ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

‘ম্যাডাম কুক’

প্রকাশিত: ০৪:১৩, ২৬ মে ২০১৫

‘ম্যাডাম কুক’

শৈশবে প্রায় বাঙালী সন্তান ‘চোখপলানি’ বা ‘পলাপলি’ খেলার সঙ্গে পরিচিত হয়ে ওঠে। লুকিয়ে থেকে শিশুদের চমকে দেয়া বা মজা করার জন্য অগ্রজরা এমনটা করে আসছেন সম্ভবত অনাদিকাল থেকে। কিন্তু এই খেলার জন্য শিশুকে পেটানো তো গর্হিত কাজ। শিশু মানেই আনন্দ, হাসি, গান, উল্লাস। সেই শিশুদের বিকশিত হয়ে ওঠার পথ যদি না হয় মসৃণ, তবে স্বাভাবিকতার বাইরে অবস্থান চলে যেতে বাধ্য। শিশুরা আচরণ করবে শিশুদের মতোই, সেটাই বাস্তবতা। তাদের ইতিবাচক জীবনের পথ দেখানো অভিভাবকদের যেমন দায়িত্ব, তেমনি শিক্ষকদেরও। এমনিতে বাংলাদেশের শিশুদের আনন্দের অপর পিঠে দুঃখের সীমা নেই। বকুনি, পিটুনি থেকে নিস্তার সহজে মেলে না ঘরে কিংবা স্কুলে। পড়া ঠিকমতো তৈরি করতে না পারা, হোমওয়ার্ক যথাসময়ে জমা দিতে না পারা কিংবা এক-আধটু দুষ্টুমি বা অন্য কোন অপরাধের পরিণাম বেত্রাঘাত। অনেককাল ধরেই এই দৃশ্য বিদ্যমান ছিল। কিন্তু সময়, সমাজ বদলে গেছে। পশ্চাৎপদতা কেটে গেছে। শিশুদের মানসিক বিকাশে ও স্বাস্থ্য গঠন সম্পর্কে সচেতনতা অনেক বেড়েছে। বকুনি-পিটুনি নয়, বুঝিয়ে-শুনিয়ে তাদের বেড়ে ওঠার পথ তৈরি করাটাই দায়িত্ব ও কর্তব্য। শিক্ষা মনোবিজ্ঞান বেত্রাঘাতবিরোধী। মনস্তাত্ত্বিক ব্যাখ্যায় শিশুর মন কোমল, এ সময় তাকে খেলাধুলার ছলে পড়াশোনায় আগ্রহী করে তুলতে হয়। বইয়ের প্রতি মনোনিবেশ ঘটানোর নানা কসরত থাকলেও তা অবলম্বন করা না হলে বিদ্যার জাহাজ ডুবে যেতে বাধ্য। শিশুরা স্কুলে যায় শিখতে, জ্ঞান অর্জন করতে। তারা বড়দের মতো সবকিছু শিখে, আচার-আচরণে পাকা হয়ে ওঠার পর স্কুলে ভর্তি হয়, এমন নয়। তারা জানার জন্য যায়। শিক্ষকদের শিক্ষাদান, তাদের কথাবার্র্তা, চালচলন ব্যাপক প্রভাব ফেলে শিশুদের জীবনে। শিক্ষকদের মানুষ গড়ার কারিগর বলা হয় এসব কারণেই। কিন্তু এই মহত পেশায় এসে কেউ যদি হালের গরু-মোষকে পেটানোর মতো করে শিক্ষার্থীকে পেটান তাহলে শুধু ছাত্রসমাজেরই সম্মানহানি হয় না, তাদের মতো দু-একজনের জন্য গোটা শিক্ষক সমাজের সম্মানও ক্ষুণœ হয়। দিন কয়েক আগে বরিশালের কাছেমাবাদ সরকারী প্রাথমিক স্কুলে পঞ্চম শ্রেণীর ক্লাসের সময় শিক্ষিকাকে উদ্দেশ করে ক্লাসের বাইরে থেকে অন্য ক্লাসের এক ছাত্র ‘ম্যাডাম কুক’ বলে ডেকে দ্রুত সরে পড়ে। শিক্ষিকা ধরে নেন ক্লাসের ছাত্ররা তা বলেছে। এমন শব্দ উচ্চারিত হওয়ার অজুহাতে ক্ষিপ্ত হন তিনি। এক পর্যায়ে দরজা বন্ধ করে ওই ক্লাসের উপস্থিত ২৯ শিক্ষার্র্থীকে বেত্রাঘাত করে আহত করেন। তাদের চিৎকারে অভিভাবকসহ অন্যরা হাজির হয়ে আহত শিক্ষার্থীদের উদ্ধাার করেন। তাদের প্রাথমিক চিকিৎসা দেয়া হয়। চরম উত্তেজনাকর পরিস্থিতিতে কর্তৃপক্ষ শিক্ষিকাকে স্কুলে আসা নিষিদ্ধ করেন। কিন্তু অভিভাবকরা চান দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি। শিশু-কিশোররা চোখপলানি খেলায় লুকিয়ে থেকে ‘কুক’ বলে ডাক দেয়। ছাত্রটি তাই করছিল। স্কুল শিক্ষার জায়গা। ছাত্রদের পেটানো, বেত মারা, শারীরিকভাবে আহত করাÑ এসবই সভ্য দুনিয়া থেকে ওঠে গেছে। হাইকোর্ট ২০১১ সালে শিশুদের স্কুলে বেত মারা নিষিদ্ধ করে। সরকার এরপর শ্রেণীকক্ষে শিক্ষার্থীদের ওপর শাস্তি নিষিদ্ধ সংক্রান্ত নীতিমালা জারি করেছিল। এতে বলা হয়েছে, শিক্ষার্থীদের ১১ ধরনের শারীরিক শাস্তি দেয়া যাবে না। বিধান না মানলে কঠোর শাস্তির উল্লেখ রয়েছে। শিক্ষকদের নিয়োগ বা প্রশিক্ষণকালে নিশ্চয়ই বিষয়টি অবহিত করা হয়। তদুপরি ছাত্র-ছাত্রী পেটানো বন্ধ হয়েছে এমনটা বলা যাবে না। শাস্তি নয়, শিক্ষাকে আনন্দময় করে তোলাটাই শিক্ষকের প্রধান দায়িত্ব ও কর্তব্য। আমরা চাই না স্কুলগুলো নির্যাতন কেন্দ্র হয়ে উঠুক। আধুনিক, যুগোপযোগী, বিজ্ঞানমনষ্ক একটি শিক্ষাব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত করতে হলে নীতিমালা মেনে চলা উচিত সংশ্লিষ্টদের।
×