহরণকারীরা তার কাছ থেকে টাকা-পয়সা কেড়ে নেয়। বাধা দিলে ব্যাপক ধস্তাধস্তি হয়। এক পর্যায়ে ওই পুলিশ কর্মকর্তা নিজেকে পুলিশ বলে পরিচয় দেয়। এরপর অপহরণকারীরা ওই পুলিশ কর্মকর্তাকে হাতুড়ি দিয়ে পিটিয়ে, দুই চোখ উপড়ে ফেলে, জিভ্্ কেটে নির্মমভাবে হত্যা করে। হত্যার পর ভোরে ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কের মির্জাপুর উপজেলার পুষ্টকুমারী (চরপাড়া বাইপাস) এলাকার রাস্তার পাশে লাশ ফেলে দেয়।
×