ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

দারিদ্র্য নিত্যসঙ্গী হলেও অদম্য প্রত্যয়ে ওরা জয় করেছে জিপিএ-৫

প্রকাশিত: ০৫:৪০, ১ জুন ২০১৫

দারিদ্র্য নিত্যসঙ্গী হলেও অদম্য প্রত্যয়ে ওরা জয় করেছে জিপিএ-৫

শর্মী চক্রবর্তী ॥ দরিদ্র মেধাবী শিক্ষার্থী, তারা সুযোগ পেলেই দেশের অহঙ্কার হতে পারে। তাদের স্বপ্ন হলো আকাশছোঁয়া। সেই শিক্ষার্থীদের অদম্য ইচ্ছাশক্তি আর আত্মপ্রত্যয়ের কাছে হার মেনেছে সকল দরিদ্রতা। শত প্রতিকূলতার মধ্যেও জিপিএ-৫ পেয়েছে গরিব কিন্তু মেধাবী একাধিক শিক্ষার্থীরা। এরা কেউ দিনমজুর, কেউ রিক্সাচালকের সন্তান, কেউ ভূমিহীন বাবার সন্তান আবার কেউ কায়িক পরিশ্রমী। অভাব অনটনে চলে তাদের সংসার। একবেলা খাবার পেলে আরেক বেলা খেতে পায় না তারা। এরপরও নিজেদের স্বপ্ন পূরণের জন্য প্রাণপণে চেষ্টা করে গেছে সেই শিক্ষার্থীরা। তাদের অক্লান্ত পরিশ্রম ও চেষ্টায় পেয়েছে সফলতা। দরিদ্র বাবা-মার কুড়েঘরে এরা যেন চাঁদের হাসি ফুটিয়েছে। জীবনের প্রতিটি বাঁকে তারা দরিদ্রতার কারণে বাধাগ্রস্ত হয়েছে। তবুও তারা পিছু হটেনি। মনে সাহস ও প্রবল ইচ্ছাশক্তি নিয়ে এগিয়ে গেছে। এতে তারা পেয়েছে কাক্সিক্ষত লক্ষ্য। তবে এই সফলতা পেলেও সামনের পথ নিয়ে চিন্তিত এসব মেধাবী দরিদ্র শিক্ষার্থী। তাদের অনেকে ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, ব্যারিস্টার হতে চায়। কিন্তু দরিদ্রের কষাঘাতে এই স্বপ্নগুলো পূরণ করতে পারবে কিনা তা নিয়ে ভাবছে তাদের পরিবার। এমনি কয়েক শিক্ষার্থীর স্বপ্ন জয়ের গল্প পাঠিয়েছেন আমাদের প্রতিনিধিরা। এই প্রতিবেদনে সহযোগিতা করেছেন রাজশাহীর প্রতিনিধি মামুন-অর-রশিদ, নীলফামারীর তাহমিনা হক ববি, গফরগাঁওয়ের শেখ আব্দুল আওয়াল। অভাবি কৃষি শ্রমিকের মেয়ে ফাতেমা ॥ কৃষি শ্রমিক বাবার অভাবি ঘরে কুপির আলোয় পড়াশোনা করে চলতি বছর এসএসসিতে মানবিক বিভাগ থেকে জিপিএ-৫ পেয়ে মলিন বাবা-মায়ের মুখে হাসি ফুটিয়েছে ফাতেমা। দারিদ্র্য তার সঙ্গী তাই অনটনের সংসারে শত প্রতিকূলতা সত্ত্বেও ফাতেমা দেখিয়েছে বিশেষ কৃতিত্ব। শনিবার দুপুরে প্রকাশিত এসএসসি পরীক্ষায় জিপিএ-৫ পাওয়ার খবর শোনে ফাতেমা আনন্দে আত্মহারা হলেও ভাল কলেজে ভর্তি আর পড়াশোনা করে ব্যারিস্টার হওয়ার আকাক্সক্ষা নিয়ে অনেকটায় বিচলিত। রাজশাহীর তানোর পৌর এলাকার আকচা ফকিরপাড়া গ্রামের কৃষি শ্রমিক সাইফুল ইসলামের মেয়ে ফাতেমা খাতুন। সে আকচা উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে এসএসসিতে অংশ নিয়েছিলা মেয়ের সাফল্যে খুশি কৃষি শ্রমিক পিতা সাইফুল ইসলাম ও মাতা গৃহিণী তারামন বিবি। ফাতেমা মেধাবী হওয়ায় পড়ালেখায় সব সময় অনুপ্রেরণা যোগাতেন তার মা তারামন বিবি। এজন্য শত প্রতিকূলতা সত্ত্বেও ফাতেমার পড়ালেখায় ছেদ পড়েনি। ক্লাসে নিয়মিত উপস্থিতি ও ভাল হওয়ায় স্কুল শিক্ষকরা তাকে সহযোগিতা করেছেন। ফাতেমার স্বপ্ন ব্যারিস্টার হওয়ার। কিন্তু দারিদ্র্য তার সেই স্বপ্ন পূরণের পথে বিশাল বাধা। এই বাধা পেরিয়ে স্বপ্ন পূরণ হবে কি না সেই চিন্তায় এখন তার চোখেমুখে। ফাতেমার বাবা সাইফুল ইসলাম জানান, তার দুই ছেলে ও এক মেয়ে। বড় ছেলে খেজের আহম্মেদ এখন কলেজে পড়ছে। একমাত্র মেয়ে ফাতেমা এবারের এসএসসি পরীক্ষায় জিপিএ-৫ পেয়েছে। ছোট ছেলে জেকের সপ্তম শ্রেণীতে পড়ালেখা করছে। সেও মেধাবী। কিন্তু মেধাবীদের পড়ালেখার মতো খরচ জোগাড় করা তার সামর্থ্য নেই। ফলে বড় দুশ্চিন্তা তার। তিনি তার মেয়ের স্বপ্ন পূরণ করতে পারবেন কি না। মেয়ের পরীক্ষার রেজাল্ট শোনে আনন্দ পেলেও স্বপ্ন পূরণ নিয়ে ভাবছেন। মাটির দেয়ালের দুটি মাত্র কুড়েঘর তাদের। এক ঘরে তিন ছেলেমেয়ে অন্য ঘরে থাকেন তারা। বাড়িতে বিদ্যুত সংযোগ নেই। কুপির আলোয় ফাতেমা রাত জেগে পড়ালেখা করত। মেয়েকে প্রাইভেট পড়ার মতো সমর্থ ছিল না তার। কিন্তু মেয়ের পড়ালেখার আগ্রহ দেখে অতিকষ্টে পড়ালেখার খরচ চালিয়ে গেছেন তিনি। এমনিতেই সংসারে অভাব-অনটন তার মধ্যে ছেলেমেয়ের পড়ালেখার বাড়তি খরচ। এককাঠা জমিও নেই। হাতে কাজ করে পেটে খান সাইফুল। তিনিও চান তার মেয়ে শহরের ভাল কলেজে পড়াশোনা করুক। কিন্তু ইচ্ছে থাকলেও সামর্থ্য নেই। ফাতেমার মা তারামন বিবি জানান, সকালে পান্তা ভাত খেয়ে মেয়ে স্কুলে যায়। দুপুরে দুমুঠো খাবারের জন্য মেয়ে স্কুল থেকে বাড়ি আসে। কিন্তু সময় মতো খাবার জোটে না। তার স্বপ্ন মেয়েকে শহরের ভাল কলেজে পড়ানোর। অর্থের অভাবে স্বপ্ন তার স্বপ্ন রয়ে যাবে। অনেকে এসেছে ফাতেমাকে অভিনন্দন জানাতে। সমাজের ধনী ব্যক্তিদের কাছে তার মেয়ের পড়ালেখার ভর্তি খরচ ও স্বপ্ন পূরণে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান তিনি। আকচা উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আসলাম উদ্দিন জানান, অনেক কষ্ট করে লেখাপড়া করে ফাতেমা আজ সার্থক হয়েছে। তার ভবিষ্যত সাফল্য কামনা করেন তিনি। ফাতেমা জানায়, শত কষ্টের মধ্যেও বাবা-মা লেখাপড়ার খরচ চালিয়েছেন। প্রাইভেট পড়ার সামর্থ্য ছিল না। মায়ের সঙ্গে সংসারের কাজ ও গ্রামের ছেলেমেয়েদের প্রাইভেট পড়িয়ে পড়ালেখা চালিয়ে গেছে সে। ফাতেমার ইচ্ছে সে ব্যারিস্টার হবে। এখন শহরের ভাল কলেজে ভর্তির ইচ্ছে তার। দিনমজুর রাজু পেল জিপিএ-৫ ॥ কায়িক শ্রমিক রাজু আহমেদ। পিতাও দিনমজুর। তাই পিতার সঙ্গে রাজুও দিনমজুরের কাজ করে। এই রাজু তাক লাগিয়ে দিয়েছে এবারের এসএসসি পরীক্ষার ফলে। দিনাজপুর শিক্ষা বোর্ডের অধীনে বিজ্ঞান বিভাগে নীলফামারী সরকারী উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এবারের এসএসসি পরীক্ষায় গোল্ডেন জিপিএ-৫ পেয়েছে সে। নীলফামারীর জেলা সদরের কচুকাটা ইউনিয়নের দুহুলী পশ্চিম ধারারপাড় গ্রামে দরিদ্র পরিবারের সন্তান রাজু আহমেদ। তার ভাল ফলের খবরে খুশি হয়েছে প্রতিবেশীরা। রাজুর বাবা লতিফর রহমান বলেন, দিনমজুরির কাজ করি আমি। আমার সঙ্গে রাজুও দিনমজুরির কাজ করে। শুনেছি সে ভাল রেজাল্ট করেছে। কিন্তু শুনে আর কি হবে। ছেলেকে কি কলেজে পড়িয়ে ডাক্তার বানাতে পারব? কেন পারবেন না প্রশ্নে দিনমজুর এই পিতা বললেন লেখাপড়ার খরচ চালাব কেমন করে। এসএসসি পরীক্ষার রেজাল্ট প্রকাশের দিন এবং পরের দিনও রাজু দিনমজুর বাবার সঙ্গে ধান মাড়াইয়ের কাজে ব্যস্ত সময় পার করেছে। রেজাল্ট জানতে স্কুলেও যেতে পারেনি। বন্ধুরা এসে তার রেজাল্ট জানিয়ে গেছে। জেলা শহর থেকে ১২ কিলোমিটার দূরে গ্রামের বাড়িতে গিয়ে রাজুকে দেখা যায় সে তার বাবার সঙ্গে উঠতি বোরো ধান মাড়াইয়ের কাজে ব্যস্ত সময় পার করছে। সে জানায়, পরীক্ষায় ভাল ফলের খবর শুনেছি। মনের আনন্দ আর বাস্তবতার আনন্দের মধ্যে অনেক ফারাক। তাই আগামী ভবিষ্যত নিয়ে তার মাঝে হতাশা বিরাজ করছে বলে রাজু অকপটে প্রকাশ করে ফেলে। রাজু জানায়, দুই ভাই এক বোনের মধ্যে সবার ছোট সে। ২০০৯ সালে পঞ্চম শ্রেণীতে ট্যালেন্টপুলে এবং ২০১২ সালে অষ্টম শ্রেণীতে সাধারণ বৃত্তি লাভ করে সে। ওই বৃত্তির টাকা আর স্কুলের ছুটিতে নিজের দিনমজুরির আয়ে চলেছে তার লেখাপড়া। এজন্য শিক্ষকরা করেছেন তাকে সহযোগিতা। সহায়তা পেয়েছে স্কুলের দরিদ্র তহবিলের। বন্ধুরাও বাড়িয়ে দিয়েছিল সহযোগিতার হাত। বাইসাইকেল চালিয়ে স্কুলে যাতায়াত করেছে ১২ কিলোমিটার পথ। রাজুর মা আরজিনা বেগম জানান, পরিবারের ফসলি জমি আছে এক বিঘা। ওই জমির ফসল, স্বামীর দিনমজুরির আয় এবং তার নিজের হাতের সেলাই কাজের উপার্জিত অর্থে সংসার চলছে। এখন ছোট ছেলে রাজুর লেখাপড়া নিয়ে চিন্তিত এই মা। রাজুর ইচ্ছে সে ডাক্তার হবে। এ জন্য চায় ভাল কোন কলেজে পড়তে। কিন্তু কাক্সিক্ষত লক্ষ্য অর্জনে কালো মেঘের ঘনঘটা রাজু কাটিয়ে তুলবে কিভাবে। এই চিন্তা তাকে কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে। নীলফামারী সরকারী উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক ইমরান আলী বলেন, ‘রাজুর মেধার কাছে হার মেনেছে দরিদ্রতা। শত কষ্টের মধ্য থেকেও অর্জন করেছে কাক্সিক্ষত লক্ষ্য। বিদ্যালয়ের সকল শিক্ষক বই, খাতা দিয়ে সহযোগিতা করেছেন তাকে। অনেকে বিনা বেতনে পড়িয়েছেন প্রাইভেট। সহযোগিতা পেলে সে তার কাক্সিক্ষত লক্ষ্যে পৌঁছবে একদিন। জাহিদের রিক্সাচালক বাবা চিন্তিত ওর সাফল্যে ॥ দরিদ্রতাকে পরাজিত করেছে ধৈর্য, শ্রম ও কঠোর অধ্যবসায়। সংসারের নুন আনতে পান্তা ফুরানো অবস্থায়ও নিজের লেখাপড়া চালিয়ে চলতি এসএসসি পরীক্ষায় জিপিএ-৫ পেয়েছে জাহিদ হাসান হৃদয়। উপজেলার গফরগাঁও ইউনিয়নের গড়াবের গ্রামের রিক্সাচালক বাদল মিয়ার একমাত্র ছেলে। ছোট থেকেই সংসারের প্রচ- অভাবের সঙ্গে যুদ্ধ করে হৃদয় এসএসসি পরীক্ষা পর্যন্ত লেখাপড়া চালিয়ে এসেছে। ভাল ফলাফলের কারণে বন্ধুরা যখন উৎফুল ঠিক তখনই আগামী দিনে অর্থনৈতিক অভাবের কারণে তার আর লেখাপড়া হবে কিনা এ নিয়ে সে চিন্তিত। জানা যায়, গড়াবের গ্রামের রিক্সাচালক বাদল মিয়ার এক ছেলে এক মেয়ে। মেয়েটি জন্ম থেকেই প্রতিবন্ধী। দরিদ্র রিক্সাচালক বাদল মিয়ার স্বপ্ন লেখাপড়া করে ছেলে একদিন মানুষের মতো মানুষ হবে। কিন্তু এতে বড় বাধা দরিদ্রতা। মাথার ঘাম পায়ে ফেলে জীবনের সঙ্গে যুদ্ধ করে ছেলের লেখাপড়ার টাকা জোগাড় করে বাদল মিয়া। ছেলেটিও পিএসসি, জেএসসি ও এসএসসিতে জিপিএ-৫ পেয়ে পিতার স্বপ্নকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু এই ব্যয় বহুল পৃথিবীতে আগামী লেখাপড়া করা নিয়ে হতাশ এই পরিবার। ইসলামিয়া সরকারী উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক নুরুল ইসলাম শিকদার বলেন, ছেলেটি মেধাবী এবং ভদ্র। লেখাপড়া চালিয়ে যেতে পারলে হয়ত ভবিষ্যতে পিতার স্বপ্ন পূরণ করতে পারবে। জাহিদ হাসান হৃদয় বলেন, আমার ভাগ্যে কি উচ্চ শিক্ষা আছে? আমি কি পিতার স্বপ্ন পূরণ করে মানব সেবা করতে পারব?
×