ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

ব্রিটেনে নির্বাচন ॥ কমিউনিটিতে উৎসবের আমেজ

রুশনারা আলী, টিউলিপ সিদ্দিক ও রূপা হক বিজয়ের দ্বারপ্রান্তে

প্রকাশিত: ০৫:৪৯, ৮ মে ২০১৫

রুশনারা আলী, টিউলিপ সিদ্দিক ও রূপা হক বিজয়ের দ্বারপ্রান্তে

সালাম মশরুর, সিলেট অফিস ॥ ব্রিটিশ পার্লামন্টের হাউস অব কমন্সের সাধারণ নির্বাচন নিয়ে জল্পনা-কল্পনার অবসান হতে আর নেই। ফল নিয়ে এখন শেষ মুহূর্তের উত্তেজনায় অস্থির বাঙালী কমিউনিটি। বিজয়ের আনন্দে ফুরফুরে মেজাজে আছেন বাংলাদেশী এমপি প্রার্থী রুশনানা আলী। অপর ২ জন টিউলিপ সিদ্দিক ও রূপা হক সম্ভাবনার দ্বারপ্রান্তে রয়েছেন বলে মনে করছেন ভোট বিশ্লেষকরা। সকাল ৮টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত ভোটগ্রহণ। বাংলাদেশের সঙ্গে ব্রিটেনের সময়ের ব্যবধান হিসেবে বৃহস্পবিার রাত তিনটে পর্যন্ত হচ্ছে ভোটগ্রহণের শেষ সময়। ব্রিটেনবাসীর সাদামাটা নির্বাচন অনুষ্ঠানকে রঙিন সাজে সাজিয়ে তুলেছেন বাংলাদেশীরা। ব্রিটেনে দীর্ঘ নির্বাচনী ইতিহাসে এবারই প্রথম ভিন্ন আমেজ তৈরি হয়েছে নির্বাচনকে ঘিরে। আর সেটা হয়েছে নির্বাচনে অধিকসংখ্যক বাংলাদেশী প্রার্থীর প্রতিযোগিতার কারণে। লন্ডন থেকে প্রকাশিত বহুল প্রচারিত সাপ্তাহিক জনমত পত্রিকার রাজনৈতিক সম্পাদক ইসহাক কাজল জনকণ্ঠের সঙ্গে আলাপকালে বলেন বাংলাদেশে ভোট একটি বড় ধরনের উৎসব। জাতীয় হোক স্থানীয় হোক, নির্বাচন এলে আমরা এই উৎসব পালন করে থাকি। ব্রিটেনে অধিকসংখ্যক বাংলাদেশী প্রার্থী ব্রিটিশরা। ভোট দিয়ে আমরা আমাদের প্রার্থীদের বিজয়ী করতে আর কিছু না হোক ভোট কেন্দ্রে ছুটে যেতে পিছপা হচ্ছি না। যা সাধারণত ব্রিটেনবাসী করে না। ভোটের প্রতি তাদের তেমন আগ্রহ না থাকায় নির্বাচনে ২৫ থেকে ৩৫% ভোট কাস্টিং হয়ে থাকে। রুশনারা আলীর আসনের ভোটার ইসহাক কাজল বললেন পরিবারের সদস্যদের নিয়ে বেলা বারোটার পূর্বেই ভোট প্রদান করে এসেছি। তার মতে রুশনারা আলীর বিজয় অনেকটাই নিশ্চিত ধরে নেয়া যায়। নির্বাচনের দিন ছুটি না থাকায় ব্রিটিশরা কাজ ফেলে ভোট দিতে যাওয়াকে কষ্টকর বিষয় এবং বাড়তি ঝামেলা হিসেবেই এটাকে এড়িয়ে যায়। গ্রেট ব্রিটেনের চারটি রাজ্যের মোট ৬৫০ আসনে একই সঙ্গে হচ্ছে এই নির্বাচন। ভোটগ্রহণ শেষে ৮ মে আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করা হবে ফল। এবারের নির্বাচনে বড় বড় রাজনৈতিক দলের কাছে অভিবাসন, আবাসন ও স্বাস্থ্যসেবা খাতের প্রাধান্য থাকলেও নির্বাচনের ফলাফলে ভাগ্য নির্ধারিত হবে ব্রিটেনের অভিবাসীদের। ব্রিটিশ পার্লামেন্টে মোট আসন ৬৫০। এককভাবে সরকার গঠন করতে যে কোন দলের প্রয়োজন ৩২৬টি আসন। সম্প্রতি এক জরিপে দেখা গেছে, কনজারভেটিভ ২৮০টি, লেবার ২৭৭টি এবং স্কটিশ ন্যাশনাল পার্টি ৫৬টি আসন জেতার সম্ভাবনা রয়েছে। অন্য ক্ষুদ্র দলগুলো জিতবে বাকি ৩৭টি আসন। এমন পরিস্থিতিতে ৭ মে নির্বাচনের পর ৮ মে আনুষ্ঠানিক ফল ঘোষণা করা হলেও সরকার গঠনে কয়েকদিন বিলম্ব হতে পারে। ২০১০ সালের নির্বাচনের পর পাল্টে গেছে ব্রিটেনের রাজনৈতিক চিত্র। কট্টর ডান এবং বামপন্থী দলগুলোর উত্থানের ফলে প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর সমর্থনে হচ্ছে বিভাজন। এ জন্য সরকার গঠন করতে মূলধারার রাজনৈতিক দলগুলোর সমর্থন নিতে হচ্ছে ক্ষুদ্র দলগুলোর কাছে। তাই নির্বাচনের আগেই সমমনা দলগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ রাখছে প্রধান দুই রাজনৈতিক দল কনজারভেটিভ ও লেবার দল। গত ২০১০ সালের নির্বাচনে কনজারভেটিভ দল লিবারেল ডেমোক্র্যাট পার্টির সঙ্গে মিলে সরকার গঠন করেছিল। কিন্তু এবার লিবারেল ডেমোক্র্যাট জনপ্রিয়তায় ভাটা পড়েছে। তাই সরকার গঠন করতে হলে কট্টর অভিবাসন বিরোধী দল ইউকে ইন্ডিপেন্ডেন্ট পার্টির সমর্থন নিতে হতে পারে কনজারভেটিভ পার্টির। আর লেবার পার্টি সরকার গঠন করতে সমর্থন নিতে পারে স্কটিশ ন্যাশনাল পার্টির ব্রিটেনে এবারের নির্বাচন সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ বাংলাদেশীদের কাছে। কারণ এবারই প্রথমবারের মতো রেকর্ড সংখ্যক এমপি প্রার্থী হয়েছেন বাংলাদেশী কমিউনিটি থেকে। মূলধারার ৩টি রাজনৈতিক দল থেকে মনোনয়ন পেয়েছেন মোট ১২ প্রার্থী। লেবার পার্টি থেকে সর্বোচ্চ ৮, লিবারেল ডেমোক্র্যাট পার্টি থেকে ৩ এবং কনজারভেটিভ পার্টি থেকে ১ জন প্রার্থী হয়েছেন। এর মধ্যে দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গের দায়ে স্কটল্যান্ডের একটি আসন থেকে লেবার পার্টি মনোনয়ন পাওয়া ব্রিটিশ বাংলাদেশী সুমন হকের প্রার্থিতা বাতিল করেছে দলটি। আর দুটি আসনে স্বতন্ত্র দল থেকে প্রার্থী হয়েছে ২ জন বাংলাদেশী। সব মিলিয়ে এবারের ব্রিটিশ পার্লামেন্ট নির্বাচনে লড়ছেন মোট ১৩ জন বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত প্রার্থী। তারা হচ্ছেন লেবার পার্টি থেকে বেথনালগ্রীন এ্যান্ড বো আসনের বর্তমান এমপি রুশনারা আলী, ইলিং সেন্ট্রাল এ্যান্ড একটন আসনে ড. রূপা হক, হ্যামস্টেড এ্যান্ড কিলবার্ন আসনে টিউলিপ সিদ্দিক, বেকেনহান আসনে ব্যারিস্টার মেরিনা আহমদ, ওয়েলউইন এ্যান্ড হার্টফিল্ড আসনে ব্যারিস্টার আনওয়ার বাবুল মিয়া, রিগেইট এ্যান্ড বানস্টেড আসনে আলী আখলাকুল, নর্থ ইস্ট হ্যাম্পশায়ার আসনে আমরান হোসাইন, লিবারেল ডেমোক্র্যাট প্রার্থী হিসেবে নর্দাম্পটন সাউথ আসনে প্রিন্স সাদিক চৌধুরী, লুটন সাউথ আসনে আশুক আহমদ এমবিই, ওয়েলসের আর্ফন আসনে কাউন্সিলর মুহাম্মদ সুলতান এবং কনজারভেটিভ পার্টি থেকে বার্কিং আসনে মিনা রহমান। এ ছাড়াও দু’জন প্রার্থী স্বতন্ত্র দল থেকে এমপি পদে লড়ছেন তারা হচ্ছেন নর্থ ওয়েস্টের রচডেল আসনে কাউন্সিলর ফারুক আহমদ এবং বেথনালগ্রীন এ্যান্ড বো আসনে মোহাম্মদ রওশন আলী। ১৩ জন প্রার্থীর মধ্যে ১০ জনই বৃহত্তর সিলেট অঞ্চলের কৃতী সন্তান। নির্বাচনে ৩ বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত প্রার্থীর বিজয়ের সম্ভাবনা প্রবল হয়ে উঠেছে। লন্ডনের বেথনালগ্রীন এ্যান্ড বো আসনের বর্তমান এমপি রুশনারা আলী, ইলিং সেন্ট্রাল এবং একটন আসনে ড. রূপা হক এবং হ্যামস্টেড এ্যান্ড কিলবার্ন আসনে টিউলিপ সিদ্দিকের জয়ের সম্ভাবনা প্রায় নিশ্চিত। এবারের ব্রিটিশ পার্লামেন্ট নির্বাচনে অভিবাসন, আবাসন ও স্বাস্থ্য খাত সবচেয়ে বেশি ভোটারদের কাছে প্রাধান্য পাচ্ছে। আবার অনেকের কাছে গুরুত্ব পাচ্ছে বিভিন্ন দলের অর্থনৈতিক পরিকল্পনা। প্রধান দুই রাজনৈতিক দলের মধ্যে লেবার পার্টির মূল নির্বাচনী অস্ত্র হচ্ছে স্বাস্থ্যসেবা খাতকে (এনএইচএস) রক্ষা করা। আর কনজারভেটিভ পার্টির মূল অস্ত্র হচ্ছে দেশের অর্থনীতিকে শক্তিশালী করা। এ ছাড়াও প্রতিবার ব্রিটিশ পার্লামেন্ট নির্বাচনে অভিবাসন একটি গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু হিসেবে ভোটারদের কাছে বিবেচিত হয়। এবারও এর ব্যতিক্রম নয়। গত নির্বাচনে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন যুক্তরাজ্যে অভিবাসীর সংখ্যা ১ লাখের নিচে কমিয়ে আনবেন বলে ঘোষণা দেন। যার ফলে বাংলাদেশীসহ ইউরোপীয় ইউনিয়নের বাইরের দেশগুলো থেকে লোক আসা প্রায় বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। এবার ডেভিড ক্যামেরন নজর দিচ্ছেন ইউরোপীয় ইউনিয়নের অভিবাসীদের দিকে। অন্যদিকে চিরায়ত অভিবাসীবান্ধব দল লেবার পার্টি এবার ঘোষণা দিয়েছে, তারাও ক্ষমতায় আসলে অভিবাসী আইন কঠোর করবে। যদিও এখনও পর্যন্ত কোন দলই অভিবাসন বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কোন রূপরেখা ঘোষণা করেনি। নির্বাচনকে সামনে রেখে বড় দলগুলোর ইমিগ্রেশন রূপরেখা কি হবে তা এখনও পরিষ্কার করে ঘোষণা না হওয়ায় দুশ্চিন্তায় আছেন সেখানকার অভিবাসীরা। নির্বাচনে জয়লাভ করতে পারলে লেবার পার্টি থেকে মন্ত্রিত্ব পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে রুশনা আলীর। আর তা যদি হয়, তবে তিনিই হবেন ব্রিটেন সাম্রাজ্যে প্রথম বাংলাদেশী মন্ত্রী। নির্বাচনে জয়ী হয়েও বাংলাদেশী এমপিরা নিজের কমিউনিটির জন্য আহামরি এমন কিছু করবেন সেটাও বড় করে ভাবার বিষয় নয়। রাষ্ট্রের স্বার্থ সামনে রেখেই নিজেদের চলতে হয়। তবে এটা আশার কথা যে ক্ষমতায় থাকলে সার্বিকভাবে কমিউনিটি লাভবান হওয়ার সুযোগ থাকবে।
×