ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

যুদ্ধাপরাধী বিচার

মহেশখালীতেই ৭৫ রাজাকারের সন্ধান

প্রকাশিত: ০৫:৫৩, ২৪ মে ২০১৫

মহেশখালীতেই ৭৫ রাজাকারের সন্ধান

বিকাশ দত্ত ॥ একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় মানবতাবিরোধী অপরাধে দেশে যত মামলা হয়েছে তার মধ্যে কক্সবাজারের মহেশখালীতেই সবচেয়ে বেশি আসামির সন্ধান পাওয়া গেছে। তদন্ত সংস্থা ও প্রসিকিউশন তদন্ত শেষে মহেশখালীতে ৭৫ জন রাজাকারের সন্ধান পেয়েছে। ইতোমধ্যে দুই দফায় ৬ জন রাজাকার গ্রেফতার হয়েছে। বাদ বাকিদের গ্রেফতারের জন্য জোর তৎপরতা চালানো হচ্ছে। যাদের গ্রেফতার করা হয়েছে তাদের মধ্যে রয়েছে রাজাকার সালামত উল্লাহ খান, মোহাম্মদ রশিদ মিয়া, জিন্নাত আলী, মৌলভী ওসমান গণি, নুরুল ইসলাম ও বাদশা মিয়া মেম্বার। প্রসিকিউশন সূত্রে জানা গেছে, রাজাকার সালামত উল্লাহ খানের মামলাটি তদন্ত করতে গিয়ে এসব রাজাকারের নাম এসেছে। এদের মধ্যে ৩২ জন রাজাকার মারা গেছে। বাদবাকি ৪৩ জন রাজাকারের মধ্যে কয়েকজনের বিরুদ্ধে তেমন বড় ধরনের অভিযোগ পাওয়া যায়নি। প্রাথমিকভাবে ১৯ জনের বিরুদ্ধে হত্যা, গণহত্যা, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ, লুটপাট, ধর্মান্তরিতসহ অন্যান্য মানবতাবিরোধী অপরাধের প্রমাণ পাওয়া গেছে। দ্বিতীয় ধাপে আরও ২৪ জনের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের প্রমাণ পাওয়া গেছে। তবে তাদের বিরুদ্ধে আরও তদন্ত করা হবে। মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় যাদের দ- দেয়া হয়েছে তার মধ্যে অনেক আসামি পলাতক রয়েছে। আবার যাদের বিরুদ্ধে গ্রেফতারী পরোয়ানা জারি করা হচ্ছে সেখানেও অনেকে পলাতক। এদের গ্রেফতার করতে কি উদ্যোগ নেয়া হয়েছে সে বিষয়ে ট্রাইব্যুনাল একটি দিকনির্দেশনা দিয়েছেন। মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে ট্রাইব্যুনালের রায়ে সাজাপ্রাপ্ত এবং গ্রেফতারী পরোয়ানা জারির পর পলাতক সকল আসামিদের গ্রেফতারের উদ্যোগ নিতে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর বিভিন্ন সংস্থার সমন্বয়ে একটি মনিটরিং সেল গঠন করার নির্দেশ দিয়েছেন ট্রাইব্যুনাল। পুলিশের (ডিআইজি) অতিরিক্ত পুলিশ মহাপরিদর্শকের সম-পদমর্যাদা নয় এমন সব (পুলিশ, ডিবি, এসবি ও র‌্যাবের) কর্মকর্তার সমন্বয়ে মনিটরিং সেল গঠন করার জন্য বলা হয়েছে। তারা ওই আসামিদের গ্রেফতার করতে সক্ষম হয়েছেন কিনা সে সংক্রান্ত প্রতিবেদন প্রতি ৪০ দিন পর পর ট্রাইব্যুনালকে জানাবেন। মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় কিশোরগঞ্জের পাঁচজনের মধ্যে এ্যাডভোকেট শামসুদ্দিন ছাড়া বাকি চারজন পলাতক রয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে গ্রেফতারী পরোয়ানা জারি করার পরও তাদের খুঁজে বের করে গ্রেফতার করতে পারছে না আইনশৃ্ঙ্খৃলা বাহিনী। এ্যাডভোকেট শামসুদ্দিন আহমেদসহ পাঁচজনের বিরুদ্ধে প্রসিকিউশনের আনা আনুষ্ঠানিক অভিযোগ (ফরমাল চার্জ) আমলে নেয়ার পরে ১৩ মে চেয়ারম্যান বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিমের নেতৃত্বে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল -১ স্বপ্রণোদিত হয়ে এই আদেশ প্রদান করেছেন। বর্তমানে দ-প্রাপ্ত এবং গ্রেফতারী পরোয়ানা জারি করা বেশ কয়েক জন আসামি পলাতক রয়েছেন। উল্লেখ্য, চলতি বছরের ১ মার্চ কক্সবাজারের তিন রাজাকারের বিরুদ্ধে গ্রেফতারী পরোয়ানা জারি করা হয়। পরোয়ানা জারির পরের দিন ২ মার্চ সালামত উল্লাহ খান ও আব্দুর রশিদ এমপিকে গ্রেফতার করে আদালতে হাজির করার পরে ট্রাইব্যুনালের নির্দেশে তাদের কারাগারে পাঠানো হয়েছে। কিন্তু পরোয়ানা জারি করার পর থেকে অপর আসামি মৌলভী জাকারিয়া পালাতক রয়েছে। ২১ মার্চ ওই একই মামলায় আরও ১৬ জনের বিরুদ্ধে গ্রেফতারী পরোয়ানা জারি করা হয়। গ্রেফতারী পরোয়ানা জারির পরে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে মহেশখালীর পুলিশ ৪ জনকে গ্রেফতার করতে সমর্থ হয়েছেন। তদন্ত সংস্থা ও প্রসিকিউশন সূত্রে আরও জানা গেছে, আশা করা যাচ্ছে আরও কয়েকজনকে গ্রেফতার করা যেতে পারে। মুক্তিযুদ্ধের সময় কক্সবাজারের এই ঝিমঝাপ দ্বীপে রাজাকার ও পাকিস্তানী বাহিনী যে হত্যাযজ্ঞ ঘটায় তা অনেকেরই অজানা রয়েছে। স্বাধীনতার দীর্ঘ ৪৪ বছর পর বঙ্গোপসাগর বেষ্টিত দ্বীপাঞ্চল মহেশখালীতে তদন্ত করতে গিয়ে লোমহর্ষক কাহিনী রেরিয়ে আসছে। মহেশখালীর গোরকঘাটা বাজার, গোরকঘাটা রাখাইন বৌদ্ধ মন্দির, গোরকঘাটা দক্ষিণ হিন্দুপাড়া মাতব্বর বাড়ি, গোরকঘাটা সরকারপাড়া, গোরকঘাটা পুটিবিলা পালপাড়া, ঠাকুরতলা, ঠাকুরতলা রাখাইন বৌদ্ধ মন্দির, গোরকঘাটা পশ্চিমপাড়া, আদিনাথ মাইগ্যাঘোনা পাহাড়ী এলাকা, পুটিবিলা কায়স্থপাড়া, মহেশখালী নাপিতপাড়া, বড়মহেশখালী হিন্দুপাড়া, বড়মহেশখালী গোরস্তান হিন্দুপাড়া, বড়মহেশখালী দেবঙ্গাপাড়া, বড়মহেশখালী মুন্সীরডেইল, আদিনাথ মন্দির সংলগ্ন পাহাড়ী এলাকাসহ বিভিন্ন স্থানে আসামিগণ গণহত্যা, লুণ্ঠন, নারী নির্যাতন, অগ্নিসংযোগসহ সকল ধরনের মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটিত করে। তদন্ত সংস্থা সূত্রে জানা গেছে, ১৯৭১ সালে কক্সবাজারের মহেশখালীতে গণহত্যা সংঘটিত হয়েছে। সেখানে শতাধিক লোককে হত্যা করা হয়েছে। গণধর্ষণ অগ্নিসংযোগসহ হিন্দু ও বৌদ্ধদের মন্দির আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে। তিনশত বছরে পুরনো রাখাইন মন্দির ধ্বংস করে দেয়া হয়েছে। তিনি আরও বলেন, আমরা সেখানে গিয়ে তদন্ত করেছি। অনেক সাক্ষী পাওয়া গেছে। মহেশখালীতে হিন্দুদের জোরপূর্বক ধর্মান্তরিত করে মুসলমান করা হয়েছে। অনেক হিন্দুকে খতনা করা হলে তারা ইনফেকশনের কারণে মরা গেছে। পরবর্তীতে দেশ স্বাধীনের পর পুনারায় তারা হিন্দুধর্মে ফিরে এসেছে। তিনি বলেন, আমরা সেখানে তদন্ত করে অপরাধের প্রমাণ পেয়েছি। আসামির সংখ্যাও বেড়েছে। আসামির সংখ্যা প্রায় ৪০ জনেরও বেশি হতে পারে। মামলা তদন্ত করা হচ্ছে। আরও একবার সেখানে যেতে হবে। মহেশখালীতে যে গণহত্যা হয়েছিল তাতে সাক্ষীরা এগিয়ে এসেছে। কিন্তু প্রশাসনের কাছে তেমন তথ্য নেই। সেখানে কোন স্মৃতিসৌধও নেই। শুধু একটি মন্দিরের দেয়ালে কয়েকজন শহীদের নাম ফলক রয়েছে। উল্লেখিত সময়ের মধ্যে অভিযুক্ত প্রতিপক্ষগণ এলাকার অগণিত নারীর সম্ভ্রমহানি ঘটায়। অনেক মহিলাকে জোরপূর্বক ধর্মান্তরিত করে বিবাহ করতে বাধ্য করে।
×