ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

ট্রান্স এশিয়ান রেলওয়ের সঙ্গে সংযুক্তি পাঁচ বছরেও অনিশ্চিত

প্রকাশিত: ০৬:০৬, ৫ জুন ২০১৫

ট্রান্স এশিয়ান রেলওয়ের সঙ্গে সংযুক্তি পাঁচ বছরেও অনিশ্চিত

মশিউর রহমান খান ॥ ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনের ৫ বছর পেরিয়ে গেলেও আজও শুরু করতে পারেনি চট্টগ্রামের দোহাজারী-কক্সবাজার-গুনদুম রেলপথের নির্মাণ কাজ। দীর্ঘবছরেও কাজ শুরু করতে না পারায় তথা ট্রান্স এশিয়ান রেলওয়ের সঙ্গে বাংলাদেশের রেল সংযোগ যুক্ত হওয়াটা অনেকটাই অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। ২০১১ সালের ৩ এপ্রিল এ রেলপথটি নির্মাণের জন্য ভিত্তিপ্রস্তর নির্মাণ করা হয়। রেলপথটি নির্মাণের বাস্তবায়নকাল ২০১৫ সালের জুনে শেষ করার কথা থাকলেও এখনও তার নির্মাণ কাজই শুরু করতে পারেনি রেলপথ মন্ত্রণালয়। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে চলতি বছর নয় আগামী ২০১৬ সালেও এর নির্মাণ কাজ শুরু করা সম্ভব হবে না। সম্প্রতি অবশ্য শোনা যাচ্ছে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) এ রেলপথটি নির্মাণে নতুন করে আশ্বাস দিয়েছে। সম্প্রতি বাংলাদেশ সফরে আসা এডিবির একটি দল এ আশ্বাস প্রদান করেছে। এরপরও বাংলাদেশের সঙ্গে বহির্বিশ্বের রেল সংযোগ স্থাপনে ও পর্যটকদের আকর্ষণ বাড়াতে অতি গুরুত্বপূর্ণ এ রেলপথটির নির্মাণ কাজ আগামী ২০১৭ সালের আগে শুরু করা সম্ভব হবে না। তবে এডিবির দীর্ঘদিনের অর্থায়নের আশ্বাস বাস্তবায়ন হবে কি-না তার অপেক্ষায় রয়েছে রেলপথ মন্ত্রণালয়। দোহাজারী থেকে কক্সবাজার হয়ে মিয়ানমারের সীমান্ত গুনদুম পর্যন্ত ১২৮ কিলোমিটার দীর্ঘ এ রেলপথটির নির্মাণ কাজ শুরু করাটা বর্তমানে রেলের অনেকটা গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে। কখনও সিঙ্গেল লাইন কখনও ডুয়েল গেজ লাইন নির্মাণের পরিকল্পনা করা হচ্ছে। বাস্তবে ভিত্তিপ্রস্তরের পর আজ পর্যন্ত পরিকল্পনাতেই সীমাবদ্ধ রয়ে গেছে। তাই চট্টগ্রামবাসী তথা কক্সবাজার জেলার নাগরিকদের আশার আলো জাগানিয়া রেলের এ প্রকল্প বর্তমানে নিভু নিভু প্রদীপের মতো টিম টিম করে জ্বলছে। কবে কাজ শুরু হবে বা আদৌ শুরু হবে কি-না তাও বলতে পারছেন না সংশ্লিষ্টরা। ফলে অনিশ্চয়তায় পড়েছে এ অতি গুরুত্বপূর্ণ রেলপথটির নির্মাণ কাজ। এডিবি সূত্র জানায়, কক্সবাজার দোহাজারী-গুনদুম রেলপথটি ডাবল লাইন নির্মাণের জন্য এডিবি অর্থায়ন করবে। বর্তমানে চট্টগ্রাম থেকে দোহাজারী পর্যন্ত ৪৬ কিলোমিটার রেললাইন আগে থেকে সিঙ্গেল লাইন রয়েছে। চট্টগ্রাম থেকে সরাসরি গুনদুম সীমান্ত পর্যন্ত রেলপথটি চালু করতে গেলে এ লাইনটিও ডাবল লাইন হিসেবে নির্মাণ করতে হবে। আর এ ৪৬ কিলোমিটার রেলপথও নির্মাণের জন্য আগ্রহ প্রকাশ করেছে এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক। অর্থাৎ মোট চট্টগ্রাম থেকে দোহাজারী হয়ে গুনদুম পর্যন্ত মোট ১৭৪ কিলোমিটার লাইন নির্মাণে আগ্রহ দেখিয়েছে। যাতে তারা অর্থায়ন করবে বলে জানা গেছে। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, দোহাজারী-কক্সবাজার-গুনদুম প্রকল্পের বাস্তবায়নকাল ২০১০ সালের জুলাই থেকে ২০১৩ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত ধরা হয়। পরে দুই দফা সময় বাড়িয়ে তা ২০১৫ সালের জুন পর্যন্ত করা হয়। তবে এখনও প্রকল্পের বাস্তব অগ্রগতি বলতে গেলে শূন্যের কোটায় রয়েছে। নতুন হিসাবে আগামী বছরও নয় অর্থাৎ ২০১৭ সালেও শুরু করতে পারলে তা ২০২০ সালের জুনে রেলপথটি নির্মাণ শেষ হতে পারে। তবে তাও নির্ভর করছে বিদেশী অর্থায়ন ও অনেকটা রেলপথ মন্ত্রণালয়ের আগ্রহের ওপর। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর রেলপথ মন্ত্রণালয় রেলের উন্নয়নে বিভিন্ন বৃহৎ প্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করলেও এ রেলপথটি নির্মাণ নিয়ে কোন কার্যকর উদ্যোগ চোখে পড়ছে না। ২০১০ সালের জুলাই মাসেই জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি (একনেক) প্রকল্পটি অনুমোদন করে। পরে ২০১১ সালের ৩ এপ্রিল এ রেলপথটি নির্মাণের জন্য ভিত্তিপ্রস্তর নির্মাণ করা হয়। কিন্তু নানা জটিলতায় আজও শুরু হয়নি এর নির্মাণ কাজ। সম্প্রতি রেলপথটি নির্মাণে পুনরায় সম্ভাব্যতা যাচাই করা হয়েছে। এতে প্রকল্পটির ব্যয় বেড়েছে প্রায় ১২ হাজার ২৫১ কোটি টাকা। ব্যয় বাড়লেও আজ পর্যন্ত প্রকল্পটি বাস্তবায়নে অর্থায়ন নিয়ে শঙ্কা কাটেনি। ২০১০ সালের ৬ জুলাই একনেকে অনুমোদনের সময় দোহাজারী-কক্সবাজার-গুনদুম মিটার গেজ রেলপথ সিঙ্গেল লাইন নির্মাণে ব্যয় ধরা হয় ১ হাজার ৮৫২ কোটি ৩৫ লাখ টাকা। পরবর্তীতে রেলপথটি ডুয়েল গেজে নির্মাণ করার সিদ্ধান্ত হয় যাতে নির্মাণ ব্যয় বাড়ছে ৬৬১ শতাংশ। এতে ব্যয় বেড়ে দাঁড়ায় ১৪ হাজার ১০৩ কোটি ৪৩ লাখ টাকা। তবে রেলপথটির নির্মাণ ব্যয় অস্বাভাবিক বলে মনে করছেন খাত সংশ্লিষ্টরা। তাদের মতে, এ রেলপথে কিলোমিটারপ্রতি ব্যয় পড়ছে ১১০ কোটি ১৮ লাখ টাকা। আর জমি অধিগ্রহণের ২ হাজার ৬০০ কোটি টাকা বাদ দিলে কিলোমিটারপ্রতি ব্যয় দাঁড়ায় ৮৯ কোটি ৮৭ লাখ টাকা। অথচ গত ডিসেম্বরে নেয়া আখাউড়া-লাকসাম রেলপথ নির্মাণে কিলোমিটারপ্রতি ব্যয় জমি অধিগ্রহণসহ হচ্ছে ৪৫ কোটি ১৭ লাখ টাকা। অর্থাৎ জমি অধিগ্রহণ ব্যয় বাদ দিলেও দোহাজারী-কক্সবাজার-গুনদুম রেলপথ প্রকল্পে ব্যয় প্রায় হচ্ছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, পরামর্শক প্রতিষ্ঠান দোহাজারী-কক্সবাজার-গুনদুম রেললাইন নির্মাণ প্রকল্পের দ্বিতীয় দফা সার্ভে জমা দিয়েছে। এর ভিত্তিতে প্রকল্পটির উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবনা (ডিপিপি) সংশোধন করা হয়েছে। এ সংক্রান্ত প্রতিবেদন পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানো হয়েছে। তবে প্রকল্প ব্যয়ের বিষয়ে রেল সংশ্লিষ্ট কেউ কোন কথা বলতে আগ্রহী নন। সংশ্লিষ্টরা জানান, প্রকল্পের জন্য প্রাথমিকভাবে চট্টগ্রাম জেলায় ৩৬০ দশমিক ৩৬ ও কক্সবাজার জেলায় ১ হাজার ৫১ দশমিক ১৫ একর জমি অধিগ্রহণের কথা ছিল। এতে মোট ব্যয় ধরা হয় ৩১২ কোটি ৪৫ লাখ টাকা। এর মধ্যে ২০১০ সালে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসককে ৯ কোটি ৭৫ লাখ, দ্বিতীয় দফায় ২২৬ কোটি ৪৮ লাখ ও সর্বশেষ চলতি বছরের ৩১ মার্চ ৭৫ কোটি ৯০ লাখ ৭৫ হাজার টাকা জমা দেয়া হয়। অন্যদিকে, জমির মূল্যবৃদ্ধির পরিপ্রেক্ষিতে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসকের পক্ষ থেকে ৩৯১ কোটি ও কক্সবাজারে জমি অধিগ্রহণে ৩১৪ কোটি টাকা চাওয়া হয়। তবে ডুয়েল গেজ রেলপথের জন্য বর্তমানে জমি অধিগ্রহণ আরও বাড়ছে। এছাড়া জমির দামও কয়েক গুণ বেড়ে গেছে। এতে জমি অধিগ্রহণ বাবদ ব্যয় ধরা হয়েছে ২ হাজার ৬০০ কোটি টাকা। জানা গেছে, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) অর্থায়নে দোহাজারী-কক্সবাজার-গুনদুম রেলপথ নির্মাণ প্রকল্পটির সম্ভাবতা যাচাই শুরু হয় ২০১৩ সালে। এতে ৩ কোটি টাকা ব্যয়ে কাজ করে কানাডার পরামর্শক প্রতিষ্ঠান ক্যানারেল কোম্পানি। সহায়তা করে জার্মানীর ডিবি ইন্টারন্যাশনাল, অস্ট্রেলিয়ার স্ম্যাক ও বাংলাদেশের এসিই কনসালট্যান্ট। চলতি বছর জানুয়ারিতে মাঠ পর্যায়ের কাজ শেষ হয়। আর প্রতিবেদন জমা দেয়া হয় গত মার্চে। সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের পাশাপাশি প্রকল্পটির বিস্তারিত নক্সা প্রণয়ন করছে প্রতিষ্ঠানগুলো। অপরদিকে, নির্মাণ ব্যয় বাড়লেও প্রকল্পটির অর্থায়নের উৎস পরিপূর্ণভাবে আজও নির্ধারিত হয়নি। বিদেশী সহায়তায় রেলপথ নির্মাণের পরিকল্পনা নেয়া হলেও এখনও চূড়ান্ত প্রস্তাব না পাওয়ায় তা ঝুলে আছে। ২০১০ সালে একনেকে অনুমোদনের সময় এডিবি প্রকল্পটিতে অর্থায়নের প্রস্তাব দেয়। যা আজও বাস্তবায়ন হয়নি। বিশ্বস্ত সূত্র জানায়, ব্যয় বাড়লেও এডিবি অর্থায়ন করতে রাজি হয়েছে। সম্প্রতি প্রকল্পটিতে এডিবি অর্থায়ন করবে বলে রেলপথকে আশ্বাসও দিয়েছে। তবে তা এখনও চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়নি। অপরদিকে, প্রকল্পটি অর্থায়নে চীনের একটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে গত ডিসেম্বরে সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) সই করা হয়। গবর্নমেন্ট টু গবর্নমেন্টের (জিটুজি) ভিত্তিতে চীন সরকারের অর্থায়নে রেলপথটি নির্মাণে আগ্রহ দেখায় কোম্পানিটি। কিন্তু এমওইউ সইয়ের পর আর কোন প্রস্তাব দেয়নি বা এ নিয়ে তেমন এগোয়নি চীনা এ প্রতিষ্ঠানটি। অপরদিকে, জানা গেছে চীনা প্রতিষ্ঠানটির সঙ্গে সমঝোতা স্মারক করায় এডিবি অর্থায়নে আগ্রহ প্রকাশ করেছে। বর্তমানে পূর্বাঞ্চল রেলওয়ের আওতাধীন চট্টগ্রামের দোহাজারী পর্যন্ত রেললাইন রয়েছে। তবে তা সিঙ্গেল লাইন। কক্সবাজারে পর্যটক ভ্রমণ ও মানুষ আসা-যাওয়ায় সড়কপথ ও বিমান যোগাযোগ থাকলেও রেলপথ নেই। এছাড়া ট্রান্স-এশিয়ান রেলপথ চালু করতে মিয়ানমারের সীমান্ত গুনদুম পর্যন্ত ট্রেন সংযোগ দরকার। তাই ১২৮ কিলোমিটার রেলপথ নির্মাণের উদ্যোগ নেয়া হয়। এর মধ্যে দোহাজারী থেকে রামু ৮৮ কিলোমিটার, রামু থেকে কক্সবাজার ১২ কিলোমিটার ও রামু থেকে গুনদুম পর্যন্ত ২৮ কিলোমিটার রেলপথ নির্মাণ করা হবে। এ রুটের উল্লেখযোগ্য স্টেশনগুলো হলোÑ সাতকানিয়া, লোহাগাড়া, চকরিয়া, ডুলাহাজরা, ঈদগাহ, রামু, কক্সবাজার, উখিয়া ও গুনদুম। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ রেলওয়ের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (প্রকল্প) সাগরকৃষ্ণ চক্রবর্তী বলেন, ২০১০ সালে একবার দোহাজারী কক্সবাজার গুনদুম সিঙ্গেল রেললাইন নির্মাণের প্রকল্পটির বাস্তবায়নের জন্য ব্যয় ধরা হয়। পরে নতুন করে ডাবল লাইন নির্মাণের জন্য প্রকল্পটির সম্ভাব্যতা আবার যাচাই করা হয়েছে। সিঙ্গেল লাইন মিটার গেজের পরিবর্তে ডাবল লাইন নির্মাণ করাসহ জমি অধিগ্রহণে ব্যয় ও সময় আগের চেয়ে অনেক বেড়ে গিয়েছে। এসব কারণে প্রকল্প ব্যয় ও সময় এতটা বাড়ছে। এছাড়া প্রকল্পটির অর্থায়ন নিয়ে এডিবি প্রাথমিকভাবে আগ্রহ দেখায়। পরে সরকার এ নিয়ে চীনের সঙ্গে নতুন করে এমওইউ সই করে। মিয়ানমার হয়ে চীনের সঙ্গে সংযোগ স্থাপনে রেলপথটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বিধায় চীন এ প্রকল্পে অর্থায়নে আগ্রহ প্রকাশ করে। সর্বশেষ বর্তমানে এডিবির একটি প্রতিনিধি দল বাংলাদেশ সফরে রয়েছে। তারা শুধু দোহাজারী থেকে নয় গুনদুম পর্যন্ত নয় চট্রগ্রাম থেকেই দোহাজারী কক্সবাজার-রামু হয়ে সীমান্ত এলাকা গুনদুম পর্যন্ত মোট ১৭৪ কিলোমিটার ডাবল লাইন রেলপথ নির্মাণের অর্থায়ন করতে রাজি হয়েছে। এডিবির অর্থায়নের পর আশা করি ২০১৬ সালের শেষের দিকে অথবা আগামী ২০১৭ সালে রেলপথটির নির্মাণ কাজ শুরু করা সম্ভব হবে। আশা করি এডিবির অর্থায়ন চূড়ান্ত হলে সব ডাবল লাইন নির্মাণের মাধ্যমে এ রেলপথের মাধ্যমে ট্রান্স এশিয়ান রেলাইনের সঙ্গে সংযুক্তির কাজ অনেকটাই এগিয়ে যাবে।
×