ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

বিএনপির মানুষ হত্যা ও ভাল প্রার্থীর অভাবে সুবিধায় আওয়ামী লীগ

প্রকাশিত: ০৫:৩৮, ২৮ এপ্রিল ২০১৫

বিএনপির মানুষ হত্যা ও ভাল প্রার্থীর অভাবে সুবিধায় আওয়ামী লীগ

রাজন ভট্টাচার্য ॥ ঢাকায় প্রথমবারের মতো দুই সিটি নির্বাচনে মেয়র প্রার্থী সংখ্যা ৩৬ জন। তাদের মধ্যে দক্ষিণের জাসদের প্রার্থী আওয়ামী লীগ সমর্থিত সাঈদ খোকনকে সমর্থন দিয়ে ভোট থেকে সড়ে দাঁড়িয়েছেন। নির্বাচন পর্যবেক্ষক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, নির্দলীয় নির্বাচন হলেও ভোটের লড়াই হবে পুরোপুরি দলীয় দৃষ্টিকোণ থেকেই। লড়াইয়ে অন্য সময়ের মতো প্রথম সাড়িতে থাকবে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি সমর্থিত প্রার্থীরা। এর মধ্যে উত্তর সিটিতে আওয়ামী লীগ, বিএনপি ছাড়াও জাতীয় পার্টি ও বিকল্পধারার এই চার দলের সমর্থিত মেয়র প্রার্থীদের মধ্যে জমবে ভোটযুদ্ধ। দক্ষিণে আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টি এই তিন দল সমর্থিত প্রার্থীর মধ্যে লড়াই হবে। সম্প্রতি রাজনৈতিক কর্মসূচীর নামে সারাদেশে ২০ দলের পেট্রোলবোমা হামলা, আগুন দিয়ে মানুষ হত্যা সন্ত্রাসসহ সঠিক প্রার্থী নির্বাচন না হওয়ায় সুবিধাজনক অবস্থানে নেই বিএনপির প্রার্থীরা। সন্ত্রাস, জঙ্গীবাদ কাল হয়ে দাঁড়াতে পারে বিএনপির জন্য। আওয়ামী লীগের জন্য বিপদ অনিয়ম আর দলীয় নেতাকর্মীদের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা। সব বিবেচনায় ভোটাররাই ঠিক করবেন কার পক্ষে রায় দেবেন তারা। শেষ পর্যন্ত কে হাসবেন বিজয়ের হাসি তা দেখতে অপেক্ষা করতে হবে মাত্র কয়েক ঘণ্টা। এদিকে খালেদা জিয়াকে বর্জন করতে ভোটারদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে আসল বিএনপি। রবিবার সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও বলেছেন, খালেদা জিয়ার মতো জালেম খুনীর ডাকে জনগণ সাড়া দেবে না। যাদের ন্যূনতম মনুষ্যত্ব বিবেক ও মানসিকতা রয়েছে তারা কখনই খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোট ও তাদের প্রার্থীদের ভোট দেবে না। অবরোধ হরতালের নামে উনি যেভাবে দেশের মানুষের সর্বনাশ করেছে, তাঁর ডাকে কখনই মানুষ সাড়া দিতে পারে না। দেবেও না। বরং হত্যার শিকার ও ক্ষতিগ্রস্ত জনগণ প্রতিশোধ নিলে কার বিরুদ্ধে নেবে? সেটিও বিএনপির নেত্রীর ভেবে দেখা উচিত। ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন ॥ ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে ২০ মেয়র প্রার্থী থাকলেও মূলত লড়াই হবে আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থী সাঈদ খোকন ও বিএনপির মির্জা আব্বাসের মধ্যে। মামলার ভয়ে দীর্ঘদিন পলাতক বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ও সাবেক মেয়র আব্বাস। আদালতে হাজিরা দিতে প্রকাশ্য হন। কাজ শেষে আত্মগোপনে যান তিনি। প্রচারে পুরো সময়েই তাকে মাঠে দেখা যায়নি। তাঁর পক্ষে ন্ত্রী আফরোজা আব্বাস নির্বাচনী প্রচার করে। প্রার্থী হিসেবে আব্বাসের মাঠে না থাকার বিষয়টি ভোটারদের অনেকেই ভাল চোখে দেখেননি। তাছাড়া রাজনৈতিক কর্মসূচীর নামে সারাদেশে সহিংস তা-বের দৃশ্যও মানুষ ভুলে যায়নি। সব মিলিয়ে ভোটের রাজনীতিতে ভাল অবস্থানে নেই আব্বাস। বিএনপির একাধিক সূত্র বলছে, আব্বাস মেয়র ছিলেন তখন তাঁর বিরুদ্ধে ছিল নানা অনিয়মের অভিযোগ। সিটি নির্বাচনকে কেন্দ্র করে আবারও তা সামনের দিকে এসেছে। মন্ত্রী হওয়ার পরও তাঁর বিরুদ্ধে ছিল নানা অভিযোগ। তাঁর ব্যক্তি ইমেজ বা নয়। বিএনপির মহানগর রাজনীতি নিয়ে সাদেক হোসেন খোকার সঙ্গে তাঁর বিরোধ চরমে। অন্য মহানগর নেতাদের সঙ্গে তাঁর সুসম্পর্ক নেই। তাই বিএনপির নগরের নেতাকর্মীরাও তাঁর পক্ষে নিবেদিত হয়ে কাজ করেননি। সবচেয়ে বেশি মামলা আব্বাসের বিরুদ্ধে। অর্থ সম্পদের দিক থেকেও সবচেয়ে বেশি তাঁর। আব্বাসের পক্ষে কেন্দ্রীয় নেতাদের মাঠে দেখা যায়নি। দলের চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া মাঠে নামলেও ব্যাপক জনপ্রতিরোধ তৈরি হয়। তবে আব্বাসের পক্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য এমাজউদ্দীন আহমদের নেতৃত্বে কমিটি কাজ করেছে। সাবেক সফল মেয়র মোহাম্মদ হানিফের পুত্র সাঈদ খোকন। ঢাকা মহানগর নেতা তিনি। তাঁর ব্যক্তি ইমেজ যেমন ভাল তেমনি পারিবারিক সুনাম তো আছেই। তাঁর পক্ষে ঐক্যবদ্ধ হয়ে দলের নেতাকর্মীরা কাজ করেছেন। বিরোধ মেটানোর চেষ্টা করেছেন খোদ প্রধানমন্ত্রী নিজেই। একেকটি ওয়ার্ডে নির্বাচনী দায়িত্ব দেয়া হয় একেক জন সংসদ সদস্যদের। ২০ দলের সন্ত্রাসের কারণে অনেকেই বিএনপি থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। সব দিক মিলিয়ে অনেকটাই সুবিধাজনক অবস্থানে সাঈদ খোকন। তাঁর পক্ষে দেশের বিশিষ্টজনরা সহস্র নাগরিক কমিটি গঠন করে অব্যাহতভাবে ভোট চেয়েছেন। বাড়ি বিক্রি করে লোন পরিশোধ করে তিনি নির্বাচন করছেন। এদিকে জাতীয় পার্টির প্রার্থী সাইফুদ্দিন আহমেদ মিলন দলীয় সমর্থকদের কিছু ভোট পাবেন। তাছাড়া বিএনপি নেতাকর্মীরাও নিজ দলের প্রার্থীদের ভোট না দিয়ে তাকে দিতে পারেন। আওয়ামী বিরোধী কথা বলায় বিএনপির কিছু ভোট টানতে পারেন আওয়ামী লীগের সাবেক সাংসদ গোলাম মাওলা রনি। চরমোনাই পীরের প্রার্থী আবদুর রহমানও ২০ দলীয় জোটের ভোট টানতে পারেন। উত্তর সিটি কর্পোরেশন ॥ ক্লিন ইমেজের প্রার্থীকে সমর্থন দিয়েছে আওয়ামী লীগ। ব্যবসায়ী নেতা ও সাংস্কৃতিক জগতের মানুষ হিসেবে পরিচিত আনিসুল হক। ক্লিন ইমেজের কারণে তিনি সর্বজনগ্রহণযোগ্য একজন প্রার্থী। তাঁর পক্ষে সহস্র নাগরিক কমিটি থেকে শুরু করে শিল্পী, ব্যবসায়ী, মুক্তিযোদ্ধা, শিক্ষকসহ বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষ মাঠে নেমেছেন। অন্তত ২০টি শিল্প প্রতিষ্ঠানের মালিক তিনি। এফবিসিসিআইর সাবেক সভাপতি ছিলেন আনিসুল হক। তাঁর বিরুদ্ধে কোন মামলা নেই। অপরদিকে বিএনপি থেকে খালেদা জিয়ার উপদেষ্টা আবদুল আওয়াল মিন্টুর মনোনয়নপত্র বাতিল হওয়ায় তাঁর ছেলে তাবিথ আওয়াল প্রার্থী হয়েছেন। তাবিথের রাজনৈতিক কোন পরিচয় নেই। রাজনীতির মাঠে কখনই ছিলেন না তিনি। এটাই বিএনপির জন্য সবচেয়ে বড় ধাক্কা। তাছাড়া দলের কেন্দ্রীয় নেতাদের তেমন কেউ তাঁর পক্ষে মাঠে নামেনি। এদিকে বিএনপির অন্যতম মিত্র বিকল্পধারার প্রার্থী মাহী বি. চৌধুরী খালেদা জিয়ার কাছ থেকে সমর্থন চেয়েও পাননি। বিএনপির অনেক ভোটেই টানবেন মাহী। ২০ দলও বিষয়টি টের পেয়েছে। এ জন্য মাহীকে ভোট থেকে সরে দাঁড়াতে হুমকি ধমকি দেয়া হচ্ছিল। শেষ পর্যন্ত মাহীসহ তাঁর স্ত্রীও ওপর তাবিথের লোকজন হামলা চালিয়েছে। সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে সরকারের বিরুদ্ধে নীরব প্রতিশোধ নিতে সবার প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া। কিন্তু সেদিনই উল্টো তাকে বয়কট করার আহ্বান জানিয়েছে ‘আসল’ বিএনপি। সোমবার গণমাধ্যমে পাঠানো এক বিবৃতিতে দলটির ‘আসল’ মুখপাত্র বলে নিজেকে দাবি করা কামরুল হাসান নাসিম এ আহ্বান জানান। বিবৃতিতে নিজের পরিচয় হিসেবে নাসিম লেখেনÑ বিএনপির রাজনীতির ক্রান্তিকালীন সময়ের সঙ্কটকালীন মুখপাত্র। এতে তিনি বলেন, ভোটের দিনে নীরব প্রতিশোধের কথা বিএনপির অবৈধ চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া ঘটা করে বললেও বাস্তবতা হলোÑ ২৮ এপ্রিল, দলের মধ্যকার গণতন্ত্র ফেরাতে এবং রাজনীতির মূল ধারায় ফিরতে তাকেই সবাই বয়কট করবে বলে দলের পক্ষ থেকে জানানো যাচ্ছে। সোমবার রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে বিএনপি সমর্থিত প্রার্থীদের পক্ষে ভোটারদের মধ্যে টাকা দিতে গিয়ে হাতেনাতে ধরা পড়েছেন অন্তত ছয়জন। ভোটের ক্ষেত্রে এটিও বিএনপির জন্য সুখকর কিছু হবে না। দলীয় প্রার্থীদের পক্ষে ভোট চাইতে বাংলামোটরে খালেদা জিয়ার গাড়ি বহরে হামলা ঘটনা ব্যাপকভাবে প্রচার হয়েছিল। কিন্তু রবিবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একটি ছবিতে দেখিয়েছেন, খালেদা জিয়ার গাড়ির নিচে মানুষ চাপা পড়ার দৃশ্য। পাশাপাশি খালেদা জিয়ার নিরাপত্তা কর্মীদের অস্ত্র দিয়ে প্রকাশ্য গুলি করার ছবিও দেখানো হয় প্রধানমন্ত্রীর সংবাদ সম্মেলনে। মূলত এ কারণেই ক্ষুব্ধ জনতা গাড়ি বহরে হামলা করার কথা বলেন প্রধানমন্ত্রী। এসব ছবি সোমবার বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে ফলাও করে চাপা হওয়ায় বিএনপির প্রতি ভোটারদের নেতিবাচক ধারণার জন্ম হয়।
×