ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

দুঃসহ স্মৃতি সর্বক্ষণ তাড়া করছে ছোট্ট সাজিদকে

প্রকৌশলীর স্ত্রী ও মামা খুন রহস্যের আজও কিনারা হয়নি

প্রকাশিত: ০৫:৫৪, ২ জুন ২০১৫

প্রকৌশলীর স্ত্রী ও মামা খুন রহস্যের আজও কিনারা হয়নি

গাফফার খান চৌধুরী ॥ ছবিটি এখন শুধুই দুঃসহ স্মৃতি। আর কোনদিনই মায়ের কোলে এভাবে বসতে পারবে না ছোট্ট সাজিদ বিন জাহিদ। পাবে না মায়ের আদর সোহাগ ভালবাসা। তার সামনেই খুনীরা তার দাদা ও মাকে নির্মমভাবে ছুরিকাঘাতে হত্যা করেছে। সেই দুঃসহ স্মৃতি স্মরণ করতেই সব কিছু এলোমেলো হয়ে যায় ছোট্ট সাজিদের। তাই আজও সে স্ব^াভাবিক হতে পারেনি। ওই বাসায় যাওয়ার কথা বলতেই ভয়ে কান্নাকাটি শুরু করে দেয়। আর কোনদিনই তাকে ওই বাড়িতে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হবে কিনা তা নিয়ে আশঙ্কায় রয়েছেন সাজিদের পিতা প্রকৌশলী জাহিদুল ইসলাম। গত ১৩ মে দুপুর দেড়টা। রাজধানীর পল্লবী থানাধীন আবাসিক এলাকার ২০ নম্বর সড়কের ‘ক্রিস্টাল ডি আমিন’ নামে ৯ নম্বর ছয়তলা বাড়ির ষষ্ঠতলায় ডেসকোর উপসহকারী প্রকৌশলী জাহিদুল ইসলাম জাহিদের (৩৪) স্ত্রী সুইটি খাতুন (২৬) ও জাহিদের মামা পক্ষাঘাতে আক্রান্ত হয়ে বাঁ হাত-পা অনেকটাই অবশ হয়ে পড়া আমিনুল ইসলামকে (৫৫) এলোপাতাড়ি ছুরিকাঘাতে হত্যা করা হয়। ওই সময় সাজিদ বাসায় ছিল। তার সামনেই ঘটে পুরো ঘটনাটি। এ বিষয়ে সাজিদের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করেও বলা যায়নি। সেসব কথা সে বলতে গিয়ে অস্বাভাবিক আচরণ করতে থাকে। সাজিদের বরাত দিয়ে তার বাবা জাহিদুল ইসলাম জাহিদ জনকণ্ঠকে বলেন, আমাদের গ্রামের বাড়ি সিরাজগঞ্জ জেলার কাজীপুর থানাধীন গান্ধাইলে। রংপুর পলিটেকনিক থেকে ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে প্রথম বর্ষ শেষ করি। সে সময় আশরাফুল আলম চিশতী ওরফে শাহীন ভাই পলিটেকনিকের ছাত্রদলের ভিপি ছিলেন। দরিদ্র তহবিলে আর্থিক সহায়তা পেতে কলেজের অধ্যক্ষ বরাবর করা আবেদনে শাহীন ভাই বরাবরই আমার জন্য সুপারিশ করতেন। সেই থেকে শাহীনকে বড়ভাই হিসেবে মেনে আসছি। পরে আমি রংপুর ছেড়ে বগুড়া পলিটেকনিক থেকে পাস করি। ২০০১ সাল থেকে ডেসকোর (ঢাকা ইলেকট্রিক সাপ্লাই কোম্পানি) সঙ্গে জড়িত। প্রথমে ৯ মাস আউট সোর্সিংয়ের কাজ করি। এরপর ২০০২ সালের ৯ অক্টোবর ডেসকোর নিম্নপদে চাকরি হয়। ২০০৬ সালে পদোন্নতি পেয়ে ডেসকোর সাব স্টেশন অফিসার হই। ২০০৮ সালে ডেসকোতে স্থায়ী নিয়োগ পাই। ডেসকোতে কাজ শুরুর পর থেকেই আমি ঢাকায় বসবাস শুরু করি। আর পাশাপাশি ব্যবসা করছিলাম। বিয়ে করি ২০০৭ সালে নিজ জেলা সিরাজগঞ্জে। বিয়ের সময় স্ত্রী সিরাজগঞ্জের একটি কলেজে অনার্সের ছাত্রী ছিল। ঢাকায় বসবাস করায় স্ত্রীর আর লেখাপড়া হয়নি। ২০১৩ সালের এপ্রিলে হত্যাকা- সংঘটিত হওয়া বাড়িটির ১২শ’ বর্গফুটের ওই ফ্ল্যাটে উঠি। ফ্ল্যাটটি ৪৮ লাখ টাকায় কিনে নেই। ফ্ল্যাটে স্ত্রী ও মামাসহ একমাত্র ছেলে সাজিদ বিন জাহিদকে (৫) নিয়ে ছিল আমাদের সুখের সংসার। চাকরির পাশাপাশি ব্যবসা করে আস্তে আস্তে দাঁড়াতে থাকি। চাকরির পাশাপাশি ব্যবসা করায় সঙ্গত কারণেই নানা ঝামেলা হচ্ছিল। ব্যবসার বর্তমান মূলধন প্রায় ৬০ লাখ টাকা। চাকরি করায় ব্যবসায় ঠিকমত সময় দিতে পারছিলাম না। ব্যবসা দেখছিল স্ত্রী। এ সময় মনে পড়ে যায় রংপুরে পলিটেকনিকে পড়ার সময় সিনিয়র ভাই ও পলিটেকনিকের ছাত্রদলের ভিপি শাহীন ভাইয়ের কথা। শাহীন ভাইকে ব্যবসা দেখাশোনা বাবদ ৩০ ভাগ ব্যবসার মালিক করি। আমরা মূলত বৈদ্যুতিক উপকেন্দ্র স্থাপনের ব্যবসা করি। পাশাপাশি মিরপুরে ট্রান্সফর্মার তৈরির কারখানা স্থাপন করছি। সম্প্রতি ব্যবসার নানা বিষয় নিয়ে দ্বন্দ্ব হয় শাহীন ভাইয়ের সঙ্গে। আমরা ব্যবসা পৃথক করার জন্য ঘটনার দুই দিন আগে টানা বৈঠকে বসি। বৈঠকে টাকা পয়সা খরচের বিষয়টি আসে। এসব বিষয় হিসাব করতে সময় লাগবে বলে শাহীন ভাই জানান। এমন পরিস্থিতির মধ্যেই হত্যাকা-ের ঘটনাটি ঘটে। তিনি বলেন, প্রতিদিনের মতো ঘটনার দিন সকালে আমি অফিসে যাই। আর প্রত্যেক দিনের মতোই দুপুর দুইটা থেকে আড়াইটার দিকে খেতে বাসায় যাই। ওদিনই আমি বাসায় যাই। বাসার দরজা বন্ধ। কলিংবেল দিলেও কোন সাড়াশব্দ নেই। গোল লক ঘুরাতেই দরজা খুলে যায়। প্রথম রুমেই মামার ছুরিকাঘাতে রক্তাক্ত লাশ দেখতে পাই। আমি দিশেহারা হয়ে স্ত্রী সন্তানকে ডাকতে থাকি। কারও সাড়াশব্দ না পেয়ে ভেতরে যাই। ভেতরের বেডরুমে দেখি আমার স্ত্রী উপুড় হয়ে বিছানায় পড়ে রয়েছে। দেখে মনে হচ্ছিল ঘুমিয়ে আছে। ধাক্কা দিলেও নড়ে না। জোরে ধাক্কা দিতেই উল্টে গেলে দেখি জবাই করা। অন্যান্য রুমে গিয়ে ছেলেকে খুঁজতে থাকি। খবর নেই। পরে আবার বেডরুম আসি। সেখানকার বাথরুম বন্ধ। বাথরুম খুলে দেখি ছেলে অনেকটাই অচেতন অবস্থায় পড়ে আছে। তার মাথা রক্তাক্ত জখম। দ্রুত ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে বাইরে যাই। এরপর পুলিশ লাশ উদ্ধার করে। তিনি বলেন, সাজিদের কাছে বহুবার ঘটনা জানার চেষ্টা করেছি। কিন্তু সবই বিফল। সেসব কথা তুললেই ও অস্বাভাবিক আচরণ করতে থাকে। বলতে বলতেই এক সময় থেমে যায়। শুধু বলে দুই লোক গ্যাসের চুলা ঠিক করার কথা বলে বাসায় আসে। দুজনই বেশ লম্বা আর কালো। দুইজনের হাতেই ছিল ছোট ব্যাগ। ব্যাগ থেকে চাপাতি বের করে প্রথমে দাদাকে মারে। এরপর তার মাকে। সে চিৎকার দিতে গেলে তাকে ঘাড় ধরে দেয়ালের সঙ্গে মাথা ঠুঁকে দেয়। এরপর তাকে বাথরুমে আটকে রাখে। তার আর কিছুই মনে নেই। বহুবার তাকে ওই বাসায় যাওয়ার কথা বলেছি। বাসার কথা শুনলেই হাউমাউ করে কান্নাকাটি শুরু করে দেয়। ভয়ে ঘরে গিয়ে দরজা বন্ধ করে রাখে। সে আর ওই বাসায় যাবে না বলে জানায়। জোর করলে কান্নাকাটি করে বাড়ি মাথায় তুলে। ঘটনার পর থেকেই অনেকটা অস্বাভাবিক আচরণ করছে সে। বাড়ির নিরাপত্তাকর্মী আব্দুল খালেক (৫৫) জানান, দুই যুবক একটি লাল মোটরসাইকেল নিয়ে ওই বাড়িতে যায়। তারা জাহিদের আত্মীয় বলে পরিচয় দেয়। গেট খুলে দিলে তারা ওপরে উঠে। আবার আধঘণ্টার মধ্যেই দ্রুত বেরিয়ে যায়। এ ব্যাপারে ডিএমপির পল্লবী বিভাগের সহকারী পুলিশ কমিশনার কামাল হোসেন জনকণ্ঠকে জানান, হত্যকা-ের ঘটনায় নিহত সুইটির ব্যবসায়িক পার্টনার শাহীনকে দুই দফায় রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। তবে উল্লেখযোগ্য কোন তথ্য পাওয়া যায়নি। এছাড়া নিহত সুইটির স্বামী জাহিদের এক দুরসম্পর্কের ভাগ্নে সোহেলকে আটক করে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। তবে হত্যাকা- সম্পর্কে উল্লেখযোগ্য কোন তথ্য মেলেনি। হত্যাকারীরাও শনাক্ত হয়নি। তবে চেষ্টা অব্যাহত আছে। ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের একটি দল মামলাটির ছায়া তদন্ত করছে। থানার পরিদর্শক (তদন্ত) বিপ্লব কিশোর শীল জনকণ্ঠকে জানান, হত্যাকারীদের গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে। পারিবারিক বিষয়াদি ছাড়াও ব্যবসায়িক দ্বন্দ্বের বিষয়টি গভীরভাবে খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
×