ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

ভূমিদস্যুদের দখলে ময়মনসিংহ রেলের জমি

প্রকাশিত: ০৬:০১, ১০ মে ২০১৫

ভূমিদস্যুদের দখলে ময়মনসিংহ রেলের জমি

বাবুল হোসেন, ময়মনসিংহ থেকে ॥ নানা অব্যবস্থাপনা, লুটপাট, সরকারী জায়গা জবরদখল আর টিকেট কালোবাজারির কারণে নৈরাজ্যের লীলাক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে বাংলাদেশ রেলওয়ের ময়মনসিংহ সেকশন। রেলওয়ের স্থানীয় চিহ্নিত কিছু কর্মকর্তা ও কর্মচারীসহ ক্ষমতাসীন দলের কতিপয় শ্রমিক নেতার অনিয়ম ও দুর্নীতির কারণে ডুবতে বসেছে ময়মনসিংহ রেলওয়ে। প্রতিবছর মোটা অঙ্কের রাজস্ব আয় হলেও যাত্রী সেবার মান সর্বনিম্ন পর্যায়ে পৌঁছেছে। ময়মনসিংহ রেলওয়ে স্টেশনে আন্তনগর ট্রেনের টিকেট কালোবাজারি এখন ওপেন সিক্রেট। ধরাধরি আর বাড়তি টাকা ছাড়া মেলে না আন্তনগরের কোন টিকেট। স্টেশন ইয়ার্ড ও প্ল্যাটফরমের ভেতরে বাইরে ভোরে ও সন্ধ্যার পর নেশাখোর পকেটমার ও পেশাদার ছিনতাইকারীদের দাপটের কাছে জিম্মি হয়ে পড়ছে ট্রেনযাত্রীরা। রেলওয়ের পরিত্যক্ত ও ড্যামেজ ঘোষিত আবাসিক বাসাবাড়ি জবরদখল করে স্থানীয় শ্রমিক নেতাদের শেল্টারে বসবাস করছে স্থানীয় গু-া মাস্তান ও বহিরাগত নানা শ্রেণী পেশার মানুষ। এসব জবরদখলকারীদের মাস শেষে রেলওয়েকে কোন ভাড়া দিতে না হলেও বিদ্যুত ও পানি ব্যবহারের জন্য রেলওয়েকে প্রতিমাসে গুনতে হয় কয়েক লাখ টাকার বিদ্যুত ও পানির বিল। রেলওয়ের সরকারী জায়গা-জমি জবরদখল ও বেদখল করে একটি মহল বাণিজ্যিক মার্কেট, দোকানপাট, হোটেল রেস্তরাঁ, কারখানা ও গ্যারেজ নির্মাণ করে ভাড়া দিয়ে প্রতিমাসে হাতিয়ে নিচ্ছে অর্ধ কোটি টাকার ওপরে। অভিযোগ রয়েছে রেলওয়ের স্থানীয় সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা অনিয়ম দুর্নীতির আশ্রয় নিয়ে এবং অবৈধ সুবিধা দেয়ার বিনিময়ে মোটা অঙ্কের টাকায় নিজেদের পকেট ভারি করছে। ফলে এতোসব অব্যবস্থাপনার ব্যাপারে কখনও কার্যকর ও দৃশ্যমান কোন পদক্ষেপ নিতে দেখা যায়নি কর্তৃপক্ষকে। অভিযোগ রয়েছে স্টেশনে একজন উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তার যোগদানের পর থেকে নানা অনিয়ম দুর্নীতি আর লুটপাটের আঁখড়ায় পরিণত হয়েছে ময়মনসিংহ রেলওয়ে স্টেশন। অভিযোগ স্বীকার করে এই কর্মকর্তা এর দায় চাপান ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের স্থানীয় কতিপয় নেতা কর্মী, প্রশাসনের কর্মকর্তা ও শ্রমিক নেতাদের ওপর। নানা মহলের চাপে কিছুটা অনিয়মের আশ্রয় নিতে হচ্ছে দাবি এই দাপুটে কর্মকর্তার। পকেটমার ও ছিনতাইকারীদের দৌরাত্ম্যে অতিষ্ঠ ট্রেনযাত্রীরা ॥ সংঘবদ্ধ পকেটমার, পেশাদার ছিনতাইকারী আর নেশাখোরদের দখলে থাকছে ময়মনসিংহ রেলওয়ে স্টেশন। হালে হিজড়াদের দৌরাত্ম্যে অতিষ্ঠ ট্রেন যাত্রীরা। কমছে না ভুয়া টিটি ও টিসিদের উৎপাত। স্টেশন চত্বরে ও প্ল্যাটফরমে অবৈধ দোকানপাটের ছড়াছড়ি। হকারদের দৌরাত্ম্যে অতিষ্ঠ অপেক্ষমাণ যাত্রীরা। গোটা প্ল্যাটফরম ও স্টেশন চত্বরের নোংরা পরিবেশ প্রতিনিয়ত উৎকট দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। সবকিছু মিলিয়ে শতাধিক বছরের ঐতিহ্যবাহী এই ময়মনসিংহ রেলস্টেশন পরিণত হয়েছে এক অরাজকতার আঁখড়ায়। অথচ এসব দেখার কেউ নেই। জানা যায়, ময়মনসিংহ রেলওয়ে স্টেশন প্রতিষ্ঠিত হয় গত ১৮৮৬ সালে। ১২৯ বছরের পুরনো প্রথম শ্রেণীর এই রেলস্টেশন থেকে এখন আন্তঃনগর, মেইল ও লোকালসহ প্রতিদিন ৪২টি ট্রেন নিয়মিত যাতায়াত করছে। এর বাইরে মালবাহী ও স্পেশাল ট্রেন তো আছেই। রেলওয়ের হিসেবে প্রতিমাসে গড়ে এক লাখ ১০ হাজার যাত্রী ময়মনসিংহ থেকে বিভিন্ন গন্তব্যে যাচ্ছে। এই হিসেবে প্রতিদিন ৩ হাজারের বেশি যাত্রী ময়মনসিংহ থেকে ট্রেনে উঠছে। গত ২০০৮-০৯ অর্থবছরে ময়মনসিংহ রেলওয়ে টিকেট বিক্রি থেকে আয় করে ২ কোটি ৮৫ লাখ টাকার ওপরে। আর গত ২০০৯-১০ অর্থবছরে এই আয় ছিল ৩ কোটি ১১ লাখ টাকার ওপরে। চলতি বছরের গত চার মাসেই টিকেট বিক্রি ও মালামাল পরিবহন বাবদ এই আয় হয়েছে প্রায় ৪ কোটি টাকা! প্রতিবছর উল্লেখযোগ্য হারে রাজস্ব আয় বৃদ্ধির পরও একটি নয়া ভবন নির্মাণ ছাড়া যাত্রী সেবার কাক্সিক্ষত কোন পরিবর্তন হয়নি স্টেশনটির। উল্টো রেলকর্মচারী ও পেশাদার অপরাধীদের স্বর্গরাজ্যে পরিণত হয়েছে স্টেশনটি। হাজারো সমস্যা আর যাত্রী হয়রানিসহ স্টেশনটি পকেটমার, ছিনতাইকারী, অজ্ঞানপার্টি আর নেশাখোরদের নিরাপদ আশ্রয়স্থল হিসাবে ব্যবহৃত হচ্ছে। ভুক্তভোগী যাত্রীদের অভিযোগ, আরএনবি, ময়মনসিংহ রেলওয়ে থানা পুলিশ, আনসার ও স্টেশন কর্তৃপক্ষের ছত্রছায়াতেই চলছে সবকিছু। যাত্রীবাহী কোন ট্রেন স্টেশনে পৌঁছামাত্র একশ্রেণীর ভুয়া টিটি ও টিসি টিকেট কালেক্ট করার নামে টিকেটবিহীন যাত্রীদের কাছ থেকে প্রকাশ্য টাকা হাতিয়ে পকেট ভারি করছে। এ নিয়ে প্রায়ই ঘটছে নানা অপ্রীতিকর ঘটনা। স্টেশনে শতাধিক ফেরিওয়ালার কাছ থেকে ৫-১০ টাকা হারে টোল আদায় করছে স্থানীয় কিছু মাস্তান। কোন ফেরিওয়ালা এই টোল আদায়ের প্রতিবাদ করলে কেড়ে নেয়া হয় তার দাঁড়িপাল্লা ও বাটখাড়া। স্টেশনে প্রতিদিন গড়ে ৫শ’ হকার ঢুকছে প্লাটফরমে। অভিযোগ খোদ স্টেশনের উচ্চ কর্মকর্তা এসব হকার ও ফেরিওয়ালার নিয়ন্ত্রক। অধিকাংশ সময় ওয়েটিংরুম দখলে রাখছে যাত্রীবেশের দুর্বৃত্তরা। যাত্রীদের অভিযোগ, ময়মনসিংহ রেলওয়ে স্টেশন এখন পেশাদার পকেটমার, অজ্ঞানপার্টি ও মাদক ব্যবসায়ীদের ট্রানজিট পয়েন্ট হিসাবে ব্যবহৃত হচ্ছে। রেলকর্মচারী পরিচয়ে স্টেশনে প্রতিদিন প্রকাশ্য চাঁদাবাজি চলছে। অভিযোগ, পেশাদার মাস্তান ও দুর্বৃত্তরা স্টেশন চত্বর ও প্ল্যাটফরমের অবৈধ দোকান মালিকদের ছত্রছায়ায় নানা অপর্কম চালিয়ে যাচ্ছে। এসব দোকানির সঙ্গে অজ্ঞানপার্টি, ছিনতাইকারী, পকেটমার ও মাদক ব্যবসায়ীদের আঁতাতেরও অভিযোগ করেন ক্ষমতাসীন দলের স্থানীয় নেতা ও ওয়ার্ড কাউন্সিলর শরাফ উদ্দিন। প্রতিবাদ করতে গেলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর উল্টো হয়রানির শিকার হতে হয় বলে জানান তিনি। স্থানীয় প্রত্যক্ষদর্শী যাত্রীদের অভিযোগ, রেল স্টেশনের ও মালগুদামের ওভার ব্রিজ রাত দিন হেরোইনসেবী নেশাখোররা দখলে রাখছে। এছাড়া স্টেশনের ক্যারেজ ডিপো ও সংলগ্ন মোড় আড্ডায় জমজমাট করে রাখছে হেরোইনসেবীরা। স্টেশনের ৩, ৪ ও ৬ নম্বর প্ল্যাটফরম দখলে রাখছে সংঘবদ্ধ ছিনতাইকারী ও যৌনকর্মীরা। রাতের বেলায় অবাধ বিচরণ করছে ভাসমান যৌনকর্মীরা। ময়মনসিংহ রেলওয়ের শ্রমিকলীগের যুগ্ম আহ্বায়ক শওকত উজ্জামান শাহীন অভিযোগ করে জানান, স্থানীয় ও বহিরাগতদের ৮-১২ ও ১৫-২০ বছরের দুইটি আলাদা গ্রুপের ছিচকে চোর, পকেটমার ও ছিনতাইকারী চক্র ট্রেন যাত্রীদের দাবড়িয়ে বেড়াচ্ছে স্টেশন এলাকায়। এদের মধ্যে মহিলা সদস্যও রয়েছে। ময়মনসিংহ রেলওয়ে স্টেশনের এক নেশাখোর মাতাল কর্মকর্তার বিরুদ্ধে এসব অপরাধীদের সহায়তার অভিযোগ রয়েছে। শহরের বাউন্ডারি রোডের বাসিন্দা আব্দুল হামিদ অভিযোগ করে জানান, ভোরের দিকে আন্তঃনগর কমিউটার ট্রেনে উঠার পর পরই অনেক যাত্রীর মোবাইল ও মানিব্যাগ খোয়া যাচ্ছে। সন্ধ্যার পর কেউ প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে একটু অন্ধকারে গেলেই ঝাপটে ধরছে ছিনতাইকারীর দল। কেড়ে নিচ্ছে সবকিছু। ভুক্তভোগীদের অভিযোগ এসব নিয়ে নালিশ করতে গেলে উল্টো হয়রানির শিকার হতে হয়। শহরের বাঘমারা রোডের গৃহবধূ আলপনার অভিযোগ, ভিড় ঠেলে আন্তঃনগর ব্রহ্মপুত্র ট্রেনে ওঠার পরই দেখেন তার পার্টসের ভেতর রাখা মোবাইল ফোন খোয়া গেছে। ময়মনসিংহ রেলওয়ে স্টেশন ইয়ার্ডের সীমানা প্রাচীর না থাকায় অরক্ষিত থাকছে রেলওয়ের মূল্যবান সম্পদ। শহরের বাঘমারা ও পুরহিতপাড়া এলাকার অনেক স্থানে সীমানা প্রাচীরের ভাঙ্গা অংশ দিয়ে দিনে দুপুরে রেলওয়ের মালামাল পাচারের অভিযোগ রয়েছে। স্থানীয় ভাংগারি দোকানগুলো এর প্রধান ক্রেতা। রেলওয়ের নিরাপত্তা চৌকি (আরএনবি) এ ব্যাপারে কার্যকর কোন ব্যবস্থাই নিতে পারছে না। এ ব্যাপারে আরএনবির স্থানীয় ইনচার্জ ফিরোজ আলীর সঙ্গে মোবাইল ফোনে জানতে চাইলে ‘ব্যস্ত আছেন’ বলে ফোন কেটে দেন। রেলওয়ের স্থানীয় শ্রমিক নেতা আবুল খায়ের চৌধুরী ময়মনসিংহ রেলস্টেশনের এসব নানা অব্যবস্থাপনায় যাত্রীসেবার মান কমে যাওয়ায় উদ্বেগ প্রকাশ করে জানান, রেলওয়ের স্থানীয় কর্তৃপক্ষ এর দায় এড়াতে পারে না। এতসব অভিযোগ অস্বীকার ও জনবল সঙ্কটের কথা উল্লেখ করে ময়মনসিংহ রেলওয়ে থানার অফিসার ইনচার্জ আব্দুল আহাদ খান জনকণ্ঠকে জানান, একসময় পেশাদার অপরাধীদের আঁখড়া থাকলেও এখন এসবের কিছুই নেই। তবে জয়দেবপুর, টঙ্গী, এয়ারপোর্ট, জামালপুর ও দেওয়ানগঞ্জসহ বাইরের এলাকা থেকে কিছু পকেটমার ও চোর ছিনতাইকারী মাঝেমধ্যে ময়মনসিংহে হানা দেয়ার সময় ধরা পড়ছে বলে দাবি এই কর্মকর্তার। বর্তমানে স্টেশন এলাকার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রয়েছে দাবি করে তিনি জানান প্রয়োজনীয় সংখ্যক ফোর্স পেলে রেলওয়ের ৯৫ ভাগ অপরাধ কমে আসবে। রেলওয়ের জমি জবরদখলের মহোৎসব ॥ শহরের মালগুদাম এলাকায় রেলওয়ের জমি জবরদখল করে নির্মাণ করা হয়েছে বাণিজ্যিক মার্কেট, দোকানপাট, জুতো ও সেলাই কারখানা, বাসাবাড়ি ও বিভিন্ন অফিস। শহরের ব্রাহ্মপল্লী এলাকায় রেলওয়ের জমি দখল করে করা হয়েছে মার্কেট, ফার্নিচারের দোকান। রেলস্টেশনে ঢোকার পথে জমি দখল করে রাতারাতি নির্মাণ করা হয়েছে হোটেল, রেস্তরাঁ, গ্যারেজ, সমিতি, পত্রিকার অফিস ও দোকানপাট। শহরের মিন্টু কলেজ, সানকিপাড়া ও কেওয়াটখালি লেভেল ক্রসিং ও রেললাইনের ওপর গড়ে উঠেছে কাঁচাবাজার। এভাবে এক শ্রেণীর প্রভাবশালী ভূমিদস্যু ময়মনসিংহ রেলওয়ের কয়েকশ’ কোটি টাকার সম্পত্তি জবরদখল করে রেখেছে। স্থানীয় সূত্রগুলোর অভিযোগ, শহরের মালগুদাম এলাকায় রেলওয়ের জমি জবরদখল করে বাণিজ্যিক মার্কেটসহ বাসাবাড়ি নির্মাণ করেছে স্থানীয় কয়েক প্রভাবশালী ভূমিদস্যু। লিজের শর্ত ভঙ্গ করে এই ভূমিদস্যু গত দুই দশক ধরে রেলওয়ের সরকারী জমি জবরদখলে রেখে দাপটের সঙ্গে ব্যবসা চালিয়ে আসছে বলে অভিযোগ স্থানীয়দের। একই এলাকায় এক রেলকর্মচারী রেলওয়ের জমি দখল করে নির্মাণ করেছে বাণিজ্যিক দোকানপাট, সেলাই কারখানা ও বাসাবাড়ি। নামে বেনামে অনেকে গড়ে তুলেছে জুতো ও সেলাই কারখানা, পাকা দোকানপাটসহ নানা স্থাপনা। রয়েছে রাজনৈতিক দলের অফিস। স্টেশনের সামনে কেউ কেউ রেলওয়ের জায়গা জবরদখল করে হোটেল রেস্তরাঁ ও গ্যারেজ নির্মাণ করে ভাড়া খাচ্ছেন। জেলা সমিতি ও নামসর্বস্ব আন্ডারগ্রাউন্ড পত্রিকার সাইনবোর্ড ঝুলিয়েও জবরদখল করা হয়েছে। রেলস্টেশনের সিগন্যাল রুমের পেছনে নির্মাণ করা হয়েছে পাকা দোকান। একই এলাকায় কয়েকজন মিলে রেলওয়ের জমি জবরদখল করে ভাড়া দিয়েছে। শহরের ব্রাহ্মপল্লী এলাকায় রেলওয়ের জমিতে নির্মাণ করা হয়েছে পাকা মার্কেট। ব্রাহ্মপল্লীতে রেলওয়ের জমি জবরদখল করে নির্মাণ করা হয়েছে স্থায়ী বাড়ি। শহরের মিন্টু কলেজ, সানকিপাড়া ও কেওয়াটখালি লেভেল ক্রসিং ও রেললাইনের ওপর প্রতিদিন ঝুঁকি নিয়ে বসছে কয়েকশ’ কাঁচাবাজার। রেললাইনের দুই পাশে ঝুপড়ি ঘর ও দোকানপাট নির্মাণ করে ভাড়া দিয়ে প্রভাবশালী মহল মোটা অঙ্কের টাকা খাচ্ছে। শহরের ভৈরব লেভেল ক্রসিং থেকে পাটগুদাম মোড়ের দুইপাশের জায়গায় গড়ে তোলা হয়েছে প্রায় অর্ধশত দোকানপাট। বাঘমারা মেডিক্যাল গেট এলাকাতেও রেলওয়ের জায়গায় নির্মাণ করা হয়েছে অর্ধশত পাকা দোকানপাট ও মার্কেট। ময়মনসিংহে এভাবে বারোভূতে লুটেপুটে খাচ্ছে এখন রেলওয়ের সরকারী জমি। রেল কোয়ার্টারে অবৈধ বিদ্যুত সংযোগ ॥ বাসা নম্বর টি/২। শহরের পাটগুদাম রেলওয়ের নিউ কলোনির ডাবল সাইজের এই বাসার ক ও খ পাশে বছরের পর বছর ধরে বাস করছে দুইটি পরিবার। এর মধ্যে ক পাশের দুই রুম দখল করে গত দুই বছর ধরে পরিবারের সাত সদস্য নিয়ে থাকছেন রেলওয়ের অবসরে যাওয়া ট্রেন চালক ইউসুফ। ইউসুফের দাবি, বাসাটি খালি ছিল। মেরামত করে তিনি বসবাস করছেন। বাসার দরজা জানালা লাগিয়েছেন। পাশের খালি জায়গায় ইটের গাঁথুনি দিয়ে নির্মাণ করছেন আলাদা কক্ষ। বাসার খ পাশে গত এক দশক ধরে বিনা ভাড়ায় থাকছেন জয়নাল ও স্ত্রী মেরিনার পরিবার। সামনের ফাঁকা জায়গায় টিনশেডের আলাদা দুইটি ঘর তোলে থাকছেন জয়নালের অপর দুই সহোদরের পরিবার। একই কলোনির টি/৩ নম্বর বাসায় গত ছয় বছর ধরে বিনা ভাড়ায় আছেন রেলকর্মচারী ফকির আলমের পুত্রবধূ দোলনা ও স্বামী রিপন। এই বাসার পাশেই দখলদারের কাছ থেকে নগদ ২০ হাজার টাকায় কেনা জায়গায় নতুন টিনশেডের ঘর করে বাস করছেন ময়মনসিংহ সদরের বাঘাডোবা গ্রামের কাজল মিয়া ও নজরুল ইসলাম। স্থানীয় প্রভাবশালী গু-া মাস্তান এদের কাছ থেকে প্রতিমাসে ভাড়া খাচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে। এভাবে রেলকর্মচারী ও স্থানীয় প্রভাবশালী বহিরাগতরা রেলওয়ের নিউ কলোনির সরকারী বাসা জবরদখল করে ভাড়া দিয়ে বছরে অন্তত ১২ লাখ টাকা কামিয়ে নিচ্ছে। অথচ রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ এসব বাসার বিপরীতে মাসিক কোন ভাড়াই পাচ্ছে না। উল্টো এসব বাসাবাড়িতে বিদ্যুত ও পানির সংযোগ থাকায় রেলওয়েকে প্রতিমাসে কয়েক লাখ টাকার বিদ্যুত ও পানির বিল পরিশোধ করতে হচ্ছে। খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, ড্যামেজ বলে পরিত্যক্ত ঘোষিত এসব প্রতিটি বাসায় ফ্রিজ, টিভি, ফ্যান, বাতি ও পানি তোলার বৈদ্যুতিক মোটরসহ ১৫শ’ ওয়াটের একাধিক হিটার ব্যবহার করা হচ্ছে রান্নার কাজে। আন্তঃনগর ট্রেনের টিকেট কালোবাজারে ॥ ঢাকায় বাস করেন, ময়মনসিংহে কর্মরত বেসরকারী একটি ব্যাংকের প্রধান সপ্তাহ শেষে ঢাকায় যাতায়াত করেন ট্রেনে। প্রথমদিকে অফিসের পিয়নকে ট্রেনের টিকেটের জন্য লাইনে দাঁড় করাতেন। তারপরও কখনও ভাগ্যে জুটেনি আন্তঃনগর ট্রেনের কোন টিকেট। শেষ পর্যন্ত সংঘবদ্ধ কালোবাজারিদের সন্ধান করে নিশ্চিত করেন নিয়মিত যাতায়াতের টিকেট। এজন্য প্রতিবার তাকে বাড়তি গুনতে হচ্ছে ৫০-১০০ টাকা। র‌্যাব ও স্থানীয় প্রশাসনের একাধিকবার ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযানে ট্রেনের টিকেট ও টাকাসহ হাতেনাতে আটক হয় চিহ্নিত কালোবাজারি চক্রের সদস্য ও ময়মনসিংহ রেলওয়ে স্টেশনের বুকিং সহকারী। তারপরও বন্ধ হয়নি আন্তঃনগর ট্রেনের টিকেট কালোবাজারি! অভিযোগ রয়েছে ময়মনসিংহ রেলওয়ের স্টেশনের এক উচ্চ কর্মকর্তার সিন্ডিকেট ট্রেনের টিকেট কালোজাজারির সঙ্গে জড়িত। এই অভিযোগ রেলস্টেশন কর্মকর্তা, কর্মচারী, শ্রমিকলীগ নেতৃবৃন্দ ও স্থানীয় ভুক্তভোগী ট্রেন যাত্রীদের। স্থানীয় সূত্র জানায়, ময়মনসিংহ থেকে রাজধানী ঢাকাগামী আন্তঃনগর ট্রেন রয়েছে পাঁচটি। এর মধ্যে ময়মনসিংহ থেকে ঢাকার জন্য আন্তঃনগর তিস্তা এক্সপ্রেসে আসন রয়েছে ১৫৮টি, অগ্নীবিনা ট্রেনে ১০৪টি, ব্রহ্মপুত্র এক্সপ্রেসে ৭০টি, যমুনা এক্সপ্রেসে ১০০টি ও হাওর এক্সপ্রেস ট্রেনে ৭২টি। ময়মনসিংহ থেকে প্রতিদিন গড়ে দুই হাজার ট্রেন যাত্রী ঢাকায় যাচ্ছেন। এসব যাত্রীর বিপরীতে আন্তঃনগর ট্রেনের আসন বরাদ্দ রয়েছে মাত্র ৫০৪টি। যাত্রীর তুলনায় আসন সংখ্যা একেবারেই কম বলে আসন সঙ্কটকে পুঁজি করে ময়মনসিংহ রেলওয়ে স্টেশন গড়ে উঠেছে টিকেট কালোবাজারি চক্রের সিন্ডিকেট। আন্তঃনগর ট্রেনের টিকেটের জন্য যাত্রার দিন ধরে ৫ দিন আগে বেলা ১১টায় কাউন্টার থেকে লাইনের যাত্রীদের কাছে টিকেট বিক্রি করা হয়। একজন যাত্রী সর্বোচ্চ ৪টি টিকেট নিতে পারছেন। ভুক্তভোগী যাত্রীদের অভিযোগ বেশ আগে থেকে লাইনে দাঁড়িয়েও টিকেট মিলছে না। টিকিট বিক্রি শুরুর ৫-১০ মিনিটের ভেতর কাউন্টার থেকে বলা হচ্ছে টিকেট শেষ। এ নিয়ে প্রতিদিনই কাউন্টারের বুকিং সহকারীদের সঙ্গে ট্রেন যাত্রীদের বাগবিত-া হচ্ছে। অভিযোগ যাত্রীরা লাইনে দাঁড়িয়ে টিকেট না পেলেও যাত্রীবেশে চিহ্নিত চেনামুখ কাউন্টার থেকে টিকেট তুলে নিচ্ছে। স্থানীয় নির্ভরযোগ্য সূত্রগুলো জানায়, স্টেশনের উচ্চ কর্মকর্তার সুপারের সহায়তায় বুকিং সহকারীসহ ১৫-২০ জনের একটি চক্র কাউন্টারের ভেতরে বাইরে থেকে আন্তঃনগর ট্রেনের টিকেট তুলে নিচ্ছে। এদের মধ্যে নারী সদস্যসহ কথিত সাংবাদিকও রয়েছে। পরে এসব টিকেট উচ্চ কর্মকর্তার তালিকা মত যাত্রীদের কাছে বাড়তি দামে বিক্রি করা হয়। আন্তঃনগর তিস্তা ও ব্রহ্মপুত্র ট্রেনের টিকেটের চাহিদা বেশি থাকায় কালোবাজারিদের প্রথম টার্গেট থাকে এসব ট্রেনের টিকেট। ময়মনসিংহ থেকে ঢাকার প্রতিটি আন্তঃনগর টিকেটে নির্ধারিত মূল্যের ৫০-১০০ টাকা বাড়তি গুনতে হয় যাত্রীদের। এমন হিসেবে দৈনিক ট্রেনের ৩০০ টিকেট কালোবাজারি বাবদ লেনদেন হচ্ছে ১৫ হাজার টাকা থেকে ৩০ হাজার টাকা। মাসিক এই লেনদেনের অঙ্ক ৫ লাখ টাকা থেকে ১০ লাখ টাকা। প্রচার রয়েছে এর ভাগ যাচ্ছে রেলওয়ের ওপর মহলসহ স্থানীয় নানা মহলে। ময়মনসিংহ রেলওয়ের শ্রমিকলীগের যুগ্ম আহ্বায়ক শওকতউজ্জামান শাহীন ট্রেনের টিকেট কালোবাজারি নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে জানান স্টেশনের উচ্চ পর্যায়ের এক কর্মকর্তার যোগদানের পর থেকেই টিকেট কালোবাজারি সিন্ডিকেটের উদ্ভব। একাধিকবার র‌্যাব ও প্রশাসনের ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযানে গ্রেফতার হওয়া কালোবাজারিদের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করলেই এর প্রমাণ মিলবে বলে দাবি এই শ্রমিকনেতার। ময়মনসিংহ নাগরিক আন্দোলনের সাধারণ সম্পাদক ইঞ্জিনিয়ার নুরুল আমিন কালাম জানান, ময়মনসিংহ রেলস্টেশনে আন্তঃনগর ট্রেনের টিকেট কালোবাজারে বিক্রি ওপেন সিক্রেট! বিক্রির সময় হাতেনাতে ধরা পড়ার পরও প্রভাবশালী জড়িত কর্মকর্তারা বরাবরই থাকছে ধরাছোঁয়ার বাইরে। অভিযুক্ত স্টেশন কর্মকর্তা বিষয়টি স্বীকার করে জানান, স্থানীয় রাজনৈতিক নেতা, প্রশাসনের কর্মকর্তা, শ্রমিকলীগ নেতৃবৃন্দের চাহিদা ও চাপেই কিছু টিকেট ম্যানেজ করতে হচ্ছে। তবে বাড়তি দামে টিকেট বিক্রির অভিযোগ স্বীকার করেননি তিনি। নাম প্রকাশ করা হবে না শর্তে ময়মনসিংহ জেলা প্রশাসনের কর্মকর্তারা জানান, নিজের দায় এড়াতেই এখন এই কর্মকর্তা অন্যের ঘাড়ে দোষ চাপাচ্ছেন।
×