ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

আরও দেড় হাজার সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে

প্রকাশিত: ০৬:১১, ৭ মে ২০১৫

আরও দেড় হাজার সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে

বিভাষ বাড়ৈ ॥ প্রাথমিক শিক্ষাঙ্গনের আওতায় আসছে দেশের প্রাথমিক বিদ্যালয়বিহীন আরও দেড় হাজার গ্রাম। সম্পূর্ণ দেশীয় অর্থায়নে এসব গ্রামের জন্য প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে দেড় হাজার সম্পূর্ণ নতুন সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়। যার মধ্যে এক হাজার ২৫টির নির্মাণ কাজ ইতোমধ্যেই শেষ। আরও তিন শ’টির কাজও শেষ ৯০ শতাংশ। ৮৩৮ কোটি টাকা ব্যয়ে প্রতিষ্ঠিত হতে যাওয়া এসব বিদ্যালয়ের জন্য সৃষ্টি করা হচ্ছে সাড়ে হাজার শিক্ষকের পদ। সরকার চাচ্ছে এমন গ্রাম বা এলাকায় নতুন এ বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করতে যাতে আশপাশের গ্রাম বা এলাকার সুবিধাবঞ্চিত শিশুরা যেন শিক্ষা লাভের সুযোগ পায়। নতুন করে প্রতিষ্ঠত সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে এটি হতে যাচ্ছে দেশের প্রাথমিক শিক্ষা বিস্তারে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ এক পদক্ষেপ। যা দেশের প্রাথমিক শিক্ষা বঞ্চিত লাখ লাখ শিশুকে নিয়ে আসবে শিক্ষাদানের আওতায়। প্রাথমিক ও গণশিক্ষামন্ত্রী এ্যাডভোকেট মোস্তাফিজুর রহমান বিদ্যালয়বিহীন গ্রামে দেড় হাজার সরকারী বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার কাজে সন্তোষ প্রকাশ করে বলছিলেন, আমাদের শিক্ষা বিস্তারে এটি হবে বড় একটি কাজ। আমরা চাই দেশের এমন কোন অঞ্চল থাকবে না যেখানে বিদ্যালয় থাকবে না। প্রতি এলাকায় বিদ্যালয় হবে যাতে শিশুরা শিক্ষা বঞ্চিত না হয়। মন্ত্রী বলেন, ‘বিদ্যালয়বিহীন এলাকায় ১৫০০ প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপন নির্মিত হচ্ছে। ইতোমধ্যেই বেশিরভাগ কাজ হয়ে গেছে। বাকি কাজও এগিয়ে চলছে। বিদ্যালয়ের জন্য এলাকাগুলোতে মানুষ জমি দান করছে। জমিদান করলে সেখানে যেমন হচ্ছে তেমনি সেভাবে জমি না পাওয়া গেলেও সরকার জমি কিনে বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করছে। আমরা এগিয়ে যাচ্ছি। আমরা চাই দেশের প্রতিটি এলাকার শিশুরা শিক্ষার সুযোগ পাক। কেউ শিক্ষা বঞ্চিত থাকবেনা। এক প্রশ্নের জবাবে মন্ত্রী বলেন, আমরা সর্বশেষ ২৬ হাজারেরও বেশি বেসরকারী রেজিস্টার্ড প্রাথমিক বিদ্যালয়কে সরকারী করেছি। এখন আর বেসরকারী নয়। নতুন প্রতিষ্ঠান হবে সরকারী। দেশের অনেক এলাকা আছে যেখান থেকে শিশুরা একটি সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে যেতেই পারে না। বিদ্যালয় থেকে শিশুটির বাড়ির দূরত্ব অনেক। সকল শিশুর জন্য শিক্ষা নিশ্চিত করার লক্ষ্য এক্ষেত্রে বাধাগ্রস্ত হয়। জানা গেছে, বর্তমানে দেশে সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সংখ্যা ৬৩ হাজার। ১৯৭৩ সালে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হাত ধরে ৩৬ হাজার ৮৪৩টি বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় জাতীয়করণ করা হয়েছিল। এরপর পর থেকে এই স্তর আর এগোয়নি। তবে এরশাদ সরকারের আমলে কিছু প্রতিষ্ঠান এবং বিএনপি ক্ষমতায় থাকাকালে সরকারী হয় মাত্র ৪টি প্রাথমিক বিদ্যালয়। এই অবস্থায় গেল মহাজোট সরকারের আমলে সরকারীকরণ হয় আরও ২৬ হাজার ১৯৩টি বেসরকারী রেজিস্টার্ড প্রাথমিক বিদ্যালয়কে। নতুন প্রতিষ্ঠিত প্রতিষ্ঠান হিসেবে এবারের কাজ হচ্ছে প্রায় তিন দশক পর। প্রাথমিক শিক্ষা প্রশাসনের বিস্তৃতি সম্পর্কে জানা গেছে, ১৯৯০ সালে প্রাথমিক শিক্ষাকে বাধ্যতামূলক করা হয়। প্রাথমিক শিক্ষা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে ১৯৯২ সালে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা বিভাগ সৃষ্টি করা হয় এবং ২০০৩ সালে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা বিভাগকে ঘোষণা করা হয় একটি পূর্ণাঙ্গ মন্ত্রণালয়। মন্ত্রণালয় থেকে গ্রাম পর্যন্ত প্রাথমিক শিক্ষার প্রশাসনিক নেটওয়ার্ক বিস্তৃত। ১৯৯১ সালে মোট প্রাথমিক বিদ্যালয়ের (সব ধররনের প্রাথমিক প্রতিষ্ঠান) সংখ্যা ছিল ৪৯ হাজার ৫৩৯টি। এ সংখ্যা বর্তমানে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮২ হাজার ২১৮টিতে (মাদ্রাসাসহ)। এ সময়ে সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সংখ্যা থেকে বেসরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সংখ্যা বেড়েছে কয়েকগুণ। ছাত্রী ভর্তির সংখ্যা ও হার ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে। কিন্তু বাস্তবতা হলোÑ দেশের প্রায় ২ হাজার ১০০ গ্রামে নেই কোন ধরনের প্রাথমিক বিদ্যালয়। বিভিন্ন মহল থেকে দীর্ঘদিন যাবত এসব এলাকায় বিদ্যালয় স্থাপনের দাবি জানানো হলেও সরকারীভাবে বিষয়টিকে এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে। তবে গেল মহাজোট সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পরেই প্রাথমিক শিক্ষার সুযোগ সম্প্রসারণের জন্য বিদ্যালয়বিহীন এলাকায় ১ হাজার ৫০০ প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপনের সিদ্ধান্ত নেয়। নতুন বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় মূলত দুটি মানদ-কে গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। একটি হলো- যে গ্রামে স্কুল প্রতিষ্ঠা করা হবে সে গ্রামে কমপক্ষে দুই হাজারের বেশি জনসংখ্যা থাকতে হবে। অপরটি হলো- যে গ্রামের দুই কিলোমিটারের মধ্যে কোন সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় নেই সে গ্রামকে প্রাধান্য দেয়া। এছাড়াও স্কুলের স্থান নির্বাচনে বন্যায় নদী ভাঙ্গন ও শিশুদের যাতায়াত সুবিধা বিবেচনায় নেয়া হচ্ছে। বন্যার সময় যাতে স্কুল পানিতে তলিয়ে না যায় সে স্থানেই স্কুল নির্মাণ করা হচ্ছে। নির্মাণাধীন বিদ্যালয়গুলো এ টাইপ এক হাজার ১৬৯টি, ডি টাইপ ৭৯টি, অন্যান্য ৪৮টি। পাশাপাশি পাহাড়ী জনপদের ৭টি বিদ্যালয় স্থানীয় চাহিদা মোতাবেক নির্মিত হচ্ছে। প্রতিটি স্কুল ভবনে ৩টি শ্রেণীকক্ষ, একটি শিক্ষক মিলনায়তন ও দুটি টয়লেট সংযোজন করা রয়েছে। প্রতিটি কক্ষের জন্য ১৬ জোড়া বেঞ্চ ও এক জোড়া চেয়ার-টেবিলসহ শিক্ষকদের রুমে ব্যবহারের জন্য আরও ৩টি টেবিল ও ৬টি চেয়ার প্রকল্প থেকে সরবরাহ করা হয়। যে এলাকায় বিদ্যুত নেই সেই এলাকার বিদ্যালয়ে সোলার প্যানেলের সরবরাহ নিশ্চিত করা হয়েছে। এই প্রকল্পের আওতায় হাওড়-বাঁওড় ও চর এলাকার ৯০টি বিদ্যালয়ের নির্মাণ হচ্ছে। সিলেট অঞ্চলের চা বাগান ও আদিবাসীদের বসবাস আছে এমন এলাকাগুলোতে আনুপাতিক হারে বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনাও রয়েছে। প্রাথমিক ও শিক্ষা অধিদফতর ও বেসরকারী গবেষণা প্রতিষ্ঠানের রিপোর্টে একাধিকবার বলা হয়েছে, দেশের যেসব গ্রামে প্রাথমিক বিদ্যালয় নেই সেসব এলাকার দরিদ্র ও নিম্নবিত্ত পরিবারের সন্তানরা লেখাপড়ার সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। আবার এসব গ্রামে দু’-একটি বেসরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় বা কিন্ডারগার্টেন থাকলেও সেগুলোতে পাঠদান অনেক ব্যয়বহুল। এসব কথা মাথায় রেখেই সরকার দেশের সব শিশুকে বিদ্যালয়ে ভর্তি নিশ্চিত করতে জোটের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি এবং জাতীয় শিক্ষানীতি-২০১০ এর আলোকে দেশের বিদ্যালয়বিহীন বিশেষ করে পিছিয়ে পড়া, পশ্চাৎপদ, চর-হাওড়-বাঁওড়, পাহাড়ী এলাকায় একটি করে সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেয়। ‘বিদ্যালয়বিহীন এক হাজার ৫০০টি গ্রামে সরকারী বিদ্যালয় নির্মাণ’ প্রকল্পের পরিচালক হিসেবে শুরু থেকেই কাজ করেছেন সিরাজুল ইসলাম খান। তিনি বলছিলেন, এটি প্রাথমিক শিক্ষায় অত্যন্ত ভাল ভূমিকা রাখবে বলে আমার বিশ্বাস। কাজের অবস্থা কি? এ প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, খুবই ভাল। এক হাজার ২৫টি বিদ্যালয়ের কাজ ১০০ ভাগই হয়ে গেছে। আরও ৩০০ প্রতিষ্ঠানের কাজও এগিয়েছে ৯০ ভাগ। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের এক জরিপ অনুযায়ী দেশের ১৬ হাজার ১৪২টি গ্রামে সরকারী বা বেসরকারী কোন ধরনেরই প্রাথমিক বিদ্যালয় নেই। ২০০৮ সালের ১০ সেপ্টেম্বর এই পরিসংখ্যান প্রকাশিত হওয়ার পর থেকেই সরকারী ও বেসরকারী বিভিন্ন পর্যায় থেকে বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার কথা বলা হচ্ছে। এর মধ্যে গ্রামের আয়তন ও জনসংখ্যার ঘনত্ব বিবেচনা করলে এক হাজার ৯৪৩টি গ্রামে প্রাথমিক বিদ্যালয় থাকা উচিত ছিল বলে বলছেন বিশেষজ্ঞরাও। সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রাথমিক ও গণশিক্ষাবিষয়ক উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধুরীর উদ্যোগে বিদ্যালয় না থাকা গ্রামের পরিসংখ্যান বের করা হয়েছিল। ওই প্রতিবেদন অনুযায়ী, কুমিল্লা জেলায় এক হাজার ১৭৩টি গ্রামে, মানিকগঞ্জে ৫৪৮, টাঙ্গাইলে ৫২৮, দিনাজপুরে ৩৩৬, রংপুরে ২৩৭, জয়পুরহাটে ৩২৬, সিরাজগঞ্জে ৩৫৬, পাবনায় ৩৬৮, সাতক্ষীরায় ৩৩৫ ও নেত্রকোনা জেলায় ৮৭৯টি গ্রামে প্রাথমিক বিদ্যালয় নেই। অন্য জেলাগুলোতেও কম-বেশি একই চিত্র। টেকনাফের ছয়টি ইউনিয়নে গ্রাম রয়েছে ১৪৩টি। এগুলোর মধ্যে ৭৭টি গ্রামে সরকারী-বেসরকারী কোন ধরনের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নেই। ব্যক্তি উদ্যোগে দুর্গম গ্রামে পাঁচটি প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপন করা হলেও নানা সমস্যায় সেগুলোও বন্ধ রয়েছে। ফলে প্রায় ৪৫ হাজারের মতো শিশু-কিশোর শিক্ষার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। এসব শিশু-কিশোর লেখাপড়ার পরিবর্তে সমুদ্র উপকূলে চিংড়ি পোনা আহরণ, মাছ ধরা, পাহাড় থেকে জ্বালানি কাঠ সংগ্রহসহ বিভিন্ন পেশায় জড়িয়ে পড়ছে। বগুড়ার সারিয়াকান্দি উপজেলার কামালপুর ও বোহাইল ইউনিয়নের মধ্যবর্তী মাত্র আড়াই কিলোমিটার এলাকায় ১৮টি প্রাথমিক বিদ্যালয় গড়ে উঠেছে। অথচ বোহাইল ইউনিয়নের নদীবেষ্টিত চরমাঝিড়া গ্রামে কোন বিদ্যালয় নেই।
×