ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

বাহালুল মজনুন চুন্নু

নক্ষত্রের প্রত্যাবর্তন

প্রকাশিত: ০৩:৫২, ১৭ মে ২০১৫

নক্ষত্রের প্রত্যাবর্তন

চতুর্দিক শ্বাপদসঙ্কুল আর অন্তর্জঙ্গলে নির্বাক্য পদধ্বনি, তবু এখানে লাল থেকে সবুজে যাওয়ার নিরন্তর দুর্নিবার প্রেরণা; আমি কোন পৌরাণিক কাহিনী বা গ্রীক দেবীর কথা বলছি না; আমি অন্য এক মহাকাব্য সৃষ্টির আখ্যান বলতে এসেছি। আজ ১৭ মে, আমাদের জাতীয় জীবনে রৌদ্রোজ্জ্বল এবং রুদ্র, সেই সঙ্গে উজ্জ্বল এক ইতিহাসের শিলান্যাসের দিন। দহনসিক্ত নির্বাসন শেষে এক অনতিক্রম্য নক্ষত্রের ঘরে ফেরার দিন। এবার তাহলে ইতিহাসের সেই বিগত সরণিতে হাঁটি। ১৯৭৫ সাল; তিনি তখন তৎকালীন পশ্চিম জার্মানিতে গবেষণারত বিজ্ঞানী স্বামীর সঙ্গে ছিলেন। সেটা ছিল তাঁর জীবনের অন্যতম সৌভাগ্য; কেননা দেশে থাকলে হয়ত তাঁকে আমরা আর আজ এই ভূমিকায় দেখতে পেতাম না। কেননা, ১৫ আগস্ট বাংলা মায়ের গায়ে ছোপ ছোপ রক্তে আঁকা হয়েছিল জঘন্য এক কৃষ্ণকায় ছবি; সপরিবারে জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে হত্যার যে নারকীয় পরিকল্পনা করা হয়েছিল, তা থেকে আপন ভাগ্যবলে বেঁচে গেলেন তিনি। ১৯৮১ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি তাঁর অনুপস্থিতিতেই (তিনি তখন দিল্লীতে অবস্থানরত) তিনি সর্বসম্মতভাবে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হন। বাংলাদেশের কোমল মাটিতে যাঁর জন্ম, তার শ্যামল প্রান্তর যাঁর সারা হৃদয়জুড়ে, তিনি তার আহ্বান শুনতে পেয়েছিলেন; এক অমোঘ টান তাঁকে ফিরিয়ে নিয়ে আসে তাঁর পিতার আকাক্সিক্ষত সোনার বাংলায়, এটা জেনেও যে, এখানে তাঁকে হত্যার ষড়যন্ত্রে ওত পেতে বসে থাকবে বাংলাদেশবিরোধী বিশ্বাসঘাতক হায়েনার দল। ঘনিয়ে এলো সময়; প্রিয় দেশবাসীর ভালবাসা তাঁকে ফিরে আসার প্রেরণা যোগাল। ১৯৮১ সাল, তিনি ফিরবেন। কুর্মিটোলা বিমানবন্দরে অবতারণা হলো অভূতপূর্ব এক দৃশ্যের। সারা এলাকা লোকে লোকারণ্য; বাঁধভাঙ্গা উচ্ছ্বাসে রানওয়েতে ঢুকে পড়েছে মানুষ, নামতে পারছে না বিমান। তারপর যখন তিনি নামলেন, সারা শহর ফেটে পড়ল উল্লাসে; মুজিবকন্যা ঘরে ফিরছেন। অগণিত মানুষের হর্ষধ্বনিতে প্লাবন বয়ে গেল সারা ঢাকা শহরে। বিমানবন্দর থেকে শেরেবাংলা নগরে তাঁর জন্য আয়োজিত সংবর্ধনা সভায় পৌঁছতে সময় লাগল তিন ঘণ্টা। বিভিন্ন প্রিন্ট ও বিদেশী ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ার বরাতে, সেদিন সারা ঢাকায় প্রায় ১৭ লাখ ছাত্র-জনতার সমাবেশ ঘটেছিল। লাখো মানুষ সরণির দু’পাশে দাঁড়িয়ে অভিবাদন জানিয়েছেন তাদের প্রাণপ্রিয় নেত্রীকে। সেদিন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি ছিলেন আবদুল মালেক উকিল, সাধারণ সম্পাদক আবদুর রাজ্জাক; আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য আবদুল মান্নানকে সভা উদযাপন কমিটির আহ্বায়ক করে কয়েকটি উপকমিটি গঠিত হয়েছিল। বাংলাদেশ ছাত্রলীগের তৎকালীন সভাপতি ওবায়দুল কাদের এবং সাধারণ সম্পাদক বাহালুল মজনুন চুন্নুর নেতৃত্বে সারা বাংলাদেশের ছাত্রসমাজ একত্রিত হয়ে সাদরে বরণ করে নিয়েছিলেন তাদের প্রিয় অপরাজেয় নেত্রী, ন্যায়বিচার ও গণতন্ত্রকামী জনমানুষের আকাক্সক্ষার প্রতীক, গণতন্ত্রের মানসকন্যা, আবহমান বাংলার চিরায়ত রূপ যাঁর অবয়বে মূর্ত, সেই মহীয়সীকে। পর্যবেক্ষকদের মতে, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পর ছাত্র-জনতার মাঝে এমন গণজাগরণ আর কখনও সচরাচর দেখা যায়নি। তিনি অন্য কেউ নন, তিনি আমাদের প্রিয় এক ভগিনী। ১৮ মে বিকেল ৩টায় সৈয়দ হোসেন সাহেবের লালমাটিয়ার বাসায় ডাকসুর নির্বাচিত প্রতিনিধিদের নিয়ে দেখা করতে গিয়েছিলাম তাঁর সঙ্গে; দেখতে গিয়েছিলাম জাতির জনকের আত্মজা ঠিক কিভাবে এই শোক সামলে কোন্ শক্তির বলে দেশ ও দল গড়ার কাজে, সর্বোপরি মানুষের সেবায় নিয়োজিত হতে আমাদের নির্দেশ দেন। আমরা বাড়ির ভেতর ঢুকে তাঁর জন্য অপেক্ষা করতে থাকলাম; মনে মনে সাজিয়ে নিচ্ছি কত কথা। কিছুক্ষণ পর নেত্রী এলেন; পিনপতন নীরবতায় স্তব্ধ হয়ে রইল ঘর। প্রথমে উনি কিছুই বলতে পারেননি সেদিন। আর আমরাও শুধু কেঁদেছিলাম। তারপর হয়েছিল কিছু দরকারি কথা। যতবার তাঁর দিকে তাকিয়েছি, শ্রদ্ধা, সম্মান ও আবেগে মাথা নত হয়ে গিয়েছিল আমার। আমাদের সঙ্গে সেদিন ছিলেন ডাকসুর মঞ্জুর কাদের কোরেশী, নুরুল ইসলাম সুজন, কামাল শরীফ, জাফর ওয়াজেদ, বাদল রায়, জেসমিন খানম, হুমায়ূন মাহমুদ, এনায়েত উল্লাহ চৌধুরী, মহিবুর রহিম বাবুল, মোক্তার হোসেনসহ আরও অনেকে। বার বার মনে হয়েছেÑ বঙ্গবন্ধুর রক্ত, তাঁর অমূল্য স্নেহসিক্ত এই সাহসিনী তাঁর যোগ্য ও যথার্থ উত্তরসূরি। জাতির জনক আজ আমাদের মাঝে নেই, কিন্তু তাঁর আদর্শ, চেতনা, মনন ও মূল্যবোধের সর্বোত্তম প্রকাশ দেখতে পাই আমাদের জননেত্রীর মাঝে। শেখ কামাল ভাইকেও আমরা হারিয়েছি। তাই এক বিধ্বস্ত দেশ নির্মাণ, দেশ ও জাতির সম্যক ও সর্বাঙ্গীণ কল্যাণের গুরুদায়িত্ব এবং বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত কর্মকাণ্ডের দায়ভার আজ নেত্রী সানন্দে নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছেন। ধীরে ধীরে বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে তার কাক্সিক্ষত লক্ষ্যে; শিক্ষা-দীক্ষা, জ্ঞান-বিজ্ঞান, রাজনীতি ও প্রগতিশীলতা সবক্ষেত্রে এখন বাংলাদেশের যে অভাবনীয় অগ্রগতি, তার পেছনে যিনি সন্দেহাতীত অদ্বিতীয় রূপকার হিসেবে নিরলস কাজ করে চলেছেন, তিনি আমাদের বঙ্গবন্ধুর আদরের সুকন্যা। বাংলাদেশের সার্বিক মুক্তির মুখপাত্র তারপর নৌকার হাল ধরলেন। বাংলাদেশজুড়ে সেই তরী বীরদর্পে চলতে লাগল, পৌঁছে গেল কোটি কোটি বাঙালীর হৃদয়ের ঘাটে। সেই নৌকার মাঝিদের অনন্যসাধারণ নির্দেশক হয়ে উঠলেন আমাদের প্রিয় নেত্রী। বুকের ভেতর পিতা-মাতা, ভাই, আত্মীয়স্বজন হারানোর অসহনীয় শোককে সীমাহীন শক্তিতে রূপান্তরিত করে তার স্ফুলিঙ্গকে পাঠিয়ে দিলেন সারা বাংলাদেশের মানুষের কাছে। আর অবিরাম চলতে থাকল অসাম্প্রদায়িক, প্রগতিশীল, ধর্মনিরপেক্ষ, বহুদলীয় গণতন্ত্রে বিশ্বাসী এক নতুন ও আধুনিক বাংলাদেশ বিনির্মাণের অভিযাত্রা। সেই পথপরিক্রমায় অগণিত আন্দোলন-সংগ্রামের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে রাজপথে বীরের মতো তিনি লড়ে গেছেন নিজের জীবনবাজি রেখে। অপশক্তির রাহু তাকে গ্রাস করে নিতে চেয়েছে বহুবার; কিন্তু স্বীয় আদর্শে বলীয়ান এই অসমসাহসিকা মৃত্যুভয় তুচ্ছ করে এগিয়ে চলেছেন; যেখানে অন্যায়, শোষণ, বঞ্চনা সেখানেই গর্জে উঠেছে তাঁর উদাত্ত কণ্ঠ; সারাদেশের কোটি কোটি নিপীড়িত, নিগৃহীত, অধিকারহীন মানুষের আশা-ভরসার মূর্ত প্রতীক হয়ে উঠলেন তিনি। ১৯৯০ সালে স্বৈরাচারী সরকারের পতনের পর যখন গণতান্ত্রিক সরকারের শুভারম্ভ ঘটে, তারপর ১৯৯৬ সালে তিনি রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হন। প্রোজ্জ্বল আলোকবর্তিকা হাতে তাঁর অতুলনীয় নেতৃত্বে দেশ সন্ধান পেল উন্নয়নের এক অনুসরণীয় বর্ণছটার। বিশ্বসভায় বাংলাদেশ মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে লাগল আপন বৈশিষ্ট্যে সমুজ্জ্বল হয়ে। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের নেপথ্য নায়ক যে জিয়াউর রহমান, সে বিষয়ে আজ আর কোন সন্দেহ নেই। জিয়াউর রহমানের মতাদর্শে বিশ্বাসী বিএনপি নামক রাজনৈতিক দলটি স্বাধীনতাবিরোধী জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে একজোট হয়ে শেখ হাসিনাকে হত্যার চেষ্টায় লিপ্ত থেকেছে অনেক দিন ধরে; তারা মনে করেছে এভাবে বঙ্গবন্ধুর আদর্শ-স্বপ্ন-চেতনাকে লুপ্ত করা যাবে। কিন্তু তারা জানে নাÑ জীবিত শেখ মুজিবের তুলনায় কায়াহীন শেখ মুজিব আরও বেশি ভাস্বর, আরও বেশি গগনবিদারী। প্রিয় নেত্রীর অবদান ও তাঁর নেতৃত্ব বুঝতে হলে এবং বাংলাদেশের মতো টালমাটাল রাজনৈতিক ঘেরাটোপে তিনি আসলে কতখানি ভূমিকা রেখেছেন, তার তুলনা শুধু বিশ্বের শ্রেষ্ঠ নারীদের সঙ্গেই চলে। ব্রিটেনের মার্গারেট থ্যাচার, ভারতের ইন্দিরা গান্ধী, শ্রীলঙ্কার শ্রীমাভো বন্দরনায়েকে যেভাবে দেশ ও জাতিকে বিশ্ব মঞ্চে তুলে ধরেছিলেন, বাংলাদেশের তিনবারের নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী, আমাদের প্রিয় নেত্রীও সেভাবে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশকে। তাঁর অসাধারণ রাজনৈতিক দূরদর্শিতা তাঁকে নিয়ে গেছে অনন্য এক উচ্চতায়। বিশ্বব্যাপী এখন তিনি উন্নয়নের রোল মডেল। রূপকল্প-২০২১ ধার্য করা হয়েছে; বাংলাদেশ ক্রমশ হয়ে উঠছে মধ্য আয়ের একটি শক্তিশালী দেশ। বর্তমানে দেশে বৈদেশিক মুদ্রার সঞ্চয় সবচেয়ে বেশি। সাহসিকতার সেনানী আমাদের নেত্রী কোনদিন তাঁর আদর্শের সঙ্গে আপোস করেননি। অকুতোভয় হৃদয়কে বিদগ্ধ করে ছুটে বেড়িয়েছেন সারা বাংলায়। তিনি বার বার বলেছেনÑ ‘মৃত্যুকে আমি ভয় পাই না; আল্লাহ আমাকে বহুবার বাঁচিয়েছেন; তিনি রক্ষা করলে কারও কিছু করবার সাধ্য নেই।’ ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট এ দেশীয় হায়েনারা যখন তাঁকে গ্রেনেডের আঘাতে হত্যা করতে চেয়েছিল, সেদিন তিনি পরম করুণাময়ের অশেষ করুণায় প্রাণে বেঁচে যান। তিন-তিনবার তিনি গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী; বাংলাদেশকে প্রকৃত অর্থে উন্নয়নের মহাসড়কে পৌঁছে দিয়েছেন তিনি। সময় পেরিয়ে যায়, ধীরে ধীরে রচিত হয় ইতিহাসের নীলাভ আলেখ্য। ১৫ আগস্ট সৌভাগ্যক্রমে বেঁচে যাওয়া সেই মানুষটি আজ বাংলাদেশের বিজয়, উন্নয়ন ও প্রগতির অপ্রতিদ্বন্দ্বী কাণ্ডারি; জাতি গর্বিত এমন একজনকে তার প্রধানমন্ত্রিত্বের আসনে বসাতে পেরে। সব হারানো একজন কেবল অবিনশ্বর মনোবল বুকে নিয়ে তিমিরভেদী সাহসে উজ্জীবিত হয়ে নিখুঁত নৈপুণ্যে পরিচালিত করেছেন দেশ, জাতি ও বাংলাদেশের সর্বস্তরের জনসাধারণের প্রাণের দল আওয়ামী লীগকে। তাঁর অটল সাহস, অপরিমেয় ধী-শক্তি, অক্ষয় অবিচলতা, অসামান্য দূরদর্শিতা, অসাধারণ রাজনৈতিক প্রজ্ঞা আমাদের যারপরনাই বিমুগ্ধ করে; তিনি সব সময় আমাদের আদর্শ এবং অনুপ্রেরণা; তিনি শতায়ু হোন, তাঁর সুস্বাস্থ্য কামনা করি; আর কেউ নন, তিনি অনন্য ও অবিসংবাদিত শেখ হাসিনা। লেখক : সিনেট ও সিন্ডিকেট সদস্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সাবেক সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ ছাত্রলীগ
×