ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

অনুসন্ধানী প্রতিবেদন

মেয়েদের বাল্যবিয়ে এখন মেয়েরাই ঠেকাচ্ছে

প্রকাশিত: ০৫:৩৬, ১৩ জুন ২০১৫

মেয়েদের বাল্যবিয়ে এখন মেয়েরাই ঠেকাচ্ছে

তৌহিদুর রহমান, খুলনা থেকে ফিরে ॥ বাগেরহাট সদর থানার পূর্ববাসাবাটি এলাকার কিশোরী সুমী আক্তারের বিয়ে ঠিক। নবম শ্রেণীর এই ছাত্রীর অমতেই তার পরিবারের সদস্যরা বিয়ে ঠিক করেন। বিয়ের বয়স না হওয়ায় এই বিয়ে ঠেকিয়েছে এলাকার সচেতন মেয়েরাই। এদিকে খুলনা শহরের বাস্তুহারা এলাকার ফাতেমা তুজ জোহরার বয়স মাত্র নয় বছর। তৃতীয় শ্রেণীতে পড়া এই মেয়ের বিয়েও ঠেকিয়েছে সেখানকার মেয়েরা। এভাবে মেয়েদের বাল্যবিয়ে ঠেকাতে এখন এগিয়ে আসছেন মেয়েরাই। খুলনা ও বাগেরহাট জেলায় বাল্যবিয়ের হার বেশি হলেও এখন জনসচেনতা বাড়ছে। কম বয়সী মেয়েদের বিয়ে ঠেকিয়ে দিচ্ছে মেয়েরা। কখনও কখনও অভিভাবকদের বুঝিয়ে এই বিয়ে ঠেকানো হচ্ছে। আবার কখনও স্থানীয় প্রশাসনের সহায়তায় ঠেকানো হচ্ছে। এছাড়া বিয়ে ঠেকানোর বিষয়ে সহযোগিতা করছে সরকারী-বেসরকারী উদ্যোগে পরিচালিত স্থানীয় সংস্থা। খুলনা জেলা প্রশাসন জানায়, বাল্যবিয়ের জন্য বিভিন্ন প্রবণতা দেখা যায়। তার মধ্যে বাল্যবিয়ের বিষয়ে বিদ্যমান আইন ও তার সঠিক প্রবণতা না হওয়া। দরিদ্র পরিবারে মেয়েদের বোঝা মনে করা। মেয়েদের লেখাপড়া করানোর বিষয়ে পরিবারের অনাগ্রহ। অল্প বয়সে বিয়ে দিলে যৌতুক কম লাগবে এ ধরনের ধারণা পোষণ করা। মুরব্বি এবং মা-বাবার শখ পূরণ করা। নিরাপত্তার অভাব। বখাটেদের উৎপাত ইত্যাদি কারণে মেয়েদের বাল্যবিয়ে দেয়া হয়। এ বিষয়ে জানতে চাইলে খুলনা জেলা প্রশাসক মোস্তফা কামাল জনকণ্ঠকে বলেন, বাল্যবিয়ে প্রতিরোধে সরকার অঙ্গীকারাবদ্ধ। বাল্যবিয়েকে কখনই বৈধতা দেয় না সরকার। আমরা কখনই চাই না যে, কোন একটি শিশুর কোলে আরেকটি শিশুর জন্ম হোক। তবে এই বিয়ে ঠেকাতে জনসচেতনতা বাড়ানোর লক্ষ্যে বিভিন্ন কর্মসূচী গ্রহণ করা হয়েছে। যেখানেই বাল্যবিয়ের খবর পাওয়া যাচ্ছে সেখানেই স্থানীয় প্রশাসন থেকে ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। এছাড়া বাল্যবিয়ে প্রতিরোধে এখন এলাকার সচেতন মেয়েরাও এগিয়ে আসছে। অনেক জায়গায় তারাই এসব বাল্যবিয়ে প্রতিরোধ করছে। এটা খুবই ইতিবাচক। ইউনিসেফের ২০১২-১৩ সালের মাল্টিপল ইন্ডিকেটর ক্লাস্টার সার্ভে (বহুমুখী সূচকের গুচ্ছ জরিপ) প্রতিবেদনে বলা হয়, দেশের ১৫ বছরের কম বয়সী মেয়েদের বিয়ের হার ২৩ দশমিক ৮ শতাংশ। তবে খুলনা বিভাগে এই হার ৩১ দশমিক ১ শতাংশ। বাগেরহাটে ৩০ দশমিক ৭ শতাংশ। খুলনায় ৩০ দশমিক ২ শতাংশ। অপরদিকে ১৮ বছরের নিচে এদেশে মেয়েদের বিয়ের হার ৬২ দশমিক ৮ শতাংশ। খুলনা বিভাগে এই বিয়ের হার ৭১ দশমিক ১ শতাংশ। বাগেরহাটে ৭০ দশমিক ২ শতাংশ। খুলনায় ৬৯ দশমিক ২ শতাংশ। বাগেরহাট সদরের ৮ নম্বর ওয়ার্ডে গত এক বছরে ৭টি বিয়ে ঠেকিয়ে দিয়েছে স্থানীয় মেয়েরাই। সেখানে স্থানীয় শিশুবান্ধব কেন্দ্রের সদস্যরা এই বিয়ে ঠেকিয়েছে। কেন্দ্রের সদস্য লিমা আক্তার জনকণ্ঠকে বলেন, বাল্যবিয়ে প্রতিরোধে আমরা এখন সচেতন। ১৮ বছরের কম বয়সী কোন মেয়ের বিয়ের খবর পাওয়া গেলে আমরা নিজেরাই অভিভাবকদের সঙ্গে এটা নিয়ে আলাপ করি। তারা যেন বিয়ে না দেন প্রথমে তাদের বোঝাই। অনেকেই আমাদের কথা শোনেন। আবার কোন অভিভাবক না শুনতে চাইলে স্থানীয় প্রশাসনকে অবহিত করি। তারাই বিয়ে ঠেকিয়ে দেয়। এদিকে খুলনা শহরের বাস্তুহারা এলাকায় এক মাসে দুটি বাল্যবিয়ে ঠেকিয়ে দিয়েছে স্থানীয় মেয়েরা। এলাকার মেয়ে হোসেনে আরা চন্দ্রা জনকণ্ঠকে বলেন, আমরা যেখানেই বাল্যবিয়ের খবর পাই সেখানে গিয়ে অভিভাকদের বুঝিয়ে থাকি। এর পরও তারা বিয়ে দিতে চাইলে স্থানীয় প্রশাসনকে অবহিত করি। তখন বিয়ে ঠেকাতে প্রশাসনই উদ্যোগ নেয়। খুলনা শহরের বাস্তুহারা এলাকায় ফাতেমা তুজ জোহরার বিয়ে ঠেকানোর জন্য স্থানীয় মেয়েরাই এগিয়ে এসেছে জানিয়ে খুলনা সিটি কর্পোরেশনের সংরক্ষিত ৫ আসনের কাউন্সিলর আনজিরা খাতুন জনকণ্ঠকে বলেন, বাল্যবিয়ে প্রতিরোধে জনসচেতনতা বাড়ছে। এলাকার মেয়েরাই বাল্যবিয়ে প্রতিরোধ করছে। তবে বাল্যবিয়ে প্রতিরোধ করতে হলে সামাজিক নিরাপত্তা বাড়াতে হবে। সামাজিক নিরাপত্তার কারণে অনেক সময় অভিভাবকরা তাদের মেয়েদের বাল্যবিয়ে দিয়ে থাকেন বলে তিনি জানান। বাল্যবিয়ে প্রতিরোধের বিষয়ে স্থানীয় মেয়েদের ভূমিকা নিয়ে জানতে চাইলে ইউনিসেফের খুলনা হেড অব জোন কফিল উদ্দিন জনকণ্ঠকে বলেন, খুলনা বিভাগে বাল্যবিয়ের হার বেশি। খুলনা ও বাগেরহাট জেলায়ও বাল্যবিয়ের প্রবণতা রয়েছে। বাল্যবিয়ে প্রতিরোধে সরকারী-বেসরকারী সংস্থা সম্মিলিতভাবে কাজ করছে। তবে বাল্যবিয়ে ঠেকানোর জন্য এখন অনেক জায়গায় স্থানীয় মেয়েরাই এগিয়ে আসছেন বলে তিনি জানান। সূত্র জানায়, দেশের অন্যান্য জেলার চেয়ে খুলনা-বাগেরহাট এলাকায় বাল্যবিয়ের প্রবণতা বেশি। তবে আগের সে অবস্থার ধীরে ধীরে পরিবর্তন ঘটছে। মানুষের মধ্যে সচেতনতা বাড়ছে। এখন মেয়েদের পড়াশোনা করাতে চাইছেন অভিভাবকরা। এর পরও অনেক অস্বচ্ছল পরিবার তাদের মেয়েদের বাল্যবিয়ে দিয়ে থাকেন। অনেকেই আবার বাল্যবিয়ের বিষয়ে আইনও জানেন না। তাই বাল্যবিয়ে প্রতিরোধে সচেতনতা বাড়ানোর লক্ষ্যে কাজ করছে সরকারী-বেসরকারী বিভিন্ন সংস্থা। ইউনিসেফের সহযোগিতায় সেখানের বিভিন্ন সংস্থা বাল্যবিয়ে প্রতিরোধে কাজ করছে। বাল্যবিয়ে প্রতিরোধে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ভূমিকা নিয়ে জানতে চাইলে খুলনার সোনাডাঙ্গা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মারুফ আহমেদ জনকণ্ঠকে বলেন, অনেক সময় দেখা যায় সামাজিক নিরাপত্তার কারণেই মেয়েদের বাল্যবিয়ে দেয়া হয়। তবে স্কুলে মেয়েরা যেন ভালভাবে যেতে পারেন, এলাকার বখাটেরা যেন ইভটিজিং করতে না পারে সেজন্য আমার থানায় বিশেষ নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। আর যেখানেই বাল্যবিয়ের ঘটনা ঘটছে সেখানেই বাধা দেয়া হচ্ছে বলেও তিনি জানান।
×