ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

বিএনপি-জামায়াত ॥ নতুন করে দেখা

প্রকাশিত: ০৬:৩২, ১৬ জুন ২০১৫

বিএনপি-জামায়াত ॥ নতুন করে দেখা

চারদিকে রব উঠেছে বিএনপি জামায়াতে ইসলামীকে পরিত্যাগ করছে। জেনারেল জিয়ার ঘনিষ্ঠ সহচর এবং বেগম জিয়ার বিএনপির প্রথম দিককার মন্ত্রগুরু সাবেক প্রেসিডেন্ট বদরুদ্দোজা চৌধুরী সম্প্রতি বলেছেন যে, বিএনপি যদি জামায়াতের সঙ্গ ত্যাগ না করে তাহলে এই দলটির রাজনৈতিক ভবিষ্যত নেই। তিনি এই বাক্য দিয়ে কী বোঝাতে চেয়েছেন তিনিই জানেন। কিন্তু এই কিছুদিন আগেও যখন বেগম জিয়া আপোসহীন হয়ে গুলশান কার্যালয় থেকে দেশব্যাপী পেট্রোলবোমা বিস্ফোরণের নেতৃত্ব দিয়ে যাচ্ছিলেন তখনও বদরুদ্দোজা চৌধুরী তার পাশে গিয়ে দাঁড়িয়েছিলেন এবং বলেছিলেন বিএনপির সঙ্গে তিনি আছেন এবং থাকবেনও। তাহলে এখন এমন কী ঘটল, যার জন্য বদরুদ্দোজা চৌধুরীও জামায়াতবিরোধী হয় উঠলেন? প্রশ্নটি এ কারণেই উত্থাপন করা জরুরী যে, জামায়াতের সঙ্গে যখন বিএনপির মিত্রতা শুরু হয় তখনও বদরুদ্দোজা চৌধুরী বিএনপির নীতিনির্ধারকদের অন্যতম। এমনকি জিয়াউর রহমান যখন জামায়াতের আমির যুদ্ধাপরাধীদের পালের গোদা গোলাম আযমকে পাকিস্তান থেকে দেশে ফিরিয়ে আনেন তখনও বদরুদ্দোজা চৌধুরী জিয়াউর রহমানের একেবারে ডানহাত না হলেও খুবই ঘনিষ্ঠজন। জামায়াতের পক্ষ থেকে তাই বদরুদ্দোজা চৌধুরীকে নিয়ে এখন বিশ্লেষণ আসতে শুরু করেছে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমগুলোতে, কেন বদরুদ্দোজা চৌধুরী চাইছেন জামায়াতকে বিএনপি থেকে বিচ্ছিন্ন করতে! সেখানে এ প্রশ্নও উঠছে যে, জিয়াউর রহমানের মৃত্যুকালে চট্টগ্রাম সার্কিট হাউসে পাশের ঘরেই বদরুদ্দোজা চৌধুরী অবস্থান করছিলেন এবং জিয়াউর রহমান হত্যাকা-ের বিচার প্রক্রিয়া কেন এখনও সম্পন্ন হয়নি? সেসব প্রশ্নে হয়ত আমার কলামের পাঠকের কোন আগ্রহ নেই। কিন্তু এ প্রশ্নটি তোলা জরুরী যে, যদি সত্যি সত্যিই বিএনপি থেকে জামায়াতে ইসলামী বিচ্ছিন্ন হয়েই যায় তাহলে আদৌ কোন লাভ আছে কি না? কিংবা এখন বিএনপি যে অবস্থায় এসে দাঁড়িয়েছে তাতে জামায়াত থেকে আদৌ তাদের বিচ্ছিন্ন হওয়ার কোন সুযোগ আছে কি না? এসব প্রশ্ন নিয়ে পূর্ণাঙ্গ বিশ্লেষণের আগে বলে রাখতে চাই, আমি কখনওই মনে করি না যে, বিএনপি নেতা বেগম খালেদা জিয়া কিংবা তার পুত্র তারেক জিয়া কোনভাবেই জামায়াতকে তাদের রাজনৈতিক সঙ্গী থেকে কোনদিন বাদ দিতে পারবেন বা বাদ দিতে চান। কেন তারা চান না তা আলাদা করে ব্যাখ্যার প্রয়োজন নেই। কারণ ওপরে উল্লিখিত প্রশ্ন নিয়ে বিস্তারিত আলোচনাতেই তা উঠে আসবে বলে মনে করি। প্রথমত বিএনপি এবং জামায়াতকে খুব মোটা দাগে আলাদা করার কোন সুযোগ নেই। বিশেষ করে দুটি রাজনৈতিক দলের রাজনীতি বিশ্লেষণ করলেই সেটা বোঝা যায়। বিএনপি সোজাসাপ্টা ধর্মভিত্তিক কোন রাজনৈতিক দল না হলেও বিএনপির রাজনীতির ভিত্তিমূল হলো ধর্ম এবং ক্ষমতা। অপরদিকে জামায়াতের রাজনীতির মূল সূত্র হচ্ছে ধর্ম ও বাংলাদেশ-বিরোধিতা। অঙ্কের হিসাবে বিএনপি ও জামায়াতের রাজনীতিকে একত্রিত করলে দাঁড়ায়, ধর্ম+ক্ষমতা+বাংলাদেশ-বিরোধিতা। এই দুটি দলের সমন্বয়ে গঠিত জোট ২০০১ থেকে ২০০৬ সাল অবধি দেশ পরিচালনা করেছে বলেই আমরা এই তিনটি মৌলিক বিষয় সম্পর্কে জানতে পেরেছি, যা দিয়ে তারা এই ৫ বছর দেশ পরিচালনা করেছে। কথায় কথায় ধর্মকে টেনে এনে দেশে একটি ধর্মাশ্রয়ী উগ্রবাদের জন্ম দিয়েছে এবং প্রশ্রয় দিয়েছে ধর্মোন্মাদ সন্ত্রাসীদের। উদাহরণ বাংলা ভাই এবং শায়খ আবদুর রহমান। ক্ষমতাকে এমনভাবে এই জোট ব্যবহার করতে সমর্থ হয়েছে যে, সে সময় আসলে মানুষ প্রতিবাদ করতে ভুলে গিয়েছিল। ভয়ে ও ত্রাসে (যদিও মানুষ সে সময়কালকে এখন প্রায় বিস্মৃত হয়েছে) এবং ক্ষমতাকে ব্যবহার করে দুর্নীতির কারণে বাংলাদেশ একাধিকবার দুর্নীতিতে বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হয়েছে এবং সর্বশেষ বাংলাদেশ-বিরোধিতার কথা বলতে হলে আমাদের ফিরতে হয় একাত্তরে। গোলাম আযম, নিজামী, মুজাহিদ ও সাঈদীর মতো চিহ্নিত রাজাকাররা এদেশে বিখ্যাতই (পড়–ন কুখ্যাত) হয়েছে এদেশের বিরোধিতা করার জন্য। তার সঙ্গে যোগ হয়েছে বিএনপির সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর মতো কুখ্যাত রাজনীতিবিদরা। যারা আজ অবধি স্বীকার করেনি একাত্তরের ভুল এবং এখনও এদেশের পতাকার প্রতি তাদের আনুগত্যের কোন প্রমাণ আমরা পাইনি। আর বিএনপি নেতা এখনও পর্যন্ত তাদেরই পক্ষ নিয়ে রাজনীতি করে যাচ্ছেন, তার পুত্রও একাধিকবার এদের পক্ষ নিয়ে কথা বলেছে। ফলে আমরা কী করে বুঝব যে, বিএনপি জামায়াতের সঙ্গ ত্যাগ করবে এবং এর পেছনে কোন সঙ্গত কারণ থাকতে পারে? যতটুকু বোঝা যাচ্ছে তা হলো, বিএনপি নেতা বেগম খালেদা জিয়া ও সম্প্রতি বাংলাদেশ সফরকারী ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে সাক্ষাতের পর অনেকেই এমন একটি জাতীয়তাবাদী ট্যাবলেটের সন্ধান পেয়েছেন, যা খেয়ে তারা ভাবতে শুরু করেছেন যে, এই বুঝি বেগম জিয়া জামায়াতকে বাদ দেয়ার ঘোষণা দেন! অনেকে আবার বিএনপির অশীতিপর নেতৃত্বের একে একে বেগম জিয়াকে অস্বীকারের কথোপকথন (গোপন টেলিফোন সংলাপ, যা প্রকাশ হওয়াটা কোনভাবেই সমর্থনযোগ্য নয়) থেকে আঁচ করতে শুরু করেছেন যে, বেগম জিয়ার আসলে জামায়াতকে ত্যাগ না করে উপায় নেই। কিন্তু এ প্রশ্ন কেউ করছে না যে, এখন যদি বেগম জিয়া জামায়াতে ইসলামীকে ত্যাগ করেন তাহলে তার হয়ে রাজনীতি করার আর কেউ অবশিষ্ট থাকে কি না? বদরুদ্দোজা চৌধুরীর বিকল্প ধারায় নেতাকর্মী সাকল্যে দু’জন, তিনি এবং তার পুত্র, যিনি কিনা মাত্রই কিছুদিন আগে সিটি নির্বাচনে অংশ নিয়ে নাকাল হয়েছেন। নিজের দলের অবস্থা বেগম জিয়ার চেয়ে তো ভাল কেউ জানেন না বা বোঝেন না, তাই না? কোন দুঃস্বপ্নেও কি কেউ ভাবতে পারেন যে, দলের এই চরম দুর্দিনে একটি পরীক্ষিত রাজনৈতিক মিত্রকে বেগম জিয়া ছেড়ে দিয়ে উপকৃত হবেন? তাছাড়া বিএনপির চরম দুঃসময়ে জামায়াতে ইসলামী বিএনপিকে যেভাবে সাহায্য-সহযোগিতা দিয়েছে তাতে জামায়াতে ইসলামীকে ত্যাগ কারাটা বিএনপির জন্যও হবে চরম মোনাফেকি। কিন্তু তার চেয়েও বড় কথা, এত বড় আদর্শিক, রাজনৈতিক ও সন্ত্রাসী মিত্র বিএনপি তথা বেগম জিয়া ও তারেক জিয়া কোথায় পাবেন, সেটা কি কেউ ভেবেছেন? সুতরাং, মোদির সঙ্গে সাক্ষাতের সূত্র ধরে কেউ যদি মনে করেন যে, বিএনপি জামায়াত নামক লেজটি খসানোর জন্য উদগ্রীব হয়ে উঠেছে তাহলে সেটা সত্যিই ভুল বিশ্লেষণ বলে আমার বিশ্বাস। আরও বড় কথা হলো, বিএনপি ও জামায়াতের মধ্যে কে লেজ আর কে মাথা তাও এখন বোঝা দায়। তবে সন্দেহাতীতভাবে একথা সত্য যে, দুটি দলের মধ্যে জামায়াত এখনও আর্থিক ও পেশীশক্তিতে বিএনপির চেয়ে অনেক বেশি শক্তিশালী এবং ২০১১ থেকেই আমরা দেখতে পেয়েছি যে, বিএনপি নেতার সরকারবিরোধী আন্দোলন ও সংগ্রামে জামায়াত-শিবিরই একমাত্র বল-ভরসা। এ বছরের গোড়ার দিকে যখন বেগম জিয়া নতুন করে পেট্রোলবোমাগ্রহ (সত্যাগ্রহতো বেগম জিয়ার কাছ থেকে আশা করতে পারি না, তাই না!) শুরু করেন তখন জামায়াতই তাকে আসলে বাঁচিয়ে রেখেছিল। না হলে এতদিনে বেগম জিয়ার রাজনৈতিক মৃত্যু ঘটত। আমার সঙ্গে অনেকেই হয়তো একমত হবেন যে, এহেন রাজনৈতিক ও শক্তিশালী টনিক কাম স্যালাইনকে কারও পক্ষেই অগ্রাহ্য করা সম্ভব নয়। বেগম জিয়া ভুলো মনের হতে পারেন। কিন্তু তাই বলে তার রাজনৈতিক বুদ্ধি-বিবেচনা নিয়ে প্রশ্ন তোলার সময় এখনও আসেনি। যে প্রশ্ন দিয়ে শুরু করেছিলাম, ধরে নেয়া যাক, বিএনপি জামায়াতে ইসলামীকে পরিত্যাগ করল। দেশে দেশে ধন্য ধন্য রব ওঠা ছাড়া, ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো মানবাধিকার বিষয়ক সচেতন (পড়–ন অচেতন) রাষ্ট্রগুলো নিঃসন্দেহে এই ঐতিহাসিক ঘটনায় দিবারাত্র পার্টির আয়োজন করবে। কিন্তু তাতে বাংলাদেশের কী লাভ হবে? এর ফলে বাংলাদেশের মৌলিক কোন লাভ আসলে হবে না। কারণ আগেই বলেছি, বিএনপি ও জামায়াত আসলে সিয়ামিজ জমজ, অপারেশনে তাদের আলাদা করা গেলেও তারা আসলে আলাদা নয়। কেবল দুটি দেহ, কিন্তু এক প্রাণ ও একই শক্তি, একই বল। আমাদের অনেকেরই হয়তো মনে নেই যে, তারেক জিয়া বলেছিলেন, বিএনপি-জামায়াত একই মায়ের পেটের ভাই। সত্যিই তো, এদের বাহ্যিক শক্তির চাপে আলাদা করা যাবে হয়তো, কিন্তু এদের রক্ত ঠিকই কথা বলবে, প্রয়োজনে আবার দোহে মিলে দোহারে দেখিবে। তাহলে লোক দেখানো আলাদা করে কী লাভ? কার লাভ? আর যারই হোক, সে লাভ বাংলাদেশের নয়, নয় এদেশের রাজনীতিরও। একথা আজকে যারা বিএনপি-জামায়াতের ছাড়াছাড়ি নিয়ে লাফাচ্ছেন তারা কবে বুঝবেন জানি না, তবে দ্রুত বুঝলে ভাল করবেন। কিন্তু আমার মনে হয়, বাংলাদেশের রাজনীতিতে অতি দ্রুতই কিছু নতুন ঘটনা ঘটতে যাচ্ছে। তবে সেটা বিএনপি-জামায়াতের বিচ্ছিন্ন হওয়া নয়। কারণ আগেই বলেছি, বেগম জিয়া ও তারেক জিয়া জামায়াতকে ছাড়তে পারবেন না। অপরদিকে জামায়াতও বিএনপিকে ছাড়তে পারবে না! এতদিন যার ঘাড়ে বন্দুক রেখে জামায়াত রাজনীতি করল, এদেশে থিতু হলো, তাদের ছেড়ে থাকা জামায়াতের পক্ষে কোনভাবেই সম্ভব নয়। বরং, ‘এখন তো সময় আরো কাছে আসার, এখন তো সময় আরো ভালোবাসার, তুমিও যে একা, আমিও যে একা, লাগে কি ভালো, ও প্রিয়’ (আমি দুঃখিত একটি জনপ্রিয় গানকে এভাবে রাজনৈতিকভাবে ব্যবহারের জন্য)। আমার কেন যেন মনে হয়, বেগম জিয়া ও তারেক জিয়াকে এখন দলটির সমর্থকদের একটি বড় ও শক্তিশালী অংশ অপশন দেবে, হয় সঙ্গে থাকুন, না হয় পথ ছাড়–ন। এই সঙ্গে থাকা বলতে তারা হয়ত নেতৃত্ব দেয়াকে বোঝান না, সত্যিকার অর্থেই দেশের ও দেশের মানুষের পক্ষে রাজনীতি করার আহ্বানকেই বোঝান। ঢাকা ॥ ১৫ জুন, সোমবার ॥ ২০১৫ ॥ [email protected]
×