ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

গণতন্ত্র বিজয়ী ষড়যন্ত্র পরাজিত!

প্রকাশিত: ০৪:২১, ৪ মে ২০১৫

গণতন্ত্র বিজয়ী ষড়যন্ত্র পরাজিত!

আশাবাদী মানুষ আমি। ’৭৬ সালে বাবা আত্মবিশ্বাসী ছিলেন জিয়াকে দিয়ে বঙ্গবন্ধু হত্যা, জেলহত্যার বিচার ও নির্বাচন অনুষ্ঠানে সম্মত করাতে পারবেন! সে সময় এটি অসম্ভব ভাবনা ছিল না। যেহেতু তখনও জিয়ার মুক্তিযোদ্ধা পরিচয় জোরালো অবস্থায় ছিল। আমি স্বয়ং জিয়া ও খালেদা, তারেকের সঙ্গে যুদ্ধাপরাধী দল জামায়াত ও আইএসআই-এর যোগসূত্র বিষয়ে অনেক কলাম লিখেছি এবং ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছি খালেদা-তারেক আসলে গণতন্ত্র চায় না। তারা চায় গণতন্ত্রের নামে, সুষ্ঠু নির্বাচনের নামে ২০০১-এর নির্বাচনের মতো নির্বাচনী ফল করে মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ এবং মুক্তিযুদ্ধপন্থী দল এবং ব্যক্তিদের ধ্বংস করে দিতে। আমার কাছে জিয়া, খালেদা, তারেক ও তাদের মিত্র যুদ্ধাপরাধী দল জামায়াতের অপরাজনীতির প্রধান লক্ষ্যই নাশকতা। জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত খালেদার মানুষ পুড়িয়ে মারার নাজি সুলভ আচরণে জনসাধারণও খালেদার খুনী রক্তপিপাসু চরিত্র দেখেছে। তবে অধ্যাপক এমাজউদ্দীন সাহেবকে ‘শত নাগরিক কমিটি’র নেতৃত্বে দেখে আশান্বিত হয়ে উঠেছিলাম এই ভেবে, অন্তত এবার তিনি খালেদা-তারেককে কৌশলে মাইনাস করে বিএনপিকে ধ্বংসের রাজনীতি পরিত্যাগ করে গণতান্ত্রিক পথে নিয়ে আসতে সক্ষম হবেন! আমার বন্ধুরা আমার এ সুপ্ত আশার কথা শুনে এতক্ষণে হেসে উঠেছে অবশ্যই। তবে সত্য এই যে, মানুষ বার বার আশাভঙ্গ হওয়া সত্ত্বেও, অসম্ভব জেনেও আবারও আশা করেÑ ভাল, শুভ ও মঙ্গলের! অধ্যাপক এমাজউদ্দীন আহমেদ উচ্চশিক্ষিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও এক সময়ের উপাচার্য। দুঃখের বিষয় এই যে, রাজনীতির নামে তিন মাস যাবত খালেদার পেট্রোলবোমায় মানুষ পুড়িয়ে মারার অসহনীয় অবস্থা দেখেও এর কড়া প্রতিবাদ করেননি! তবুও দ্রুত বিএনপিকে সিটি নির্বাচনে অংশগ্রহণের উদ্যোগটি গ্রহণ করেছেন। সেজন্য মনে হয়েছিল তিনি বোধ হয় খালেদাকে কিছুটা দূরে রেখে অন্যান্য শুভ বোধবুদ্ধিসম্পন্ন বিএনপি নেতাদের সঙ্গে নিয়ে সিটি নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে বিএনপিকে সুস্থ রাজনীতির পথে আনতে ভূমিকা রাখার চেষ্টা করছেন! কিন্তু আমার ধারণা, তাঁকে অন্ধকারে রেখে খালেদা-তারেকের নেপথ্য নির্দেশদাতাদের নির্দেশে সুষ্ঠু ভোটদান প্রক্রিয়ায় পরিকল্পিত নাশকতা সৃষ্টির চেষ্টা করা হয়েছে। তাদের উদ্দেশ্য ছিলো আবারও ৫ জানুয়ারির মতো নির্বাচন অনুষ্ঠানের ভুয়া অভিযোগ তুলে, সরকারকে বিদেশীদের কাছে বেকায়দায় ফেলা! তবে খালেদা-তারেক ও তাদের প্রধান নির্দেশদাতাদের ভয়ঙ্কর বেকায়দায় ফেলে দেয় বিএনপির মেয়র পদে অংশগ্রহণকারীদের প্রাপ্ত লক্ষাধিক ভোট সংখ্যা! কয়েকদিন আগে খালেদার পেট্রোলবোমা সন্ত্রাসের মাধ্যমে মানুষ হত্যা, আহত দগ্ধ মানুষের আহাজারি, দেশের পরিবহন, কৃষি, শিল্প খাত ধ্বংসের কার্যক্রম দেখার পরও বিএনপি প্রার্থীদের পক্ষে এই বিপুল ভোটÑ সমর্থন ওই প্রার্থীদেরসহ জনগণকে বিস্মিত করেছে! কেন মুক্তিযুদ্ধপন্থী সরকার দেশের সর্বক্ষেত্রে এত উন্নয়ন করার পরও দেশবিরোধী, দেশ ধ্বংসরত এই দলটি এত বিপুলসংখ্যক ভোট লাভ করে? তবে কি মুক্তিযুদ্ধপন্থী ও যুদ্ধাপরাধী বাংলাদেশ-বিরোধীর সংখ্যা প্রায় কাছাকাছি? বিএনপির মতে ভোটে ‘কারচুপি’ হয়েছে! তাই যদি সত্য হয়, তাহলে তো বলতে হয়, কারচুপি হলে বিএনপির পক্ষেই তা হয়েছে, নতুবা প্রার্থিতা প্রত্যাহার করার পরও ওই প্রার্থীরা এত লাখ ভোট কিভাবে পায়? এমাজউদ্দীন সাহেব ‘শত নাগরিক’ কমিটির নেতা হিসেবে ২০০৬-এর বিএনপি প্রেসিডেন্ট ইয়াজউদ্দীনের মতোই খালেদার আরেকজন ‘ইয়েসউদ্দীন’ হয়ে নিজেকে নিজেই লজ্জা দিয়েছেন, নিজেকে অবনমিত করেছেন, যা করার জন্য তাঁর কোন প্রয়োজনই ছিল না! বিএনপির পুরো দলে এমাজউদ্দীন সাহেবই ছিলেন একমাত্র যিনি দৃঢ়ভাবে ওই কুচক্রী নির্দেশ অমান্য করতে পারতেন, প্রার্থীরা যারা প্রার্থিতা প্রত্যাহার করতে অনাগ্রহী ছিল, তারা শক্তি লাভ করত, বিএনপির গণতন্ত্রপন্থী গোষ্ঠীটি তাঁকে কেন্দ্র করে জোট বদ্ধভাবে গণতান্ত্রিক রাজনীতির বন্ধ দুয়ারটি বিএনপির জন্য তিনি খুলে দিতে পারতেন! বিএনপির জন্য, গণতন্ত্র রক্ষার জন্য এমাজউদ্দীনের হাতে একটি সুবর্ণ দুর্লভ সুযোগ এসেছিল যেটি তিনি হেলায় হারালেন এবং বিএনপি ও গণতন্ত্র দুটিকেই পরাজিত করার পক্ষে অবস্থান গ্রহণ করলেন! আবারও ৫ জানুয়ারি যেমন সংবিধান ও গণতন্ত্র রক্ষার্থে বঙ্গবন্ধু-কন্যার অসামান্য দৃঢ় অবস্থানের ফলে এবং খালেদার নেতৃত্বেও নির্দেশে সাধিত বিপুল ক্ষয়-ধ্বংসযজ্ঞের মধ্যেও নির্বাচন অনুষ্ঠান করে একটি সাংবিধানিক সরকার গঠন করেছিলেন। ঠিক তেমনি বর্তমান সরকার ও নির্বাচন কমিশনের কাছে জামায়াত-বিএনপির পরিকল্পিত নাশকতা বন্ধে আগাম ব্যবস্থা গ্রহণের ফলে জাতি আরও একবার ভোটারের ভোট প্রদানের অধিকার, প্রার্থীদের নিরাপত্তা ও প্রচারের অধিকার, নির্বাচনী কার্যক্রমের সবার নিরাপত্তা, ভোট গণনা ও ফল প্রকাশ সব কার্যক্রম সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করা সম্ভব হয়েছে। এতে ৫ জানুয়ারি যেমন গণতন্ত্র রক্ষা পেয়েছিল তেমনি আবার ২৮ এপ্রিলও প্রধানমন্ত্রীর খালেদারক্ত পিপাসার বিপরীতে শুভবোধ ও দেশ এবং জাতির স্বার্থে দৃঢ় অবস্থান গণতন্ত্রকেই রক্ষা করেছে! খালেদা সব কর্মকা-ই দেশ বিরোধী, প্রমাণ হয়েছে, যেমনÑ তাঁর নির্দেশে ২০১৩-এর হেফাজত-জামায়াত-বিএনপি ক্যাডার দিয়ে যে হত্যাযজ্ঞ দেশ ধ্বংসের অপতৎপরতা চলেছে! তা তাঁকে মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ-বিরোধী খলনায়িকা হিসেবে চিত্রিত করেছে। আবার, ২০১৫-এর জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত ‘রাজনৈতিক আন্দোলনের’ নামে পেট্রোলবোমা ছুড়ে মানুষ হত্যা, যানবাহন ধ্বংস, কৃষি, শিল্প ধ্বংস তাঁকে আবারও মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশের শত্রু প্রমাণ করেছে! সিটি নির্বাচনে নিজে ভোটভিক্ষা করে কোন কারণ ছাড়াই নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দিয়ে খালেদা আরও একবার প্রমাণ করেছে- সে গণতন্ত্র চায় না, চায় নাশকতা, ষড়যন্ত্রের দ্বারা যা মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশকে ধ্বংস করা! খালেদা-তারেক-জামায়াত-জঙ্গী আইএসআই যৌথভাবে একটিই লক্ষ্যেÑ কাজ করছে মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশকে ধ্বংস করা! গণতন্ত্র গুলে খায়, না মাথায় দেয়, তা নিয়ে খালেদাসহ এদের বিন্দুমাত্র ভাবনা নেই। খালেদার লক্ষ্যÑ সিটি নির্বাচনকে ‘একদলীয় নির্বাচন’ হিসেবে বিদেশীদের কাছে উপস্থাপন করার লক্ষ্যটি পুরোপুরি মাঠে মারা গেছে! এই বিএনপি প্রার্থীরা লক্ষাধিক ভোট পেয়ে খালেদার, ‘শত নাগরিক কমিটি’র প্রতিবাদের মুখ বন্ধ করে দিয়েছে! বাকি থাকল, ডেইলি স্টার, প্রথম আলো, যুগান্তর, এসএ টিভি, একুশে টিভিসহ কিছু মিডিয়ায় বার বার কতিপয় কিশোর যুবকের ভাংচুরের ঘটনাগুলো ও বড় বড় করে প্রচার! নির্বাচন কমিশন তিনটি কেন্দ্রের ভোটগ্রহণ একই দলীয় কাউন্সিলরদের সমর্থকদের মধ্যে গ-গোলের কারণে বন্ধ করা হয়েছে বলে জানান, তখন হাজারের ওপর কেন্দ্রের মধ্যে এ সংখ্যা হয় অতি নগণ্য! সুরিটোলা স্কুল ও কবি নজরুল কলেজের চিত্র বারংবার প্রচারিত হয়েছে নির্দিষ্ট কিছু টিভিতে এবং বড় সংবাদপত্রে! এখন মিডিয়া ব্যক্তিদের বুঝতে হবে ১. জনগণ জানে জামায়াত-বিএনপির-মিডিয়ায় হাজার কোটি টাকা বিতরণ করেছে! ২. দুই মিডিয়ায় শুধু দু’তিনটি ঘটনাকে নানাভাবে, বড়, ছোট করে প্রচার করা এ মন্ত্র যুগে কোন ব্যাপারই নয়! ৩. ইংরেজীতে প্রচার করলে খালেদা বেশি খুশি হবে, তাই কোন কোন টিভি অসময়ে ইংরেজীতে ভাংচুর, কারচুপির খবর বার বার প্রচার করছিল! ডেইলি স্টার তো নির্বাচনকে খালেদার পেট্রোলবোমার চাইতে বিশাল ক্ষতিকর ঘটনা হিসেবে চিত্র, সংবাদ মন্তব্য প্রতিবেদন দিয়ে প্রমাণ করার চেষ্টা করেছে! এর ফল অবশ্য ফলেছে! ইইউ, কানাডা, যুক্তরাষ্ট্র এসব ঘটনার তদন্ত চেয়েছে, যা আমরাও চাই, কারণ আমার মতে, এগুলোও ছিল পরিকল্পিত ভাংচুর-নাশকতা যা দুপুরের পর সংঘটিত হয়েছে। আমরা জনগণ বিএনপি প্রার্থীদের লাখ লাখ ভোট পেতে দেখে যতই বিস্মিত হই না কেন, একদিক থেকে এ ভোট কিন্তু আমাদের জন্য সাপে বর হয়ে এসেছে! লাখ লাখ ভোট লাভ করা দলটিকে স্বীকার করতেই হবেÑ বর্তমান সরকারের অধীনে বর্তমান নির্বাচন কমিশনের পরিচালনায় অনুষ্ঠিত নির্বাচনে কারচুপি হয়নি! কারচুপি হলে তো তারা পেত কয়েক হাজার ভোট, আর আওয়ামী লীগ পেত আরও বেশি ভোট তাই নয়, কি? যে দুটি স্থানে সিল মারার দৃশ্য প্রচার করেছে সে দৃশ্যগুলো খুব বেশি পরিকল্পিত বলে মনে হয়নি কি? যে দেশে হাজার টাকা দিয়ে খুন করানো যায়, সে দেশে টাকা দিয়ে সিল মারা, দু-তিনটি ব্যালটবক্সে ব্যালট পেপার ভরানো টিভির ক্যামেরার সামনে কোন ব্যাপার নয়, টাকা তো কথা বলে। সবশেষে বলব, এ নির্বাচনে গণতন্ত্র বিজয়ী হয়েছে, ষড়যন্ত্র ও ষড়যন্ত্রকারী খালেদা পরাজিত হয়েছে। দেশবাসীর প্রতি আহ্বান, দেশ ধ্বংসকারীর পক্ষ ত্যাগ করুন, গণতন্ত্রের প্রকৃত বন্ধুর পক্ষ গ্রহণ করুন। লেখক : শিক্ষাবিদ ও গবেষক
×