ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

ছাত্রসংঘের নেতা থেকে উত্থান যেভাবে-

প্রকাশিত: ০৫:৫০, ১৭ জুন ২০১৫

ছাত্রসংঘের নেতা থেকে উত্থান যেভাবে-

স্টাফ রিপোর্টার ॥ মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে চূড়ান্ত মৃত্যুদ-প্রাপ্ত জামায়াত নেতা আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ একাত্তরে ছিলেন আলবদর বাহিনীর কমান্ডার। মুক্তিযোদ্ধাদের ভারতীয় চর বা দুষ্কৃতকারী উল্লেখ করে ওই সময় এই আলবদর বাহিনীর নেতারাই নিজেদের সম্পর্কে বলেছিলেন, ‘ভারতীয় চর বা দুষ্কৃতকারীদের কাছে আলবদর সাক্ষাত আজরাইল।’ তৎকালীন জামায়াতে ইসলামীর ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্র সংঘের নেতা হিসেবে রাজনীতির অঙ্গনে পা দেয়া মুজাহিদ একাত্তরে বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিপক্ষেই শুধু দাঁড়াননি, গণহত্যা-লুণ্ঠনসহ মানবতাবিরোধী অপরাধের মাধ্যমে বাঙালীর স্বাধীনতার আকাক্সক্ষাও দমন করতে পাকিস্তানী বাহিনীকে সব ধরনের সহযোগিতা দিয়েছিলেন। একাত্তরে যুদ্ধাপরাধে জড়িত থাকলেও বাংলাদেশের রাজনৈতিক পালাবদলে এই মুজাহিদের গাড়িতেই উঠেছিল জাতীয় পতাকা। ২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের সমাজকল্যাণমন্ত্রী হয়েছিলেন তিনি। ইসলামী ছাত্রসংঘ দিয়ে শুরু করে মূল দল জামায়াতের অন্যতম কা-ারি হয়ে ওঠেন মুজাহিদ, পান নির্বাহী প্রধান অর্থাৎ সেক্রেটারি জেনারেলের পদ। মন্ত্রী কিংবা দলের শীর্ষ পদে আসীন হলেও জনগণ যে কখনও তাকে গ্রহণ করেনি তার প্রমাণ সংসদ নির্বাচনে কয়েকবার প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেও জিততে না পারা। ১৯৪৮ সালের ২ জানুয়ারি জন্ম নেয়া মুজাহিদ পারিবারিক আবহেই সেই রাজনীতিতে যুক্ত হন, যে রাজনীতি অসাম্প্রদায়িক ধারার বিপরীত। তার বাবা তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদের অন্যতম সদস্য আব্দুল আলী ১৯৭১ সালে শান্তি কমিটির ফরিদপুর জেলা শাখার প্রধান ছিলেন। গত শতকের ষাটের দশকে ফরিদপুর রাজেন্দ্র কলেজে উচ্চ মাধ্যমিকে পড়ার সময়েই জামায়াতে ইসলামীর তখনকার ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্রসংঘে যোগ দেন মুজাহিদ। ১৯৬৮-৭০ মেয়াদে সংগঠনের জেলা শাখার সভাপতি ছিলেন তিনি। উচ্চ মাধ্যমিক পাসের পর চলে আসেন ঢাকায়, ১৯৭০ সালে তিনি ছাত্রসংঘের ঢাকা জেলা শাখার সেক্রেটারির দায়িত্ব নেন। ১৯৭১ সালের অক্টোবরে সংগঠনের পূর্ব পাকিস্তান শাখার সভাপতি হন তিনি। মুজাহিদ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে এমএ করেন বলে তার আইনজীবীর ওয়েবসাইটে উল্লেখ করা হয়েছে। ছাত্রসংঘের সভাপতি হিসেবে কার্যত পদাধিকার বলেই আলবদর বাহিনীর শীর্ষ পদে চলে আসেন মুজাহিদ। তার আগে ওই পদে ছিলেন মতিউর রহমান নিজামী, যিনি এখন জামায়াতের আমির এবং যুদ্ধাপরাধের দায়ে ট্রাইব্যুনালে মৃত্যুদ-প্রাপ্ত। যুদ্ধাপরাধ মামলায় গ্রেফতার হওয়ার আগে মুজাহিদ ছিলেন জামায়াতের মুখপত্র দৈনিক সংগ্রামের পরিচালনা পর্ষদের প্রধান। ১৯৭১ সালের ১৪ নবেম্বর ওই পত্রিকায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে মতিউর রহমান নিজামী বলেন, ‘আমাদের পরম সৌভাগ্যই বলতে হবে। এ দেশের ইসলামপ্রিয় তরুণ ছাত্রসমাজ বদর যুদ্ধের স্মৃতিকে সামনে রেখে আলবদর বাহিনী গঠন করেছে।’ আলবদর বাহিনীর প্রধান হিসেবে মুজাহিদ যে বুদ্ধিজীবী হত্যায় নেতৃত্বের ভূমিকায় ছিলেন তা উঠে আসে আদালতের রায়ে। একাত্তরে বাংলাদেশের স্বাধীনতার সূর্যোদয়ের ঠিক আগ মুহূর্তে মুজাহিদের নির্দেশেই জাতির সূর্যসন্তানদের ধরে নিয়ে হত্যা করা হয়েছিল, যাতে মূল ভূমিকা পালন করে আলবদর বাহিনী। প্রসিকিউটর তুরীন আফরোজ আদালতে শুনানিতে বলেছিলেন, ‘সারা দেশের আলবদর বাহিনীর নিয়ন্ত্রণ ছিল মুজাহিদের হাতে। শেষ দিন পর্যন্ত আলবদর বাহিনীর সদস্যরা মুজাহিদের হুকুম তামিল করেছে।’ মুজাহিদের নেতৃত্বেই আলবদর বাহিনী মুক্তিযুদ্ধের মধ্যে ফরিদপুর, ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে হত্যা, অপহরণ, লুটপাটের মতো ব্যাপক মানবতাবিরোধী কর্মকা- চালায়। একাত্তরে তার কর্মকা-ের ঘনিষ্ঠ সহযোগী পলাতক আবুল কালাম আযাদ ওরফে বাচ্চু রাজাকারেরও ফাঁসির রায় হয়েছে ট্রাইব্যুনালে। মুজাহিদের বিরুদ্ধে মামলা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলে বিচার চলাকালে দাবি করে জামায়াত। একই কথা গোলাম আযম, দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী, আব্দুল কাদের মোল্লা, মোঃ কামারুজ্জামানের ক্ষেত্রেও বলেছিল জামায়াত, যাদের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধ আদালতে প্রমাণিত হয়েছে। ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানী বাহিনীর আত্মসমর্পণের প্রস্তুতির সময়ও বাহিনী নিয়ে আত্মসমর্পণ না করার সিদ্ধান্ত নেন মুজাহিদ। স্বাধীন বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধু হত্যাকা-ের পর পুনরুজ্জীবিত জামায়াতে সক্রিয় হয়ে ১৯৮২ সালে কেন্দ্রীয় পরিষদের সদস্য হন মুজাহিদ। ১৯৮৯ থেকে সহকারী সেক্রেটারি জেনারেলের দায়িত্ব পালনের পর ২০০০ সালে জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল হন তিনি। মুজাহিদকে ২০১০ সালের ২৯ জুন ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেয়ার অভিযোগে আটক করা হয়। একই বছরের ২ অক্টোবর মানবতা-বিরোধী অপরাধে গ্রেফতার দেখানো হয় তাকে। তখন থেকে কারাগারেই রয়েছেন তিনি। বন্দী হওয়ার কয়েক বছর আগেও মুজাহিদ নিজের এবং দলীয় সহকর্মীদের বিরুদ্ধে সব অভিযোগ অস্বীকার করে বলেছিলেন, বাংলাদেশে কোন যুদ্ধাপরাধী নেই। তবে শেষ পর্যন্ত যুদ্ধাপরাধের দায়ে ফাঁসিতে ঝুলতে হচ্ছে মুজাহিদকে।
×