ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

উখিয়ায় পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে আরেক পাচারকারী নিহত

প্রকাশিত: ০৫:৩৯, ১১ মে ২০১৫

উখিয়ায় পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে আরেক পাচারকারী  নিহত

চট্টগ্রাম অফিস/কক্সবাজার ও উখিয়া প্রতিনিধি ॥ রবিবার ভোর রাতে উখিয়ার উপকূলীয় জালিয়া পালং এলাকায় গোয়েন্দা পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে আরেক মানব পাচারকারী প্রাণ হারিয়েছে। এ ঘটনায় গুলিবিদ্ধ হয়েছে দুই পুলিশও। ঘটনাস্থল থেকে উদ্ধার করা হয়েছে একটি দেশীয় বন্দুক ও ৫ রাউন্ড কার্তুজ। নিহত মানব পাচারকারীর নাম জাফর আলম (৩৮)। স্থানীয়ভাবে জাফর আলম লেইট্যা মাঝি নামে পরিচিত। গুলিবিদ্ধ দুই পুলিশ সদস্যকে কক্সবাজার সদর হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। এর আগে গত শুক্রবার ভোরে টেকনাফে পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে মানব পাচারকারী হিসেবে চিহ্নিত ধলু হোসেন প্রকাশ ধলু মাঝি, দালাল জাহাঙ্গীর আলম ও জাফর আলম নিহত হয়। এছাড়া গত শনিবার ভোরে চকরিয়া লামা সড়কে কুমারি ব্রিজ সংলগ্ন এলাকায় পুলিশের সঙ্গে গুলিবিনিময়ে নিহত হয়েছে খোরশেদ আলম। সে একদিকে যেমন ডাকাতির সঙ্গে জড়িত, তেমনি মানব পাচারেও যুক্ত। এ নিয়ে পুলিশের সঙ্গে গুলিবিনিময়ের ঘটনায় ৫ মানব পাচারকারী প্রাণ হারাল। এদিকে দেশের ইয়াবা কিং হিসেবে পরিচিত কক্সবাজারের উখিয়া-টেকনাফ এলাকার সরকারদলীয় সংসদ সদস্য আবদুর রহমান বদি এবার সমুদ্রপথে মানব পাচারে জড়িত গডফাদারদের মধ্যে শীর্ষ তালিকায় স্থান পেয়েছেন। কক্সবাজার জেলা পুলিশ শুধু টেকনাফে মানব পাচারে জড়িত ৩১ গডফাদার এবং ৪৮ দালালের যে তালিকা প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে প্রেরণ করেছে তা ইতোমধ্যে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দফতর ঘুরে পুলিশ সদর দফতরে পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য রয়েছে। উল্লেখ্য, ইতোমধ্যে জ্ঞাত আয়বহির্ভূত অর্থের মালিক হওয়ার দায়ে বদির বিরুদ্ধে ইতোমধ্যে দুদক চার্জশীট প্রদান করেছে। পুলিশের প্রদত্ত রিপোর্টে কক্সবাজার অঞ্চলে ইয়াবা পাচার বদির ছত্রছায়ায় হয়ে থাকে বলে উল্লেখ রয়েছে। এছাড়া মানব পাচারে গডফাদারদের তালিকায় তার নাম রয়েছে এক নম্বরে। প্রসঙ্গত, কক্সবাজার পুলিশ সাগর পথে মানব পাচারের সঙ্গে জড়িত যে ৭৯ জনের তালিকা প্রণয়ন করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে প্রেরণ করেছে তার মধ্যে গডফাদারের সংখ্যা ৩১। অবশিষ্ট ৪৮ জন দালাল। এরা সকলেই টেকনাফ অঞ্চলের। তালিকাভুক্ত ৩১ গডফাদাররা হচ্ছেন আবদুর রহমান বদি এমপি, জাফর আহমদ, মৌলবী মজিবুর রহমান (এমপি বদির ভাই), ধলু হোসেন (বন্দুকযুদ্ধে নিহত), তার সহোদর মোঃ ইউনুস, শাহপরীরদ্বীপ বাজার পাড়া মোঃ ইসমাইল, ডাঙ্গরপাড়া ফিরোজ আহমদ, দেলোয়ার, মাঝেরপাড়ার মোঃ সাহাব মিয়া, মিস্ত্রী পাড়ার মোঃ শরীফ হোসেন, শরীফ হোসেন বুলু, সাবরাংয়ের সাহেদুর রহমান নিপু, বাজারপাড়ার হামিদ হোসেন, মুন্ডার ডেইলের কানা জহির, সামলাপুরের ওলামা লীগ নেতা মৌলবী আজিজ, শাহপরীর দ্বীপের নূর মোহাম্মদ মেম্বার, নূর হাকিম মাঝি, কুন্ডবুনিয়ার মৌলবী রশিদ, কচুবুনিয়ার নজির আহমদ, আবদুল হামিদ, গুরা মিয়া, মোঃ কাশেম, মোঃ ইসলাম ওরফে বাগু, রোহিঙ্গা হেফজ রহমান, আমান উল্লাহ ওরফে আনু, লেদার নুরুল হুদা ও নুরুল কবির। এছাড়া ৪৮ লিস্টেড দালালরা হচ্ছে- টেকনাফের বেলাল উদ্দিন, (বন্দুকযুদ্ধে নিহত ধলু হোছনের পুত্র) নূর হোসেন, নুরুল আলম, এনায়েত উল্লাহ, মোঃ সেলিম, মোঃ হোসেন, জাফর আহমদ, মোঃ শফিক, আবু তাহের, মোঃ জাফর, আলী মাঝি, সামসুল আলম, মোঃ সাব্বির আহমদ, মোঃ কামাল হোসেন, মোঃ হাসান, মোঃ কবির হোসেন, আবুল কালাম, মোঃ কবির হোসেন, সাদ্দাম, মোঃ শরীফ, মোঃ লিটন, মোঃ আবুল হাসেম, মোঃ দলিল আহমদ, সিদ্দিক আহমদ, ফয়েজ, নুরুল ইসলাম ওরফে কালা পুতু, জাহাঙ্গীর, মীর আহমদ, মোঃ শাকের মাঝি, নুরু মাঝি, হাফেজ মোক্তার, মোঃ সৈয়দ আলম, আব্দুর রহিম, আলী আহমদ ওরফে আলী বলী, নুরুল ইসলাম মাঝি, আইয়ুব আলী মাঝি, আল মাসুদ, জাহাঙ্গীর, সোহাগ আবদুল্লাহ, কবির ওরফে ডাঃ কবির, নয়াপাড়া ক্যাম্পের রোহিঙ্গা মোঃ আলম ওরফে মাত আলম, এনায়েত উল্লাহ, শামসুল আলম, আবদুস সালাম ওরফে আবদু কো¤পানি, ও আজিজুল ইসলাম ওরফে পুতুইয়া। মামলা হলেও দ-িত হয়নি কেউ ॥ কক্সবাজার অঞ্চলে মানব পাচারের ঘটনা নিয়ে মামলার সংখ্যা তিন শতাধিক। এসব মামলায় আসামির সংখ্যা দেড় সহস্রাধিক। এর মধ্যে ১৬৬ মামলার চার্জশীট হওয়ার পর বিচারে ১৪ মামলার সব আসামি খালাস পেয়েছে। কক্সবাজার আদালতের আইনজীবীদের বিভিন্ন সূত্রে জানানো হয়েছে, এ সংক্রান্ত মামলায় পুলিশের বড় ধরনের গাফিলতি রয়েছে। যে কারণে আইনের ফাঁক ফোকরে এরা খালাস পেয়ে গেছে এবং ভবিষ্যতেও যাবে। এছাড়া এসব মামলায় সাধারণ মানুষ কেউ সাক্ষী দেয় না। পুলিশ সাক্ষী করলেও তারা আসে না। আবার যারা আসে তারা সঠিক সাক্ষী দেয় না। ফলে এ পর্যন্ত আদালত সুনির্দিষ্টভাবে কাউকে দ-াদেশ দিতে পারেননি। থাই ও মালয়েশিয়া কারাগারে সহস্রাধিক বাংলাদেশী ॥ এদিকে অব্যাহত মানব পাচারের ঘটনায় থাইল্যান্ড ও মালয়েশিয়ায় পুলিশের হাতে ধরা পড়ে সে সব দেশের কারাগারে অবর্ণনীয় দুঃখ দুর্দশায় জীবন কাটাচ্ছে সহস্রাধিক বাংলাদেশী যুবক। কক্সবাজারে মানব পাচার প্রতিরোধ কমিটির আহ্বায়ক ও এনজিও সংস্থা হেল্প-এর নির্বাহী পরিচালক এমএ কাশেম রবিবার জনকণ্ঠকে জানিয়েছেন, এ দুদেশের কারাগারে বন্দী এসব বাংলাদেশীরা দালালদের খপ্পরে পড়ে সমুদ্রপথে মালয়েশিয়ার উদ্দেশে পাড়ি জমিয়েছিল। থাইল্যান্ড ও মালয়েশিয়ায় যারা পুলিশের হাতে ধরা পড়েছে তারা কারাগারে গিয়ে প্রাণে বেঁচেছে। আর যারা দালালদের নিয়ন্ত্রণে থেকে বন্দী শিবিরে স্থান পেয়েছে নির্মম নির্যাতনের শিকার হয়ে এদের অনেকে প্রাণ হারিয়ে গণকবরে হয়েছে তাদের শেষ ঠিকানা। এ ঘটনা ফাঁস হওয়ার পর থাইল্যান্ডে গত ১ মে থেকে পুলিশ ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের জোরালো অভিযান অব্যাহত রয়েছে। যে কারণে ইতোমধ্যে একে একে আবিষ্কার হচ্ছে বন্দী শিবির ও গণকবর। উখিয়া-টেকনাফের শতাধিক মানব পাচারকারীর গা ঢাকা ॥ কক্সবাজার অঞ্চলে মানব পাচার কাজে জড়িত গডফাদার ও দালালদের বিরুদ্ধে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সর্বাত্মক অভিযান শুরু হওয়ার পর চিহ্নিত শতাধিক পাচারকারী গা ঢাকা দিয়েছে। মানব পাচার প্রতিরোধ কমিটির নেতৃবৃন্দদের দাবি, এসব মানব পাচারকারীদের আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রদান করা না হলে উপকূলে মানব পাচার প্রতিরোধ করা সম্ভব হবে না। র‌্যাব-পুলিশসহ বিভিন্ন আইন প্রয়োগকারী সংস্থার লোকজন উখিয়া-টেকনাফের গ্রামাঞ্চলে ছদ্মবেশে ব্যাপক তৎপরতা শুরু করেছে। উখিয়ার কুতুপালং ও শরণার্থী ক্যাম্প ভিত্তিক চক্র, রাজাপালং, উপকূলীয় জালিয়াপালংসহ বিভিন্ন স্থানে, টেকনাফের শাহপরীরদ্বীপ, সাবরাং, টেকনাফ পৌরসভা, সদর ইউনিয়ন, হ্নীলা ও হোয়াইক্যং ইউনিয়নের চিহ্নিত দালালরা এখন এলাকায় নেই। এসব মানব পাচারকারী দালাল কেউ মিয়ানমারে আবার কেউ দেশের অভ্যন্তরে বিভিন্ন স্থানে পাড়ি জমিয়েছে বলে স্থানীয় বিভিন্ন সূত্রে বলা হচ্ছে। স্থানীয় বিভিন্ন সূত্রে জানানো হয়েছে, উপকূলের ৮০ শতাংশ পরিবারের কেউ না কেউ সাগরপথে মালয়েশিয়ার উদ্দেশে পাচার হয়েছে। এসব পাচারের পেছনে রয়েছে স্থানীয় কতিপয় জনপ্রতিনিধি, রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দসহ মোড়ল শ্রেণীর গুটি কয়েক পেশাদার দুর্বৃত্ত। তাদের অনৈতিক কর্মকা-ের খেসারত দিতে গিয়ে শত শত স্বজনহারা পরিবারের আর্তনাদে এলাকার পরিবেশ ভারি হয়ে উঠেছে। মানব পাচার প্রতিরোধ কমিটির আহ্বায়ক ও এনজিও সংস্থা হেলপ্ কক্সবাজারের নির্বাহী পরিচালক এমএ কাশেম জানিয়েছেন, এ পর্যন্ত থাইল্যান্ড কারাগারে আটক, নিখোঁজ ও মুক্তিপণের জন্য দালালের হাতে আটক রয়েছে এমন শতাধিক অভিযোগ তারা সরেজমিন তদন্ত করে ক্ষতিগ্রস্ত ৩০টি পরিবারের মধ্যে আর্থিক অনুদান প্রদান করেছেন। এদিকে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের একটি চিঠির বরাত দিয়ে কক্সবাজার জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে সচেতনতা বৃদ্ধিকল্পে পাচারের শিকার হওয়া ব্যক্তিদের দুঃখ দুর্দশা নিয়ে আরও অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রচার করার জন্য গণমাধ্যমের প্রতি অনুরোধ করা হয়েছে। উখিয়ায় দেড় কোটি টাকার ইয়াবাসহ গ্রেফতার ৫ ॥ কক্সবাজার টেকনাফ সড়কের মরিচ্যা এলাকায় আটক হয়েছে প্রায় দেড় কোটি টাকা মূল্যের মাদক ইয়াবার একটি চালান। এ ঘটনায় গ্রেফতার হয়েছে ৫ জন। শনিবার রাতে টেকনাফ থেকে ছেড়ে আসা একটি বাস মরিচ্যা চেকপোস্টে আসার পর বিজিবি সদস্যরা গোপন সূত্রের খবর অনুযায়ী অভিযান চালালে বেরিয়ে আসে ৪৪ হাজার পিসের ইয়াবার চালান। ১৭ বিজিবি দফতরের জনসম্পদ কর্মকর্তা মোঃ মহসিন রেজা সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, এ ঘটনায় গ্রেফতার হয়েছে পাচারকারী টেকনাফের সাবরাং ইউনিয়নের সাজিরা খাতুন, তার পুত্র মোঃ ইসমাইল এবং একই এলাকার জান্নাত বিবিসহ ৫ জন। ইয়াবার এ চালানটি যাত্রীবাহী বাসটির নিচে সংযুক্ত একটি বাক্সের মধ্যে অত্যন্ত কৌশলে লুকিয়ে পাচার করা হচ্ছিল।
×