ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

আজ বিশ্ব শিশু শ্রম প্রতিরোধ দিবস

শিশু শ্রমিকের সংখ্যা কমলেও ভাগ্যের পরিবর্তন নেই

প্রকাশিত: ০৬:০৭, ১২ জুন ২০১৫

শিশু শ্রমিকের সংখ্যা কমলেও ভাগ্যের পরিবর্তন নেই

এমদাদুল হক তুহিন ॥ দেশে শিশু শ্রমিক কমে আসার কথা বলা হলেও শ্রমের সঙ্গে জড়িয়ে যাওয়া শিশুদের ভাগ্যের কোন পরিবর্তন নেই। স্বয়ং ঈশ্বরও যেন তাদের ভাগ্যের বিপরীত! আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) উদ্যোগে ২০০২ সাল থেকে আজকের দিনটি বিশ্ব শিশুশ্রম প্রতিরোধ দিবস হিসেবে পালিত হয়ে এলেও শ্রমিক শিশুদের জীবনমানের কোন উত্তরণ নেই। এ পরিস্থিতিতে শিশুশ্রম বন্ধ না হওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন সমাজের সচেতন মহল। তবে অত্যন্ত আশার খবর হচ্ছে, প্রতি বছরই কমছে শিশু শ্রমিকের সংখ্যা। সংশ্লিষ্টরা ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রম প্রতিরোধে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা গ্রহণের অনুরোধ জানিয়েছেন। আইনের প্রয়োগ, দারিদ্র্য প্রতিরোধ, সামাজিক সচেতনতা, প্রতিরোধমূলক ক্যাম্পেইনসহ নানা কার্যক্রম বৃদ্ধির আহ্বান জানিয়েছেন মানবাধিকারকর্মীরা। সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্য নিয়ে দেশে এমন একটি পরিস্থিতিতে বিশ্ব শিশুশ্রম প্রতিরোধ দিবস পালিত হচ্ছে আজ। এ উপলক্ষে রাষ্ট্রপ্রতি মোঃ আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাণী দিয়েছেন। ‘মাসে ১ হাজার ৫০০ টাকা পাই। রাতে নাস্তার জন্য ১৫ টাকা দেয়া হয়। মা নেই (আবেগমিশ্রিত ভাঙ্গা কণ্ঠ)। বাবা ভাঙ্গারি দোকান চালায়। অনেক রাত পর্যন্ত কাজ করতে হয়। বিভিন্ন বাসায় গিয়েও যন্ত্রপাতি ঠিক করি।’Ñ কথাগুলো বলছিল রাজধানীর একটি গ্যারেজে কাজ করা শিশু শ্রমিক মোফাজ্জেল বাবু। কিশোরগঞ্জের করিমগঞ্জ উপজেলার এ শিশুটির বয়স ১০। রাজধানীর বিজয় সরণির জান্নাত মটরসে কাজ করে। মাকে হারানোর পরই কঠিন জীবনযুদ্ধে জড়াতে হয় শিশুটিকে। শুধু গ্যারেজে নয়, মোটরসাইকেল ঠিক করতে বিভিন্ন বাসাবাড়িতেও গ্যারেজ থেকে পাঠানো হয়। বৃহস্পতিবার দুপুর ২টায় বিজয় সরণি থেকে তেজগাঁও বিজ্ঞান কলেজের পাশের গলির একটি বাসায় মোটরসাইকেল ঠিক করতে যাচ্ছিল বাবু। যে বয়সে মায়ের হাতে হাতবদ্ধ থাকার কথা ছিল এ শিশুটির হাত, সে বয়সেই হাতে মেরামতের যন্ত্র। খোঁজ নিয়ে দেখা গেল পূর্ব তেজতুরী বাজারের ৩০ নম্বর বাসায় মোটরসাইকেল ঠিক করছে বাবু। তার পাশেই বসেছিলেন ৪০ বছর বয়স্ক মোটরসাইকেলের মালিক। দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করেও ওই মালিকের সঙ্গে কথা বলা সম্ভব হয়নি। তবে সহজেই স্পষ্ট হয়, শিশুশ্রম বন্ধে সচেতনতা ও বিবেকবোধ জাগ্রতের বিকল্প নেই। একাধিক বিশেষজ্ঞ বলছেন, শিশুশ্রম বন্ধে সামাজিক সচেতনতা, দারিদ্র্য প্রতিরোধ, আইনের সঠিক প্রয়োগ, ঝুঁকিপূর্ণ শ্রম বন্ধে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা গ্রহণের দিকে জোর দিতে হবে। তবে আশার খবর হচ্ছে, সরকারী-বেসরকারী নানা উদ্যোগে দেশে শিশু শ্রমিকের সংখ্যা কমছে। কয়েকটি পরিসংখ্যান থেকে জানা যায়, গত দশ বছরে শিশু শ্রমিকের সংখ্যা কমে এসেছে। ২০১১ সালের আরেকটি তথ্যে দেখা যায়, তখন দেশে শিশু শ্রমিকের সংখ্যা ছিল প্রায় ৭৯ লাখ। আর ২০১৩ সালের বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো পরিচালিত এক জরিপে দেশে ৩৫ লাখ শিশু শ্রমিক থাকার কথা বলা হয়েছে। তবে শিশু শ্রমিক কমলেও ঝুঁকি কমেনি। বন্ধ হয়নি ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রম। শিশুশ্রমের চিত্র ইতিবাচক দাবি করা হলেও মানবাধিকারকর্মীরা তা মেনে নিতে নারাজ। বাস্তবতা বলছে, শিশুশ্রম কিছুটা কমলেও শ্রমের সঙ্গে যুক্ত শিশুদের জীবনমানের চিত্র পুরনোই। পরিসংখ্যান ও বাস্তবতার নিরিখে দেখা যায়, দেশে কয়েকটি খাতে শিশুশ্রম কমেছে। বেশ কয়েকটি খাতে এ চিত্র ইতিবাচক। হিউম্যান হলারে শিশু শ্রমিকের সংখ্যা কমছে। হলারগুলোতে কমে এসেছে শিশু শ্রমিক, তবে পুরোপুরি বন্ধ হয়নি। ফার্মগেট হয়ে নিউমার্কেটের রাস্তায় চলা হিউম্যান হলারগুলোতে বর্তমানে নেই কোন শিশু শ্রমিক (হেলপার)। গত তিন দিন সরেজমিন ঘুরে দেখা যায়, ফার্মগেট টু নিউমার্কেট রুটে চলমান হিউম্যান হলারগুলোতে কোন হেলপার নেই। প্রতি ২০টি টেম্পোর একটিতে কখনও কখনও হেলপারের দেখা মেলে। হেলপার না থাকায় সাময়িক এ অসুবিধাকে কেউ অসুবিধাও মনে করছেন না। গত বুধবার টেম্পোতে চড়ে দেখা যায়, ইডেন কলেজ পড়ুয়া এক ছাত্রী ভাড়া সংগ্রহে ড্রাইভারকে সাহায্য করছেন, যা সমাজের বদলে যাওয়ার চিত্রই প্রকাশ করে। আরেকটি টেম্পোতে দেখা যায় ভাড়া উঠানোর কাজে সাহায্য করছেন রহিম মিয়া (৫০)। তিনি বলেন, ‘হেলপার নেই। সাময়িক অসুবিধা হচ্ছে। তবে শিশু শ্রমিক না থাকায় এক ধরনের শান্তি। সমাজের সর্বত্র এ শান্তি ফিরে আসুক।’ রাস্তাটিতে হেলপার না থাকার কথা স্বীকার করে নেন হিউম্যান হলারের একজন ড্রাইভার। এ রাস্তাটিতে শিশু শ্রমিক কমে এলেও ফার্মগেট-ধানম-ি, মহাখালী-ফার্মগেট, মহাখালী-শ্যামলী, নাখালপাড়া-ফার্মগেট পূর্বের মতোই। দেশে পুরোপুরি শিশুশ্রম বন্ধ করা সম্ভব নয় উল্লেখ করে মানবাধিকারকর্মী এ্যাডভোকেট এলিনা খান জনকণ্ঠকে বলেন, অর্থনৈতিক কারণে দেশে পুরোপুরি শিশুশ্রম বন্ধ করা সম্ভব নয়। প্রথমত ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রম বন্ধের দিকে মনোনিবেশ করতে হবে। আইনের প্রয়োগ, সচেতনতা বৃদ্ধি ও প্রচারের মাধ্যমে তা কমানো যেতে পারে। বাসাবাড়িসহ একাধিক খাতে যুক্ত থাকা শিশু শ্রমিকদের চিত্তবিনোদন ও লেখাপড়ার নিশ্চয়তা থাকতে হবে।
×