ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

ড. মহীউদ্দীন খান আলমগীর

বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তচুক্তি শেখ হাসিনার অবদান

প্রকাশিত: ০৩:৪২, ১০ জুন ২০১৫

বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তচুক্তি শেখ হাসিনার অবদান

১৯৪৭ সালে ভারত বিভাগের সময় মাঠ পর্যায়ে বাস্তবতার নিরিখ না করে কেবলমাত্র মানচিত্রভিত্তিক রেডক্লিফ রোয়েদাদ অনুযায়ী ভারত ও তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের সীমান্ত নির্ধারিত হয়েছিল। তদুপরি রেডক্লিফ তার রোয়েদাদে জলপাইগুড়ি জেলার বোদা থানা উল্লেখ করেননি। এই ভ্রান্তি থেকে উৎসারিত জলপাইগুড়ির বেরুবাড়ী ইউনিয়ন ১৯৫৮ সালের নেহেরু-নুন সমঝোতা অনুযায়ী বিভক্তিকরণের ব্যতিক্রম ছাড়া ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর মূলত রেডক্লিফ অঙ্কিত একই রেখা বাংলাদেশ ও ভারতের সীমানা নির্ধারক হিসেব গৃহীত হয়। এরূপ নির্ধারণ ও তা অনুসরণ প্রক্রিয়ায় আঙ্গুরপোতা ও দহগ্রাম ব্যতীত বাংলাদেশের সীমান্তের অভ্যন্তরে ১৭ হাজার ১শত ৬০ একর আয়তনের ১শত ১১টি ভারতীয় ছিটমহল স্থান পায় এবং বেরুবাড়ী ছাড়া বাংলাদেশের ৭ হাজার ১শত ১০ একর বিশিষ্ট ৫১টি ছিটমহল ভারতে থেকে যায়। বাংলাদেশের অভ্যন্তরে এসব ছিটমহল ৪টি জেলা যথা : পঞ্চগড়, লালমনিরহাট, কুড়িগ্রাম, নীলফামারীতে অবস্থিত। ভারতের অভ্যন্তরে বাংলাদেশের ৫১টি ছিটমহলের সবগুলো পশ্চিমবঙ্গের কুচবিহার জেলায় অবস্থিত। ব্রিটিশ আমলে কুচবিহারের মহারাজা ও রংপুরের নওয়াবের রাজ্য বা জমিদারীর ছড়ানো ছটানো বেশ কয়েকটি মহল বা অংশসমূহ রেডক্লিফ রোয়েদাদ অনুযায়ী অঙ্কিত সীমান্তরেখা ছাড়িয়ে কুচবিহারের মহারাজার মহল হিসেবে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে এবং রংপুরের নওয়াবের মহল হিসেবে কুচবিহারে থেকে যায়। কথিত আছে যে কুচবিহারের মহরাজারা ও রংপুরের নওয়াবগণ তিস্তা নদীর তীরে পাশা বা দাবা খেলায় হেরে-জিতে তাদের রাজ্য বা জমিদারীর মহল বা অংশবিশেষ একে অন্যকে সেখানে বসবাসরত জনগণসহ দিয়ে এসব ছিটমহলের জন্ম দেন। এসব ছিটমহল ছাড়াও রেডক্লিফ রোয়েদাদের অপূর্ণাঙ্গতার কারণে ভারতের আন্তর্জাতিক সীমানা রেখা ছাড়িয়ে বাংলাদেশী নাগরিকদের পশ্চিমবঙ্গে ২৩৯৮ একর, মেঘালয়ে ২৪০.৫ একর এবং ত্রিপুরায় ১৩৮.৪ একর সর্বমোট ২৭৭৭ একর জমি ভারতের ভেতরে অবস্থিত। এসব জমির আনুষ্ঠানিক বা আইনী মালিকানা বাংলাদেশীদের। এসব জমি ভারতের অপদখলীয় জমি হিসেবে আখ্যায়িত। তেমনি বাংলাদেশের সীমান্ত রেখার অভ্যন্তরে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের নাগরিকদের আনুষ্ঠানিক মালিকানার আওতায় ১৯৫৭.৫ একর এবং অসমস্থিত ভারতীয় নাগরিকদের ২৬৮ একর সব মিলিয়ে ২২৬৮ একর জমি বাংলাদেশের তথাকথিত অপদখলে থেকে যায়। ১৯৭৪ সালের ১৬ মে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে মূলত রেডক্লিফ রোয়েদাদের ভ্রান্তি ও অসংগতিসমূহ দূর করার লক্ষ্যে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সাথে ঐতিহাসিক সীমান্তচুক্তি সই করেন। এই চুক্তিতে বাংলাদেশ ও ভারতের সীমান্তের তখনও অচিহ্নিত সীমান্ত রেখা চিহ্নিতকরণ ও এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিটমহল ও অপদখলাধীন জমির বিনিময় বিষয়ক বিরোধ সত্বর নিষ্পত্তির জন্য বিস্তারিত ও অনুপুঙ্খভাবে অনুসরণীয় পদক্ষেপমালা উল্লেখিত হয়। এই চুক্তি অনুযায়ী বাংলাদেশে অবস্থিত ভারতীয় ছিটমহল এবং ভারতে অবস্থিত বাংলাদেশী ছিটমহল বিনিময় করার লক্ষ্য নির্ধারিত হয় (অনুচ্ছেদ-১ ধারা-১২)। এই সাধারণ সূত্রের প্রান্তিক ব্যতিক্রম হিসেবে উভয় পক্ষ সম্মত হয় যে, বাংলাদেশের মধ্যে অবস্থিত দক্ষিণ বেরুবাড়ী ইউনিয়নের ২.৬৪ বর্গমাইল বিশিষ্ট দক্ষিণাংশ ভারতে থাকবে এবং এর বিনিময়ে বাংলাদেশ ভারতীয় সীমান্তের ভেতরে অবস্থিত আঙ্গুরপোতা ও দহগ্রাম ছিটমহল রাখবে। দহগ্রাম ও আঙ্গুরপোতা ছিটমহলে বাংলাদেশ থেকে ভারতীয় ভূমির মধ্যে দিয়ে যাতায়াত ও যোগাযোগের জন্য ভারত তিন বিঘা ভারতীয় ভূমি বাংলাদেশকে চিরস্থায়ীভাবে ইজারা দেবে (অনুচ্ছেদ ১, ধারা ১৪)। এর বাইরে এই চুক্তি হিলি এলাকার সীমান্ত রেখা রেডক্লিফ অঙ্কিত মানচিত্র (অনুচ্ছেদ-১৩) এবং লাঠি-টিলা ও ডামবাড়ী এলাকার সীমান্তরেখা কেন্দ্রিক মতপার্থক্য সংশ্লিষ্ট মৌজার ম্যাপ ও সীমান্তফলক অনুযায়ী নির্ধারিত হবে বলে বিধান দেয়। ১৯৭৫ সালের ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে এই চুক্তি অনুযায়ী সকল পদক্ষেপ নিয়ে সীমান্ত এলাকার সম্মত স্ট্রিপ মানচিত্র দুই দেশের মধ্যে সইয়ের পর অনধিক ৬ মাসের মধ্যে এলাকা ভিত্তিক সরকারী কর্তৃত্ব হস্তান্তর করা হবে বলে বলা হয় (অনুচ্ছেদ-২)। এ ক্ষেত্রে দু’দেশের মতপার্থক্য মূলত সংশ্লিষ্ট মৌজা ম্যাপ ও সীমান্ত ফলক অনুযায়ী নিধারিত হবে বলে বলা হয়। ১৯৭৪ সালের এই ঐতিহাসিক চুক্তি অনুযায়ী বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে বিদ্যমান সীমান্ত নির্ধারণ বিষয়ক মতপার্থক্য ১৯৭০-এর দশকেই দূর হয়ে যাওয়ার কথা। দুই দেশের অন্তর্ভুক্ত এলাকা বা ভূমি একে অন্যের কাছে হস্তান্তরের জন্য দুই দেশের সংবিধান যা রাষ্ট্রভুক্ত এলাকা হিসেবে সংজ্ঞায়িত করেছিল তা সংশোধনের প্রয়োজন হয়। চুক্তি বাস্তবায়ন করার লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে ১৯৭৪ সালের ২৮শে নবেম্বর বাংলাদেশের সংসদে সংবিধানের ৩য় সংশোধনী গৃহীত হয়ে মুজিব-ইন্দিরা চুক্তি অনুযায়ী বাংলাদেশের এলাকা অন্তর্ভুক্তি ও বহির্ভূতকরণের সক্ষমতা সরকারকে দেয় (বাংলাদেশের সংবিধানের অনুচ্ছেদ-২)। এর ফলে বাংলাদেশ তখন তার অন্তর্ভুক্ত দক্ষিণ বেরুবাড়ী ও সংলগ্ন ছিটমহল ভারতকে হস্তান্তর করতে সক্ষম হয়। পক্ষান্তরে ভারতের বাংলাদেশকে হস্তান্তর করণীয় এলাকা হস্তান্তরকরণের জন্য প্রয়োজনীয় সাংবিধানিক সংশোধন (ভারতীয় সংবিধানের প্রথম তফসিল) করতে সক্ষম না হওয়ায় সীমান্ত নির্ধারণ সংক্রান্ত প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ বিশেষত ছিটমহল হস্তান্তর বিষয়ক কার্যক্রম গ্রহণ করতে ২০১৫-এর ৭ মে পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুর নির্মম হত্যা এবং এর পরবর্তী সরকারসমূহের গোষ্ঠীগত স্বার্থ উদ্ধারের অপচেষ্টা ১৯৭৪ সালের ঐতিহাসিক মুজিব-ইন্দিরা চুক্তি বাস্তবায়ন বাধাগ্রস্ত করে। ১৯৭৫ পরবর্তী স্বৈরশাসক ও তার উত্তরাধিকারীরা ১৯৯৬ পর্যন্ত ক্ষমতায় থেকে তাদের ভারতবিরোধী প্রচারণায় ১৯৭৪ সালের ঐতিহাসিক মুজিব-ইন্দিরা চুক্তিকে গোলামীর চুক্তি হিসেবে আখ্যায়িত করতে থাকে। ফলত মুখ্যত ৩টি ইস্যু, যথা (১) ৬.০ কি.মি. দীর্ঘ দইখাতা (পশ্চিম বাংলার সীমান্তের সাথে) মুহরি নদী ও বিলোনিয়া (ত্রিপুরার সীমান্তের সাথে) এবং লাঠি-টিলা ও ডামবাড়ী (অসমের সীমান্তের সাথে) সংলগ্ন সীমান্তরেখা নির্ধারণ, (২) ছিটমহল বিনিময় এবং (৩) অপদখল সামঞ্জস্যকরণ অসম্পূর্ণ ও অমীমাংসিত থাকে। এর ফলে সীমান্ত এলাকায় সময়ান্তরিক গোলযোগের সৃষ্টি হয়, ছিটমহলসমূহে কোন দেশই কোন উন্নয়ন বা জনকল্যাণমূলক কার্যক্রম গ্রহণ করতে সক্ষম হয় না। সবচেয়ে প্রাণান্তকর অবস্থার সৃষ্টি হয় ভারতীয় ছিটমহল জহলা খাগড়াবাড়ী ও বাংলাদেশী ছিটমহল উড়নচৌকি ভজনীতে। এই দুই ছিটমহল ভিন্নতর দেশের দুই পর্যায়ে একাধিক বেড়িতে অন্তর্ভুক্ত ছিল। ২০১১ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রচেষ্টার ফল হিসেবে এসব মীমাংসার জন্য বাংলাদেশ ও ভারতের সংশ্লিষ্ট আধিকারিক পর্যায়ের প্রতিনিধি সমন্বয়ে যৌথ সীমান্তরেখা কর্ম দল গঠন করা হয়। এই যৌথ দল পরবর্তী সময়ে ১০বার মিলিত হয়ে ১৯৭৪ সালের ঐতিহাসিক চুক্তি অনুযায়ী পারস্পরিক মতভিন্নতা দূর করতে সচেষ্ট হন। এর আগে ১৯৯৭ সালের এপ্রিলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশ ও সমর্থন অনুযায়ী বাংলাদেশ ও ভারত দুই দেশে বিদ্যমান অন্য দেশের ছিটমহলগুলোর জরিপ, নকশা প্রণয়ন ও মতভিন্নতা দূরীকরণ করে এসবের তালিকা ও তথ্য একে অন্যের কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে হস্তান্তর করে। এই তালিকা ও তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশের সীমান্তের ভেতর ১৭১৬০.৬৩ একর ভূমি সম্বলিত ভারতের ১১১টি ছিটমহল এবং ভারতের সীমান্তের ভিতর ৭১১০.০২ একর ভূমি সম্বলিত বাংলাদেশের ৫১টি ছিটমহল নিরূপিত হয়। ২০০১ সালে অসমের বরুইবাড়ী এলাকায় বাংলাদেশের তৎকালীন সীমান্ত রক্ষীদের দ্বারা ভারতের ১৬ জন সীমান্ত রক্ষী নিহত হওয়ার পরও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই লক্ষ্যে ভারতের কাছে দাবি উত্থাপন কিংবা দাবি আদায়ের প্রচেষ্টায় দৃঢ়সংকল্পবদ্ধ থাকেন। পরে ২০১১ সালের জুলাই মাসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অনুরোধ ও দাবি অনুযায়ী দুই দেশ যৌথভাবে শুমারি করে বাংলাদেশের ভিতরে ভারতীয় ছিটমহলে ৩৭৩৩৪ এবং ভারতের ভিতরে বাংলাদেশের ছিটমহলে ১৪২১৫ জন বসতি গেড়ে আছেন বলে জেনে নেয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১০-এর জানুয়ারিতে ভারত সফরকালে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিংয়ের কাছে ১৯৭৪ সালের সীমান্ত চুক্তি অনুযায়ী বিদ্যমান সীমান্তবিরোধ মেটানোর অখ-নীয় যৌক্তিকতা ও জোর দাবি তোলেন। এর ফলে ২০১১ সালের ৬ সেপ্টেম্বর ঢাকায় ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিংয়ের ফিরতি সফরের সময় বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক তৎপরতার ফল হিসেবে দুই দেশের প্রধানমন্ত্রীর উপস্থিতিতে সংশ্লিষ্ট পররাষ্ট্রমন্ত্রীদ্বয় ১৯৭৪ সালের চুক্তির অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে একটি প্রটোকল সই করেন। ১৯৭৪ সালের মুজিব-ইন্দিরা চুক্তি অনুসরণ করে তার অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে সইকৃত ২০১১ সালের এই প্রটোকল অনুযায়ী : (১) দুই দেশের মধ্যে ৬.৫ কিলোমিটার দীর্ঘ তখন পর্যন্ত অচিহ্নিত সীমান্ত রেখা ইতোপূর্বকার দুই দেশের জরিপ ও যৌথ কর্মদলের সুপারিশ অনুযায়ী সুস্পষ্টভাবে চিহ্নিত হবে, এই ৬.৫ কি.মি. মধ্যে ৩ কি.মি. অসমের, ১.৫ কি.মি. পশ্চিমবঙ্গের এবং ২ কি.মি. ত্রিপুরার সঙ্গে বাংলাদেশের সীমান্তরেখা বরাবর। (২) বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ভারতের ১৭১৬০.৬৩ একর ভূমি সম্বলিত ১১১টি ছিটমহল বাংলাদেশের অন্তর্ভুক্ত হবে । এই সূত্র অনুযায়ী ভারতের অভ্যন্তরে অবস্থিত ৭১১০ একর ভূমি সম্বলিত বাংলাদেশের ৫১টি ছিটমহল ভারতভুক্ত হবে; (৩) দুই দেশের অভ্যন্তরে এসব ছিটমহলের অধিবাসীরা যে দেশে ছিটমহল অন্তর্ভুক্ত হবে তাদের ইচ্ছামতো সেদেশের নাগরিক হতে পারবেন। এই প্রক্রিয়ায় ৩৭৩৩৪ জন বাংলাদেশের নাগরিক এবং ১৪৩১৫ জন ভারতের নাগরিক হতে পারবেন। (৪) এসব ছিটমহল এয়াজবদলের জন্য কোন দেশ অন্য দেশে থেকে ক্ষতিপূরণ পাবে না। (৫) বাংলাদেশ ও ভারতের অভ্যন্তরে অপদখলীয় জমি সংশ্লিষ্ট দেশের জমি হিসেবে গণ্য হবে । ১৯৭৪ সালের মুজিব-ইন্দিরা চুক্তি অনুযায়ী অপদখলীয় জমি বিনিময় করণীয় ছিল। এ চুক্তি ভারতীয় সংবিধান সংশোধন ও অনুসমর্থন করে ভারতীয় রাজ্যসভা ও লোকসভা যথাক্রমে গত ৬ ও ৭ মে। ৭ জুন নরেন্দ্র মোদির ঢাকা সফরকালে এই অনুসর্মথন অনুযায়ী ২০১১ সালের প্রটোকল ১৯৭৪ সালের মুজিব-ইন্দিরা চুক্তি অনুসরণ ও বাস্তবায়নের জন্য দুই দেশ একে অন্যের কাছে সংশ্লিষ্ট দলিলাদি হস্তান্তর করে । ফলত ঐ প্রটোকল বাস্তবায়নের কাজ দুই প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ অনুযায়ী ৭জুন ২০১৫ থেকে শুরু হয় । ১৯৭৪ সালে ১৬ মে সইকৃত মুজিব-ইন্দিরা সীমান্তচুক্তি হতে শুরু করে ২০১৫ সালের ৭ জুন ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর ঢাকা সফরের ঐ সময় চুক্তির অংশ হিসেবে ২০১১ সালের ৬ সেপ্টেম্বরের প্রটোকল অনুসর্মথন ও বাস্তবায়নের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা পর্যন্ত ঘটনাবলী পর্যালোচনা করলে কয়েকটি বিষয় সুস্পষ্ট হয়ে দেখা দেয় : (১) ১৯৭৪ সালে সীমান্ত চুক্তি প্রণয়নে বঙ্গবন্ধু অসাধারণ দূরদৃষ্টি ও দেশের স্বার্থ সংরক্ষণে দৃঢ় সংকল্পবোধ দেখিয়েছিলেন। বস্তুত পরবর্তীকালে বাংলাদেশ ও ভারত সীমান্ত চিহ্নিতকরণ এবং এর সাথে সম্পর্কিত সকল সমস্যা আলোচনার ভিত্তিতে বস্তুনিষ্ঠভাবে সমাধান করার ভিত্তি তিনি জাতিকে উপহার দিয়ে গিয়েছিলেন। এর পরে এই ক্ষেত্রে ও বিষয়ে যত পদক্ষেপ দুই দেশ নিয়েছে, তার সকল কিছু ১৯৭৪ সালের ঐ চুক্তিতে গৃহীত সূত্রাদি অনুসরণ করেই নেয়া হয়েছে। (২) ১৯৭৪ সালের মুজিব-ইন্দিরা চুক্তি অনুযায়ী সীমান্ত নির্ধারণ ও এ সম্পর্কিত স্বার্থ সংরক্ষণের জন্য বাংলাদেশ সরকার ১৯৭৫ সাল থেকে শুরু করে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি। গোষ্ঠীগত স্বার্থরক্ষাকরণে তারা এ সময় যত মনোযোগী ছিল, তত মনোযোগ সীমান্ত চিহ্নিতকরণ ও সীমান্ত সমস্যাদি সমাধানকরণ বা সার্বিকভাবে দেশের স্বার্থ সংরক্ষণ ও প্রসারণে প্রযুক্ত করেনি। প্রথম মহাযুদ্ধের পর থেকে শুরু করে এখন পর্যন্ত ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় যে কোন দেশেই স্বৈরতান্ত্রিকতা বন্ধুত্বপূর্ণ দ্বিপাক্ষিক আলোচনার মাধ্যমে সীমান্ত সংক্রান্ত বিরোধ মেটাতে সক্ষম হয়নি। বাংলাদেশ ও ভারতের ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। স্বৈরতন্ত্র ও তাদের উত্তরাধিকারী থাকাকালীন সময়ে বাংলাদেশ ভারতের কাছে সীমান্ত সমস্যা সমাধানে কোন কার্যকর পদক্ষেপ নিতে পারেনি । ১৯৭৪ সালের মুজিব-ইন্দিরা চুক্তি এবং ২০১১ সালের প্রটোকল গণতান্ত্রিকতার ভিত্তিতেই আলোচিত ও সম্পাদিত হয়েছে। (৩) বঙ্গবন্ধুর কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা তার প্রথম প্রধানমন্ত্রিত্বকালে ১৯৯৬ সাল থেকে ২০০১ এবং তারপরে দ্বিতীয় প্রধানমন্ত্রিত্বকালে ২০০৯ থেকে এখন পর্যন্ত নিরবচ্ছিন্নভাবে সীমান্তরেখা ও সংশ্লিষ্ট রেখা নিরসনে প্রচেষ্টা চালিয়েছেন। তার এই প্রচেষ্টা তার পিতার মতোই প্রশাসনিক দক্ষতা, দৃঢ়-সংকল্পবোধ, নিরবচ্ছিন্ন তৎপরতা এবং দেশ ও জনগণের প্রতি প্রশ্নাতীত আনুগত্যের পরিচয় জাতীয় ও আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক মোজাইকে প্রস্ফুটিত করেছে। ২০১১ সালের সেপ্টেম্বরে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিংয়ের ঢাকা সফরকালে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার কাছ থেকে বাংলাদেশের ছিটমহল আঙ্গুরপোতা ও দহগ্রামের সঙ্গে তিনবিঘা করিডর দিয়ে ২৪ ঘণ্টা যোগাযোগ উন্মুক্তকরণে দাবি জানিয়ে ছিলেন। ড. সিং এই দাবি গ্রহণ করার পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ১৯ অক্টোবর ২০১১ সালে নিজে দহগ্রাম ও আঙ্গুরপোতা যেয়ে এই যোগাযোগের অধিকার বাংলাদেশের অনুকূলে প্রসারিত এবং সমুন্নত করেন। (৪) প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে বিরোধ ও মতভিন্নতা দূরীকরণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পারস্পরিক আলোচনা ও নিরবচ্ছিন্ন প্রচেষ্টার ফলদায়কতা প্রমাণিত করেছেন । এর আগে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে তৃতীয় পক্ষের মধ্যস্থতা ছাড়াও গঙ্গার পানি বিভাজন, চট্টগ্রামের শান্তি স্থাপন ও বঙ্গোপসাগরে দুই দেশের কর্তৃত্বের সীমানা নির্ধারণ বিষয়ে বাংলাদেশ সফল হয়েছে। শেখ হাসিনা এই প্রেক্ষিতে ২৯ মে ২০১৫ এ ঢাকায় ভারতের সঙ্গে সীমান্ত বিরোধ সফলতার সঙ্গে মিটানোর জন্য তার সম্মানে আয়োজিত নাগরিক সংবর্ধনায় বলেছেন যে কোন দেশের মাঝে সমস্যা আলোচনা ও সুসম্পর্কের মাধ্যমেই যে সমাধান করা যায় তিনি তা প্রমাণ করেছেন। ভারত পাকিস্তানের সীমান্তে, পূর্ব-ইউরোপের কতিপয় রাষ্ট্রের ক্ষেত্রে এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াসংলগ্ন প্রশান্ত মহাসাগরীয় এলাকার কতিপয় দ্বীপসদৃশ রাষ্ট্রের ক্ষেত্রে সীমান্ত এবং এর সাথে সং্িশ্লষ্ট ছিটমহল কেন্দ্রিক বিরোধ এখনও নিষ্পত্তি হয়নি। ভারতের অরুণাচল রাজ্যের লাগোয়া বা অন্তর্ভুক্ত এক এলাকা নিয়ে এরূপ বিরোধ চীনের সঙ্গে এখনও বিদ্যমান আছে বলে জানা গেছে। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ও ভারতের সহযোগিতামূলক নিষ্পত্তি সেসব দেশের কাছে অনুসরণীয় দৃষ্টান্ত হিসেবে বিবেচিত হবে। এই প্রেক্ষিতে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অনুসৃত কূটনৈতিক কৌশল, রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও নিরবচ্ছিন্ন প্রচেষ্টা ইতিহাস হয়ে থাকবে। এই প্রেক্ষিতে ঐ নাগরিক সংবর্ধনায় কৃতজ্ঞ দেশবাসীর তরফ থেকে বলা হয়েছে যে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশকে তার কৃতকর্ম ও অবদানের বলে বিশ্বে মাথা উঁচু করে দাঁড় করিয়েছেন। দেশরতœ হিসেবে নিজকে সমুজ্জ¦ল করেছেন। (৫) বাংলাদেশ ও ভারতের সীমান্ত ও ছিটমহল সম্পর্কিত বিরোধ নিষ্পত্তির পরও সীমান্ত এলাকার অপরাধ ও চোরাচালান বন্ধকরণ, যোগাযোগ, বাণিজ্য অবকাঠামো উন্নয়ন, নদী অববাহিকতায় অবকাঠামো সৃষ্টি, উভয় দেশে যৌথ উদ্যোগে শিল্প স্থাপন ইত্যাদি সকল দ্বিপাক্ষিক ক্ষেত্রে পারস্পরিক সহযোগিতা বৃদ্ধি পাবে। সংহতি, পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ ও সাধারণভাবে জনগণের প্রতি মমত্ব¡বোধে উজ্জীবিত হয়ে এই উপমহাদেশে এই দুই প্রধান রাষ্ট্র সার্বিক প্রগতি ও সংস্কৃতির ধারক ও বাহক হিসেবে পৃথিবীতে স্থান করে নিতে পারবে এবং এর সফলতা হবে জননেত্রী দেশরতœ শেখ হাসিনার দৃঢ়, নিরবচ্ছিন্ন ও জনস্বার্থিক প্রচেষ্টার ফসল এবং এই প্রেক্ষিতেই ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ৭ জুন ঢাকা ছেড়ে যাওয়ার আগে বলেছেন, শেখ হাসিনা ও তার ধ্যান ও স্বপ্ন এক-উন্নয়ন ও দারিদ্র্য বিমোচন এবং এই উদ্দেশ্যে তারা একযোগে কাজ করবেন। (ইত্তেফাক -৮ জুন, ২০১৫) বাংলাদেশ ও ভারতকে একই পথে এই লক্ষ্য নিয়ে এসেছেন দেশরত্ব প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এই উপমহাদেশের উন্নয়ন সংকল্পায়নে ও বাস্তবায়নে এই হলো তার শ্রেষ্ঠ অবদান।
×