ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

অভিযোগ বিএনপি সমর্থিত মেয়র প্রার্থীদের বিরুদ্ধে

পবিত্র কোরান ছুঁইয়ে টাকা দিয়ে ভোট কেনার চেষ্টা!

প্রকাশিত: ০৫:৪৯, ২৬ এপ্রিল ২০১৫

পবিত্র কোরান ছুঁইয়ে টাকা দিয়ে ভোট কেনার চেষ্টা!

বিভাষ বাড়ৈ/আরাফাত মুন্না ॥ পবিত্র ধর্ম ও কোরান শরীফের অপব্যবহার করে মিথ্যা তথ্য ছড়িয়ে সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে ভোটারদের বিভ্রান্ত করছে বিএনপি। উস্কানি আর অর্থের প্রলোভন দেখিয়ে মৌলবাদী গোষ্ঠীকে মাঠে নামানোর সঙ্গে চলছে পবিত্র কোরান শরীফ ছুঁয়ে ভোট দেয়ার শপথ আদায়ের মতো অপরাধ। ধর্মের বিকৃত ব্যাখ্যা দিয়ে কোরান শরীফ ছুঁয়ে ভোট দেয়ার প্রতিশ্রুতি আদায়ের মতো গুরুতর অভিযোগ উঠেছে বিএনপি সমর্থিত মেয়র প্রার্থীদের বিরুদ্ধে। এ লক্ষ্যে মাঠে নামানো হয়েছে কয়েক হাজার নারীকে। জামায়াতের আশীর্বাদ থাকায় ঢাকা সিটি উত্তরের মেয়র প্রার্থী তাবিথ আউয়ালের পক্ষে মাঠে নেমেছে জামায়াতের ছাত্রী সংস্থার কর্মীরাও। মেয়র প্রার্থীর পক্ষে এরা বোরকা পরে বিভিন্ন বস্তি ও বাসাবাড়িতে গিয়ে নারী ভোটারদের কাছে ধর্মের অপব্যাখ্যা দিয়ে ভোট চাইছেন। কৌশলে কোরান শরীফ হাতে ধরিয়ে ভোট দিতে শপথ করাচ্ছেন। দেয়া হচ্ছে টাকাও। এদিকে কোরান শরীফ তথা ধর্মের নামে এ ধরনের তৎপরতাকারীদের ইসলামের দুশমন ও ধোঁকাবাজ বলে অভিহিত করেছেন দেশের বিশিষ্ট ইসলামী চিন্তাবিদ, আলেম ওলামারা। তাঁরা বলেছেন, এই অপশক্তি আজীবনই ইসলামের বদনাম করেছে মানুষের সঙ্গে ধোঁকাবাজি করে। জামায়াত হলো ইসলামের দুশমন আর তাদের দোসর হচ্ছে বিএনপি। এরা তাই এক সঙ্গেই ইসলামের বদনাম করছে। অবিলম্বে জনগণকে প্রতিরোধ গড়ে তোলার আহ্বানের সঙ্গে সঙ্গে নির্বাচন কমিশনকে এদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়ার দাবি জানিয়েছেন ইসলাম চিন্তাবিদরা। জানা গেছে, আইন থাকলেও প্রয়োগে নির্বাচন কমিশনের নীরবতার সুযোগে সরকারের বিরুদ্ধে অপপ্রচারের জন্য আগেই দিন ধরে মাঠে নামানো হয়েছে হেফাজত, খেলাফত মজলিশ, নেজামে ইসলামী, জমিয়াতে উলামায়ে ইসলামসহ মৌলবাদী গোষ্ঠীকে। সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে বিএনপিকে ইসলামের ধারক বাহক আর আওয়ামী লীগসহ সরকারকে ইসলামের প্রতিপক্ষ হিসেবে প্রচার চালানোর জন্য উগ্রবাদীদের সক্রিয় করছে বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া নিজেই। উগ্রবাদীদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করছেন জামায়াত-বিএনপির শীর্ষ নেতারা। হেফাজতের অনেক নেতাকর্মীকে উস্কানি, অর্থের প্রলোভন দেয়া হয়েছে। তৎপরতার অংশ হিসেবেই গেল সপ্তাহে খালেদা জিয়ার ও বিএনপি সমর্থিত মেয়র প্রার্থীর সঙ্গে বৈঠক করেছিলেন মৌলবাদী নেতারা। সূত্রগুলো বলছে, বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া ও তার ছেলে তারেক রহমানও মৌলবাদীদের ব্যবহার করে নির্বাচনী বৈতরণী পার হতে চান। তাদের নির্দেশের পরই উগ্রবাদী সংগঠনগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ শুরু করে বিএনপির শীর্ষ নেতারা। বিএনপি নেতারা এ কাজে জামায়াতের সহায়তা চেয়েছেন। সে অনুযায়ী বিএনপি-জামায়াতসহ উগ্রবাদী গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে কয়েক দফা বৈঠক হয়েছে। গত কদিন ধরেই বিভিন্ন মসজিদ মাদ্রাসায় দিয়ে একদিকে উগ্রবাদী দলগুলো নিজেদের অরাজনৈতিক বলে প্রচার চালাচ্ছে অন্যদিকে সরকার সমর্থক প্রার্থীদের ধর্মবিরোধী হিসেবে দাঁড় করানোর জন্য চালাচ্ছে অপপ্রচার। কৌশল হিসেবেই এবার আনুষ্ঠিতভাবে ঘোষণা দিয়ে মৌলবাদীরা নির্বাচনে বিএনপির মেয়র প্রার্থীদের পক্ষে মাঠে নামেনি উগ্রবাদী ধর্ম ব্যবসায়ী গোষ্ঠীটি। নেতাকর্মীরা স্থানীয়ভাবে মাঠে কাজ করছে যাবে যার যার অবস্থান থেকে। মসজিদ, মাদ্রাসাকে কেন্দ্র করে সরাসরি কৌশলে আওয়ামী লীগ বিরোধী তৎপরতা চালাচ্ছে এরা। বলা হচ্ছে ‘দেশে ইসলাম থাকবে না, যদি বিএনপি সমর্থিত প্রার্থীকে ভোট দেয়া না হয়।’ এদিকে ধোঁকাবাজি এ তৎপরতার অংশ হিসেবে সকাল থেকে মধ্য রাত পর্যন্ত পবিত্র কোরান শরীফ ছুঁয়ে ভোট আদায়ের মতো অপরাধে জড়িয়ে পড়েছে বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্ব ও তার প্রার্থী। ধর্মের বিকৃত ব্যাখ্যা দিয়ে কোরান শরীফ ছুঁয়ে ভোট দেয়ার প্রতিশ্রুতি আদায়ের মতো গুরুতর অভিযোগ উঠেছে বিএনপি সমর্থিত সকল মেয়র প্রার্থীর বিরুদ্ধেই। তবে এক্ষেত্রে সবচেয়ে এগিয়ে আছেন ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের উত্তরের প্রার্থী তাবিথ আউয়াল। কারণ হিসেবে জানা গেছে, তাবিথ আউয়ালের বাবা ব্যবসায়ী আবদুল আইয়াল মিন্টু বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়ার উপদেষ্টা হলেও তার শ্বশুর প্রভাবশালী জামায়াত নেতাদের একজন। শ্বশুর জামায়াত নেতা ইসকান্দার মির্জার মেয়ে জামাই হচ্ছেন তাবিথ আউয়াল। রাজনৈতিক পরিচয় বলতে এর বাইরে নিজস্ব তেমন কিছু ছিল না তাবিথের। তাবিথ আসলে বিএনপির নাকি জামায়াতের প্রার্থী তা নিয়েও প্রশ্ন আছে। বলা হয়, জামায়াতের তদবিরের কারণেই তাবিথ আউয়ালকে মেয়র প্রার্থীর টিকেট দেন বিএনপি চেয়ারপার্সন। মূলত নিজেদের প্রার্থীর তাবিথের পক্ষে মাঠে নেমেছে জামায়াতের ছাত্রী সংস্থার কর্মীরাও। প্রার্থীর পক্ষে এরা বোরকা পরে বিভিন্ন বস্তি ও বাসাবাড়িতে গিয়ে নারী ভোটারদের কাছে ধর্মের অপব্যাখ্যা দিয়ে ভোট চাইছেন। কৌশলে কোরান শরীফ হাতে ধরিয়ে ভোট দিতে শপথ করাচ্ছেন। বস্তিতে বস্তিতে গিয়ে ভোট চাচ্ছেন প্রধানত নারীদের কাছে। বস্তির গরিব নারীদের দেয়া হচ্ছে টাকা। বলা হচ্ছে, ‘কোরান শরীফ ছুঁয়ে শপথ করেন আমাদের প্রার্থীকে ভোট দেবেন। বোঝানোর চেষ্টা করা হচ্ছে, বিএনপির প্রার্থীকে ভোট দিলে ইসলাম থাকবে। না হয় সরকার ইসলামকে ধ্বংস করে ফেলবে।’ নারী ভোটারদের কাছে যুদ্ধাপরাধের দায়ে অভিযুক্ত জামায়াত নেতাদের বিষয়েও দেয়া হচ্ছে মিথ্যা ও বিবৃত তথ্য। আরও বলা হচ্ছে, ‘বিএনপি-জামায়াত প্রার্থীকে ভোট দিলে পরকালে মঙ্গল হবে।’ জানা গেছে, এ তৎপরতা চলছে রাজধানীর প্রায় প্রতিটি এলাকাতেই। গেল বৃহস্পতিবার রাত সাড়ে আটটার দিকে মহাখালীর আরজত পড়ায় একটি বাসায় গিয়ে হাজির হয়েছিলেন বোরকা পরিহিত চার মহিলা। পরিবারের কলেজ পড়ুয়া ছেলেটি দরজা খুলতেই তারা বললেন, খালা আছেন আমরা তাদের সঙ্গে কথা বলতে এসেছি নির্বাচনের বিষয়ে। আম্মা অসুস্থ বলে ছেলেটি জানালে তারা বলেন, একটু কথা বলেই চলে যাব। তবে তার পরেও ছেলেটি কথা বাড়াতে না চাইলে তারা বলেন, ভাই সামনে নির্বাচন। খালার কাছে এসেছিলাম ভোট চাইতে। আমাদের প্রার্থী তাবিথ আউয়াল। দেশে তো ইসলাম থাকবে না এই সরকারের প্রার্থীকে ভোট দিলে। আমাদের প্রার্থীকে ভোট দিলে ইসলাম ঠিকবে আর না হয় সরকার ইসলাম শেষ করে ফেলবে।’ ছেলেটি জনকণ্ঠকে শনিবার বলছিলেন, ‘তারা আমাকে অনেক বোঝানোর চেষ্টা করেছেন। কথা বলতে বলতে কোরান শরীফ বের করছিলেন। ইসলামী দল করেন বলেই জামায়াত নেতাদের সরকার যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে বিচার করছেন বলে প্রচার করছে ওরা।’ একই ঘটনা ঘটেছে শুক্রবার ইস্কাটনের দিলু রোডের একটি বাসাতেও। এবার সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের একটি পরিবারে গিয়ে হাজির বোরকা পরা চার নারী। সন্ধ্যায় সাড়ে ছয়টা দিকে আসায় গেলে বুয়া দরজা খোলেন। এরপর তারা বলেন, খালাকে একটু ডাকেন। বুয়া আপা বলে ডাক দিলে দরজায় দাঁড়িয়েই তারা বলেন, খালা ইসলামের জন্য ভোট চাইতে এসেছি। আমরা মহিলাদের কাছেই যাচ্ছি শুধু। আশা করি আমাদের প্রার্থী তাবিথ আউয়ালকে বাস মার্কায় ভোট দেবেন। হিন্দু সম্প্রদায়ের ওই মহিলা ভয় পেয়েই তখন আর কথা বলেননি। যাত্রাবাড়ী জামায়াত নিয়ন্ত্রিত তামিরুল মিল্লাত মাদ্রাসার পাশেই বাস করেন হাসনাহেনা নামে এক গার্মেন্টস কর্মী। শুক্রবার তার আসায় গিয়ে ৫০০ টাকা দিয়েছেন দক্ষিণে বিএনপির আরেক প্রার্থী মির্জা আব্বাসের কর্মীরা। হাসনাহেনা বলছিলেন, কয়েকজন বোরকা পড়া মহিলা এসে বলেন, আপা আপনার ভোট আছে? আমাদের প্রার্থীকে ভোট দিয়েন এই বলেই ৫০০ টাকা বের করেন। ওই ভোটার শুক্রবার জনকণ্ঠকে বলেন, ওই এলাকায় অনেক বাড়িতেই রাতভর বোরকা পরে মহিলারা বাসায় বাসায় যাচ্ছেন। অনেককেই টাকা দিয়ে হঠাৎ করে কোরান শরীফ বের করে বলছেন, শপথ করেন আমাদের প্রার্থীকে ভোট দেবেন। এদিকে কোরান শরীফ তথা ধর্মের নামে এ ধরনের তৎপরতাকারীদের ইসলামের দুশমন ও ধোঁকাবাজ বলে অভিহিত করেছেন দেশের বিশিষ্ট ইসলামী চিন্তাবিদ আলেম ওলামারা। ঐতিহাসিক শোলকিয়া ঈদগার ইমাম ও খতীব আল্লাম ফরীদ উদ্দিন মাসউদ বলছিলেন, জামায়াত ও তার দোষররা সব সময় ইসলামের অপব্যবহার করে মানুষের সঙ্গে ধোঁকাবাজি করে। একাত্তর সালে এরা ইসলামের নামে হত্যা, ধর্ষণ করেছে। এরা ইসলামের আসল শত্রু। এদের দোসরা এখন কোরান নিয়ে যা করছে তা প্রতিরোধ না করলে দেশ ইসলাম ক্ষতিগ্রস্ত হবে। সরকার নির্বাচন কমিশনকে শক্ত হতে হবে। বাংলাদেশ তরিকত ফেডারেশনের মহাসচিব লায়ন এম এ আউয়াল বলছিলেন, ইসলামের নামে যারা এসব করছে তারা ইসলামের কেউ না। এরা ইসলামের দুশমন। যেখানেই এদের পাওয়া যাবে প্রতিরোধ করতে হবে দেশ ও ইসলামের স্বার্থেই।
×