ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

নেতাকর্মীরা হতাশ

বিএনপি মহাসঙ্কটে, পথ খুঁজে পাচ্ছে না হাইকমান্ড

প্রকাশিত: ০৬:২৭, ৯ মে ২০১৫

বিএনপি মহাসঙ্কটে, পথ খুঁজে পাচ্ছে না হাইকমান্ড

শরীফুল ইসলাম ॥ নানামুখী সমস্যায় জর্জরিত হয়ে বিএনপি এখন চরম দুঃসময় অতিক্রম করছে। ১৯৭৮ সালের ১ সেপ্টেম্বর দল প্রতিষ্ঠার পর বিএনপি এমন মহাসঙ্কটে আর কখনও পড়েনি। তাই চলমান সঙ্কট উত্তরণে হিমশিম খাচ্ছে দলের হাইকমান্ড। মূলত দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন বর্জনের পর থেকেই সঙ্কটের মুখে পড়ে বিএনপি। এরপর চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়াসহ প্রভাবশালী নেতারা মামলায় জড়িয়ে পড়া, এ বছর ৬ জানুয়ারি থেকে টানা ৩ মাসের নেতিবাচক আন্দোলন, সদ্যসমাপ্ত ৩ সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন বর্জন ও নানামুখী চেষ্টা করেও সরকারকে বেকায়দায় ফেলতে না পারা ও দলের সাংগঠনিক দুরবস্থার কারণে এখন মহাসঙ্কটে পড়েছে। এই সঙ্কট উত্তোরণের পথ খুঁজে পাচ্ছে না দলটি। এ কারণে দলের সর্বস্তরের নেতাকর্মীরা হতাশ হয়ে পড়ছেন। আর এ হতাশা কাটিয়ে উঠতে দলীয় হাইকমান্ডের পক্ষ থেকে কোন পদক্ষেপও নেয়া হচ্ছে না। এদিকে আন্দোলন চলাকালে যাত্রাবাড়ীতে গাড়িতে পেট্রোলবোমা মেরে মানুষ হত্যা মামলা এবং জিয়া চ্যারিটেবল ও জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলাসহ বিভিন্ন মামলায় জড়িয়ে বিএনপিকে বড় ধরনের সঙ্কটের মুখে ফেলেছেন চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া। দ্রুতই এসব মামলার চূড়ান্ত রায় হয়ে যাবে বলে সরকারী দলের নেতারা বলে আসছেন। আর তা হলে খালেদা জিয়া গ্রেফতার হতে পারেন বলে বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে। মামলার কারণে কারাগারে যেতে হলে তিনি রাজনীতিও করতে পারবেন না। খালেদা জিয়ার বড় ছেলে লন্ডন প্রবাসী তারেক রহমানও একাধিক মামলার ফেরারি আসামি। তাই খালেদা জিয়া গ্রেফতার হলে বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানও গ্রেফতার এড়াতে দেশে আসতে চাইবেন না। আর বিএনপির একাংশ তারেক রহমানের স্ত্রী ডাঃ জোবাইদা রহমানকে রাজনীতিতে আনার চেষ্টা করলেও ডাঃ জোবাইদার এ ব্যাপারে কোন আগ্রহ নেই বলে জানা গেছে। তাই খালেদা জিয়া কখনও গ্রেফতার হলে বিভিন্ন মামলার আসামি হওয়ায় ঝামেলা এড়াতে দলের অন্যান্য সিনিয়র নেতারাও গা বাঁচিয়ে চলতে শুরু করবেন। এমনটি হলে বিএনপিকে আরও বেহাল দশায় পড়তে হবে। প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনাসহ এ দলের সিনিয়র নেতারা বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়াসহ বিএনপির সিনিয়র নেতাদের প্রতি ইঙ্গিত করে বলেছেন যারা আন্দোলনের নামে পেট্রোলবোমাসহ বিভিন্নভাবে নাশকতা চালিয়ে মানুষ পুড়িয়ে মেরেছেন তাদের বিচার বাংলার মাটিতে হবেই হবে। সরকারের প্রভাবশালী মন্ত্রীদের এমন বক্তব্যের পর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরাও এ বিষয়ে অধিকতর সক্রিয় হয়েছেন। তবে বিএনপির চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া গ্রেফতার এড়াতে দেশে-বিদেশে নানামুখী তৎপরতা চালাচ্ছেন বলে জানা গেছে। সেই সঙ্গে দলের অন্য সিনিয়র নেতাদেরও কিভাবে মামলা থেকে রক্ষা করা যায় সে চেষ্টা চালাচ্ছেন। তবে বিএনপির কোন কোন সিনিয়র নেতা মামলার জামেলা এড়াতে আগে থেকেই গোপনে সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছেন বলে জানা গেছে। আবার দলের সংস্কারপন্থী কিছু বিএনপি নেতা দল ভাঙ্গার জন্যও সুযোগ খুঁজছেন। খালেদা জিয়া গ্রেফতার হয়ে গেলে তাদের কাছে সে সুযোগ এসে যাবে। তাই এমন সুযোগ এলে দলের বর্তমান নির্বাহী কমিটিতে থাকা অনেক নেতাই নতুন দলে যোগ দেয়ার চেষ্টা করবেন। ২০১৩ সালের শেষ দিকে নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে দেশব্যাপী লাগাতার আন্দোলন কর্মসূচী চালিয়েও সফল হতে পারেনি বিএনপি। আন্দোলনে ব্যর্থ হওয়ার পর দাবি আদায়ে ব্যাপক কূটনীতিক তৎপরতা চালায় বিএনপি। এতেও সফল না হওয়ায় বিএনপি জোট নির্বাচন বর্জন করে। কিন্তু তারা বর্জন করলেও আওয়ামী লীগ সমমনা দলগুলোকে নিয়ে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন করে সরকার গঠন করে ফেলে। বিএনপি হাইকমান্ড মনে করেছিলেন আওয়ামী লীগ হয়ত নির্বাচনের পর সংবিধান সংশোধন করে আরেকটি নির্বাচনের ব্যবস্থা করবে। কিন্তু সে আশার গুড়ে বালি পড়ায় বর্তমান সরকারের এক বছর পূর্তিকে কেন্দ্র করে বড় ধরনের আন্দোলনের সিদ্ধান্ত নেয় বিএনপি জোট। সরকারবিরোধী আন্দোলন চাঙ্গা করতে ৫ জানুয়ারি রাজধানীতে বড় ধরনের শোডাউন করার সিদ্ধান্ত নেন বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া। এ জন্য প্রস্তুতি জোরদার করতে ৩ জানুয়ারি রাতে বাসা ছেড়ে গুলশান কার্যালয়ে অবস্থান করেন তিনি। তার সঙ্গে দলের আরও ক’জন নেতাকর্মীও গুলশান কার্যালয়ে অবস্থান করেন। খালেদা জিয়ার ডাকে ৬ জানুয়ারি থেকে সারাদেশে ২০ দলীয় জোটের টানা অবরোধ কর্মসূচী শুরু হয়। আর অবরোধের মধ্যেই দফায় দফায় হরতাল পালন করে বিএনপি জোট। এ কর্মসূচী পালনকালে দলের নেতাকর্মীরা রাজপথে তেমন সক্রিয় না থাকলেও তা সফল করতে চোরাগোপ্তা নাশকতা চালিয়ে সারাদেশে জানমালের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি করা হয়। বিশেষ করে পেট্রোলবোমার আঘাতে শতাধিক মানুষ মারা যাওয়া এবং আরও শতাধিক মানুষ আগুনে দ্বগ্ধ হয়ে মৃত্যুমুখে পতিত হওয়ার মতো নেতিবাচক দিকগুলো এখনও দেশের সাধারণ মানুষ ভুলতে পারেনি। আন্দোলনের কথা মনে হলেই মানুষ বিএনপির বিরুদ্ধে এই ধ্বংসাত্মক কর্মকা-ের অভিযোগ উত্থাপন করে। বিদেশী কূটনীতিকরাও বার বার এ বিষয়টির প্রতি দেশবাসীর দৃষ্টি আকর্ষণ করে। এদিকে আন্দোলনের নামে নাশকতামূলক কর্মকা-ে জড়ানোর অভিযোগ এনে সরকারও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মাধ্যমে বিএনপি নেতাকর্মীদের কঠোর নজরদারির আওতায় আনে। বিভিন্ন মামলার আসামি হওয়ায় দলের অনেক নেতাকর্মী গ্রেফতার হন। আর পুলিশের চোখ এড়াতে দলের অনেক নেতাকর্মী আত্মগোপনে চলে যান। নতুন করে বিএনপির আরও অনেক নেতাকর্মী বিভিন্ন মামলায় জড়িয়ে পড়তে যাচ্ছেন বলেও বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে। ৩ সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনকে সামনে রেখে বিএনপির অনেক নেতাকর্মী কারাগার থেকে মুক্তি পায়। এছাড়া আত্মগোপনে থাকা আরও অনেক নেতাকর্মী প্রকাশ্যে আসার সুযোগ পান। তাদের কেউ কেউ নির্বাচনে প্রার্থীও হন। আর অন্যরা দলীয় মেয়র ও কাউন্সিলর প্রার্থীদের পক্ষে প্রচার কার্যক্রমে মাঠে নামেন। কিন্তু ২৮ এপ্রিল ৩ সিটির নির্বাচনের দিন ভোট শুরুর কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দেয় বিএনপি। কিন্তু এর আগে প্রার্থী ও তৃণমূল পর্যায়ের নেতাকর্মীদের মতামত না নেয়ায় তাদের মধ্যে হতাশা দেখা দেয়। দলীয় হাইকমান্ডের প্রতি ক্ষুব্ধ হয়ে কেউ কেউ আর রাজনীতি না করারও ঘোষণা দেন। এদিকে নির্বাচনে কোন ধরনের কারচুপি হলে কঠোর আন্দোনে যাওয়ার আগাম ঘোষণা দিলেও নেতাকর্মীদের সায় না থাকায় নির্বাচনের পর আর আন্দোলন কর্মসূচী ঘোষণা করেনি বিএনপি। উপরন্তু নির্বাচনের পর বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়াসহ দলের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে আবারও নতুন করে মামলার খড়গ নেমে আসে। এ পরিস্থিতিতে অনেকটাই অসহায় হয়ে পড়েন দলীয় হাইকমান্ড। তাই বিএনপির তৃণমূল পর্যায়ে হতাশা আরও বেড়ে যায়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার তৎপরতায় ভারতের মোদী সরকার সংসদে স্থল সীমান্ত বিল পাস করায় ছিটমহলবাসীদের ৪০ বছরের সমস্যা সমাধানের পথ উন্মুক্ত হওয়ায় সারাদেশের মানুষের মধ্যে আনন্দের বন্যা বয়ে যাচ্ছে। বিএনপি ৫ বার ক্ষমতায় গিয়েও এ সমস্যার সমাধান করতে পারেননি। কিন্তু শেখ হাসিনার নেতৃত্বে থাকা সরকার ঠিকই ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়ন করে এ সমস্যার সমাধান করতে পারায় রাজনৈতিকভাবে আওয়ামী লীগ আগের চেয়ে আরও শক্ত অবস্থানে চলে এসেছে মনে করে বিএনপি নেতাকর্মীদের মধ্যে হতাশা আরও বেড়ে গেছে।
×