ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

অরূপ কুমার দেবনাথ

শিক্ষা সেক্টর ও একটি ভাবনা

প্রকাশিত: ০৩:২৯, ২২ মে ২০১৫

শিক্ষা সেক্টর ও একটি ভাবনা

জ্ঞানী, দক্ষ ও সৎ মানবশক্তি যে কোন দেশ ও জাতির উন্নতির ভিত্তিস্বরূপ। আর জ্ঞান ও দক্ষতা শিক্ষানির্ভর। শিক্ষা তথা সুশিক্ষার মাধ্যমে মানুষের বুদ্ধি, বিবেক, বিবেচনা ও মানবিক চেতনার বিকাশ ঘটে। তাই শিক্ষাকে বলা হয় জাতির মেরুদ-। অপুষ্ট, জরাজীর্ণ ও বাতগ্রস্ত মেরুদ- যেমন দেহকলেবরকে সোজা রাখতে পারে না তেমনি সুশিক্ষিত জনগোষ্ঠী ছাড়া কোন জাতি বা দেশের উন্নতি হতে পারে না। এখন দেশের চাহিদা মতো জাতির সাফল্য বয়ে আনতে সক্ষম এমন শিক্ষিত জন তৈরির আদর্শ ক্ষেত্র প্রস্তুত করা জরুরী। যেমনটা শুরু করেছিলেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি ও তাঁর সরকার পাকিস্তানী হানাদার ও তাদের এদেশীয় দোসরদের তা-বের শিকার কোটি মানুষের পুনর্বাসনের পাশাপাশি দেশের শিক্ষাকেই সংস্কারের শীর্ষে রেখেছিলেন। তবে ঘাতকের বুলেট তাঁকে, তাঁর পরিবারকে এবং দেশের শিক্ষা কাঠামোকে তছনছ করে দিয়েছে। প্রবাসে থাকার কারণে ভাগ্যজোরে প্রাণে বেঁচে যাওয়া তাঁরই কন্যা শেখ হাসিনার বর্তমান সরকার এখন অনুরূপ সংস্কারের উদ্যোগ নিয়েছেন। কিন্তু দীর্ঘকালের অপসংস্কৃতি লালিত সে দূষিত ক্ষত রাতারাতি সারানো দুঃসাধ্য। তবে তা অসাধ্য নয়। এখন সবার আগে দরকার সুশিক্ষা প্রসারে দৃঢ় জাতীয় চেতনার উন্মেষ ঘটানো এবং সে লক্ষ্যে যথাযথ উদ্যোগ গ্রহণ। কেবল বিদ্যালয় গড়লেই চলবে না। প্রাথমিক থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত শিক্ষাসংশ্লিষ্ট সব প্রতিষ্ঠানের পরিচালনা ও ব্যাবস্থাপনা স্বচ্ছ, দক্ষ, নিরপেক্ষ ও কলুষমুক্ত হওয়া চাই। পাশাপাশি এসব প্রতিষ্ঠানে শিষ্টাচারসহ শিক্ষার গুণগতমান রক্ষা ও উন্নয়নের অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি ও তা বজায় রাখা আবশ্যক। আর এজন্য চাই দলমত নির্বিশেষে সকল দায়িত্বশীল ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের সদিচ্ছা ও সহযোগিতা। অথচ দেশের শিক্ষাকে হালে দল-বেদলে দেশের ক্ষমতাসীন বা বিরোধী রাজনৈতিক দলের সাফল্য ও ব্যর্থতার অন্যতম মানদ- রূপে উপস্থাপন শুরু হয়েছে। আর এরই ধারাবাহিকতায় শিক্ষিত নয়, ফল উন্নয়নের পাল্লা শুরু হয়েছে দেশের বিদ্যালয় থেকে শিক্ষাবোর্ড সর্বত্র। উত্তরপত্রের যথাযথ মূল্যায়ন বাদ রেখে ঢালাও নম্বরদানের ব্যবস্থার পর ভর করে প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিকের সব চূড়ান্ত পরীক্ষার ফলাফলে পাসের হার শতভাগের দোরগোড়ায় পৌঁছে গেছে। মুড়ি-মুড়কির মতো জিপিএ ‘এ+’ সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ছে। এ কাজে উদারহস্ত প্রসারিত করেছেন শিক্ষককুল। পাশে আছে শিক্ষাবোর্ডগুলোর পারস্পরিক সাফল্যের পাল্লা এবং রাজনৈতিক নেকনজর। আর অশুভ এ পাল্লার প্রভাবে বিদ্যাশিক্ষা ও জ্ঞান বিকাশ ক্রমাগত বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। প্রথম থেকে অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত নোট-গাইড নিষিদ্ধ থাকলেও সে নিষেধ মানছেন না দেশের বই প্রকাশক ও শিক্ষক অভিভাবক কেউই। উপরন্তু বহু শিক্ষক প্রকাশনী তরফের নানা লোভনীয় উপঢৌকন নিয়ে বিভিন্ন নামের একাধিক ‘সহায়িকা, গাইড, মডেল টেস্ট’ ইত্যাদি বই কিনতে বাধ্য করছেন শিক্ষার্থীদের। দোকানে, শিক্ষার্থীর ব্যাগে, শিক্ষকের হাতে প্রকাশ্যে ডোরেমন, সুপারম্যান, স্পাইডারম্যান, হ্যারিপটার ইত্যাদি রঙ-বেরঙের মনোহারি কার্টুন চরিত্র সংবলিত গাইডবই থাকলেও তা দেখতে পচ্ছেন না নজরদারি কর্তৃপক্ষ। হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ওষুধের দোকানগুলোতে ভিড় করে থাকা ওষুধ কোম্পানির রিপ্রেজেন্টেটিভদের মতো বিদ্যালয়, শিক্ষকের বাসা, বইয়ের দোকান, কোচিং সেন্টারসহ বহু স্থান-কাল-পাত্র সর্বত্র বই প্রকাশনীর রিপ্রেজেন্টেটিভদের আনাগোনা ও অবস্থান এখন সচরাচর দেখা যাচ্ছে। এরা দোকানে বই কিনতে আসা শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের কাছে পাঠরত কোচিং সেন্টার ও স্যারের নাম-ঠিকানা জানতে চান এবং সে সব ঠিকানায় নিজ নিজ বই ব্যবসা প্রসারের তদবিরে নেমে পড়েন। প্রাইভেট কোচিং নিষিদ্ধ থাকলেও বিদ্যালয়ের অধিকাংশ শিক্ষক- বিশেষ করে শহর এলাকার শিক্ষকগণ তা মানছেন না। উল্টো শিক্ষার্থীদের বিদ্যালয়ের ইউনিফর্ম পরিহিত অবস্থায় শ্রেণীকক্ষে, বাসায় অথবা ভাড়া বাড়িতে অর্থের বিনিময়ে কোচিং ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছেন। কোন কোন শিক্ষক লজ্জা-সঙ্কোচ এড়াতে প্রাইভেট পড়ানোর জন্য রাতের আঁধারকে বেছে নিচ্ছেন। নিত্যদিন প্রায় বিনিদ্র রজনী পার করা এসব শিক্ষক প্রায়ই ক্লাসে ঝিমিয়ে ঝিমিয়ে দায়সারা পাঠদানের পাশাপাশি অবসন্নতা, গ্যাসট্রিক, ডায়াবেটিস ইত্যাদি রোগের শিকার হচ্ছেন, কিন্তু সুস্থ ও সুন্দর থাকার সুপথে চলছেন না। শৃঙ্খলা, সদাচার, নিয়মানুবর্তিতা, দায়িত্ব- কর্তব্য, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি, দেশপ্রেম প্রভৃতি সদগুণ যারা শেখাবেন তাদের আইনশৃঙ্খলা ভঙ্গ করে ক্রমাগত এমন অস্বাভাবিক হয়ে ওঠা দেশ ও জাতির জন্য ভয়াবহ এক অশনি সঙ্কেত। এছাড়া বিদ্যালয়ে শিক্ষকের অপ্রতুলতা, নগণ্য সংখ্যক শিক্ষার্থীর বিদ্যালয়ের বোঝা বয়ে চলা, শিক্ষক নিয়োগে অব্যাহত অনিয়ম-দুর্নীতি, সরকারী ও বেসরকারী শিক্ষকদের অস্বাভাবিক বেতনবৈষম্য ইত্যাদি দেশের শিক্ষা সংস্কারের ক্ষেত্রে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিদ্যালয়ে বিদ্যা-শিক্ষার পরিবেশ মুখ্য বিষয়। এর পর শিক্ষার্থীর আগ্রহ, অভিভাবকের দায়িত্ববোধ এবং শিক্ষকের নিরপেক্ষ সহযোগী মনোভাব ও নীতি কঠোর বিচক্ষণ ভূমিকা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রে শিক্ষক নিয়োগে সংশ্লিষ্ট কর্তা ও নির্বাচকম-লীর সরাসরি চুক্তি বা বিদ্যালয়ে ‘ডোনেশন’ নামক অর্থকড়ি হাতানোর চলতি অপকৌশলের ফাঁদে আটকে যাচ্ছেন অভিজ্ঞ-সুশিক্ষিতজন। তাছাড়া বিদ্যালয়ে শিক্ষার পরিবেশ বজায় রাখা ও উন্নয়নের জন্য বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের ও শিক্ষকের প্রয়োজনীয় শাসন ও নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা থাকা দরকার। কিন্তু হালে আইন করে গুরুত্বপূর্ণ ও আবশ্যক সে ক্ষমতা খর্ব করা হয়েছে। আর যার কুফল ফলতেও শুরু করেছে। এখন বিদ্যালয় এলাকায় কিছুক্ষণ অবস্থান করলেই যে কেউই এটা উপলব্ধি করতে পারবেন। এখন সচরাচর দেখা যাচ্ছে বিদ্যালয়ে আসা শিক্ষার্থীদের প্রকাশ্যে ধূমপান, হাতাহাতি, মারামারি। আর শোনা যাচ্ছে অশালীন বকাবকি। এসবের মধ্য দিয়ে শিক্ষকের গা বাঁচিয়ে চলার দৃশ্যও এখন সচরাচর। সঙ্গে সঙ্গে বিদ্যালয়ে শিক্ষার পরিবেশ ক্রমশ নাজুক হয়ে পড়ছে। শিক্ষা, জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা না থাকায় গাইডনির্ভর হওয়া ছাড়া কোন উপায় থাকছে না অধিকাংশ শিক্ষকের। আর তাই একের পর এক আইন ও নির্দেশ জারি করেও বিদ্যালয়ে পাঠশিক্ষা মানসম্মত রাখা বা উন্নয়ন কোনটাই সম্ভব হচ্ছে না। এই একই কারণেই শিক্ষার্থীর জ্ঞান বিকাশে অন্যতম বাধা গাইড দৌরাত্ম্যও হ্রাস বা নিয়ন্ত্রণ কোনটাই সম্ভব হচ্ছে না। এখন শুধু শিক্ষার্থী নয়, অধিকাংশ অভিভাবকও চাইছেন তাঁর সন্তানের খুব ভাল ফলাফলের সনদ। তা ন্যায়-অন্যায় যে পন্থায়ই হোক না কেন। আবার শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের এহেন জঘন্য মানসিকতাকে পুঁজি করে নীতিভ্রষ্ট ও দুর্লোভী শিক্ষকরা প্রশ্নপত্র ফাঁস, উত্তরপত্রে ঢালাও নম্বর প্রদান, পরীক্ষাকেন্দ্রে সহায়তা ইত্যাদি অপকর্মের মাধ্যমে প্রাইভেট টিউশনির ব্যাপক প্রসার ঘটিয়ে চলেছেন। আর এ কাজের শীর্ষে আছেন সরকারী বিদ্যালয়ের শিক্ষকগণ। এদের অর্থকড়ি ও পৃষ্ঠপোষকদের যৌথ প্রভাব ও প্রতাপের কাছে হেরে যাচ্ছে বা বশীভূত হচ্ছে সংশ্লিষ্ট প্রশাসন ও আইন প্রয়োগকারী কর্তৃপক্ষ এবং শীর্ষ কর্তা পর্যন্ত সবাই। দেশের আইন ও উচ্চ আদালতের আদেশ-নির্দেশ উপেক্ষা করে সব নিষিদ্ধ ক্রিয়াকর্ম সাবলীলভাবে চালিয়ে যাচ্ছেন এরা। তবে যে যাই বলুন না কেন দেশ ও জাতির ভবিষ্যত গড়া বাদ রেখে উল্টো তা বিনষ্টকারী কুরুচিশীল স¦ার্থপর- এ চক্রের ক্ষমতার ভীত কতটা শক্ত তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। দেশের সর্বজনমান্য আইন ও আদালত উপেক্ষা করে অবিরাম চলতে থাকা বহু ঘটনার ব্যাখ্যা এখন কোন বিবেকবান মানুষ দিতে পারছেন না। অবস্থাদৃষ্টে আমাদের দেশে জ্ঞান ও দক্ষতা নয় বরং চাকরি বা অর্থ উপার্জনই শিক্ষার একমাত্র লক্ষ্য হয়ে উঠেছে। আর এমন মানসিকতার জন্যই যত অনর্থের সৃষ্টি। অথচ প্রচলিত আইনের যথাযথ প্রয়োগ দ্বারা এ সমস্যার সহজ সমাধান সম্ভব। আর দায়িত্ব পেলে মাত্র ছয় মাসের মধ্যে আমি যার বাস্তবায়ন করে দেখাতে পারি। তবে অবিলম্বে বাস্তবের ওপর পা রাখতে না পারলে দেশ ও জাতির সমূহ সর্বনাশ অবধারিত। [email protected]
×