ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

সিরিজ জয়ের হাতছানি

প্রকাশিত: ০৬:২০, ৫ মে ২০১৫

সিরিজ জয়ের হাতছানি

মোঃ মামুন রশীদ ॥ একটি টেস্ট ড্র করাটাই অনেক বড় প্রাপ্তি পাকিস্তানের বিরুদ্ধে। প্রথম টেস্টে পুরোপুরি ব্যাকফুটে গিয়েও যেভাবে ড্র করেছে বাংলাদেশ দল সেটাকে জয়ের চেয়েও বেশি মনে করছেন অনেকে। কারণ খুলনা টেস্টের আগে পাকিস্তান দলের বিরুদ্ধে খেলা ৮ টেস্টের একটিতেও ন্যূনতম ড্র পর্যন্ত করতে পারেনি বাংলাদেশ দল। সিরিজে আর মাত্র একটি টেস্ট বুধবার ‘হোম অব ক্রিকেট’ মিরপুর শেরেবাংলা জাতীয় স্টেডিয়ামে শুরু হবে। দারুণ আত্মবিশ্বাসী টাইগাররা এখন সিরিজ জয়ের স্বপ্ন দেখছে। বাংলাদেশ অধিনায়ক মুশফিকুর রহীমের কণ্ঠেই তেমন প্রত্যয় শোনা গেছে। তিনি প্রথম টেস্টের পর বলেছেন, ‘এত ভাল দলের বিপক্ষে এ রকম খেলা কখনই খেলিনি। শুরুটা খারাপ হলেও পরে আমরা দারুণভাবে ম্যাচে ফিরেছি। এখন আমাদের লক্ষ্য, সামনের টেস্টটা ভাল খেলে যেন সিরিজ জিততে পারি।’ সিরিজ জিততে হলে মিরপুরে বুধবার শুরু হওয়া দ্বিতীয় টেস্ট জিততে হবে। সেটাই এখন লক্ষ্য বাংলাদেশের। প্রথম টেস্টে রেকর্ডে ভরা অবিস্মরণীয় ড্রয়ের পর এখন সেই জয়টা হাতছানি দিয়েই ডাকছে টাইগারদের। ২০০৫ সালে প্রথমবার টেস্ট জয়ের স্বাদ নেয়ার পাশাপাশি জিম্বাবুইয়ের বিরুদ্ধে সিরিজ জয়েরও স্বাদ নেয় বাংলাদেশ। সেবার চট্টগ্রামের এমএ আজিজ স্টেডিয়ামে গৌরবময় ইতিহাস রচনা করেছিল বাংলাদেশ দল হাবিবুল বাশারের নেতৃত্বে। চার বছর পর ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরে স্বাগতিকদের ২-০ ব্যবধানে হোয়াইটওয়াশ করে নতুন এক মাত্রা যোগ করে বাংলাদেশ দল নিজেদের টেস্ট ইতিহাসে। তবে সেই কৃতিত্বে বিশ্বের ক্রিকেটবোদ্ধারা কিছুটা অনুজ্জ্বলতা ছড়াতে ভোলেননি। কারণ ক্যারিবীয় দলের নিয়মিত সদস্যরা বিদ্রোহ করার কারণে দ্বিতীয় সারির একটি দল নিয়ে মুখোমুখি হয়েছিল। এরপর ২০১৩ সালে জিম্বাবুইয়ে সফরে একটি টেস্ট জিতলেও অপরটি হেরে যাওয়ায় সিরিজ ড্র নিয়েই ফিরতে হয়েছিল। দীর্ঘ অপেক্ষার পর অবশেষে গত বছর শেষদিকে আলোর ঝলকানি। নিকটতম শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী জিম্বাবুইয়েকে ঘরের মাঠে ৩-০ ব্যবধানে হোয়াইটওয়াশ করে বাংলাদেশ দল। সব মিলিয়ে টেস্টে এই ৭টি জয়ই আছে বাংলাদেশের। তবে পূর্ণ শক্তির বড় কোন দলের বিরুদ্ধে ড্র করাটাই ছিল বিরল ঘটনা। জয় পাওয়াটা তো আকাশ-কুসুম কল্পনা। ২০০৪ সালে প্রথমবার বিশ্ব ক্রিকেটে অন্যতম শক্তিধর দল হিসেবে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে তাদেরই মাটিতে টেস্ট ড্র করেছিল বাংলাদেশ। গ্রস আইলেটে ওই টেস্ট ড্র করলেও সিরিজে হেরেই ফিরতে হয়েছিল ১-০ ব্যবধানে। তিন বছর পর আরেক ক্রিকেট পরাশক্তি ভারতের বিরুদ্ধে ২০০৭ সালের মে মাসে চট্টগ্রামে একটি টেস্ট ড্র করে বাংলাদেশ। ২০০৮ সালে নিউজিল্যান্ড এবং ২০১১ সালে আবার ওয়েস্ট ইন্ডিজের সঙ্গে একটি করে টেস্ট ড্র করতে সক্ষম হয় টাইগাররা। জয়ের দেখা মেলেনি। ড্র ম্যাচই ছিল অনিয়মিত। দীর্ঘ বিরতি দিয়ে কদাচিৎ ড্রয়ের দেখা পেয়েছে বাংলাদেশ দল বিশ্বের শক্তিধর দলগুলোর বিরুদ্ধে। তবে ২০১৩ সাল থেকে পরিস্থিতি কিছুটা পাল্টে গেছে। শ্রীলঙ্কার মাটিতে যে কোন সফরকারী দলকে বেশ সমস্যায় পড়তে হয়। আর ভয়ঙ্কর ভেন্যু গলে ভাল করা যে কোন সফররত দলের জন্য বিভীষিকাময় অভিজ্ঞতার শামিল। কিন্তু সেখানেই ওই বছর দুর্দান্ত নৈপুণ্য দেখিয়ে টেস্ট ড্র করে বাংলাদেশ দল। একই বছর নিউজিল্যান্ডের বিরুদ্ধে চট্টগ্রামে এবং ঢাকায় টানা দুই টেস্টে ড্র করে বিশ্বকে নিজেদের শক্তির প্রমাণ দেয় স্বাগতিক বাংলাদেশ। গত বছর ফেব্রুয়ারিতে সেই ধারাবাহিকতায় শ্রীলঙ্কার বিরুদ্ধেও একটি টেস্ট ড্র করে। সাফল্য বলতে সেই একটিই ছিল গত বছরের সময়জুড়ে। শেষ দিকে জিম্বাবুইয়ের বিরুদ্ধে টেস্ট সিরিজে শতভাগ জয় পেয়ে মাঝের দুঃসময়টা ভুলিয়ে দেয় টাইগাররা। দারুণ ধারাবাহিকতা ছিল বিশ্বকাপেও। কোয়ার্টার ফাইনালে প্রথমবারের মতো খেলে বাংলাদেশ। বিশ্ব আসর শেষে সবার মধ্যেই প্রত্যাশা ছিল এবার সফরকারী পাকিস্তানকে নাস্তানাবুদ করবে টাইগাররা। সেটাই ঘটেছে। ওয়ানডে সিরিজে পাকদের ৩-০ ব্যবধানে হোয়াইটওয়াশ করার পর একমাত্র টি২০ ম্যাচে বড় জয় তুলে নেয়। একেবারেই বিপর্যস্ত হয় পাক শিবির। এমন পরিস্থিতির শিকার এর আগে কখনও বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ক্রিকেট মাঠে হতে হয়নি। আর সেটাই যেন নতুন করে জাগিয়ে তুলেছে বাংলাদেশ দলকে। ক্রিকেটাররাও এখন দারুণ আত্মবিশ্বাসে টগবগ করে ফুটছেন। খুলনা টেস্টে এরপরও অনেকে ধরে নিয়েছিলেন ওয়ানডে ও টি২০ দলের চেয়ে শক্তিমত্তায় সমৃদ্ধ ও অভিজ্ঞ পাকিস্তানের কাছে হেরেই যাবে বাংলাদেশ। পরিস্থিতিটা ম্যাচের তিনদিন পর্যন্ত সে রকমই ছিল। কিন্তু ম্যাচের তৃতীয় ইনিংসে কি দুর্দান্ত নৈপুণ্যই দেখাল বাংলাদেশ দল। ২৯৬ রানে পিছিয়ে থাকার চাপে কোণঠাসা টাইগাররা লড়াই করল সেয়ানে-সেয়ানে। ম্যাচের তৃতীয় ইনিংসে সর্বোচ্চ স্কোর করেছে বাংলাদেশ। পাকিস্তানের বিপক্ষে এক ইনিংসে সর্বোচ্চ (দ্বিতীয় ইনিংসে ৬ উইকেটে ৫৫৫) রান করেছে। ব্যক্তিগতভাবে, যে কোন উইকেটে বাংলাদেশের পক্ষে তামিম-ইমরুল রেকর্ড ৩১২ রানের জুটি গড়েছেন। ৫৫ বছর আগের রেকর্ড ভেঙ্গে দিয়েছেন এ দু’জন। ম্যাচের তৃতীয় ইনিংসে দুই ওপেনারের ১৫০ রান ক্রিকেট ইতিহাসে প্রথম হলো। তবু টেস্ট অঙ্গনে প্রাপ্তির খাতায় বড় কিছু যোগ হয়নি এখনও দলগতভাবে। ৮৯ টেস্টের ৭০ ম্যাচেই হার, মাত্র ১২ ড্র আর ৭ জয়। সিরিজ জয় মাত্র তিনটি। এবার মোক্ষম সুযোগ আরেকটি টেস্ট জিতে সিরিজ বিজয়ের। এভাবে চাপে পড়েও টেস্ট ড্র করা যায় সেটার দারুণ এক উদাহরণই সৃষ্টি করল বাংলাদেশ দল। অনেকেই বলছিলেন পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ড্র করতে পারলেই হবে জয়ের সমান। সেটাই হয়েছে। এবার বাস্তবে জয় পাওয়ার সুযোগ। মোক্ষম সুযোগই বলা যায়। এখন পর্যন্ত সফরে কোন জয় না পাওয়া পাকিস্তান দলই এখন নানামুখী চাপে বিপর্যস্ত। এভাবে কোণঠাসা প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধেই সবসময় বাংলাদেশ দলকে থাকতে হয়েছে। সেই পরিস্থিতি এবার পাকিস্তানের। এর আগে একবার পুরোপুরি জয়ের দ্বারপ্রান্তে চলে গিয়েছিল বাংলাদেশ দল। ২০০৩ সালে পাকিস্তান সফরে মুলতানে বাংলাদেশের জয়টাকে চুরি করে নিয়ে গিয়েছিলেন ইনজামাম-উল-হক। ১ উইকেটের বিস্ময়কর জয় তুলে নিয়েছিল পাক শিবির। মনস্তাত্ত্বিকভাবে জয়টা হয়েছিল বাংলাদেশেরই। এবার সত্যিকার জয়ের সময় এসেছে। কারণ তখন সবেমাত্র তিন বছরে পা দিয়েছিল বাংলাদেশ দল টেস্ট অঙ্গনে। এখন পেরিয়ে গেছে ১৫টি বছর। অনেক এগিয়েছে বাংলাদেশ দল। সেটা সর্বশেষ ১০ টেস্টের পরিসংখ্যান থেকেই পরিষ্কার। সর্বশেষ ১০ টেস্টে ৩টি জয়, ৪টি ড্র আর ৩টি পরাজয় দেখেছে টাইগাররা। কোণঠাসা পাকিস্তানকে মিরপুর টেস্টে হারানোর সুযোগটা কাজে লাগানোর অপেক্ষা। জয় সত্যিই এবার হাতছানি দিয়ে ডাকছে বাংলাদেশ দলকে। পারবেন তো মুশফিকবাহিনী?
×