ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

ভারতে ম্যাগি নুডুলস নিষিদ্ধ

বাংলাদেশে বিএসটিআইয়ের সার্টিফিকেট নিয়ে প্রশ্ন

প্রকাশিত: ০৪:৫৮, ৭ জুন ২০১৫

বাংলাদেশে বিএসটিআইয়ের সার্টিফিকেট নিয়ে প্রশ্ন

অর্থনৈতিক রিপোর্টার ॥ প্রতিবেশী দেশ ভারতে ম্যাগি নুডুলস নিষিদ্ধ হলেও বাংলাদেশে ম্যাগি উৎপাদনকারী নেসলের হয়ে ‘ভালোত্বের’ সার্টিফিকেট দিয়ে দিয়েছে বিএসটিআই। প্রশ্ন উঠেছে তড়িঘড়ি করে দেয়া এ সনদের ফলে নির্বিঘœ থাকতে পারে কি বাংলাদেশের ক্রেতারা? ক্রেতারা বলছেন, পণ্যের মান নিয়ন্ত্রণকারী সরকারী প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ড এ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউটের (বিএসটিআই) পরীক্ষার মান বরাবরই প্রশ্নবিদ্ধ। আর খাবারটি যেহেতু শিশুদের কাছে অত্যন্ত প্রিয় তাই দাবি উঠেছে আরও পরীক্ষা-নিরীক্ষার। বরং বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ভারতের বাজারে বিক্রিত নুডলসের চেয়ে ?বাংলাদেশের বাজারে বিক্রিত নুডলসে ক্ষতিকর সোডিয়াম ও স্যাচুরেটেড ফ্যাটের মাত্রা অনেক বেশি। ভারতের বাজারের বিক্রিত নুডলসে এই সোডিয়ামেই পাওয়া গেছে মোনো সোডিয়াম গ্লটামেট (এমএসজি), যা ক্ষতিকর মাত্রার সীসার উৎস বলে নির্দিষ্ট করা হয়েছে। প্রশ্ন উঠেছে, ম্যাগি নুডলস বাংলাদেশে যে উপাদানে তৈরি তা কি ভারতের চেয়ে আলাদা? নেসলে কি দুই দেশে দুই ধরনের ও ভিন্নমাত্রার উপাদানে নুডলস তৈরি করে? যদি সেটা করে থাকে তাও যেমন মেনে নেয়ার মতো নয়, তেমনি যদি না করে থাকে তাহলে ভারতের নুডলসে অতিরিক্ত মাত্রার সীসা মিললে বাংলাদেশের নুডলসেও একই মাত্রা থাকতে পারে বলেই সন্দেহ করা যায়। অথচ পণ্যের মান নিয়ন্ত্রণকারী সরকারী প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ড এ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউট (বিএসটিআই) গত মঙ্গলবার নিজেই সাংবাদিকদের ডেকে জানিয়েছে, ম্যাগি নুডলসে ক্ষতিকারক কোন উপাদান পাওয়া যায়নি। প্রতিষ্ঠানটির সার্টিফিকেশন মার্কস বিভাগ সরাসরি বলে দিয়েছে, পরীক্ষা করে ক্ষতিকারক মাত্রায় কোন উপাদান পাওয়া যায়নি। বাংলাদেশে ম্যাগির প্রস্তুত ও বিপণনকারী আন্তর্জাতিক কোম্পানি নেসলেও তাদের নুডলসে যে ক্ষতিকারক মাত্রায় সীসা নেই সে দাবি করে আসছে। একই দাবি তারা করছে ভারতেও। অথচ ভারত সরকার সে দাবি প্রত্যাখ্যান করেছে। দেশটির সেনাবাহিনীর জন্য ম্যাগি নুডলসকে নিষিদ্ধ খাবার হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। সাধারণ বাজারেও ম্যাগির ওপরে এসেছে নিষেধাজ্ঞা। তাহলে ভারতের বাজারে নিষিদ্ধ হলে বাংলাদেশের বিএসটিআই কিভাবে আগ বাড়িয়ে বলে যে, বাংলাদেশে ম্যাগি নুডুলসে ক্ষতিকারক মাত্রায় কোন উপাদান নেই। দুই দেশে বিক্রিত ম্যাগি নুডলসের প্যাকেট বিশ্লেষণ করেও দেখা যায়, ভারতের বাজারের প্যাকেটে এর গুণাগুণ যেভাবে বর্ণিত একইভাবে বাংলাদেশেও। কারণ বহুজাতিক এই প্রতিষ্ঠানটি ভারত ও বাংলাদেশের বাজারের জন্য একই পণ্য তৈরি করছে। পার্থক্য শুধু ভারতের প্যাকেটের ‘মেরি মাসালা ম্যাগি’ বাংলাদেশে হয়ে গেছে ‘আমার মাসালা ম্যাগি’। আর দুই মিনিটের ইনস্ট্যান্ট নুডলস সে কথাতো রয়েছেই। একই ভিটামিন এ, আয়রন, প্রোটিন আর আয়োডিনের কথা উল্লেখ রয়েছে খাদ্যগুণের কাছে। পার্থক্য যে কিছু নেই তা নয়। ভারতের একেকটি ছোট ইনস্ট্যান্ট মাসালা নুডলস প্যাকের ওজন ৯৫ গ্রাম যার দাম ১২.৫০ রুপী। বাংলাদেশে প্রতি প্যাকেটের দাম ১৭ টাকা রয়েছে ৬২ গ্রাম। ভারতের সঙ্গে মুদ্রা দরের হেরফেরে ঢাকায় এই পণ্যের দাম হতে পারত ১০ টাকা ০৮ পয়সা, যা খুচরা বাজারে বিক্রি হচ্ছে ১৭ টাকা দরে। সেসব প্রশ্ন এড়িয়ে গেলেও কিছু কিছু উপাদান দেখা গেছে, ভারতের ম্যাগির তুলনায় বাংলাদেশের ম্যাগিতে অনেক বেশি। এসব উপদান ক্ষতিকর হিসেবেই বিবেচিত। ভারতের একটি ৯৫ গ্রাম নুডলস প্যাকের সঙ্গে ?বাংলাদেশে উৎপাদিত ৬২ গ্রাম প্যাকের পার্থক্যগুলোও বিশ্লেষণ করেও দেখা যায়, গড়ে প্রায় প্রতিটি উপদানই বাংলাদেশে বেশি ব্যবহৃত হচ্ছে। ভারতে যেখানে ৯৫ গ্রামের প্যাকেটে চর্বি ব্যবহৃত হয় ১৪ গ্রাম সেখানে বাংলাদেশে ৬২ গ্রামের প্যাকেটে চর্বি থাকে ১০.৪ গ্রাম। তুলনামূলক হিসেবে যা ১.৩০ গ্রাম বেশি। এর মধ্যে ক্ষতিকর স্যাচুরেটেড ফ্যাট ভারতের ৯৫ গ্রামের প্যাকেটে রয়েছে ৬ গ্রাম সেখানে বাংলাদেশের ৬২ গ্রামের প্যাকেটে রয়েছে ৪ গ্রাম। তুলনামূলক হিসেবে বাংলাদেশের প্রতি প্যাকেটে ক্ষতিকর এই ফ্যাট প্রায় ১ (প্রকৃত দমমিক ৯) গ্রাম করে বেশি রয়েছে। সোডিয়াম প্রসঙ্গেও একই অবস্থা দেখা যায়। ভারতের ৯৫ গ্রামের নুডলস প্যাকে সোডিয়ামের মাত্রা ১১৩০ মিলিগ্রাম। বাংলাদেশের ৬২ গ্রামের প্যাকেটে ৭৬৮.৮ মিলিগ্রাম। এই মাপের ভারতীয় নুডলসের চেয়ে ৩১.৪ মিলিগ্রাম বেশি সোডিয়াম রয়েছে বাংলাদেশে। ভারতের নুডলসে এই সোডিয়ামেই মিলেছে মাত্রাতিরিক্ত সীসা। ভারত যেখানে পুরো বিষয়টি নিয়ে সতর্ক ও কঠোর প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে অগ্রসর হয়েছে, তখন বাংলাদেশে ‘ম্যাগি’র বিষয়টি কম গুরুত্ব পেয়েছে। যদিও নিষেধাজ্ঞার বেড়াজালে শেষপর্যন্ত বহস্পতিবার রাতে টু মিনিটস নুডলস তুলে নেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে তারা। প্রোডাক্ট তুলে নিলেও ম্যাগিকে সম্পূর্ণ নিরাপদ বলে দাবি করেছে নেসলে ইন্ডিয়া। বিতর্কের শুরু হয়েছিল উত্তরপ্রদেশে। পরীক্ষায় ম্যাগিতে মিলেছিল মাত্রতিরিক্ত সীসা, মনোসোডিয়াগ্লুটামেট। তারপরই দেশজুড়ে শুরু হয় বিতর্ক। পরীক্ষার পর একের পর এক রাজ্যে নিষিদ্ধ হয় ম্যাগি। বিতর্কের মুখে পরে শুক্রবার শেষমেশ বাজার থেকে সাময়িকভাবে তদের জনপ্রিয় প্রোডাক্ট ম্যাগি তুলে নেয়ার সিদ্ধান্ত নেয় ম্যাগি। শুধু ম্যাগি-ই নয়, ম্যাগি নিয়ে বিজ্ঞাপন করার ভারতের তিন সেরা সেলিব্রেটিও বিপাকে পড়েছেন। এই তিন সেরা তারকা হলেন অমিতাভ বচ্চন, মাধুরী দিক্ষিত ও প্রীতি জিনতা। তাদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনে গ্রেফতার নির্দেশ জারি করেছেন আদালত। অবশ্য বিগবি খ্যাত অমিতাভ বচ্চন বলে দিয়েছেন, নোটিস পেলে আইনী প্রক্রিয়ায় সহযোগিতা করবেন। তিনি নিজে ম্যাগি নুসলসের বিজ্ঞাপন বন্ধ করে দিয়েছেন বলেও জানান। ভারতের নুডলসে পাওয়া গেছে মোনো সোডিয়াম গ্লুটামেট। এটি গ্লুটামেটিক এসিডমিশ্রিত সোডিয়াম লবণ, যা সীসার অন্যতম উৎস। তৈরি খাবারে স্বাদ আর গন্ধ যুক্ত করতেই এই সোডিয়াম লবণের ব্যবহার। ম্যাগি নুডলস তেমনই একটি খাবার। সোডিয়ামের ব্যবহার বেশি হলে এই এ্যাসিডের মাত্রা বেশি থাকার সম্ভাবনাই প্রকট। আর হিসাবে দেখা গেছে, বাংলাদেশের ম্যাগি নুডলসে সোডিয়ামের ব্যবহারের মাত্রা ভারতের ম্যাগির চেয়েও বেশি। এ অবস্থায় বাংলাদেশে বিএসটিআই খুব দ্রুত তার পরীক্ষা সম্পন্ন করে সংবাদ সম্মেলন করে যে ঘোষণা দিয়ে দিয়েছে তাতে নেসলেরই প্রভাব রয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। অনেকেই বিএসটিআইয়ের পরীক্ষণ পদ্ধতি নিয়েও কথা তুলেছেন। কারও কারও মন্তব্য পণ্যের সঠিক মান নির্ধারণে বিএসটিআই সারাদেশে খুব কমই আস্থা অর্জন করতে পেরেছে। সে কারণে বিএসটিআইয়ের সার্টিফিকেটের খুব একটা মূল্য সাধারণ ক্রেতার কাছে নেই। আরও সতর্ক পরীক্ষা নিশ্চিত করা প্রয়োজন বলেই মনে করছে ক্রেতা সাধারণ। এর আগে অবশ্য বিবিসিকে বিএসটিআইয়ের মহাপরিচালক ইকরামুল হক বলেছিলেন, বাংলাদেশে ম্যাগি নুডলস তৈরি করে নেসলে বাংলাদেশ। আর যেহেতু নেসলে ইন্ডিয়ার তৈরি ম্যাগি নুডলসে সীসা পাওয়া গেছে তাই ওই খবরে তারা ততটা উদ্বিগ্ন নন। তবে সতর্কতা হিসেবে ম্যাগি নুডলসসহ বেশ কয়েক প্রকারের নুডলস বাজার থেকে নিয়ে পরীক্ষা করা শুরু করেছে বিএসটিআই। তারা পণ্যের বিষয়ে জানতে নেসলের সঙ্গেও যোগাযোগ করেছেন এবং নেসলেও বলেছে তাদের পণ্যে তিকারক কিছু নেই। কিন্তু ম্যাগি নুডলস পরীক্ষা করেই পণ্যে তিকারক উপাদান আছে কি নেই সে বিষয়ে নিশ্চিত হবেন বলে জানিয়েছেন বিএসটিআই মহাপরিচালক ইকরামুল হক।
×