ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

পাহাড়ে আধিপত্য নিয়ে লড়াইয়ের মূলে চাঁদাবাজি

প্রকাশিত: ০৫:৪৬, ১৬ জুন ২০১৫

পাহাড়ে আধিপত্য নিয়ে লড়াইয়ের মূলে চাঁদাবাজি

মোয়াজ্জেমুল হক/জীতেন বড়ুয়া ॥ পার্বত্য চট্টগ্রামে পাহাড়ীদের এক সময়ের অধিকার আদায়ের সশস্ত্র তৎপরতা ঐতিহাসিক শান্তিচুক্তির পর অবসান ঘটলেও এখন পাহাড়ীদের তিন গ্রুপ নিজেদের আধিপত্য বিস্তারের লড়াইয়ে লিপ্ত হয়ে রক্তের হোলিখেলায় মত্ত রয়েছে। আর এ কারণে থেমে থেমে পার্বত্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন অঞ্চল অত্যাধুনিক অস্ত্রের ঝনঝনানি চলছে। ঝরছে প্রাণ। বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার ইতোপূর্বে ১৯৯৭ সালে ক্ষমতায় থাকাকালীন সময়ে দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে চলমান শান্তিবাহিনীর সশস্ত্র পন্থায় অধিকার আদায়ের তৎপরতায় শান্তির পরশ বুলিয়ে দেয় শান্তিচুক্তি সম্পাদনের মাধ্যমে। ঐ বছরের ২ ডিসেম্বর সম্পাদিত এ চুক্তি ঐতিহাসিক হিসেবে দেশের ইতিহাসে স্থান করে নিয়েছে। ইতোমধ্যে সম্পাদিত চুক্তির ৯৮ ভাগ বাস্তবায়ন হয়েছে বলে সরকারের দাবি রয়েছে। কিন্তু সরকারের সঙ্গে চুক্তি সম্পাদনকারী পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি (পিসিজেএসএস) এ দাবি মানতে নারাজ। অথচ বাস্তবতা তা বলে না। এর উপর জনসংহতি সমিতি থেকে বেরিয়ে যাওয়া একটি গ্রুপ যা ইউপিডিএফ (ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট) নামে ভিন্ন সংগঠনের জন্ম দেয়। ইউপিডিএফ জন্মের পর থেকে জনসংহতি সমিতি প্রধান জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা ওরফে সন্তু লারমাকে পাহাড়ী জনগণের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা ও প্রতারণার অভিযোগ এনে নিজেদের মধ্যে সহিংসতা তৎপরতায় লিপ্ত হয়েছে। যা অদ্যাবধি চলমান। এরই মধ্যে জনসংহতি সমিতি থেকে আরেকটি গ্রুপ বের হয়ে গঠন করেছে জনসংহতি সমিতি (এমএন লারমা) গ্রুপ। পাহাড়ীদের মধ্যে এই তিন গ্রুপ এখন একে অপরের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগের পাশাপাশি ভ্রাতৃঘাতি সশস্ত্র তৎপরতায় লিপ্ত থেকে পাহাড়ের বিভিন্ন অঞ্চলকে অশান্ত করে তুলেছে। অথচ শান্তিকামী পাহাড়ী ও বাঙালীদের মাঝে এ ধরনের অপতৎপরতা শুধু উদ্বেগ উৎকণ্ঠার সৃষ্টি করেনি, রীতিমতো প্রতিনিয়ত মৃত্যুর মুখোমুখি করে রেখেছে। শান্তিচুক্তির পর গত প্রায় ১৮ বছরে সবুজে ঘেরা পাহাড়ে এসব পাহাড়ী গ্রুপের সশস্ত্র সদস্যদের আধিপত্য বিস্তারের লড়াইয়ে হানাহানিতে প্রাণ হারিয়েছে ৭ শতাধিক নেতাকর্মী ও আহত হয়েছে কমপক্ষে দেড় হাজার। এর পাশাপাশি পাহাড়ে বসবাসরত বাঙালীদের অনেকে এদের হাতে নির্মমভাবে নিহত হয়েছে। এছাড়া রাঙ্গামাটিতে প্রাণ হারিয়েছে এক সেনা কর্মকর্তাও। শান্তিচুক্তির পর শান্তিবাহিনী থেকে বেরিয়ে গিয়ে প্রসিত খীসার নেতৃত্বে জন্ম নেয়া ইউপিডিএফ একদিকে আধিপত্য বিস্তারে লিপ্ত থেকে বেপরোয়া চাঁদাবাজিতে জড়িয়ে যায়। জনসংহতি সমিতির সঙ্গে ইউপিডিএফ’র বিরোধ চলে যায় তুঙ্গে যা এখনও অব্যাহত রয়েছে। উভয় গ্রুপের অসংখ্য সংঘর্ষ ও প্রাণহানি ঘটনা পাহাড়কে নতুন করে অশান্তির মাঝে ঠেলে দিয়েছে। সর্বশেষ রাঙ্গামাটির লংগুতে জনসংহতি সমিতি সশস্ত্র সদস্যদের ব্রাশফায়ারে ৩ ইউপিডিএফ কর্মী প্রাণহানির ঘটনা নতুন করে জানান দিয়েছে এরা কত বেপরোয়া। তিন জেলা নিয়ে গঠিত পার্বত্য চট্টগ্রাম। এর মধ্যে রাঙ্গামাটি ছিল জেলা। এর অধীনে বান্দরবান ও রামগড় ছিল সাবডিভিশন। ১৯৮৩ সালের ৭ নবেম্বর তৎকালীন সরকার রামগড়ের কিছু অংশ নিয়ে খাগড়াছড়িকে জেলায় উন্নীত করে। আর রামগড় পরিণত হয় উপজেলায়। জনসংহতির নেতৃত্বে এর সামরিক উইং শান্তি বাহিনী তাদের অধিকার আদায়ে যে সশস্ত্র সংগ্রাম চালায় মূলত তা ছিল খাগড়াছড়ি ভিত্তিক। যে কারণে শান্তিচুক্তি সম্পাদনের পর শান্তি বাহিনীর আত্মসমর্পণের জন্য খাগড়াছড়িকেই বেছে নেয়া হয়। বর্তমানে এই খাগড়াছড়ির সদরসহ অধিকাংশ উপজেলায় ইউপিডিএফ’র নিরংকুশ আধিপত্য বিদ্যমান। পক্ষান্তরে রাঙ্গামাটি ও বান্দরবানে রয়েছে জেএসএস’র আধিপত্য। পাহাড়ীদের এই তিন গ্রুপ নিজেদের অভ্যন্তরীণ হানাহানি ও আধিপত্যের লড়াই মূলত খাগড়াছড়ি ও রাঙ্গামাটি জেলাজুড়ে বিস্তৃত। তাদের এই লড়াই শান্তিচুক্তির শর্ত বাস্তবায়নের পক্ষে যত নয়, তার চেয়ে বেশি নিজেদের আধিপত্য কর্তৃক ও একে অপরের প্রতি বিরোধিতার লড়াই নিয়ে। পাহাড়ে আধিপত্য বিস্তারের লড়াইয়ে জনসংহতি সমিতি ও ইউপিডিএফ মুখোমুখি অবস্থানের কারণে সবুজ পাহাড় এখন প্রতিনিয়ত রক্তে রঞ্জিত হচ্ছে। পরিস্থিতি কখনও কখনও একেবারে উদ্বেগজনক পর্যায়েও চলে যাচ্ছে। কিছুতে যেন বন্ধ হচ্ছে না রক্তক্ষয়ী এ সংঘাত। ফলে ভয়ঙ্কর রূপ নিচ্ছে পাহাড় পরিস্থিতি। জেএসএস-ইউপিডিএফে ক্যাডারদের হাতে রয়েছে অত্যাধুনিক অস্ত্রশস্ত্র ও গোলাবারুদ। পাহাড়ী-বাঙালী উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যে ভর করেছে মারাত্মক ভীতিকর পরিস্থিতি। অনেকেই এ সংঘাতময় পরিস্থিতিতে এক এলাকা ছেড়ে অন্য এলাকায় আশ্রয় নিচ্ছে। তিন পার্বত্য জেলায় শান্তিচুক্তির পক্ষে-বিপক্ষের সমর্থকদের এহেন সংঘাত পাহাড়ে রক্তের হোলিখেলা বন্ধ হচ্ছে না। উল্টো তা যেন বেড়েই চলেছে। প্রাণঘাতি এ বিরোধ বিশেষ করে খাগড়াছড়ির দীঘিনালা, নারাইছড়ি, পানছড়ি, রাঙ্গামাটি জেলার কাপ্তাই, রাজস্থলী, লংগদু, বাঘাইছড়ি ও নানিয়ারচর উপজেলায় এ বিরোধ চরম আকার ধারণ করে আছে। আর এই পরিস্থিতিতে খাগড়াছড়ি ও রাঙ্গামাটিতে বিবাদমান গ্রুপগুলো যেন দিন দিন বেপরোয়াই হয়ে উঠেছে। পার্বত্য এলাকায় প্রতিদিনই বন্দুকযুদ্ধ, গোলাগুলি, হত্যা, অপহরণ, চাঁদাবাজি নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনায় পরিণত হওয়ায় সাধারণ মানুষ রয়েছে চরম আতঙ্কে। ইউপিডিএফ-জেএসএস এবং সংস্কারপন্থী জেএসএসের আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে এ ধরনের ঘটনা চলছে। একের পর এক এসব হত্যাকা- ঘটনার পরও খুনীরা ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকায় পাহাড়ে বসবাসরত সাধারণ বাঙালী ও পাহাড়ী পরিবারগুলোর মধ্যে সর্বক্ষণিক অজানা আতঙ্ক ভর করে আছে। বেশ কিছুদিন নীরব থাকার পর আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে রাঙ্গামাটি জেলার লংগদু উপজেলায় জেএসএস সন্ত্রাসীদের ব্রাশফায়ারে গত রবিবার নতুন করে প্রাণ হারাল ৩ ইউপিডিএফ কর্মী। ইউপিডিএফ তাদের প্রতিপক্ষ পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির সন্তু গ্রুপকে এ ঘটনার জন্য দায়ী করেছে। তবে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকার কথা ইতোমধ্যেই অস্বীকার করেছে। ১৯৯৭ সালে শান্তিচুক্তির পর পাহাড়ে যে শান্তির সুবাতাস বইতে শুরু করেছিল তা এখন দুর্যোগের ঘনঘটায় পরিণত হয়ে আছে। খাগড়াছড়ি স্টেডিয়ামে শান্তি বাহিনীর অস্ত্র সমর্পণকালে শান্তি চুক্তিকে প্রত্যাখ্যান করে কালো পতাকা উত্তোলনের মাধ্যমে চুক্তি সম্পাদনকারী পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি পিসিজেএসএস থেকে বেরিয়ে জন্ম নেয়া নতুন বিদ্রোহী গ্রুপ ইউপিডিএফ পরবর্তীতে একটি বিশেষ মহলের পৃষ্ঠপোষকতায় পাহাড়ে আধিপত্য বিস্তারের লড়াই শুরু করেছে। যা পরবর্তীতে ৪ দলীয় জোট সরকারের আমলে গোপন পৃষ্ঠপোষকতা পেয়ে ফুলে ফেঁপে একটি আতঙ্ক ও বৃহৎ সশস্ত্র সন্ত্রাসী ও চাঁদাবাজ সংগঠনে পরিণত হয়। গুরু সন্তু লারমা ও শিষ্য প্রসীতের দুই সংগঠন পিসিজেএসএস এবং ইউপিডিএফ’র এলাকায় আধিপত্য বিস্তারের লড়াইয়ে অশান্ত হতে থাকে পাহাড়ের বিস্তীর্ণ অঞ্চল। প্রতিনিয়ত পড়তে থাকে লাশ। পাহাড়বাসীর জনজীবন হতে থাকে বিপন্ন। দুই সংগঠনের প্রতিনিয়ত বন্দুকযুদ্ধ ও হতাহতের ঘটনায় পাহড়ে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ক্রমে অবনতির দিকে ধাবিত হতে থাকে। এক সময় সন্তু লারমা ও প্রসীত বিকাশ খীসা ছিলেন গুরু-শিয্য। সন্তু লারমা ছিলেন শান্তি বাহিনীর রাজনৈতিক সংগঠন পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির (পিসিজেএসএস) সভাপতি আর প্রসীত ছিলেন ঐ সংগঠনের অঙ্গ সংগঠন পাহাড়ী ছাত্র পরিষদের সভাপতি। পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির বিরোধিতা করে ১৯৯৭ সালে প্রসীতের নেতৃত্বে জন্ম নেয় ইউনাইটেড পিপল্স ডেমোক্রেকি ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ) নামের বিদ্রোহী এ সংগঠনটি। এরা পার্বত্য চট্টগ্রামে পূর্ণ স্বায়ত্তশাসনের জন্য আন্দোলন করে যাচ্ছে। সূত্র জানায়, পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তিচুক্তির পর পিসিজেএসএস ও ইউপিডিএফ’র আধিপত্য লড়াইয়ে এ পর্যন্ত উভয়ের ৭শ’ শতাধিক নেতাকর্মী নিহত ও প্রায় দেড় সহস্র আহত হয়েছে। বহু বাঙালী তাদের হাতে প্রাণ হারিয়েছে। এছাড়া প্রায় সময় নিরাপত্তা বাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেই থাকে। এসব সংঘর্ষে এক সেনা কর্মকর্তা রাঙ্গামাটিতে প্রাণ হারিয়েছে। অনুসন্ধানে জানা গেছে, বর্তমানে আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে পাহাড়ে বিবদমান ৩টি গ্রুপ রয়েছে। এর একটি পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি (পিসিজেএসএস) পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি (পিসিজেএসএস) এমএন লারমা গ্রুপ এবং ইউনাইটেড পিপলস অব ডেমোক্রটিকস ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ)। এর মধ্যে নিজেদের কর্তত্বের লড়াইয়ে প্রতিনিয়ত ইউপিডিএফ, জনসংহতি সমিতি এমএন লারমা গ্রুপের সঙ্গে জনসংহতির সংঘাত লেগেই রয়েছে। গত প্রায় ১৮ বছরে চুক্তিবিরোধী সশস্ত্র এ সংগঠনটির হাতে শতাধিক জেএসএস কর্মীসহ দেড় শতাধিক লোক নিহত ও ২ শতাধিক অপহৃত হয়েছে। অনুরূপভাবে জেএসএসের হাতে প্রায় একই সংখ্যক ইউপিডিএফ কর্মী নিহত হয়েছে বলে বেসরকারী পরিসংখ্যান রয়েছে। পাহাড়ের এই হানাহানির পেছনে রয়েছে মূলত এলাকায় তাদের নিজ নিজ আধিপত্য বিস্তার ও চাঁদা আদায়ের ঘটনা। পাহাড়ে প্রয়োজনীয় সংখ্যক পুলিশী অবস্থান না থাকায় চাঁদাবাজদের দৌরাত্ম্য সমতলের চেয়ে বহুগুণে বেশি। এ পর্যন্ত কোন চাঁদাবাজ দ-িত হয়েছে এমন কোন রেকর্ড নেই। জেএসএস ও ইউপিডিএফ এই দুই আঞ্চলিক রাজনৈতিক দলের লালিত অস্ত্রধারীদের উন্মাদনায় বিশেষ করে খাগড়াছড়ি ও রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলায় সাম্প্রতিক আইনশৃঙ্খলার পরিস্থিতি সাধারণ মানুষকে নতুন করে শংকিত করে তুলেছে। পাহাড়ী বাঙালী উভয় সম্প্রদায়ের জনগোষ্ঠী রয়েছে, অপহরণ ও প্রাণহানির আতঙ্কে। স্থানীয় বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, প্রতিবার সংঘর্ষের সময় পাহাড়ের বিবাদমান সশস্ত্র সংগঠনগুলো ব্যবহার করছে অত্যাধুনিক আগ্নেয়াস্ত্র। বন্দুকযুদ্ধে লিপ্ত হয়ে তারা শত শত রাউন্ড গুলিও ব্যবহার করছে। কিন্তু সংঘর্ষ শেষ হওয়ার পর আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এই দুই গ্রুপের কাছ থেকে কোন অস্ত্র উদ্ধার করতে পারে না। ফলে দিন যতই যাচ্ছে শান্তিপ্রিয় পাহাড়ী বাঙালীদের মাঝে ততই আতঙ্ক বাড়ছে। এছাড়া এ দুটি সংগঠনের বেপরোয়া চাঁদাবাজি রীতিমতো ওপেন। টোকেন কিংবা রসিদ দিয়ে নিয়মিত চাঁদা আদায় কর যাচ্ছ এরা। কৃষক, শ্রমিক ও ব্যবসায়ী কেউই সন্ত্রাসীদের চাঁদাবাজির হাত থেকে রেহাই পাচ্ছে না। স্থানীয়দের মতে, চুক্তির পর পার্বত্য চট্টগ্রামে সন্ত্রাস ও চাঁদাবাজির ঘটনা নজিরবিহীন। জেএসএস ও ইউপিডিএফ নামে পার্বত্য চট্টগ্রামের আনাচে-কানাচে ব্যাঙের ছাতার মতো গড়ে উঠেছে অসংখ্য ক্লাব ও সংগঠন। এই ক্লাবগুলোও ব্যাপক চাঁদাবাজি করে চলেছে। স্থানীয় সূত্রগুলো জানায়, এমন কোন সেক্টর নেই যেখান থেকে সন্ত্রাসীরা চাঁদা আদায় করছে না। তবে সব চেয়ে বেশি চাঁদা আদায় বনজসম্পদ ও উন্নয়ন প্রকল্প থেকে। এছাড়াও যানবাহন, বিভিন্ন টোল কেন্দ্র, বাজার ডাক, ফসলের জমি, জুম চাষ, গবাদিপশু এমনকি বিপুলসংখ্যক চাকরিজীবীদেরও বার্ষিক চাঁদা দিয়ে সেখানে অবস্থান করতে হচ্ছে। শান্তিচুক্তির আগে একটি সন্ত্রাসী সংগঠনকে চাঁদা দিলে ব্যবসা-বাণিজ্য নিবিঘেœ করা যেত। কিন্তু চুক্তির পর ইউপিডিএফ ও জেএসএস (এমএন লারমা গ্রুপ) ও অনুরূপ চাঁদাবাজির পাশাপাশি নিজেদের মধ্যে আধিপত্যের লড়াইয়ে সশস্ত্র তৎপরতায় লিপ্ত রয়েছে। প্রসীত বিকাশ খীসার নেতৃত্বে ইউপিডিএফ। পরবর্তীতে পিসিজেএসএস ভেঙে রূপায়ন দেওয়ান, সুধাসিন্দু খীসা ও তাতিন্দ্র লাল চাকমা ওরফে মেজর পেলে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি (এমএন লারমা) নামে বিদ্রোহী একটি কমিটি গঠন করে সন্তু লারমার জেএসএস’র সঙ্গে প্রকাশ্যে দ্বন্দ্ব ও সংঘাতে জড়িয়ে যায়। সূত্র জানায়, পার্বত্য চট্টগ্রামে চলাচলকারী প্রতিটি যানবাহনের মালিক, ব্যবসায়ী ও ঠিকাদাররা সংগঠনগুলোকে প্রতিবছর ডিসেম্বর মাসে বাৎসরিক চাঁদা দিয়ে পরবর্তী বছরের টোকেন সংগ্রহ করতে হয়। সন্ত্রাসীরা বিভিন্ন বিদেশী দাতাগোষ্ঠী ও সংস্থা এবং এনজিওদের কাছ থেকেও চাঁদা আদায় করে থাকে। চাঁদা না দিলে অপহরণের শিকার হতে হয়। সূত্রমতে, ট্রাক, বাস বা কোস্টার প্রতিটি বাৎসরিক চাঁদা হিসেবে জেএসএসকে ৯ হাজার টাকা ও ইউপিডিএফকে ৬ হাজার টাকা, জীপ ৩ হাজার ও ২ হাজার, বেবিট্যাক্সি ১৫শ’ ও ১ হাজার, রিক্সা ৩শ’ ও ২শ’, বড় সাইজের বাঁশ প্রতি হাজার ৬শ’ ও ৪শ’, উন্নয়ন প্রকল্পের মধ্যে স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসা থেকে ১৫ ও ১০ শতাংশ, রাস্তা, সেতু কালভার্ট ও বিল্ডিং ৩০ ও ২০ শতাংশ, কড়ই কাঠ, গর্জন, চাপালিশ ও সেগুন প্রতিঘন ফুট ৬০ টাকা ও ৪০ টাকা এবং প্রতিটি শ্রেণীর গোলকাঠ ফুট প্রতি ৩০ ও ২০ টাকা, কলা, আদা হলুদ, সবজি, ধান ও চাল ভর্তি প্রতি ট্রাক ৬শ’ ও ৪শ’, প্রতিটি বাছুর ৭৫ টাকা ও ৫০ টাকা, ষাড় বা গরু ১৫০ টাকা ও ১শ’ টাকা, ছাগলের জন্য ৬০ টাকা ও ৪০ টাকা করে চাঁদা দিতে হয়। সূত্র জানায়, সন্ত্রাসীরা বিভিন্ন পদ্ধতিতে চাঁদা আদায় করে থাকে। চাঁদা আদায় করার জন্য পার্বত্য চট্টগ্রামের ২৫টি উপজেলা ছাড়াও ইউনিয়ন ও গ্রাম পর্যায়ে তাদের রয়েছে কালেক্টর। চাঁদা আদায়ের ক্ষেত্রে কালেক্টররা একটা পার্সেন্ট পেয়ে থাকে। কালেক্টররা চাঁদা আদায় করার পর তাদের অংশটা রেখে বাকিটা কেন্দ্রীয় তহবিলে জমা দেয়। এছাড়াও কৃষক ও ঝুম চাষীদের একর হিসাব করে চাঁদা দিতে হয়। দেশের বিভিন্ন স্থানে যে সব উপজাতীয় চাকরিজীবী রয়েছে তাদের অনেককেও এখন বার্ষিক হারে চাঁদা দিতে হচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে। যদিও এর সুনির্দিষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায় না। খাগড়াছড়ির সাবেক সংসদ সদস্য এ কে এম আলীম উল্লাহ এ প্রসঙ্গে বলেন, চাঁদার বাইরে কেউ নেই। উপজাতি-বাঙালী সবাইকে চাঁদা দিতেই হয়। খাগড়াছড়ি পুলিশ প্রশাসন সূত্রে জানানো হয়, চাঁদাবাজির অভিযোগ মুখে আছে কিন্তু কেউ অভিযোগ করে না। ফলে প্রশাসন প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে পারছে না। স্থানীয় নিরাপত্তা বাহিনীর এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, ব্যবসায়ী ও ঠিকাদাররা নিরাপত্তা বাহিনীকে না জানিয়ে সন্ত্রাসীদের কাছে গোপনে চাঁদা পৌঁছে দিয়ে থাকে। ফলে সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া সম্ভব হয় না। এক ব্যবসায়ী নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে আইনের আশ্রয় নিলে পরবর্তীতে অপহরণসহ বড় ধরনের বিপদে পড়ার শঙ্কা থাকে। ফলে অনেকে নীরবে চাঁদা দিয়ে থাকে। এদিকে জেএসএস প্রধান সন্তু লারমা বরাবরই অভিযোগ করে আসছে ইউপিডিএফ শান্তিচুক্তি বিরোধী এবং এদের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসী এবং চাঁদাবাজির অভিযোগ এনে এ সংগঠনটিকে নিষিদ্ধ করার জন্য সরকারের কাছে তার দাবি রয়েছে। অপরদিকে ইউপিডিএফের পক্ষ থেকে এসব অভিযোগ অস্বীকার করে বলা হয়ে থাকে, কেউ স্বেচ্ছায় সংগঠনকে সহযোগিতা করলে তাকে চাঁদাবাজি বলা যাবে না।
×