ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

আওয়ামী লীগ জিতলে গণতন্ত্র পরাজিত, আর বিএনপি জিতলে গণতন্ত্রের জয়!

প্রকাশিত: ০৫:৫৪, ১০ মে ২০১৫

আওয়ামী লীগ জিতলে গণতন্ত্র পরাজিত, আর বিএনপি  জিতলে গণতন্ত্রের জয়!

বিএনপি-জামায়াত তো বটেই, এমনকি আওয়ামী নেতা ও বুদ্ধিজীবীসহ সরকার ও প্রশাসনের অনেকের মধ্যেই এখন পর্যন্ত রয়ে গেছে পাকিস্তানী মন-মানসিকতা এবং হেফাজতি মনোভাব। সিটি নির্বাচনসহ চলমান রাজনীতিতেও এর প্রতিফলন ঘটে চলেছে প্রতিনিয়ত। ৯ মে’র পর আজ পড়ুন শেষ কিস্তি এই নির্বাচনের সবচেয়ে নেতিবাচক দিক, জামায়াত-বিএনপির এত ভোট পাওয়া এবং শক্তিশালী মিডিয়ার তাতে সমর্থন। ২০১৩-১৪ সালে এবং ২০১৫ সালে জামায়াত-বিএনপি মানুষ হত্যা, পোড়ানো, অগ্নিসংযোগ, নিরাপত্তা কর্মী হত্যা, ধ্বংসযজ্ঞ, হাজার কোটি টাকার সম্পদ বিনষ্ট করাÑ কী না করেছে। কিন্তু শহরের মানুষ তাদের ভোট দিয়েছে এবং এদের মধ্যে শিক্ষিতজনের সংখ্যা কম নয়। অর্থাৎ হেজাবীদের পক্ষে অন্ধ এবং সচেতন উদ্দেশ্যমূলক একটি সমর্থন দাঁড়িয়ে গেছে, যা বর্তমান রাষ্ট্র ব্যবস্থার বিরোধী। বিএনপি-জামায়াত বা হেজাবীরা পাকিস্তানী মানসের অন্তর্গত, এই একটি বিশেষণই কি তাদের প্রত্যাখ্যান করার জন্য যথেষ্ট নয়? অর্থাৎ গত প্রায় তিন দশক তারা রাজনৈতিকভাবে অনেক মানুষকে জয় করেছে, মানস-জগতে আধিপত্য বিস্তার করেছে। আমার মনে হয়, এতে অনেকে একমত হবেন না যে, ১৪ দল বা আওয়ামী লীগ রাজনৈতিকভাবে জমি হারাচ্ছে অর্থাৎ মানস জগতে তারা বিস্তার করতে পারছে না। কেন পারছে না? কারণ, তাদের মধ্যে অনেককে রাখা হয়েছে, যারা বিভিন্ন কারণে হেজাবীদের দিকে চলে যায়। আমার এ লেখা যখন ছাপা হচ্ছে, তখন হাশেম খান একটি ঘটনার কথা মনে করিয়ে দিলেন। জেনারেল মঈন উদ্দিনের সামরিক শাসনের সময়, পুরো দেশ আতঙ্কে কাঁপছিল। মিডিয়ার বড় অংশ তখন মঈনের বন্ধু। কিংস পার্টিগুলো আত্মপ্রকাশ করছে। আমরা কয়েকজন শুধু লিখছি। তখন স্বদেশ রায় জনকণ্ঠের জন্য একজনের লেখা চাইলেন। তিনি শেখ হাসিনার ঘনিষ্ঠ, অনেক আনুকূল্য প্রদান করেন তাকে। সাহিত্যিক ভদ্রলোক তখন কাগজে কলাম লিখতেন। তিনি বললেন, এখন কী লিখব, দাঁড়ান না, অস্থির হন কেন? অবস্থা কী দাঁড়ায় দেখা যাক। তিনি আর লেখেননি। কিন্তু এখনও তিনি প্রধানমন্ত্রীর অতি ঘনিষ্ঠ ও আনুকূল্য পেয়ে চলছেন। আওয়ামী লীগের অনেকে মনে করেন, ভোটের বাজারে বিএনপি-জামায়াত বা হেজাবীদের খেপানো যাবে না। শেখ হাসিনা স্পষ্ট বলেছেন, আমাদের এতো আকাল পড়েনি যে, জামায়াতকে সঙ্গে নিতে হবে দল করার জন্য। কিন্তু তার দলে ঘোষণা দিয়ে জামায়াতকে নেয়া হয়েছে এবং হচ্ছে। তিনি কি ঠেকাতে পেরেছেন? কয়েক দিন আগে চ্যানেল আইয়ের একটি প্রতিবেদনে দেখা গেল, গাইবান্ধায় ২০১৩-১৪ সালে নাশকতার জন্য ১৪ জন জামায়াতী নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করা হয়েছিল। বিভিন্ন মাদ্রাসার সঙ্গে তারা জড়িত। তারা এখন পলাতক। ঐ সব মাদ্রাসার ম্যানেজিং কমিটিতে আছেন আওয়ামী লীগ নেতারা। স্থানীয় এমপির নির্দেশে ঐ সব কমিটির চেয়ারম্যান/ সদস্যরা ঐ সব পলাতক আসামিদের উপস্থিত দেখিয়ে নিয়মিত বেতন-ভাতা দিচ্ছেন। পারবে আওয়ামী লীগ এ সব জামায়াত সহযোগীদের শাস্তি দিতে? হেজাবীদের তোষামোদ করলে তারা ভোট দেবে, এরকম থিসিস সব সম্ভবের দেশ বাংলাদেশেই সম্ভব। সে কারণে, বা এ বিশ্বাসী সরকারে/দলে হেজাবীদের জন্য সফট কর্নারের লোক আছেন। সংসদীয় রাজনীতিতে সমঝোতা করতে হয়, এটি আমাদের বোঝানোর দরকার নেই। কিন্তু সেই সমঝোতার আবার একটা মাত্রা থাকতে হবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং তার দলের অনেক নেতা জামায়াত-বিএনপিকে সন্ত্রাসী বা সন্ত্রাসীর দল [এ কারণেও মিডিয়া ক্রুদ্ধ। কারণ, এটি ঠিক হলে ব্যাপারটা দাঁড়ায় যে তারা সন্ত্রাসীদের সমর্থন করছে] বলে চিহ্নিত করেছেন। সন্ত্রাসীদের সঙ্গে তারা কী ভাবে সমঝোতা করবেন, সেটিও ভেবে দেখা দরকার। অন্যদিকে, হেজাবীদের বিপক্ষে, আওয়ামী লীগের দুঃসময়ে যারা শেখ হাসিনাকে সমর্থন করেছেন, তাদের স্থান উপদেষ্টা/পরামর্শক কোনখানেই হয়নি। বরং সমঝোতাকারীরা উচ্চপদগুলো দখল করেছেন। নাম অনেক দিতে পারতাম। কিন্তু দেব না, কারণ আমাকে এ দেশে থাকতে হবে। তারা অত্যন্ত শক্তিশালী। হেজাবীরা এলেও তাদের কিছু হয় না। বর্তমান সরকারেও তারা শক্তিশালী। শ্যামল দত্ত যে মতবিনিময় সভায় কথাটা বলেই ফেললেন ও সবাই এর সমর্থন করলেন, তার কারণ ঐটিই। হেজাবীমনা বা এদের সমর্থকদের প্রশ্রয় দেয়ার অর্থÑ বা এ বার্তা দেয়া যেÑ হেজাবীদের মনোচিন্তা বেঠিক নয়, সন্ত্রাস খারাপ নয়, মৌলবাদ/জঙ্গীবাদ একটা পর্যায় পর্যন্ত সহনীয়। আর বাঙালী পাকিস্তানীরাতো আমাদের ভাই। শেখ হাসিনা গত প্রায় এক দশকে বাংলাদেশকে যতোটা উন্নয়নের পথে নিয়ে গেছেন এসব হেজাবী বাধা সত্ত্বেও, তা অতুলনীয়। আমরা বলি, তিনি না থাকলে মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার কেউ করতে পারতেন না। তোফায়েল আহমদের মতো ব্যক্তিও নির্মূল কমিটির সভায় বলেছেন, আমিও এ সাহস করতে পারতাম কিনা সন্দেহ। ঢাকা শহরে গত ৭ বছরে যত ফ্লাইওভার বা যোগাযোগের উন্নতি হয়েছে, তাতে আওয়ামী সমর্থক প্রার্থীদের ঘরে বসে ভোট পাওয়ার কথা। কিন্তু তাতো হয়নি। এর অন্য মানে হতে পারে, উন্নয়নের সঙ্গে ভোটের খানিকটা সম্পর্ক আছে, আবার নেইও। উন্নয়ন দরকার, সমান্তরালে মানস জগতেও আধিপত্য বিস্তার জরুরী। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা সমুন্নত রাখুনÑ এ ধরনের আপ্তবাক্য মানস জগৎ গড়ে তোলে না। পুরো শিক্ষা ব্যবস্থাটাই হেজাবীদের পক্ষে। এটির সংস্কার একদিনে হবে না, কিন্তু হওয়াটা জরুরী এবং এখন প্রধানমন্ত্রীর সেদিকে মনোযোগ দেয়াটা জরুরী। কলেজ ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়ছে। সেটি শক্তিশালী করা জরুরী। দেশের ইতিহাস, বিশেষ করে মুক্তিযুদ্ধ বা যে সংগ্রামের মাধ্যমে বাংলাদেশ অর্জিত হয়েছে, তা শিক্ষার্থীরা জানে না। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে ১০০ নম্বরের একটি কোর্স খোলা কি এতই অসম্ভব? বা বিসিএস পরীক্ষায় ১০০ নম্বরের বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের একটি পরীক্ষাপত্র থাকা কি অসম্ভব? তা’হলে অনেকেই বাধ্য হয়েও ইতিহাসটা জানতে পারত। সাংস্কৃতিক বিপ্লব না হোক, সংস্কৃতির উন্নয়ন জরুরী। আসলে এসব বিষয়ে যৌথ কার্যক্রম গ্রহণের জন্য শিক্ষা, সংস্কৃতি ও মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয়ের সমন্বিত কার্যক্রম জরুরী। তাহলে মানস জগতে আধিপত্য বিস্তারের ব্যাপারটা ঘটত। হেজাবীরা এই কাজ করতে পারলে, শেখ হাসিনা তা পারবেন না, এটি বিশ্বাসযোগ্য নয়। যিনি মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার করতে পারেন, মার্কিন অন্যায় আবদার প্রত্যাখ্যান করতে পারেন, এই সামান্য কাজটুকু তিনি পারবেন না, এটি বিশ্বাস করা কষ্ট। নাকি হেজাবীরা এতই শক্তিশালী যে, এই চিন্তা করা দুরূহ? তাই যদি হয়, তাহলে এই সেøাগানই সত্যে পরিণত হবে বা তারা পরিণত করে ছাড়বে যে, আওয়ামী লীগের বিজয় : গণতন্ত্রের পরাজয়। জামায়াত-বিএনপির বিজয় : গণতন্ত্রের জয়। বাঙালীর ইতিহাসে এরচেয়ে বড় ট্র্যাজেডি আর কী হতে পারে? কারণ ব্যাপারটা এভাবে দেখতে হবেÑ মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের বিজয় : গণতন্ত্রের পরাজয়। বাঙালী পাকিস্তানীদের বিজয় : গণতন্ত্রের জয়।
×