ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

সমুদ্র হক

ভয়ঙ্কর দুর্যোগ হয়ে আসছে ভূমিকম্প

প্রকাশিত: ০৩:৫৫, ২৮ এপ্রিল ২০১৫

ভয়ঙ্কর দুর্যোগ হয়ে আসছে ভূমিকম্প

বঙ্গীয় বদ্বীপে ভূঅভ্যন্তরে শিলাস্তরের গঠন এলোমেলো হয়ে ফাটল দেখা দেয়ায় এবং শিলাচ্যুতি ঘটার কারণে ভূকম্পনের ভৌগোলিক অবস্থানও আর ঠিক থাকছে না। বছর কয়েক আগেও বাংলাদেশে ভূমিকম্পের মাত্রা কোন অঞ্চলে কতটা হবে, তার একটা হিসাব কষা হয়েছিল। সেই হিসাবে ভূকম্পন প্রবণ এলাকা ছিল তিনটি। বর্তমানে উপমহাদেশের সিসমিক জোন বাংলাদেশ পর্যন্ত বিস্তৃত করে ৪ ও ৫ নম্বর জোনে বাড়ানো হয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বিপজ্জনক জোন হলো ৫ নম্বর, যেখানে ঢাকা বিভাগের পূর্বাংশকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এর সঙ্গে যোগ করা হয়েছে চট্টগ্রাম বিভাগের একাংশ। এরপরেই ৪ নম্বর জোনে রয়েছে পশ্চিমাঞ্চলীয় এলাকা- রাজশাহী, খুলনা ও ঢাকা বিভাগের আরেক অংশ। যে ভাবেই হোক ভূকম্পনের ভয়াবহ পরিণতির টার্গেটে রয়েছে ঢাকা। তার অর্থ এই নয়, ইতোপূর্বে যে এলাকাগুলোকে কম ঝুঁকিপূর্ণ মনে করা হচ্ছে, তা ঠিক থাকবে। এ বিষয়ে বিজ্ঞানীরা ১৯৯৩ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর ভোরে ভারতের মহারাষ্ট্রে সবচেয়ে বড় ভূকম্পনের দৃষ্টান্ত দেন। বরাবরই বলা হয়েছিল মহারাষ্ট্র ভূকম্পন ঝুঁকির বাইরে। বিজ্ঞানীরা বলেছিলেন, ওই এলাকার (মহারাষ্ট্র) ভূস্তর স্থিতিশীল। ভূকম্পন ঘটবে না। সেই তত্ত্ব¡ আর টেকেনি। ভূকম্পনের পর বিজ্ঞানীরা বলেছেন, ভূস্তরের বিন্যাসে কোন ভারসাম্যহীনতার কারণেই ভয়ঙ্কর ভূমিকম্প হয় মহারাষ্ট্রে। ওইদিন সাত দফায় ভূকম্পন হয় মহারাষ্ট্রে। প্রথম দফায় ভোর ৩টা ৫৬ মিনিট, দ্বিতীয় দফায় ভোর ৪টা ৪২ মিনিট, তৃতীয় দফায় সকাল ৬টা ২৫ মিনিট, চতুর্থ দফা সকাল ৭ টা ৪৭ মিনিট, পঞ্চম দফা সকাল ৯ টা ৩ মিনিট, ষষ্ঠ দফা সকাল ৯ টা ৪০ মিনিট এবং শেষ দফা (সপ্তম) দুপুর ২টা ৪০ মিনিট। মহারাষ্ট্রের এই ভূকম্পনের পর ভূবিজ্ঞানীরা এতটাই বিস্মিত হয়ে যান যে, তারা ভাবতেই পারেননি প্রায় দশ ঘণ্টার ব্যবধানে সাত বার প্রচ- কম্পন হতে পারে। এরপর ভূবিজ্ঞানীরা ভূমিকম্প নিয়ে অনেক গবেষণা করেছেন, এখনও করছেন। কোন কিনারা করতে পারছেন না। বার বার একই বিষয় চলে আসছে, ভূঅভ্যন্তরের ফল্ট। এই ফল্ট মানুষেরই সৃষ্টি বলে ধারণা করা হচ্ছে। প্রকৃতির সঙ্গে যে ভাবে অসম যুদ্ধ শুরু হয়েছে, প্রকৃতি তার প্রতিশোধ নিচ্ছে নানাভাবে। বর্তমানে জলবায়ুর সঙ্গে প্রকৃতির সবচেয়ে বড় দুর্যোগ হতে যাচ্ছে ভূমিকম্প। উপমহাদেশে সেই আলামত এখন পরিষ্কার। রাজধানী ঢাকা থেকে প্রায় ৭শ’ কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে নেপালের দুই জায়গায় শনি ও রবিবারের ভূমিকম্পের উৎসস্থল। গত শতকের শেষের দিকেও বলা হতো, বাংলাদেশে ভয়াবহ ভূকম্পনের সম্ভাবনা নেই। কারণ হিসেবে বলা হতো, বাংলাদেশের ভূস্তরের শিলাস্তর বেশ দূরে এক কিলোমিটার নিচে। অর্থাৎ শিলাস্তরের ওপরের মাটি এক কিলোমিটার পুরু। এই মাটি কম্পন অনেকটা শুষে নিতে পারে। পরবর্তী সময়ে মহারাষ্ট্রের ভূমিকম্পের পর বিজ্ঞানীরা এই জায়গা থেকে সরে গিয়ে জানালেন, ভূকম্পন এলাকার বাইরে অনেক জায়গায় ভূমিকম্প হচ্ছে। ইন্দোনেশিয়ার সুমাত্রা ও জাভা থেকে ভূকম্পন এলাকা অগ্নিবলয়ের শুরু এবং তা আন্দামান ব্যারণ দ্বীপ ছুঁয়ে গিয়েছে একেবারে আরাকান সীমান্ত পর্যন্ত। এই অগ্নিবলয়ের পশ্চিম ও উত্তর প্রান্তে বাংলাদেশ। পূর্ব ও দক্ষিণ প্রান্তে চট্টগ্রাম। উত্তর ও পূর্ব প্রান্তের সিলেট, ময়মনসিংহ ও রংপুর এলাকা ভূমিকম্প বলয় দ্বারা প্রভাবিত। তবে মারাত্মক শঙ্কা হলো, বাংলাদেশের অধিকাংশ এলাকা গাঙেয় সমভূমি অঞ্চল। যা ক্রমেই সঙ্কুচিত হচ্ছে। এই সঙ্কোচন কোথাও কম, কোথাও বেশি যা যে কোন সময় ভূস্তরে সংঘর্ষ ঘটাতে পারে। এই সঙ্কোচনে শিলাচ্যুতি ঘটলে এক কিলোমিটার মাটির পুরু স্তর ভেদ করে ভূমিকম্প শহর ও জনপদ ধ্বংস করে দিতে পারে। তিনশ’ বছর আগে কলকাতা তার বড় প্রমাণ। সেইদিন কলকাতা ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছিল। কলকাতাও বাংলাদেশের মতোই গাঙেয় সমভূমি বা বদ্বীপ অঞ্চলে অবস্থিত। একবিংশ শতকের ভূমিকম্পের পর্যবেক্ষণে দেখা যায়, অনেক ক্ষেত্রে মানুষ প্রকৃতির দুর্যোগকে আহ্বান জানাচ্ছে। যেমন পাহাড় কাটা, ভূমি স্তরের গঠন নষ্ট করে দিয়ে বালি উত্তোলন (উত্তরাঞ্চলের অনেক জায়গায় নদী ও শুকনো ভূমির নিচে থেকে পাম্পের প্রেসার দিয়ে বালি উত্তোলন), পরিবেশ সংরক্ষণ না করা। বিজ্ঞানীদের কথা, মাটির নিচে প্রকৃতির যে স্তর আছে, তা এক ধরনের প্লেট। এই প্লেট যে কোনভাবে স্থানচ্যুত হলে ভয়াবহ ধ্বংসের সৃষ্টি হবে ভূউপরিভাগে। বঙ্গীয় বদ্বীপে হিমালয় পর্বতমালার প্লেটটি সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব বহন করে। এই প্লেটটিতেই ফাটল ধরেছে। আরেক দল ভূবিজ্ঞানী বলছেন, বর্তমানে অনেক ফল্ট লক্ষ্য করা যাচ্ছে ভূঅভ্যন্তরে। এই কারণে বেশি ম্যাগনিচুডের ভূমিকম্প রেকর্ড হচ্ছে। এবার নেপালে ৭ দশমিক ৫ ম্যাগনিচুডের যে ভূকম্পন হলো, তা ভূঅভ্যন্তরের ফল্টকেই তুলে ধরছে। এই দেশে ১৯১৮ সালে সিলেটের শ্রীমঙ্গলে ৭ দশমিক ৫ ম্যাগনিচুডের ভূকম্পন হয়েছিল। এই ভূমিকম্পটিই একশ’ বছর পর ফিরে আসতে পারে। সেই হিসেবে ২ হাজার ১৮ সালে বড় ভূমিকম্পের সম্ভাবনা দেখা যায়। তবে যেহেতু ভূমিকম্পের কোন পূর্বাভাস বিজ্ঞানসম্মতভাবে এখনও আবিষ্কার হয়নি, সে কারণে বলা যায়, যে কোন সময়েই ভয়াবহ ভূকম্পন হতে পারে বাংলাদেশে। যে আলামত এখন স্পষ্ট। নেপাল থেকে বাংলাদেশের দূরত্ব মাত্র ৭শ’ কিলোমিটার। বাংলাদেশে আসতেই বা কতক্ষণ...!
×