ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

অধ্যাপক হাসান আবদুল কাইয়ূম

প্রসঙ্গ ইসলাম ॥ ইসলামে শ্রমিকের অধিকার

প্রকাশিত: ০৪:১৮, ১ মে ২০১৫

প্রসঙ্গ ইসলাম ॥ ইসলামে শ্রমিকের অধিকার

‘দুনিয়ার মজদুর এক হও’ স্লোগানটি আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবসের স্লোগান হিসেবে উচ্চারিত হয়ে আসছে ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ দিক থেকে। শ্রমিক বা মেহনতী মানুষের অধিকার ও শ্রমের মর্যাদা ইসলাম তারও বহু পূর্ব থেকে নিশ্চিত করেছে। প্রথম মানব আদম ‘আলায়হিস্ সালাম’ ও প্রথম মানবী হযরত হাওয়া ‘আলায়হাস্্ সালামকে জান্নাত থেকে যেদিন পৃথিবীতে পাঠিয়ে দেয়া হলো সেদিন থেকেই তাঁরা শ্রমনির্ভর হয়ে পড়লেন। প্রায় সাড়ে তিন শ’ বছর হযরত আদম ‘আলায়হিস্্ সালাম শ্রীলঙ্কার একটি পাহাড় চূড়ায় এবং হযরত হাওয়া ‘আলায়হাস্্ সালাম’ লোহিত সাগরের তীরবর্তী জেদ্দার বিরান ভূমিতে নিঃসঙ্গ অবস্থায় রাত-দিন আল্লাহর কাছে তাঁদের জান্নাতে থাকাকালে শুধুমাত্র একটি ভুলের জন্য মাফ চেয়ে কান্নাকাটি করেছেন। কোনকিছু পাওয়ার জন্য কঠিন পরিশ্রম করার স্পৃহা তখন থেকেই মানব-মানবী সত্তায় সঞ্চারিত হয়। যে কোন কিছু অর্জনের জন্য শ্রম অপরিহার্য হয়ে পড়ে। আদম-হাওয়ার সেই শ্রম বিফলে যায়নি। আল্লাহ্্ তাঁদের তওবাকে কবুল করে মক্কা মুর্ক্রামায় পুনর্বাসিত করেন। পৃথিবীতে প্রথম মানব-মানবী সংসার বাঁধেন। অন্ন, বস্ত্র ও বাসস্থানের জন্য প্রয়োজন হয় শ্রমের। আল্লাহর ফেরেশ্্তা জিব্্রাঈল (আ.) হযরত আদম ‘আলায়হিস্্ সালামকে’ খাদ্য উৎপাদন, বস্ত্র বয়ন, গৃহনির্মাণ এবং মা হাওয়া ‘আলায়হাস্ সালামকে বস্ত্র সেলাই, রান্নাবান্না, সন্তান লালনপালন প্রভৃতির কায়দা-কানুন বাতলিয়ে দেন। তখন থেকেই উপার্জনে এবং সংসার গড়ে তোলার ক্ষেত্রে শ্রমের বা মেহনতের গুরুত্ব প্রকট হয়ে ওঠে। আদম-হাওয়ার বংশধারা বৃদ্ধি পেতে পেতে সমাজ, গোষ্ঠী, জনপদ গঠিত হতে থাকে। সবাই মিলেমিশে যৌথ শ্রমে খাদ্য সংগ্রহে, খাদ্য, উৎপাদনে এবং জীবিকার তাবত কিছুতে আত্মনিয়োগ করে এবং সমতার ভিত্তিতে ভাগ-বাটোয়ারার মাধ্যমে বসবাস করতে থাকে। কিন্তু কালক্রমে একপর্যায়ে এসে সমাজের ভেতরে শক্তিধরের উদ্ভব ঘটে। ফলে সমাজের মানুষ শিকার করে আনে, ফসল উৎপাদন করে এনে তা জড়ো করে শক্তিধরের উঠোনে। শক্তিধরের কব্জায় শ্রমজীবী বা মেহনতী মানুষের উৎপাদিত ফসল বিনাশ্রমে এসে যায় এবং সেই শক্তিধর ব্যক্তি বিনাশ্রমে ওগুলো সিংহভাগ আত্মসাত করতে থাকে। এমনি করে সমস্ত প্রথার উদ্ভব ঘটে, উদ্ভব ঘটে শোষক ও শাসকের। মাথার ঘাম পায়ে ফেলে শ্রমিক উৎপাদন করে আর তার বেশিরভাগ ভোগ করে শোষক ও শাসক। ক্রমান্বয়ে রাজতন্ত্র এসে সব গ্রাস করতে থাকে। অথচ আল্লাহ্্ জাল্লা শানুহু সব মানুষকে সমান অধিকার দিয়েছেন। কেউ খাবে আর কেউ খাবে না- এই অসমনীতির বিরুদ্ধে ইসলাম সোচ্চার হয়েছে এবং এমন এক সুষম ব্যবস্থা সুসংহত করেছে যার মাধ্যমে একটা ভারসাম্যপূর্ণ শ্রমনীতির বিকাশ লাভ করেছে। যে নীতিতে মালিক-শ্রমিকের ব্যবধান ও বৈষম্য দূর করে ইনসাফ ও আদলভিত্তিক ব্যবস্থা নিশ্চিত করা হয়েছে। মালিক পুঁজি বিনিয়োগ করে আর শ্রমিক বিনিয়োগ করে শ্রম। যে কারণেও যে কোন ক্ষেত্রে মূলধন বিনিয়োগকারীর অবদান যে রকম গুরুত্ব বহন করে, একই রকম গুরুত্ব বহন করে শ্রমিকের শ্রম। উৎপাদনে উভয়ের অবদানই সমান। আবার এটাও ঠিক শ্রমবিহীন কোন উৎপাদনই সম্ভব নয়। সেদিকটা বিচার করলে পুঁজিলগ্নিকারীর চেয়ে শ্রমলগ্নিকারীর অবদান বেশি। হযরত ‘আবদুল্লাহ ইব্নে উমর রাদিআল্লাহু তা‘আলা আন্্হু’ থেকে বর্ণিত আছে যে, হযরত রসুলুল্লাহ (সা.) খায়বারের বাগান ও জমি ইয়াহুদীদের দিয়েছিলেন এই শর্তে যে, তারা তাতে মেহনত করবে ও ফসল ফলাবে এবং তারা সেই ফসলের অর্ধেক পাবে। (বুখারী শরীফ)। প্রিয়নবী হযরত মুহাম্মাদুর রসুলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম শ্রমজীবী মানুষের ন্যায্য অধিকার প্রদানের জোর তাকীদ দিয়েই ক্ষান্ত হননি; তিনি বলেছেন : তোমরা যা খাবে যা পরিধান করবে তাদেরও তাই খেতে দেবে, তাই-ই পরতে দেবে। এর দ্বারা এটা স্পষ্ট হয়ে যায় মালিকের অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান যেমনটা হবে, তেমনটা শ্রমিকেরও হতে হবে। প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু ‘আলায়হি ওয়া সাল্লাম’ যথাসময়ে শ্রমিকের ন্যায্য পারিশ্রমিক দিয়ে দেবার তাকীদ দিয়ে বলেন, শ্রমিকের ঘাম শুকিয়ে যাবার পূর্বেই তাঁর ন্যায্য মজুরি দিয়ে দাও। (ইবনে মাজা)। হাদিসে কুদসীতে আছে যে, আল্লাহ্ তা‘আলা বলেন, কিয়ামতের দিন আমি যে তিন ধরনের লোকের বিপক্ষ হব তারা হচ্ছে : আমার নামে ওয়াদা করার পরে যে লোক তা ভঙ্গ করে, যে কোন আযাদ ব্যক্তিকে বিক্রি করে তার মূল্য খায় এবং যে লোক শ্রমিককে কাজে লাগিয়ে তার দ্বারা নিজের কাজ আদায় করে নিয়ে তার পারিশ্রমিক দেয় না (বুখারী শরীফ)। শ্রমিকের শ্রমকে কাজে লাগিয়ে নিজের কাজ করিয়ে নিয়ে তার যথাযথ মজুরি না দেয়া উপরিউক্ত হাদিস শরীফের মর্মানুসারে বড় গোনাহ্্র কাজ, শুধু বড় গোনাহর কাজই নয়, কিয়ামতের দিন শ্রমিকের মজুরি না দেয়ার কারণে সে ব্যক্তি আল্লাহর শত্রু হিসেবে গণ্য হবে। ইসলাম শ্রমের মর্যাদা দিয়েই ক্ষান্ত হয়নি, শ্রম না করে যারা ভিক্ষাবৃত্তি অবলম্বন করে তাদের ব্যাপারেও কঠোর শাস্তির কথাও ঘোষণা করেছে। হযরত ‘আবদুল্লাহ্্ ইবনে ‘উমর রাদিআল্লাহু তা‘আলা আন্্হু থেকে বর্ণিত আছে যে, হযরত রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম বলেছেন : যে লোক রুজি-রোজগারের জন্য শ্রমের পরিবর্তে ভিক্ষাবৃত্তি অবলম্বন করে সে কিয়ামতের দিন এমন অবস্থায় উত্থিত হবে যে, তার চেহারায় এক টুকরো গোশ্্তও থাকবে না (বুখারী শরীফ)। এই হাদিসখানি দ্বারা এটা স্পষ্ট হয়ে যায় যে, শ্রমবিমুখ মানুষের রোজহাশরে বিকৃত ও হাড্ডিসর্বস্ব কঙ্কাল চেহারা হবে। হাদিস শরীফে আছে যে, হযরত আনাস রাদিআল্লাহ্্ু তা’আলা আন্্হু বলেন যে, একবার আনসারদের অন্তর্ভুক্ত এক ব্যক্তি প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলায়হি ওয়া সাল্লামের’ কাছে এসে ভিক্ষা চাইলে তিনি বললেন : তোমার ঘরে কি কিছুই নেই? সে বলল : জি, হ্যাঁ, একটি কম্বল আছে যার একটি অংশ বিছিয়ে শুই আর একটি অংশ গায়ে দেই আর একটি পানি পান করার জন্য লোটা আছে। হযরত রসুলুল্লাহ্্ সাল্লাল্লাহু ‘আলায়হি ওয়া সাল্লাম’ লোকটিকে ওই দুটো জিনিস নিয়ে আসতে বললে সে তা নিয়ে আসলো তখন হযরত রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম তা হাতে তুলে নিয়ে বললেন : এই দুটো জিনিস কিনে নেবার মতো কেউ কি আছে? উপস্থিত সাহাবীগণের মধ্য থেকে একজন বললেন : আমি এক দিরহামের বিনিময়ে ওই দুটো জিনিস কিনতে রাজি আছি। হযরত রসুলুল্লাহ্্ সাল্লাল্লাহু ‘আলায়হি ওয়া সাল্লাম’ বললেন : এর চেয়ে বেশি দামে কেউ কি খরিদ করার আছে? এভাবে তিনি দুই বা তিনবার বললেন। এক ব্যক্তি বললেন : আমি দুই দিরহাম মূল্য দিয়ে তা কিনতে রাজি আছি। হযরত রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলায়হি ওয়া সাল্লাম’ দুই দিরহামের বিনিময়ে লোকটিকে জিনিস দুটো দিয়ে দিলেন। তারপর দিরহাম দুটো আনসার লোকটির কাছে দিয়ে বললেন : এক দিরহাম দিয়ে খাবার-দাবার কিনে নিজ পরিবারের কাছে যাবে, আর অন্য একটি দিরহাম দিয়ে একটি কুড়াল কিনে আমার কাছে নিয়ে আসবে। লোকটি একটি কুড়াল কিনে হযরত রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলায়হি ওয়া সাল্লামে’র নিকট নিয়ে আসল। হযরত রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলায়হি ওয়া সাল্লাম’ নিজ হাতে কুড়ালটির একটি হাতল লাগিয়ে দিয়ে বললেন : যাও এই কুড়াল দিয়ে জঙ্গল থেকে কাঠ কেটে এনে বিক্রি কর গিয়ে। আমি যেন ১৫ দিনের মধ্যে তোমাকে না দেখি। অতঃপর লোকটি জঙ্গলে গিয়ে কাঠ সংগ্রহ করে এনে তা বিক্রি করে দশ দিরহাম আয় করল। এই উপার্জিত দিরহামের কয়েকটি দ্বারা খাবার-দাবার ও কাপড়-চোপড় খরিদ করল। সে হযরত রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলায়হি ওয়া সাল্লামের’ দরবারে হাজির হলো। তখন হযরত রসুলুল্লাহু (সা.) বললেন : কিয়ামতের দিন তোমার চেহারায় ভিক্ষা করার কারণে যে বিশ্রী দাগ পড়তো তার চেয়ে এটা তোমার জন্য উত্তম পন্থা। (আবূ দাউদ শরীফ)। প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলায়হি ওয়া সাল্লাম’ আরও বলেছেন : যে ব্যক্তি ভিক্ষা করে সে নিজের চেহারাকে নিজেই ক্ষতবিক্ষত করে। (আবূ দাউদ শরীফ)। আমরা যদি নবী-রসুলগণের জীবনী পর্যালোচনা করি তাহলে দেখতে পাব তাঁরা সবাই পরিশ্রমী ছিলেন। হযরত ‘আবদুল্লাহ ইবন ‘আব্বাস রাদি আল্লাহু তা’আলা আনহু বর্ণিত একখানি হাদিসে আছে যে, কানা দাউদু যাররাদান্্ ওয়া কানা আদামু র্হ্রাাছান্্ ওয়া কানা নূহুন নাজ্্ জারান্্ ওয়া কানা ইদ্্রীসু খায়ইয়াতান ওয়া কানা মূসা র’ইইয়ান-হযরত দাউদ ছিলেন বর্ম প্রস্তুতকারী, আদম ছিলেন কৃষিজীবী, নূহ ছিলেন কাঠমিস্ত্রী, ইদরীস ছিলেন দর্জি এবং মূসা ছিলেন রাখাল। হযরত আবূ হুরায়রা রাদিআল্লাহু তা’আলা আন্্হু থেকে বর্ণিত আছে যে, হযরত রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলায়হি ওয়া সাল্লাম বলেছেন : পৃথিবীতে আল্লাহ্্ এমন কোন নবী পাঠাননি যিনি বকরি চরাননি। সাহাবায়ে কেরাম জিজ্ঞাসা করলেন : আপনিও কি! তিনি বললেন : হ্যাঁ আমি কয়েকটি কীরাতের বিনিময়ে মক্কার লোকদের ছাগল চরাতাম (বুখারী শরীফ)। শ্রমজীবী মানুষের মেহনতে বিশ্বসভ্যতা বিকশিত হয়েছে। কুরআন মজীদে ইরশাদ হয়েছে : নিশ্চয়ই আমি (আল্লাহ মানুষকে সৃষ্টি করেছি শ্রমনির্ভর করে (সূরা বালাদ : আয়াত ৪)। ১ মে আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস। যে ঘটনার প্রেক্ষিতে এই দিবসের উদ্ভব তা ঘটেছিল ১৮৮৬ খ্রিস্টাব্দের এ দিনে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো শহরের হে মার্কেটে চলা শ্রমিক ধর্মঘটের সময় মালিকদের লেলিয়ে দেয়া পেষ্য গুণ্ডা ও পুলিশ বাহিনীর আক্রমণে নিহত ৬ শ্রমিকের স্মরণে। সেই আন্দোলনের যাঁরা নেতা ছিলেন তাঁদের আদালতের কাঠড়ায় দাঁড় করিয়ে ফাঁসির হুকুম দেয়া হয়। এই ফাঁসির বিরদ্ধে বিশ্ব বিবেক সোচ্চার হয়ে ওঠে। মনীষী জর্জ বার্নার্ড শ’ ও জোরালো প্রতিবাদ জানান। সেই জর্জ বার্নার্ড শ’ বলেছেন : If all the world was united under one leader then Muhammad would have been the best fitted man to lead the peoples of various creeds, dogmas and ideas to peace and happines.- নানা ধর্মমত, ধর্ম বিশ্বাস ও চিন্তাধারার মানুষকে শান্তি এবং সুখের দিকে পরিচালিত করার জন্য গোটা পৃথিবীটাকে যদি একত্র করা হতো তাহলে হযরত মুহাম্মদ (সা.)ই হবেন সর্বোত্তম যোগ্য নেতা। লেখক : পীর সাহেব দ্বারিয়াপুর শরীফ, উপদেষ্টা ইনস্টিটিউট অব হযরত মুহাম্মদ (সা.) সাহেব পরিচালক ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ
×