ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

২২ জনকে সতর্ক করে ক্ষমা করে দিয়েছে ট্রাইব্যুনাল

আদালতের কাঠগড়ায় এক ঘণ্টার দ- জাফরুল্লাহ চৌধুরীর

প্রকাশিত: ০৬:০৩, ১১ জুন ২০১৫

আদালতের কাঠগড়ায় এক ঘণ্টার দ- জাফরুল্লাহ চৌধুরীর

স্টাফ রিপোর্টার ॥ ব্রিটিশ নাগরিক ডেভিড বার্গম্যানকে দেয়া ট্রাইব্যুনালের দ- ও জরিমানার রায়ের বিষয়ে উদ্বেগ জানিয়ে বিবৃতি দেয়ায় গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ডাঃ জাফরুল্লাহ চৌধুরী আদালত অবমাননার দায়ে কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে এক ঘণ্টার দ- ভোগ করলেন। একই সঙ্গে তাকে পাঁচ হাজার টাকা জারিমানা করা হয়েছে। সাত দিনের মধ্যে এই টাকা রেজিস্ট্রার বরাবর পরিশোধ করতে হবে। অনাদায়ে তাকে আরও এক মাস কারাদ- ভোগ করতে হবে। একই আদেশে আদালত অবমাননার অভিযোগ থেকে অপর ২২ জনকে সতর্ক করে ক্ষমা করে দিয়েছে ট্রাইব্যুনাল। চেয়ারম্যান বিচারপতি ওবায়দুল হাসান শাহীনের নেতৃত্বে তিন সদস্য বিশিষ্ট আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল এ আদেশ প্রদান করেছেন। ট্রাইব্যুনালে অন্য দুই সদস্য ছিলেন বিচারপতি মোঃ মুজিবুর রহমান মিয়া ও বিচারপতি মোঃ শাহিনুর ইসলাম। দ- ভোগ করার পর ট্রাইব্যুনাল থেকে বেরিয়ে ডাঃ জাফরুল্লাহ চৌধুরী সাংবাদিকদের বলেন, তিনি এ রায়ের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে আপীল করবেন। আর জরিমানার টাকা প্রদান করবেন না। আদেশে ডাঃ জাফরুল্লাহ চৌধুরী বাদে বাকি ২২ জনকে সতর্ক করে ক্ষমা করে দিয়েছেন ট্রাইব্যুনাল। পরবর্তীতে তাদের কোন মন্তব্য ও বিবৃতির কারণে ট্রাইব্যুনালের মর্যাদা যেন ক্ষুণœ না হয় সে বিষয়ে সতর্ক করা হয়েছে। ক্ষমা পাওয়া ২২ জন হলেনÑ মাসুদ খান, আফসান চৌধুরী, হানা শামস আহমেদ, অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ, আনুশেহ আনাদিল, লুবনা মারিয়াম, মুক্তাশ্রী চাকমা সাথী, এ্যাডভোকেট এ জিয়াউর রহমান, শিরিন হক, ড. সি আর আবরার, ফরিদা আক্তার, ড. বিনা ডি কস্টা, রেহনুমা আহমেদ, ড. শহীদুল আলম, লিসা গাজী, ড. জরিনা নাহার কবির, তিবরা আলী, শবনম নাদিয়া, মাহমুদ রহমান, দেলোয়ার হোসেন, আলী আহম্মেদ জিয়াউদ্দিন ও নাসরিন সিরাজ এ্যানি। আদালতের পর্যবেক্ষণে বলা হয়, বিবৃতিদাতাদের মধ্যে সমন্বয়ের অভাব ছিল। আদালতে তারা ভিন্ন ভিন্ন বক্তব্য রেখেছিলেন। এদিকে দ- ভোগ করার পর ট্রাইব্যুনাল থেকে বেরিয়ে ডাঃ জাফরুল্লাহ চৌধুরী সাংবাদিকদের বলেন, তিনি এ রায়ের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে আপীল করবেন। আর জরিমানার টাকা প্রদান করবেন না। জাফরুল্লাহ চৌধুরী বলেন, আজকের (বুধবার) আদালত অবমাননার রায়টা তিনজন বিচারকের মানসিক অসুস্থতার প্রমাণ। এখানে বিচারপতিরা সমালোচনা সহ্য করতে পারেন না। যেখানে তারা সমালোচনা সহ্য করতে পারেন না, সেখানে ন্যায়বিচার হয় না। তারা আইনের আড়ালে আত্মগোপন করেন। সেখানে তিনটির একটি বিষয় প্রমাণ করতে হয়। আদালতের বিরুদ্ধে কুৎসা রটনা, বিচারের প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করা, আদালতের মর্যাদাকে ক্ষুণœ করা। তিনি বলেন, বিচারপতিরা আদেশের কোথাও সুস্পষ্টভাবে বলেননি, কোন জায়গাতে আমরা বা বিশেষ করে আমি এই তিনটি বিষয় ভঙ্গ করেছি। তাদের যুক্তি নাই বলেই তিন বিচারপতি উষ্মা প্রকাশ করেছেন। এ মামলার শুরু থেকে আজকেও তাই। পৃথিবীর মধ্যে এটা অভদ্রজনিত ব্যবহার। যখন রায় পড়েন তখন সকল অভিযুক্ত ব্যক্তিদের দাঁড় করিয়ে রাখা অর্থহীন। এটা মধ্যযুগের ঘটনা। অন্যদিকে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ বলেছেন, বর্তমান আইনে আপীল করার কথা নেই। একটা ইস্যু উচ্চ আদালতে পেন্ডিং রয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের শক্তি হিসেবে দাবি করে অথচ ট্রাইব্যুনালের আদেশের পর আদালত পাড়ায় যে ধরনের আচরণ করেছেন তা অনাকাক্সিক্ষত। আদালত কক্ষের বাইরে গান করা, বিভিন্ন ধরনের অঙ্গভক্তি করাটা অনাকাক্সিক্ষত। তারা কোন অবস্থানেই আইনের উর্ধে নয়। বিবৃতিদাতাদের মধ্যে ডাঃ জাফরুল্লাহ চৌধুরীকে দ- দিয়েছে ট্রাইব্যুনাল। এর কারণ হলো এর আগেও আদালত অবমাননার জন্য ট্রাইব্যুনাল-১ থেকে তাকে সতর্ক করা হয়েছিল। যেন তিনি ট্রাইব্যুনাল সম্পর্কে পরবর্তীতে এমন কোন মন্তব্য করা থেকে বিরত থাকেন। কিন্তু তিনি ক্রমাগতভাবে ট্রাইব্যুনালের আদেশের বিরুদ্ধে আবারও ভুল করলেন। সেজন্য ট্রাইব্যুনালে তার আসামির কাঠগড়ায় এক ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকা ও পাঁচ হাজার টাকা জরিমানা এবং অনাদায়ে এক মাসের কারাদ- দেয়া হয়েছে। অন্যদিকে ২৯ এপ্রিল একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সময় মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচারে আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনালস) আইন-১৯৭৩ এর দুটি ধারায় আদালত অবমাননা বিষয়ক বিধানকে চ্যালেঞ্জ করে ব্রিটিশ নাগরিক ডেভিড বার্গম্যানের সাজায় উদ্বেগ প্রকাশ করে বিবৃতিদাতা ১২ নাগরিকের দায়ের করা একটি রিটের নিষ্পত্তি করে দেয় হাইকোর্ট। বিচারপতি ফারাহ মাহবুব ও বিচারপতি কাজী মোঃ ইজারুল হক আকন্দের হাইকোর্ট দ্বৈত বেঞ্চ কিছু পর্যবেক্ষণ দিয়ে রিটটির নিষ্পত্তি করে দিয়েছেন। পর্যবেক্ষণে বলা হয়েছে ট্রাইব্যুনালে আদালত অবমাননায় অভিযুক্ত যে কেউ ইচ্ছা করলে আপীল বিভাগে আপীল করতে পারবেন। আবেদনকারীদের আইনজীবী রাশনা ইমাম আদেশের পর সাংবাদিকদের বলেছিলেন, পর্যবেক্ষণে বলা হয়েছে, ট্রাইব্যুনাল আইনে কেউ দ-িত হলে তিনি সংবিধানের ১০৪ ধারা অনুযায়ী সর্বোচ্চ আদালতে যেতে পারবেন। বুধবার বেলা এগারোটা ২৪ মিনিটের সময় চেয়ারম্যান বিচারপতি ওবায়দুল হাসান শাহীন আদালত অবমাননার এ রায় দেন। সে হিসেবে দুপুর বারোটা ২৪ মিনিট পর্যন্ত আসামি ডাঃ জাফরুল্লাহ চৌধুরীর কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে থেকে দ- ভোগ করার কথা ছিল। কিন্তু তিনি কাঠগড়ায় উঠতে অস্বীকৃতি জানিয়ে দীর্ঘ এক ঘণ্টা ২৫ মিনিট ধরে এজলাসে বাগ্বিত-া, ট্রাইব্যুনাল ও বিচারপতিদের সঙ্গে অসৌজন্যমূলক আচরণ করেন। এমনকি বিচারপতিদের তিনি বলেন, আপনারা ক্ষমতার অপব্যবহার করে এ আদেশ দিয়েছেন। অবশেষে অনেকের অনুরোধ ও জোরাজুরিতে দুপুর বারোটা ৪৯ মিনিট থেকে একটা ৪৯ মিনিট পর্যন্ত কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে দ- ভোগ করেন ডাঃ জাফরুল্লাহ চৌধুরী। দ- ভোগ করার পর সাংবাদিকদের বলেন, আমি বলেছি আপনাদের এই আদেশ স্থগিত রাখেন যেন উচ্চ আদালতে আপীল করতে পারি। তারা সেই সুযোগ না দিয়ে দ্রুত আদালত ত্যাগ করেছেন। এখন বিষয়টা আপনারা বিবেচনা করেন। আমি কোন জরিমানা দেব না, আপীল করব। আপীলে যা হয় তা পরে দেখা যাবে। আমি কোথাও ভুল করিনি। সমালোচনা আমার গণতান্ত্রিক অধিকার। গণতান্ত্রিক দেশে কথা বলতে পারব না? এই দেশের জন্য আমি মুক্তিযুদ্ধ করেছি। সেই দেশের ব্যাপারে কোন বক্তব্যও রাখতে পারব না তা তো হয় না। এখানে আমি পরিষ্কার বলেছি, আপনাদের রায়ের কপি দেন আমাকে। বিচারকরা ভুলটা কোথায় কোথায় করেছেন? আমি সেই প্রশ্নটাই তাদের করার জন্যই দাঁড়ালাম। কিন্তু প্রথমেই বক্তব্যটা শুনে দ্রুত কক্ষ ত্যাগ করলেন তারা। এরপর যদি দেখা যায়, উচ্চ আদালতে আমার বিরুদ্ধে দেয়া রায়টা ভুল হয় তাহলে তারা কি আমার এই জীবনের সময়টা ফিরিয়ে দিতে পারবেন? তাহলে কি তিনজন বিচারপতি আমার এই জায়গায় এসে বসে থাকবেন এক ঘণ্টা? তার দাবি, রায়টা অত্যন্ত অবিবেচনাপ্রসূত। সম্পূর্ণ রায়টাই তারা পড়েছেন উষ্মা ও রাগ নিয়ে। ডেভিড বার্গম্যানের যে রায়ে ১০৫টি প্যারাগ্রাফ আছে তার মধ্যে ৩১টি প্যারাগ্রাফে ডেভিড বার্গম্যানকে ছোট করা হয়েছে। সেটি মুক্তিযুদ্ধের মৃত্যু সংখ্যা নিয়ে, অথচ তা নিয়ে কোন নির্দেশনা নাই। তারপরও মনে করি, এ জাতীয় কথার প্রয়োজন আছে। আমরা বিবৃতিদাতারা বোঝাতে চেয়েছি যে গণতন্ত্রের স্বার্থেই আলাপ-আলোচনার প্রয়োজন আছে। রায় না মানা আদালত অবমাননার শামিল কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, তাহলে আরেকটা করুক আমার বিরুদ্ধে। তারাই তো দেরি করেছেন লিখিত আনতে। লিখিত আনার সঙ্গে সঙ্গেই আমি আসামির কাঠগড়ায় উঠেছি। ডেভিড বার্গম্যানের দ- ও জরিমানার বিষয়ে ৫০ নাগরিক বিবৃতি প্রদান করেন। এর মধ্যে মানবাধিকার কর্মী ও নারীনেত্রী খুশি কবির ওই বিবৃতি প্রকাশের পরপরই নিজের নাম প্রত্যাহার করে নিয়েছিলেন। বিবৃতিতে স্বাক্ষরকারীদের মধ্যে ১৪ জনের নিঃশর্ত ক্ষমা প্রার্থনার আবেদনের প্রেক্ষিতে গত ২৩ ফেব্রুয়ারি তাদের অবমাননার অভিযোগ থেকে অব্যাহতি দেয় আদালত। ওই দিন সুপ্রীম কোর্টের আইনজীবী শাহদীন মালিক, সুজন সভাপতি এম হাফিজ উদ্দিন খান, সুজনের সাধারণ সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার, সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধুরী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহমেদ ও আমেনা মহসিন, বাংলাদেশ শিশু বিকাশ কেন্দ্রের ন্যাশনাল কো-অর্ডিনেটর ডাঃ নাযলা জামান খান, ড. শাহনাজ হুদা, পরিবেশ আন্দোলনকর্মী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের শিক্ষক আসিফ নজরুল, মানবাধিকারকর্মী জাকির হোসেন, সঙ্গীতশিল্পী অরূপ রাহী, লেখক শাহীন আক্তার ও অধিকারকর্মী ইলিরা দেওয়ান আদালতের ক্ষমা পান। এরপর ৩ মার্চ নিঃশর্ত ক্ষমা প্রার্থনা করে রেহাই পান বিবৃতিদাতা আরও ১০ জন। এরা হলেন- যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেইট ইউনিভার্সিটির রাজনীতি ও সরকার বিভাগের শিক্ষক ড. আলী রিয়াজ, ড. পারভিন হাসান, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজীর ফিরদৌস আজিম, প্রকাশক মহিউদ্দিন আহমেদ, মানবাধিকার আইনজীবী ড. ফস্টিনা পেরেইরা, আইন ও সালিশ কেন্দ্রের পরিচালক নূর খান লিটন, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. সামিয়া হক, ড. সেঁউতি সবুর, তাসমিন সারা সাহাবুদ্দীন ও লেখক তাহমিমা আনাম। বিবৃতিতে স্বাক্ষরকারী দিনা এম সিদ্দিকী ও অধিকারকর্মী রেজাউর রহমানও পরে নিঃশর্ত ক্ষমা চেয়ে রেহাই পান।
×