ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

মুক্তিপণ আদায়ের বিশাল বাণিজ্য;###;গডফাদার ও দালালচক্র অধরা ;###;তদন্ত রিপোর্ট ফাইলবন্দী

মানব পাচার, ইয়াবা চোরাচালান ভয়াবহ রূপ নিয়েছে

প্রকাশিত: ০৫:৫৬, ৭ মে ২০১৫

মানব পাচার, ইয়াবা চোরাচালান ভয়াবহ রূপ নিয়েছে

মোয়াজ্জেমুল হক/এইচএম এরশাদ ॥ মিয়ানমারের তৎকালীন আরাকান থেকে ইঞ্জিনচালিত বোটের মাঝি তাজর মুল্লুক সাগরে বোট চালানোর অভিজ্ঞতায় মালয়েশিয়ায় যাওয়ার যে রুট খুঁজে পেয়েছিল ১৪ বছর আগের সে রুটটি এখন ফুলে-ফেঁপে মানব পাচারে রীতিমতো মহীরূপে পরিণত হয়েছে। আবার একই রুটে মিয়ানমার থেকে মরণনাশা মাদক ইয়াবা চোরাপথে ঢুকছে বাংলাদেশে। একদিকে বাংলাদেশ থেকে থাইল্যান্ড-মালয়েশিয়ায় পাচারে মানব অন্যদিকে মিয়ানমার থেকে চালানে চালানে ইয়াবার আগমন সরকার ও পুরো জাতির জন্য বড় ধরনের উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সর্বশেষ মিয়ানমারের মালয়েশিয়ার সীমান্তবর্তী এলাকার থাই উপকূলের গভীর জঙ্গলে অভিবাসীদের গণকবরের যে সন্ধান মিলেছে এবং সে সব গণকবর থেকে মানব কঙ্কাল ও পচা এবং গলিত যেসব লাশ ইতোমধ্যে বেরিয়ে এসেছে তা রীতিমতো পিলে চমকানো ঘটনা হিসেবে মানুষের মাঝে আবির্র্ভূত হয়েছে। কক্সবাজারের টেকনাফ, উখিয়া ও বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়িসহ সন্নিহিত এলাকাগুলো মিয়ানমারের সীমান্ত সংলগ্ন হওয়ায় সে দেশের রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর বড় একটি অংশ একদিকে নিজেরা যেমন পাচার হচ্ছে, অপরদিকে ইয়াবা চোরাচালানের সঙ্গে জড়িত হয়ে বাংলাদেশের সর্বনাশ ঘটিয়ে চলেছে। মানব পাচার এবং ইয়াবার চোরাচালান বর্তমানে এতই উদ্বেগজনক অবস্থায় পৌঁছেছে যে এর থেকে পরিত্রাণ পেতে সরকারের কঠোর দিকনির্দেশনা এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনী দিয়ে এর শতভাগ বাস্তবায়ন ছাড়া আর কোন গত্যন্তর নেই। মানব পাচার শুরু হয়েছে প্রায় দেড় দশক আগে। প্রথমে ছিল ছোট আকারে। এখন তা ব্যাপকতর রূপ নিয়েছে। মূলত মালয়েশিয়ায় মানব পাচারের নেপথ্য ঘটনা এখন রীতিমতো অপহরণ করে মুক্তিপণ আদায়ের বড় ধরনের একটি বাণিজ্যিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। গেল বছর অর্থাৎ ২০১৪ সালে মানব পাচারের ঘটনা ভয়াবহ রূপ নিলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে পুলিশের উর্ধতন একটি অনুসন্ধান কমিটি প্রায় ৪৫ দিনেরও বেশি সময় সরেজমিন তদন্ত চালিয়ে নেপথ্যের নায়ক ও কর্মকা- নিয়ে বিস্তারিত একটি প্রতিবেদন পেশ করে। ওই রিপোর্টে এ ব্যাপারে সরকারের কাছে আট দফা রিপোর্ট পেশ করা হয়েছিল। যা এক ধরনের ফাইলবন্দী রয়েছে বলা চলে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে গঠিত ওই কমিটির প্রধান ছিলেন চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (ক্রাইম এ্যান্ড অপারেশন) বনজ কুমার মজুমদার। সদস্যরা ছিলেন কক্সবাজারের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার তোফায়েল আহমদ, বিএসবির অতিরিক্ত পুলিশ সুপার নাঈমুল হাসান ও সিএমপির সহকারী কমিশনার নিয়াজ মোহাম্মদ। ওই সময়ে ওই রিপোর্টে কমিটির পক্ষ থেকে ১৪ বছরে ২০ সহস্র্রাধিক মানুষ মালয়েশিয়ায় পাচার হয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়। এছাড়া দেশের বিভিন্ন জেলায় মানব পাচারে সরাসরি জড়িত বলে ৩শ’ ব্যক্তির নাম ঠিকানা এবং কিভাবে পাচার কার্যক্রম সংঘটিত হচ্ছে, মানব পাচার কাজে গডফাদারদের নাম এবং অর্থায়নকারী কারা তা তুলে ধরা হয়। ওই রিপোর্টে দেশের ৪১ জেলা থেকে লোক সংগ্রহে দালাল নিয়োজিত রাখা এবং ৬০ পয়েন্টে ইঞ্জিন বোটযোগে গভীর সমুদ্রে এদের পৌঁছানোর বিবরণ ছাড়াও পাচারকালে প্রায় তিন হাজার মানুষকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের মাধ্যমে উদ্ধারের ঘটনা তুলে ধরা হয়। রিপোর্টে মানব পাচার কাজে দেশে ৩শ’ জনের একটি সিন্ডিকেট এবং দেশের বাইরে ১১ সদস্যের একটি সিন্ডিকেট এ কাজে জড়িত বলে উল্লেখ করে এ ১১ জনের মধ্যে ৮ জন জন্মসূত্রে বাংলাদেশী বলে উল্লেখ করা হয়। ওই কমিটি যে আট দফা সুপারিশ প্রদান করে তার মধ্যে রয়েছে মানব পাচার সংক্রান্তে দায়েরকৃত মামলার তদন্তে উচ্চ পর্যায়ের মনিটরিং সেল গঠনÑ যেখানে স্বরাষ্ট্র, আইন বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয় এবং এ্যাটর্নি জেনারেলের প্রতিনিধি অন্তর্ভুক্ত থাকবে। এ ছাড়া মানব পাচারের মামলায় সাক্ষীদের সাক্ষ্য নিশ্চিত করতে জেলা বা মেট্রোপলিটন পর্যায়ে বিশেষ মনিটরিং সেল গঠন এবং এ জাতীয় সব মামলা দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে প্রেরণ করতে হবে। টেকনাফের শাহপরীরদ্বীপে একটি পূর্ণাঙ্গ পুলিশ তদন্ত কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা, উপকূলীয় অঞ্চলে ওয়ার্ডভিত্তিক মানব পাচার প্রতিরোধ কমিটি গঠন, মিয়ানমারের সঙ্গে টেকনাফের ৬০ কিলোমিটার এবং উখিয়া থানার সঙ্গে ২০ কিলোমিটার নৌপথ এলাকায় নৌ পুলিশের ইউনিট স্থাপন এবং পাচার কাজে জড়িত ছাড়াও হু-ি ব্যবসায়ীদের আইনের আওতায় আনার সুপারিশ করা হয়। কিন্তু ওই কমিটির সুপারিশের মধ্যে মাঝেমধ্যে সন্দেহজনকদের বিরুদ্ধে মামলা এবং মানব পাচার রোধে কিছু এনজিও সংস্থার প্রচারণা ছাড়া আর কিছুই বাস্তবায়ন হয়নি। এদিকে, থাইল্যান্ডের শংথলা প্রদেশে বন্দীশালা ও গণকবরের সন্ধান লাভের পর থাই সরকার যে জোরালো পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে বলে দৃশ্যমান সে ক্ষেত্রে বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্তৃপক্ষের জোরালো কোন ভূমিকা এখনও দৃশ্যমান নয়। অথচ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তদন্ত কমিটি গডফাদার এবং দালালদের নাম ঠিকানাও মন্ত্রণালয়ের কাছে জমা দিয়েছে। কিন্তু এদের বিরুদ্ধে ধরপাকড় অভিযান না থাকায় এবং মাঝেমধ্যে পাচারকারী হিসেবে যাদের গ্রেফতার করা হয় তারাও অতি সহজে জামিন লাভের ঘটনায় অবৈধ এ তৎপরতা বেড়েছে বলে বিভিন্ন সূত্রের অভিমত। মানব পাচারে গডফাদার ও দালাল হিসেবে যাদের নাম সুনির্দিষ্টভাবে পরিচয়সহ তুলে ধরা হয়েছে তাদের মধ্যে রয়েছে উখিয়া সোনাইছড়ির ইসলাম মিয়ার পুত্র শামসুল আলম, টেকনাফের শাহপরীরদ্বীপের শরীফ হোসেন প্রকাশ সর হোসন, উখিয়ার সোনারপাড়ার নুরুল কবির, পশ্চিম সোনাইছড়ির কায়সার জনি, সোনার পাড়ার রেজিয়া আক্তার ওরফে রেবী (এ পর্যন্ত দুবার গ্রেফতার হয়েছেন), কক্সবাজার শহরের কুতুবদিয়া পাড়ার একরাম ওরফে রাশেদ, শাহাদাত উল্লাহ, পশ্চিম সোনাইছড়ির রুস্তম আলী, পূর্ব সোনার পাড়ার লালু মাঝি, পশ্চিম সোনারপাড়ার নুরুল আবসার, কুতুবদিয়া উপজেলার কৈয়ার বিলের মাহমুদুল করিম, লম্বরী পাড়ার মফিজুর রহমান ওরফে মফিজ, পশ্চিম সোনাই ছড়ির শাহ আলম, লম্বরি পাড়ার বেলাল ওরফে লাল বেলাল, সোনাইছড়ির আকতার, পশ্চিম সোনার পাড়ার সৈয়দ আলম, সওদাগর পাড়ার মফিজ ওরফে মালয়েশিয়া মফিজ, সোনার পাড়ার জয়নাল আবেদিন, পশ্চিম সোনার পাড়ার জাফর মাঝি, খামার পাড়ার সৈয়দ হোসেন, বেলাল, আজিজুল হক, মুনু, আনোয়ার হোছন, কক্সবাজারের খুরুশকুলের নুর মাঝি, দক্ষিণ পাড়ার একরাম মেম্বার, পোকখালীর শুক্কুর সারাং, নুরুল হাকিম মেম্বার, রুবেল, আবুল কালাম, খুরুশকুলের আরাফাত, কাউয়ারপাড়ার পারভেজ, শামসুল আলম, রেজাউল করিম, কুতুবদিয়া পাড়ার বেলাল, রেজাউল করিম, দস্তগীর, আনিসুর রহমান, কামরুল হাসান, বাদশা, রিদোয়ান, রশিদ মাঝি, সোনা মিয়া, নুনিয়ারছড়ার সৈয়দ করিম, বিসিক শিল্প এলাকার মোহাম্মদ আলী পাখি, তার সহোদর শওকত, লিঙ্ক রোড মুহুরীপাড়ার নাসির, মোজাহের পাড়ার সৈয়দ হোছন মনির, মৌলবী মুহিবুল্লাহ, শাহপরীরদ্বীপের ডাঙ্গরপাড়ার মোঃ হাশেম, উখিয়া জালিয়া পালংয়ের চ্যাপ্টাখালির মোজাম্মেল, জিয়াউল হক, মোসলেম উদ্দিন, সৈয়দ হোছন, শাহ পরীরদ্বীপের মিস্ত্রীপাড়ার শরীফ হোসেন, নুর হাকিম মাঝি, বাজার পাড়ার বেলাল উদ্দিন, মিস্ত্রী পাড়ার নুর হোসেন, নুরুল আলম, এনায়েত উল্লাহ, মোঃ সেলিম মোঃ হোসেন, জাফর আহমদ, দক্ষিণ পাড়ার মোঃ শফিক, আবু তাহের, মোঃ জাফর, আলী মাঝি, ছনখোলার শরীফ উল্লাহ, বাহার উদ্দিন, মাঝের পাড়ার দলু হোসেন, শরীফ হোসেন বুলু, নুর হাকিম মাঝি, বাজার পাড়ার বেলাল উদ্দিন, গোলা পাড়ার শামসুল আলম, মাঝের পাড়ার সাব্বির আহমদ, পাবনা জেলার মধ্য পাড়ার মহসিন, হবিগঞ্জের নাজিরপুল এলাকার শহীদ মিয়া, যশোরের ডুমুরখালির মিলন হোসেন, নড়াইলের কচুয়াডাঙ্গার বিদ্যুত শেখ, টেকনাফের জহির মাঝি, মালেক মাঝি, সাবরাংয়ের খুইল্লা মিয়া, এজাহার মিয়াদ জাহেদ হোসেন, মোঃ ইউনুস, আমান উল্লাহ, ফজল আহমদ, সলিম উদ্দিন, আইয়ুব, জহির আহমদ, আবদুল্লাহ, জসিম, আবদুল হক, কাটাবুনিয়ার মোঃ ইসহাক, সিদ্দিক আহমদ, ফয়েজুর রহমান সিকদার, নুরুল ইসলাম, জাহাঙ্গীর, মীর আহমদ, কোয়াইন ছড়ির মোঃ কাশেম, মোঃ ইসলাম, জোনায়েদ হোসাইন, ইমাম হোসেন, রিয়াজু বেগম, ফিরোজা বেগম, হাফেজ উল্লাহ, মনির উল্লাহ, জাহাঙ্গীর, আলমগীর, শওকত হোসেন, সলিম উদ্দিন, সৈয়দ হোসেন, জাহাঙ্গীর, সিদ্দিক, মোঃ সফি, মীর আহমদ, মোজাহের মিয়া, মোঃ ফারুক, মোঃ শরীফ, মুন্নী আকতার, আবদুল্লাহ, আবদুর রহমান, কামাল, আবুল কালাম, জামাল, জাহাঙ্গীর, রাশেদ, শাকের, জাফর, মোঃ হোছন ওরফে লুলা, ওমর হোসেন, ওসমান, ফয়েজ উল্লাহ, হেলাল, আবদুল্লাহ, জিয়াউর রহমান, নুরুল আলম, আবদুল করিম, শামসুল আলম, আবদুল আজিজ, নুরুল আলম, মোঃ আমিন, মোঃ দিলু, টেকপাড়ার মিজান, মোঃ ফারুক, জিয়াউল হক, দিলদার মিয়া, কচুবুনিয়ার মৌলবী বশির, নজির আহমদ, মোঃ কাশেম, মোঃ ইসলাম, জাফর আলম, মোঃ সিরাজুল হক, সাব্বির, মোঃ হোছন, হাসান, আবদুস সালাম, শাহজাহান, মাজেদ, মৌলবী আবুল হোসেন, সাইফুল, রশিদ আহমদ ভুট্টু, মৌলভী জিয়াউল হক, হাফের কবির, মৌলবী করিমউল্লাহ, বশির আহমদ, মোহাম্মদ আলী, মোঃ জাবেদ, বক্সি মাঝি, রশিদ আহমদ, মৌলভী আবুল হোসেন, রহিমউল্লাহ, ইমাম হোসেন, আলীর ঢেইলের আকতার কামাল, সাঈদ কামাল, হাদুরছড়ার আবদুল গফুর, মোঃ শাকের মাঝি, নুর মাঝি, জহির উদ্দিন, নয়াপাড়ার ইমাম শরীফ, মোঃ শরীফ, মোঃ লিটন, মোঃ আবদুল হাশিম, মোঃ দলিল আহমদ পুরান পাড়ার হাফেজ মুক্তার, হারিয়া খালির সাদ্দাম, আবুল কালাম, আমান, ঘোনারপাড়ার মোঃ শরীফ, রহমত উল্লাহ, সাবরাংয়ের মোয়াজ্জেম হোসেন, সাব্বির আহমদ সাজেদা বেগম, মৌলবী আবদুল্লাহ, মৌলবী ইউনুস, মৌলবী কলিম উল্লাহ, শাহপরীরদ্বীপের আবদুল শুক্কুর, লাফারঘোনার আবদুর রহমান, বাজারপাড়ার হামিদ হোসেন, তাজিয়াকাটার মমতাজ মিয়া, মোজাম্মেল, বটতলীর আবুল কাশেম, লম্বাঘোনার নেয়ামত উল্লাহ বাসি, বটতলার নুরুল আবসার, মধ্য গহিরার মোঃ কামাল, আবদুল হাকিম, গহিরার মোঃ লোকমান, মোঃ জসিম, মিস্ত্রীপাড়ার মোঃ হাসান, আলমগীর, বিশু মিয়া, সোনা মিয়া, উত্তর সলিমপুরের মোঃ তাজ উদ্দিন, হারুনুর রশীদ, রুবেল, নওশাদ, খোরশেদ, জাহেদ, বেলাল, জালাল, জকু মাঝি, আহসান মাঝি, কামাল হোসেনসহ ৩শ’ জনের নাম সুনির্দিষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। এদিকে অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে বাংলাদেশ থাইল্যান্ডভিত্তিক মানব পাচারের পুরো নিয়ন্ত্রণ করছে উখিয়ার সোনাইছড়ির যুবদল নেতা শামসু। মানব পাচারের মামলায় এ শামসু গেল বছর গ্রেফতার হয়ে মাসখানেক জেল খেটে জামিন পেয়েছে। সে এখনও মানব পাচার কাজে জড়িত। যুবদল নেতা শামসু এবং চ্যাপ্টাখালির ফয়েজ সিকদারের নেতৃত্বে গঠিত সিন্ডিকেট কক্সবাজারের উখিয়া, টেকনাফ ও রামুর সংঘবদ্ধ পাচারকারী দালালরা সম্পূর্ণ ধরাছোঁয়ার বাইরে। এদিকে, কক্সবাজারের উখিয়া থেকে পাচার হওয়া ৫ শতাধিক ব্যক্তি এখনও নিখোঁজ রয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে এদের কেউ কেউ বন্দী শিবিরে রয়েছে, কেউ সাগরে ডুবে মরেছে। আর কেউ মালয়েশিয়ায় জেলবন্দী হয়ে আছে। মালয়েশিয়ায় কারাভোগের পর কক্সবাজারের উখিয়ায়, টেকনাফ ও রামুর ১০ যুবকের প্রদত্ত তথ্য অনুযায়ী সম্প্রতি মালয়েশিয়াগামী একটি ইঞ্জিন বোট ডুবে ৭ জন মারা গেছে। এছাড়া গত মাসে সেন্টমার্টিনের কাছাকাছি মালয়েশিয়াগামী ৪০ জনকে উদ্ধারসহ অধিকাংশ ঘটনার মূলনায়ক ওই যুবদল নেতা শামসু। মানব পাচার অনুৎসাহিত করতে এনজিও সংস্থা হেলপ কাজ করে যাচ্ছে। এ পর্যন্ত তারা মালয়েশিয়া ফেরত ৭০ জনকে তাদের আওতায় এনেছে। ৩০ জনকে ১০ হাজার টাকা করে অনুদান দিয়েছেন বলে জানিয়েছেন এ এনজিওর নির্বাহী পরিচালক আবুল কাশেম। তারা আরও ৬০ ভিকটিমকে অনুদান প্রদানের জন্য লিপিবদ্ধ করেছ। এছাড়া তাদের কম্পিউটার প্রশিক্ষণ প্রদানের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। পাশাপাশি তারা সচেতনতামূলক সমাবেশ করে যাচ্ছে। মিয়ানমারের আরাকান প্রদেশের সেই তাজর মুল্লুক মাঝি যে সর্বপ্রথম মালয়েশিয়ার রুটটি আবিষ্কার করেছিল সে এ কাজে জড়িত থেকে এখন বিত্তের পাহাড় গড়ে তুলেছে। টেকনাফ সদরে নির্মাণ করেছে থাকার জন্য দৃষ্টিনন্দন ভবন। এছাড়া ঢাকা ও চট্টগ্রামে রয়েছে বেশ কয়েকটি ফ্ল্যাট। সে কখনও গ্রেফতার হয়নি। তার বয়স এখন ৫০ এর কাছাকাছি বলে জানা গেছে। টেকনাফ থানায় ২০১৩ সালে তার নামে একটি মামলা (নং-৭) রয়েছে। সব সময় লোকচক্ষুর অন্তরালে থাকে। আকস্মিকভাবে টেকনাফ গেলেও দ্রুত সটকে পড়ে। অভিযোগ রয়েছে, পুুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ রেখেই তার চলাচল। জনকণ্ঠের উখিয়া সংবাদদাতা দীপন বিশ্বাস জানান, উখিয়ার উপকূলীয় ইউনিয়ন জালিয়া পালংয়ের উপকূলজুড়ে পাহাড়ী এলাকার নির্জন আস্তানায় বসে শতাধিক মানবপাচারকারী দালাল চক্র মানবপাচারের জন্য রীতিমতো হাট বসিয়েছে। আইন-শৃঙ্খলারক্ষাকারী বাহিনীর অভিযানের খবর প্রায় সময়ই আগে ফাঁস হয়ে যাওয়ায় মানবপাচারের গডফাদাররা থাকছে ধরাছোঁয়ার বাইরে। ঘন ঘন কৌশল ও অবস্থান পাল্টিয়ে সাগর পথে চালিয়ে যাচ্ছে মানবপাচার। বিশেষ করে বিজিবি সদস্যরা মানবপাচার প্রতিরোধে উপকূলজুড়ে নিরাপত্তা ও টহল জোরদার করার কারণে সম্প্রতি কিছুটা হ্রাস পেলেও একেবারে থেমে নেই। যেখানে প্রতি রাতে সাগরের অন্তত ১০ পয়েন্ট দিয়ে শত শত লোকজনকে ট্রলারে তুলে দিয়ে মালয়েশিয়ায় পাচার করার কাজ চলে আসছিল তার সংখ্যা কিছুটা হ্রাস পেয়েছে। কক্সবাজারের সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, থাইল্যান্ডে গণকবরের সন্ধান পাওয়ার খবরে স্বাভাবিকভাবে পুলিশসহ অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা উদ্বিগ্ন। সে সঙ্গে জেলার আওতাধীন সব থানা পুলিশের কর্মকর্তাদের মানবপাচার প্রতিরোধে কঠোর অবস্থানে থাকার নির্দেশনাও দেয়া হয়েছে। এলাকাবাসীর অভিযোগের যথাযথ তদন্ত ও অনুসন্ধানপূর্বক মানবপাচারকারীদের চিহ্নিত করে তাদের আইনের আওতায় আনার জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় পুলিশ কর্মকর্তাদের কড়া নির্দেশ প্রদান করা হয়েছে। কয়েক মন্ত্রণালয়ের সমন্বয়ে কমিটি হচ্ছে ॥ বুধবার প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থানমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশারফ হোসেন সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, স্বরাষ্ট্র, পররাষ্ট্র ও প্রবাসী কল্যাণসহ সংশ্লিষ্ট সব মন্ত্রণালয়ের সমন্বয়ে একটি কমিটি গঠন করা হচ্ছে। একই সময়ে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মোঃ শাহরিয়ার আলম সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, টানা পাঁচদিন ছুটির পর বুধবার থাই সরকারের দফতরগুলো খুলেছে। আজ বা কাল শুক্রবার আমরা সেখানে যাব। সেদেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও বিভাগগুলোর তদন্তের পর আমাদেরও সুযোগ দেয়া হবে। প্রতিমন্ত্রী বলেন, যেহেতু বিষয়টি একাধিক মন্ত্রণালয়ে সম্পৃক্ত তাই দ্রুত আন্তঃমন্ত্রণালয়ের বৈঠকে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। তার আগে আমাদের নিশ্চিত হতে হবে থাইল্যান্ডের ওই ঘটনায় বাংলাদেশের কত নাগরিক এ নির্মম ঘটনার শিকার হয়েছে। প্রতিমন্ত্রী আরও জানান, অবৈধভাবে বিদেশ গমন ঠেকাতে দেশের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা জোরদার করা হচ্ছে। অপ্রতিরোধ্য ইয়াবা পাচার ॥ মিয়ানমার থেকে সীমান্ত পেরিয়ে ইয়াবার চালান আসা যেন অপ্রতিরোধ্য। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতায় অহরহ বড় বড় চালান ধরা পড়লেও তা থামছে না। এছাড়া এ মাদক চালানের গডফাদাররাও ধরাছোঁয়ার বাইরে। এ ইয়াবা স্থলপথে ও সমুদ্রপথে চট্টগ্রাম, ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় পাচার হচ্ছে। যুব সম্প্রদায়ের বড় একটি অংশ বর্তমানে ইয়াবার প্রতি এতই আসক্ত যে, চোরাচালানিরা এ ধরনের মাদক চালান থেকে মোটা অঙ্কের অর্থ পেয়ে যাচ্ছে। ইয়াবা চালানের ঘটনায় মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের পক্ষ থেকে মিয়ানমার সীমান্তে ৩৯ ইয়াবা কারখানার একটি তালিকা প্রস্তুত করা হয়েছে। এগুলো সম্পূর্ণ অবৈধ। এসব কারখানা থেকে চালানে চালানে ইয়াবা চলে আসছে বাংলাদেশে। মালয়েশিয়ায় মানবপাচারে ব্যবহৃত ফিশিং ট্রলারে করে সমুদ্র পথে মিয়ানমার থেকে নিয়ে আসা হয়ে থাকে ইয়াবার চালান। এসব দালাল ও ইয়াবা সম্রাটগণ উখিয়া ও টেকনাফে বর্তমানে সম্পদের পাহাড় গড়ে তুলেছে। কক্সবাজারের সমিতিপাড়া, সোনারপাড়া, পেকুয়া, মহেশখালী ও চট্টগ্রামের বিভিন্ন ঘাটে দালালরা খালাস করে থাকে ইয়াবার চালান। জানা যায়, ২৫ থেকে ৩৫ মিলিগ্রাম মেথাম্ফিটামিনের সঙ্গে ৪৫ থেকে ৬৫ মিলিগ্রাম ক্যাফেন মিশিয়ে তৈরি এ ট্যাবলেটের রং সবুজ, লালচে ও কমলা রঙের। স্বাদ হয় আঙুর, কমলা বা ভ্যানিলার মতো। আর আকৃতি খুব ছোট, যা ড্রিংকিং স্ট্রয়ের ছিদ্রের সমান। তাই এটি সহজে লুকিয়ে পরিবহন করা যায়। দালালের নিয়োজিত মানবপাচারে জড়িত লোকজন থাইল্যান্ডের সীমানায় বনি আদমদের পৌঁছে দিয়ে ফেরার পথে জেলে ও মাঝি-মাল্লা এবং মাছ শিকারের ভান করে ওই ট্রলারে করে লাখ লাখ পিচ ইয়াবার চালান নিয়ে আসছে মিয়ানমার থেকে। মরণ নেশার চোরাচালান বন্ধে প্রায় তিন বছর আগে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় একটি নির্দেশনা পাঠিয়েছিল কক্সবাজারে। এদের মধ্যে আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার সঙ্গে এন্কাউন্টারে ৬ নিহত এবং ৮ আটক হলেও এ পর্যন্ত রাঘব-বোয়ালরা ধরা পড়েনি। খোদ এমপি বদির দুই ভাই (শুক্কুর ও মুজিব) ইয়াবা সম্রাট হিসেবে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে আসা তালিকাভুক্ত থাকায় এমপি বদির ভয়ে অন্যরাও পার পেয়ে যাচ্ছে। সরকারদলীয় এমপি বলেই পুলিশসহ আইন প্রয়োগকারী সংস্থার লোকজনকে হুঙ্কার ছাড়াও অনেক সময় পিটিয়ে থাকে এমপি বদি। এ জন্য মানইজ্জত রক্ষা করে চাকরির নির্ধারিত সময়টা পার করে ওই এলাকা ত্যাগ করার চিন্তায় থাকে প্রশাসনের কর্মকর্তাদের অনেকে। ইয়াবা চালান দেশে আসার অন্যতম প্রধান রুট মিয়ানমার থেকে টেকনাফ হয়ে কক্সবাজার ও চট্টগ্রাম। আর এ রুট দিয়ে ইয়াবা চোরাচালান রোধে বছর খানেক আগে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দেয়া নির্দেশনা মানা হয়নি।
×