ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

প্রফেসর ড. মুহম্মদ মাহবুব আলী

অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রা ও পিকেএসএফ

প্রকাশিত: ০৪:৪৯, ১৪ মে ২০১৫

অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রা ও পিকেএসএফ

পল্লী কর্ম সহায়ক ফাউন্ডেশন (পিকেএসএফ) দেশের তৃণমূল পর্যায়ের কর্মকা-কে গতিশীল করতে সচেষ্ট রয়েছে। গত রবিবার (১০ মে) ছিল এক বছরব্যাপী পিকেএসএফের পঁচিশ বছর পূর্তির সমাপনী দিবস। সমাপনী দিবসে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিত মন্তব্য করেন যে, এ মুহূর্তে দেশে ২০ হাজারের অধিক রেজিস্টার্ড এনজিও রয়েছে এবং ১৯০৪ সাল থেকে কো-অপারেটিভ ব্যবস্থার আদলে দেশে ক্ষুদ্রঋণ বিতরণ কার্যক্রম শুরু হয়। দেশে পিকেএসএফ বর্তমানে যেভাবে গতিময়তা সঞ্চার করেছে, তার মূলে রয়েছেন পিকেএসএফের সভাপতি ড. কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ। সভাপতির দায়িত্বভার গ্রহণ করার পর থেকেই নিরলসভাবে তিনি প্রয়াস নিয়েছেন কিভাবে দেশে ক্ষুদ্রঋণ বিতরণের পাশাপাশি তৃণমূল পর্যায়ের মানুষের মৌলিক অধিকারগুলো সম্পর্কে সচেতন করে তোলা যায় এবং পার্টনার অর্গানাইজেশনগুলোর মাধ্যমে গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে রাখতে পারা যায় ইতিবাচক প্রভাব। ড. কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ একজন মিশনারির মতো ছুটে বেড়াচ্ছেন রাজধানী থেকে আরম্ভ করে গ্রামের তৃণমূল পর্যায় পর্যন্ত। দেশের উন্নয়ন কাঠামোয় গতিময়তা সঞ্চার করা তাঁর লক্ষ্য। এ লক্ষ্য বাস্তবায়নে তিনি অনড়, দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। জননেত্রী শেখ হাসিনার রূপকল্প-২০২১ যাতে যথার্থভাবে বাস্তবায়িত করা যায় তার জন্য তিনি পিকেএসএফের সংবিধিবদ্ধ কাঠামোর আওতায় নির্লোভভাবে কাজ করে চলেছেন। গঁষঃরফ রসবহংরড়হধষ হচ্ছে তাঁর কর্মক্ষেত্র। পিকেএসএফ দরিদ্রতা দূরীকরণের জন্য আর্থিক অন্তর্ভুক্তিকরণ কর্মসূচী গ্রহণের পাশাপাশি গ্রামীণ শিল্প উন্নয়ন, জলবায়ু পরিবর্তন, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বাল্যবিবাহ প্রতিরোধ, নারী নির্যাতন প্রতিরোধসহ বহুমুখী এবং বহুমাত্রিক কর্মসূচী গ্রহণ করা হয়েছে। বস্তুত গ্রামীণ অবকাঠামো বিনির্মাণে লাগসই প্রযুক্তির উদ্ভাবন ও ব্যবহারে সহযোগী প্রতিষ্ঠানসমূহের মাধ্যমে কর্মকা- গ্রহণ করেছে। সম্পূর্ণ দেশজ সম্পদের সর্বোত্তম ব্যবহার করে পিকেএসএফ এখন দেশে-বিদেশে রোল মডেল হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। এ সাফল্যের পেছনে ড. কাজী খলীকুজ্জমান আহমদের দূরদর্শী চিন্তা-ভাবনা কাজ করছে। তাঁর আমলে পিকেএসএফের কর্মকা-কে সুদূরপ্রসারী করা হচ্ছে। একটি কথা না বললেই নয়, পিকেএসএফ সূচনালগ্ন থেকে বিদেশী দাতাগোষ্ঠীর ওপর নির্ভরশীল ছিল না। ফলে তার দেশীয় চাহিদা দেশী বিশেষজ্ঞদের তত্ত্বাবধানে জনকল্যাণ ও সামাজিক কল্যাণকে বেগবান করতে সচেষ্ট ছিল। মানষুকে স্বাবলম্বী করে গড়ে তোলা এবং মানুষের মধ্যে যে অন্তর্নিহিত শক্তি আছে, তার যথাযথ স্ফুরণ ঘটাতে পিকেএসএফ বর্তমানে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। সরকারের সহায়তায় প্রতিষ্ঠানটি একটু ব্যতিক্রমধর্মী। সেবা করার ব্রত নিয়ে বর্তমানে প্রতিষ্ঠানের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা থেকে আরম্ভ করে অধিকাংশই কাজ করে চলেছেন। আসলে মানুষের সেবা করা, জনকল্যাণ করা গেলে তা মূলত দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে ভূমিকা পালন করে। ১৯৯০ সালে প্রতিষ্ঠিত এ প্রতিষ্ঠানটির সার্বিক কর্মকা-ে গতিময়তা বৃদ্ধি পায় ২০১০ সালে। ২০১০ সালে প্রতিষ্ঠানের কর্মকা-ে বহুমুখী পদক্ষেপ যেমন শিক্ষা, প্রশিক্ষণ, স্বাস্থ্যসেবা, অবকাঠমো, সামাজিক পুঁজি, বাজারজাতকরণ ও বিপণন ব্যবস্থা, প্রাকৃতিক দুর্যোগ ব্যবস্থাপনাসহ বিভিনমুখী পদক্ষেপ ক্ষুদ্রঋণের সঙ্গে গ্রহণ করা হয়। মানব উন্নয়নকেন্দ্রিক ভূমিকার জন্য ঊহযধহপরহম জবংড়ঁৎপবং ধহফ রহপৎবধংরহম পধঢ়ধপরঃরবং ড়ভ ঢ়ড়ড়ৎ যড়ঁংবযড়ষফং ঃড়ধিৎফং ঊষরসরহধঃরড়হ ড়ভ ঃযবরৎ চড়াবৎঃু (ঊঘজওঈঐ) গ্রহণ করা হয়, যা বর্তমানে দেশের ১৪৩টি ইউনিয়নে কার্যক্রম পরিচালনা করছে। দেশের উন্নয়নে গ্রামীণ অবকাঠামো শক্তিশালী হওয়ার পেছনে পিকেএসএফ এবং তার সহযোগী উন্নয়ন প্রতিষ্ঠানসমূহ একটি শক্তিশালী ভূমিকা রেখে চলেছে। মূলত সরকারী অর্থায়নে পিকেএসএফ নিজের পায়ে দাঁড়ানোর ব্যবস্থা করছে। মানুষের অধিকার বুঝে নেয়ার জন্য তাদের ভেতরে লুকায়িত সুপ্ত বাসনা জাগ্রত করতে সচেষ্ট রয়েছে। এ দেশের দারিদ্র্যের হার হ্রাসকল্পে বহুমুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। সরকারী অর্থায়নে প্রতিষ্ঠিত পিকেএসএফ একটি ব্যতিক্রমধর্মী প্রতিষ্ঠান। মনে করিয়ে দেয় মহাত্মা গান্ধীর সেই অমর বাণী : ‘তোমার দুয়ারে কেউ এসেছে, তাকে সেবা দিয়ে নিজেকে ধন্য মনে করো না বরং তোমার দুয়ারে এসে সেবা নিয়ে তোমাকেই সে ধন্য করেছে।’ আসলে পিকেএসএফের পার্টনার এনজিওসমূহ গ্রামীণ তৃণমূল পর্যায়ের মানুষকে যেভাবে সেবা দিচ্ছে তা সত্যি প্রশংসনীয়। মানুষের কর্মক্ষেত্র তৈরির পাশাপাশি সক্ষমতা তৈরির ক্ষেত্রে বেশ উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে চলেছে। গ্রামীণ পর্যায়ে অর্থনৈতিক অবদানের ক্ষেত্রে পিছিয়ে পড়া নারীদের জন্য ভাগ্য ফেরানোর ক্ষেত্রে তারা যথেষ্ট মাত্রায় সচেতন। মানুষের অন্তর্নিহিত শক্তিকে কাজে লাগাচ্ছে পিকেএসএফ। নারীর ক্ষমতায়নে তাদের প্রশংসনীয় ভূমিকা রয়েছে। পিকেএসএফের পার্টনার অর্গানাইজেশন থেকে যারা সহযোগী হিসেবে ঋণ নিচ্ছেন তাঁদের ৯১% হচ্ছেন নারী। বিশ্বব্যাংক পিকেএসএফের সুন্দর ব্যবস্থাপনা দেখে তাদের মাধ্যমে ‘দরিদ্র বস্তিবাসীদের জন্য যোগসূত্রমূলক প্রকল্প’ এবং ‘পয়ঃনিষ্কাশন প্রকল্প’সহ কিছু প্রকল্পে অর্থায়ন করতে চাচ্ছে। ইউএসএইড, প্রভিবি, ডিএফআইডি, ইউ, ইফাদ, কেজিএফসহ কিছু কিছু অর্থায়িত প্রকল্প নিয়েছে। সামাজিক উন্নয়নের ভিত্তিভূমি হিসেবে ২০১৩ সালে পিকেএসএফ ‘সামাজিক সালিশি এবং জ্ঞান বিতরণ’ চালু করেছে। মানবিক কল্যাণে এটি একটি দূরদৃষ্টিসম্পন্ন কর্মকা- হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। বাল্যবিবাহ প্রতিরোধকল্পে পিকেএসএফের ভূমিকা প্রশংসনীয়। তারা এক্ষেত্রে সচেতনতা সৃষ্টির জন্য নাটিকা, কবিগান, জারিগান, ভাওয়াইয়াসহ নানা ধরনের দেশীয় সংস্কৃতির বিকাশ ঘটাচ্ছে। এতে জনসচেতনতা বাড়ছে। উন্নয়নের অন্যতম শর্ত হচ্ছে অজ্ঞানতা ও কুসংস্কার থেকে মুক্তি। পিকেএসএফের দেশীয় সংস্কৃতির বিকাশে কাজটি আসলে মানুষের মৌলিক অধিকার সম্পর্কে সচেতন করার পাশাপাশি উন্নয়নমূলক কর্মকা-ে ভূমিকা রাখতে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে বলে বিশ্বাস করি। এদিকে দেশে দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা মানবপাচার হঠাৎ করে ধরা পড়ায় যেভাবে পত্র-পত্রিকায় উঠে আসছে, তাতে মনে হয় দরিদ্র ও হতদরিদ্র মানুষ যাতে মানবপাচারকারীদের খপ্পরে না পড়ে সেজন্য পিকেএসএফ এই মুহূর্তে বিশেষ অধিৎহবংং চৎড়মৎধস গ্রহণ করতে পারে। উদ্যোক্ত তৈরির ক্ষেত্রে পিকেএসএফের ভূমিকা প্রশংসনীয়। তৃণমূল পর্যায়ে তারা ছড়িয়ে দিচ্ছে নিজের পায়ে দাঁড়ানোর শক্তি। পাশাপাশি কর্মসংস্থানের অপার সম্ভাবনা। ছাগল পালনই বলুন, হস্তশিল্পের কথা বলুন কিংবা প্রাথমিক শিক্ষার মান উন্নয়নসহ নানামুখী কর্মসূচী আসলে দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক অগ্রগতির ক্ষেত্রে বিশাল ভূমিকা পালন করে চলেছে। আবার নারী নিগ্রহের হাত থেকে বাঁচানোর পাশাপাশি নারীর ক্ষমতায়নে পিকেএসএফের ভূমিকা অত্যন্ত বাস্তবমুখী। ক্ষমতায়ন কেবল তখনই সম্ভব হয় যখন নিজের পায়ে দাঁড়ানো যায়। আজ দেশের মোট দেশজ উৎপাদন বৃদ্ধির ক্ষেত্রে গ্রামীণ অর্থনীতি একটি শক্তিশালী ভূমিকা পালন করে চলেছে। ইফাদ অর্থায়িত প্রকল্প ‘উদ্যোক্তা তৈরিকরণে অর্থায়ন এবং কর্মসংস্থান তৈরি প্রকল্প’-এ পিকেএসএফ দক্ষতার সঙ্গে কাজ করেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকও গত সাড়ে চার বছরে এক লাখের অধিক নারী উদ্যোক্তা তৈরিকরনে অর্থায়ন করেছে। অথচ উদ্যোক্তাদের নিয়ে গবেষণা করার জন্য বাংলাদেশ ফেডারেশন অব উম্যান এন্ট্রিপ্রিনিউরের প্রেসিডেন্ট রোকেয়া আফজাল রহমানের সঙ্গে যোগাযোগ করলে জানান যে, তাদের কাছে নারী উদ্যোক্তাদের কোন ডাটাবেজ নেই। এটি সত্যি দুঃখজনক। আমাদের দেশ এগিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু তৃণমূলের যে শক্তি, সে শক্তিকে উন্নয়নের ক্ষেত্রে কাজে লাগাতে হবে। আসলে পিকেএসএফের মাধ্যমে অর্থায়নের ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা ও ন্যায়পরায়ণতা অনুভূত হয়। এ কারণেই পিকেএসএফের মাধ্যমে রূপকল্প-২০২১-এর মৌল উদ্দেশ্যসমূহ পূরণ হচ্ছে। পিকেএসএফ হতদরিদ্র মানুষের জীবনমান উন্নয়নের জন্য অর্থায়নের যে অধিকার রয়েছে তার ক্ষেত্রে সহায়তা করে থাকে। এজন্য তারা বহুমুখী কর্মসূচী গ্রহণ করেছে। দেশে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে গেলে নিজের ক্ষমতায়ন সর্বাগ্রে নিশ্চিত করা দরকার। পরমুখাপেক্ষিতা, কুসংস্কার, অজ্ঞানতা এবং খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা প্রয়োজন। পাশাপাশি গ্রামীণ অবকাঠামো উন্নয়ন এবং জনগণকে উন্নয়ন কাঠামোয় সম্পৃক্ত করতে হলে তাদের সচেতন করতে হবে। এজন্যও বিশেষ উদ্যোগ পিকেএসএফ গ্রহণ করেছে। জলবায়ু পরিবর্তন বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। এ ব্যাপারে ড. কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ দেশবাসীকে সজাগ করতে বিভিন্ন ফোরামে নিরলস প্রয়াস গ্রহণ করেছেন। পিকেএসএফের সমাপনী দিনে একটি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হয়। এতে শাহ আব্দুল করিম, হাছন রাজা ও ভাওয়াইয়া গান এবং নৃত্য, উপজাতীয় নৃত্য ও চট্টগ্রামের আঞ্চলিক গান, গম্ভীরা, লালনগীতি, কবিগান প্রভৃতি পরিবেশন করা হয়। মানুষের সুস্থ বিনোদন যেমন শারীরিক সুস্থতার জন্য প্রয়োজন, তেমনি উন্নয়ন কর্মকা-কে দেশের সংস্কৃতি ও কৃষ্টির মাধ্যমে ছড়িয়ে দেয়ার কোন বিকল্প নেই। ড. কাজী খলীকুজ্জমান আহমদের সুযোগ্য নেতৃত্বগুণে পিকেএসএফ একটি জবাবদিহিমূলক ও ন্যায়পরায়ণ সংস্থা হিসেবে মানবকল্যাণ এবং সামাজিক দায়িত্ব পালন করে চলেছেন। লেখক : অধ্যাপক, ম্যাক্রো ও ফিন্যান্সিয়্যাল ইকোনমিস্ট। ই-মেইল : [email protected]
×