ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

সব সরকারের আমলেই সরকারী দলের লোক বনে যায় অবৈধ ঘরের মালিকরা;###; অবৈধ পানি, গ্যাস, বিদ্যুত সংযোগ ;###; সরকারী খাস পতিত জমি এবং ঝিল দখল করে গড়ে তোলা হয় এসব স্থাপনা

অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ এসব আবাসনে ২৫ হাজার পরিবারের বসবাস ॥ বিপজ্জনক টংঘর

প্রকাশিত: ০৫:৪৮, ২৪ এপ্রিল ২০১৫

অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ এসব আবাসনে ২৫ হাজার পরিবারের বসবাস ॥ বিপজ্জনক টংঘর

মশিউর রহমান খান ॥ আমরা সরকারী বেসরকারী জমি বুঝি না, কাজের লাগিন ঢাকা আইছি। আমরা তো আর এই ঘরডা বানাইছি না (বানাইনি)। সরকারী বেসরকারী বৈধ অবৈধ ব্যাপারডা বাড়ির মালিকে বুঝব। কাম শেষে খালি ঘুমানির লাগিন (জন্য) এই ঘরডা ভাড়া নিছি। মাসে ১ হাজার ৮শ’ টেহা দেই। সম্প্রতি রাজধানীর রামপুরার বউবাজার এলাকায় টিনের দোতলা ঘর দেবে ১২ জন নিহত হওয়ার ঘটনাস্থলে প্রতিবেদকের কাছে ওই এলাকার একটি টংঘরে বসবাসকারী সাফিয়া খাতুন এসব কথা বলেন। দুর্ঘটনাস্থলের পাশের একটি অবৈধ বাড়ির একটি কক্ষে বসবাসরত ময়মনসিংহের অধিবাসী গার্মেন্টসকর্মী সাফিয়া স্বামীসহ দুই সন্তান নিয়ে বসবাস করছেন। তাঁর পাশের বাড়িটিতেই ঘটা দুর্ঘটনার পর তিনি হতবাক। প্রতিবেদককে তিনি বলেন, মানুষের দাম কি এতই কইম্যা গেছে? মালিকের ভুলে আমরা লাশ হইতাম কেরে? সরকার কি এগুলা দেহে না? শুধু সাফিয়া নয়, এরকম আরও অনেকেই জীবনের তাগিদে ঢাকা এসে কম খরচে মাথা গোঁজার ঠাঁই হিসেবে বাধ্য হয়ে এসব অবৈধ বস্তির টংঘরে বসবাস করছে। সরকারী বিভিন্ন সংস্থার নিজস্ব ও খাস জমিতে এসব বস্তি গড়ে তোলে সব সরকারের সময় ক্ষমতাবান এক শ্রেণীর নেতাকর্মী ও তাদের দোসররা। ভাড়ার টাকার ভাগ পান সংশ্লিষ্ট দখলদার, স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাকর্মী ও সরকারী কর্মকর্তা-কর্মচারীরাও। এর বাইরে এলাকার প্রভাবশালী ব্যক্তিবর্গ ও সন্ত্রাসীদের আশ্রয়ে থাকা লোকজনও এসব জমি দখল করে বস্তি তৈরি করে নিম্ন আয়ের মানুষদের কাছে ভাড়া দেয়। বসবাসের জন্য তুলনামূলক কম ভাড়ায় ঘর প্রয়োজন। বসবাসকারীরা থাকার ঘরটির বৈধতা অবৈধতা আছে কিনা তা যাচাইয়ের প্রয়োজন বোধ করেন না। আর আবাসস্থল ঝুঁকিপূর্ণ কিনা তা তো যাচাইয়ের চিন্তাই নেই। রাত পোহালেই বেরিয়ে পড়েন এসব টংঘরে বসবাসকারী মানুষজন। রাজউক, সিটি কর্পোরেশন কিংবা জেলা প্রশাসন কেউই জানে না অবৈধ ঝুঁকিপূর্ণ এসব টংঘরের সঠিক সংখ্যা। প্রায় দুই কোটি লোকের বসবাস এ রাজধানীর এক-তৃতীয়াংশ লোকই বস্তিতে বসবাস করে। এদের মধ্যে যারা তুলনামূলক একটু সচ্ছল তারাই এসব টংঘরে বসবাস করে। অথচ রাজধানীর উন্নয়নের জন্য গঠিত কর্তৃপক্ষ রাজউক আজ পর্যন্ত হাজার হাজার অস্থায়ী এসব স্থাপনা নির্মাণের বা নিয়ন্ত্রণের কোন নীতিমালা তৈরি করেনি। কোনপ্রকার দুর্ঘটনা হলে এককভাবে এর দায়ভার নিতে রাজি হয় না কোন সরকারী প্রতিষ্ঠান। যে যেভাবেই পারে যখন তখন যে কোন স্থানে গড়ে তোলে টংঘরসহ নানা অবৈধ স্থাপনা। কম ভাড়ায় বিদ্যুত, গ্যাস, পানিসহ ডিশ সংযোগ পাওয়া যায় বলেই এসব ঘরে নিম্ন আয়ের শ্রমিক শ্রেণীর লোকজন বসবাসে আগ্রহী হয়। আর সকল অবৈধ সুযোগের ব্যবস্থা করে অবৈধ মালিক দাবিদার ব্যক্তিরা। শুধুমাত্র রাজধানীর রামপুরা ও তার আশপাশের এলাকার ঝিলের মধ্যে টংঘরে অবৈধ প্রায় পাঁচ শতাধিক পরিবারের বাস। এছাড়া রায়েরবাজার বেড়িবাঁধ, মিরপুর ও মোহাম্মদপুর বেড়িবাঁধসংলগ্ন এলাকা, কামরাঙ্গীরচর ও কড়াইলে সবচেয়ে বেশিসংখ্যক টংঘরের অবস্থান। এর বাইরে রাজধানীর অসংখ্য স্থানে যে যেখানে পারছে উঠিয়ে নিচ্ছে টংঘর। এসব ঘরে নিম্ন আয়ের লোকজন বসবাস করে। এসব স্থাপনার মধ্যে কিছু জমির বৈধ মালিকানা থাকলেও বেশিরভাগই সরকারী জমি অবৈধভাবে দখল করে ঘর তোলা হয়েছে। কোনোক্রমে বাঁশ আর কাঠ দিয়ে এসব ঘর তৈরি করা হয়। পানির উপরে অত্যন্ত দুর্বল ভিত্তির উপর রাতারাতি গড়ে তোলা হয় এসব অবৈধ ঘর। ফলে যে কোন সময় ঘটে যায় বড় দুর্ঘটনা। জলাশয় কিংবা নিচু জমি, ঝিল দখল কিংবা লেকের পাড় দখল করে এসব স্থাপনা তৈরি করা হয়। জলাশয় ভরাট করে ও অত্যন্ত নরম মাটির উপর এসব ঘর তোলা হয়। অত্যন্ত কম খরচে এসব ঘর তৈরি করা সহজ বিধায় অনেকেই সরকারী জমিতে ঘর তৈরি করতে আগ্রহী হয়। তাছাড়া নিম্নশ্রেণীর ও নিম্ন আয়ের লোকজনের জন্য আবাসস্থল হিসেবে আয়ের সঙ্গে সামঞ্জস্য থাকায় এসব ঘর ভাড়া নিতে অনেক স্থানে কাড়াকাড়ি পর্যন্ত লেগে যায়। বাঁশ, কাঠ, টিন দিয়ে তৈরি এসব ঘর তৈরিতে ৭ থেকে ১০ দিন পর্যন্ত সময় লাগে। রাতের আঁধারে নয় এসব টংঘর প্রকাশ্য দিবালোকে স্থানীয় নেতাকর্মী ও লোকজনের সহায়তায় তৈরি করা হয়। ভাড়াটিয়াদের টানতে সম্পূর্ণ অবৈধভাবে দেয়া হয় বিদ্যুত, পানি ও গ্যাসের সংযোগ। তবে সকল সুবিধাযুক্ত টংঘরের চাহিদা ও ভাড়া তুলনামূলক বেশি। তাছাড়া বাড়ি তৈরির আগেই সংশ্লিষ্ট এলাকার বিভিন্ন দলের নেতাকর্মী, সিটি কর্পোরেশন ও যে প্রতিষ্ঠানের জমি দখল করে স্থাপনাটি নির্মাণ করা হবে তাদের অফিসের কর্মকর্তাদের ম্যানেজ করেই তা করা হয়। ধারণক্ষমতার চেয়ে বেশি লোক ও তাদের ব্যবহার্য জিনিসের ভার বেশি হয়ে যাওয়ায় এসব ঘর সব সময়ই ঝুঁকিতে থাকে। দুর্বল বাঁশের উপর এসব টংঘর কোনক্রমেই টিকতে পারে না। রাজধানীতে বস্তির সংখ্যা স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় কিংবা বিভিন্ন এনজিও জানলেও এমন টংঘরের সংখ্যা কত তা জানে না সরকারী বা বেসরকারী কোন প্রতিষ্ঠানই। ধারণামতে, প্রায় ২৫ হাজার পরিবার এসব টংঘরে বসবাস করে। এসব ঘরের মধ্যে কিছু ঘরের সামনের অংশে মাটি থাকলেও পেছনের অংশ বাঁশের বা কাঠের খুঁটি দিয়ে দাঁড় করিয়ে রাখা হয়। কোন কোন বাড়ির ক্ষেত্রে সামান্য ঝড়বৃষ্টিতেই এসব ঘর বাতাসে দুলতে থাকে। এর সঙ্গে সঙ্গে দুলতে থাকে বসবাসকারী মানুষের জীবনও। রায়েরবাজার এলাকার রায়েরবাজার কবরস্থান, মহাখালী টিএ্যান্ডটি কলোনির পূর্ব পাশে গুলশান লেকের উপর, মিরপুর ও মোহাম্মদপুর বেড়িবাঁধের পাশেই বাঁশের খুঁটির উপর কয়েক হাজার টংঘর তৈরি করা হয়েছে। সবচেয়ে বড় ভাসমান লোকের আবাসস্থল হিসেবে পরিচিত মহাখালীর টিএ্যান্ডটি কলোনিতে প্রায় ছয় হাজার পরিবার বাস করে। টংঘরের মালিক দাবিদার কারা ॥ সব সরকারের আমলেই বেশকিছু রাজনৈতিক পরিচয়ধারী ব্যক্তি এসব ঘর তৈরি করে থাকে। এদের মধ্যে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ, বিএনপিসহ জাতীয় পার্টির নেতাকর্মী রয়েছেন। এছাড়া সব দলের কেন্দ্রীয় কমিটির নেতাকর্মীদের পাশে থাকা সুযোগসন্ধানী একটি শ্রেণীও রয়েছে। এর বাইরে সব সরকারের আমলেই সরকারী দলের লোক বনে ক্ষমতাসীন হয়ে যাওয়া এরকম শ্রেণীই সবচেয়ে বেশি এসব টংঘরের মালিক দাবিদার। এসব ঘর থেকে প্রতি মাসে মোটা অঙ্কের অর্থ পাওয়া যায় বিধায় ক্ষমতার পালাবদলের সঙ্গে সঙ্গেই তারাও নিজের পরিচয় পাল্টায়। প্রতিটি ঘর থেকে কমপক্ষে ১ হাজার ৮শ’ থেকে ২ হাজার ২শ’, কোন কোন ক্ষেত্রে আড়াই হাজার টাকা পর্যন্ত ভাড়া আদায় করা হয়। ২৫ হাজার পরিবারের হিসাবে যার পরিমাণ বছরে গিয়ে দাঁড়ায় কয়েক শ’ কোটি টাকা। বসবাসকারীদের জীবন পূর্ণ ঝুঁকিতে রেখে অবৈধ মালিকগণ এ পরিমাণ অর্থ ভোগ করছেন। রামপুরার বউবাজারের দেবে যাওয়া টংঘরটির জমির প্রকৃত মালিক ঢাকা জেলা প্রশাসন হলেও এলাকার মানুষ এখনও প্রকৃত মালিক হিসেবে মনিরুজ্জামান চৌধুরী মনিরকেই জানেন। ১২ জনের মৃত্যুর পরও এলাকার অনেকেই খোঁজ নেননি এ জমির প্রকৃত মালিক কে? অবৈধ এসব জমিতে থাকা কতটুকু যৌক্তিক তা-ই তাঁরা বিচার করতে চান না। তাঁরা চান দিনশেষে মাথা গোঁজার একটু ঠাঁই। ঠাঁইটি নিরাপদ কিনা তা ভেবে দেখেন না পর্যন্ত। টংঘর স্থাপনকারীদের পরিচয় ॥ রামপুরার বউবাজারের টংঘরের মালিক দাবিদার ব্যক্তি মনিরুজ্জামান চৌধুরী মনির। এলাকায় সময় সময় রঙ পাল্টানো নেতা হিসেবে তাঁর পরিচিতি রয়েছে। ক্ষমতা পাল্টানোর সঙ্গে সঙ্গেই দলবদল করেন তিনি। গত জোট সরকারের আমলে মনির চৌধুরী বিএনপি জোটের নেতাকর্মীদের কাছ থেকে সর্বোচ্চ সুযোগ সুবিধা গ্রহণ করেছেন। পরবর্তীতে ওয়ান ইলেভেনের সময় কিছুটা নীরব হয়ে গেলেও ক্ষমতার পালাবদলের সঙ্গে সঙ্গেই তিনি আওয়ামী লীগে যোগদান করেন। সর্বশেষ তিনি যুবলীগ নেতা হিসেবে ক্ষমতার অপব্যবহার করে অবৈধভাবে এ ঘরটি তৈরি করেন। তাঁর অপর এক ভাই জাতীয় পার্টির ও আরেকজন বিএনপির নেতা। ফলে যে সরকারই ক্ষমতায় যায় তাঁদের পরিবারের মধ্যেই ক্ষমতা রয়ে যায়। এক ভাই সিটি নির্বাচনে ওই ওয়ার্ডের কাউন্সিলর প্রার্থী বলে জানা গেছে। এ স্থাপনার কাছেই মালিবাগ গুলবাগের জাতীয় পার্টির নেতা সারোয়ার হোসেন। দোতলা টিনের ঘর তৈরি করে রিক্সা গ্যারেজসহ আটটি কক্ষ ভাড়া দিয়েছেন। জানা গেছে, এই জমিটি ৩১২নং দাগের সরকারী খাস জমি। এর আরেকটু দূরে মালিবাগ চৌধুরীপাড়া এলাকার বাসিন্দা বিএনপি নেতা আব্দুল আওয়াল রেলের জমিতে ঝিলের উপর ২৫টি ঘর তৈরি করে ভাড়া দিয়েছেন। এক সময় এই বিএনপি নেতার ঘরে বিদ্যুত, পানি ও গ্যাসের সংযোগ দেয়া হলেও স্থানীয় লোকদের বাধার মুখে সেবাদানকারী এসব সংস্থার কাছে নালিশ করে সকল সংযোগ কেটে দেয়া হয়। পরে ওই নেতার ছেলে পুলিশ কর্মকর্তা হওয়ার সুবাদে ক্ষমতা প্রয়োগ করে অবৈধ বিদ্যুত সংযোগ দেয়া হয়, যা এখনও বহাল আছে। অপরদিকে রায়েরবাজার কবরস্থানের ১নং গেটের উল্টোদিকে বেড়িবাঁধের পাশ ঘেঁষে গত কয়েক বছরে জলাশয়ের জমি ভরাট করে কয়েক শ’ টিনের ঘর তোলা হয়েছে। এরমধ্যে একটি কলোনি গড়ে তুলেছেন মোহাম্মদপুর থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি সাদেক খান। তাঁর অধীনে গড়ে তোলা হয়েছে ২২৬টি পরিবারের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ এসব ঘর। তাঁর ভাই কাদের খান মহানগর যুবলীগ উত্তরের সহসভাপতি, যিনি উত্তর সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে ৩৪নং ওয়ার্ডের একজন কাউন্সিলর প্রার্থী। তবে এসব জমি তাঁরা বৈধ ও উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া বলে সব সময় দাবি করেন। অবৈধভাবে অস্থায়ী স্থাপনায় বৈধ কোন গ্যাস, পানি কিংবা বিদ্যুতলাইনের সংযোগ কিভাবে দেয়া হলো- এর উত্তর কেউ জানেন না। সরকারী সংস্থার অবহেলা আর দায় এড়ানো কাজ ॥ সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, দুর্ঘটনার স্থানটি ঢাকা জেলা প্রশাসনের খাস জমি, কিন্তু এর পাশের জমিটিই বাংলাদেশ রেলওয়ের। সিটি কর্পোরেশন এলাকায় নির্দিষ্ট বাড়িতে বসবাস করে নাগরিক হিসেবে দাবি করার পাশাপশি ভোট প্রদান করলেও কর্পোরেশন কর্তৃপক্ষ তাদের আবাসস্থলকে হোল্ডিং হিসেবে স্বীকৃতি দেয় না। এসব টংঘরে বসবাসকারীদের সরকার ঘোষিত সামান্য সুযোগ-সুবিধা দিতেও রাজি নয় তারা। কর্তৃপক্ষের মতে নাগরিক হলেও অবৈধ স্থানে তারা বসবাস করে। নিয়মানুযায়ী সিটি কর্পোরেশন কর্তৃপক্ষ তাদের এলাকায় বসবাসকারী নাগরিকদের বৈধ সব ধরনের সযোগ-সুবিধা প্রদানে বাধ্য। কিন্তু এসব নাগরিকের কেউ কেউ পরিমাণ কম হলেও নিয়মিত পৌরকর পরিশোধ করেন। ব্যবসার জন্য কেউ কেউ ট্রেড লাইসেন্স গ্রহণ করেছেন। তবে কেন তাদের আবাসস্থলের অবস্থান বৈধ কি অবৈধ তা যাচাই করবেন না সিটি কর্পোরেশন কর্তৃপক্ষ ? এসব ঘরে বসবাসকারী নাগরিকদের প্রশ্ন টংঘরে আমাদের বসবাস যদি অবৈধ হয় তাহলে সিটি কর্পোরেশন কর্তৃপক্ষ কোন উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা করছে না কেন? অপরদিকে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের আইনানুযায়ী রাজউক নির্ধারিত এলাকায় কোন প্রকার স্থায়ী স্থাপনা নির্মাণ করতে হলে রাজউক কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিতে হবে। অন্যথায় রাজউক কর্তৃপক্ষ অনুমোদনহীন সকল স্থাপনা অবৈধ হিসেবে তা বিনা নোটিসে উচ্ছেদ করবে। নিয়মানুযায়ী স্থায়ী স্থাপনা বলতে সরকারী প্রতিষ্ঠান বা বেসরকারী কোন ব্যক্তি কোন প্রকার স্থায়ী স্থাপনা নির্মাণ করার পূর্বে সরকারী প্রতিষ্ঠান হলে নির্দিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে ঐ স্থানে স্থাপনা নির্মাণের ও জমি ব্যবহারের অনুমতি নিতে হবে। বেসরকারী বা ব্যক্তি মালিকানায় কোন স্থাপনা নির্মাণ করতে হলে রাজউক কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন-পূর্ব অনুমতি সাপেক্ষে তা নির্মাণ করা যাবে। এ আইনানুযায়ী শুধু স্থায়ী স্থাপনা বিল্ডিং ঘর নির্মাণ করতে হলেই কেবলমাত্র রাজউক কর্তৃপক্ষের অনুমোদন প্রয়োজন। এর বাইরে সরকারের কোন খাস জমি, সিটি কর্পোরেশন, রেলওয়ে কিংবা অন্য যে কোন সরকারী প্রতিষ্ঠানের জমিতে অবৈধ স্থাপনা নির্মাণ করলে রাজউক কর্তৃপক্ষ তার বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নেবে না। এর দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের। অতএব, রামপুরার বউ বাজারের দুর্ঘটনাস্থলের সকল স্থাপনাই ঢাকা জেলা প্রশাসনের সরকারী খাস জমিতে স্থাপিত এবং কোন ঘরই যেহেতু স্থায়ী স্থাপনা (বিল্ডিং নয়) তাই রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের কোন দায়ভার নেই। রাজউক কর্তৃপক্ষ এ অজুহাতে নিজেদের গুটিয়ে নিয়েছে। হাজার হাজার পরিবারের লাখ লাখ লোকের বসবাসের আজ পর্যন্ত কো নীতিমালা তৈরির চিন্তাই করেনি রাজউক। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, রাজউকের এলাকায় শুধু অনুমোদনকারী স্থাপনার দায়িত্বই রাজউকের। এর বাইরে ঝুঁকিপূর্ণ কোন স্থাপনার রক্ষণাবেক্ষণ বা উচ্ছেদের যে দায়িত্ব রাজউকের রয়েছে তা পালন করতে বাধ্য নয় রাজউক কর্তৃপক্ষ। দীর্ঘদিন যাবত এসব স্থাপনা নির্মাণ করে অসংখ্য নিম্ন আয়ের লোকজন বসবাস করে আসলেও রাজউক কর্তৃপক্ষ কিংবা সিটি কর্পোরেশন কর্তৃপক্ষ কোন আইনী ব্যবস্থা নেয়নি। দুই কর্তৃপক্ষের পক্ষ থেকে ঝুঁকিপূর্ণ কিংবা অবৈধ এমন দাবি করে দুর্ঘটনার আগের দিন পর্যন্ত বসবাসকারীদের দেয়া হয়নি কোন নোটিস। এর বাইরে টংঘরের প্রকৃত মালিক ঢাকা জেলা প্রশাসন হলেও দখলদারদের হাত থেকে এসব জমি উদ্ধারের কোন উদ্যোগই নেয়নি। টংঘরে বসবাসকারী অর্ধ বা কম শিক্ষিত লোকজন রাজউক কর্তৃপক্ষ অনুমোদিত বা ঝুঁকিপূর্ণ আবাস কিনা তা না দেখেই ভাড়া নেয়। সরেজমিনে দেখা যায়, ঘটনাস্থলের পাশের বাড়িটিই রাজউকের নিয়মানুযায়ী অবৈধভাবে আধাপাকা ঘর করে পাঁচটি কক্ষ করে ভাড়া দেয়া হয়েছে। উক্ত বাড়িওয়ালা সরকারী জমি নয় তা প্রমাণের জন্য ওয়ারিশ সূত্রের জমি প্রমাণে একটি সাইনবোর্ড লাগিয়ে রেখেছে। কিন্তু উক্ত বাড়ির মালিক যে কোন স্থায়ী স্থাপনা নির্মাণে যে রাজউকের অনুমোদন নিতে হয় তাই জানে না বা প্রয়োজন মনে করেনি। এমনকি উক্ত এলাকার দায়িত্বে নিয়োজিত রাজউকের কোন কর্মকর্তাও ঘর নির্মাণের আগে- পরে বাড়ির মালিককে সতর্ক করেননি। দুর্ঘটনার পর সিটি কর্পোরেশন, রাজউক ও ঢাকা জেলা প্রশাসন ফায়ার সার্ভিসসহ সরকারী-বেসরকারী উর্ধতন কর্মকর্তাগণ দুর্ঘটনাস্থল পরিদর্শন করলেও ঐ টংঘরটির পাশেই একটি সেমিপাকা ঘর নির্মাণ করা হচ্ছে। যাতে কবুতরের খোপের মতো পাঁচটি কক্ষ রয়েছে। তদন্তে সংশ্লিষ্ট ৩ কর্তৃপক্ষের গাছাড়া মনোভাব ॥ দুর্ঘটনা কিংবা দায়িত্বে অবহেলার কথা সংশ্লিষ্ট কোন কর্তৃপক্ষই স্বীকার করে না। রামপুরার ঘটনার জন্য দায়ী করে কোন কর্মকর্তা বা কর্মচারীকে আজ পর্যন্ত দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি বা ক্লোজড করা হয়নি। এমনকি কোন কর্তৃপক্ষ কাউকে এ দুর্ঘটনার জন্য কারণ দর্শানো নোটিস পর্যন্ত প্রদান করেনি। এমনকি সরকারের পক্ষ থেকে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকার এরকম আরও টংঘর নিয়ে সৃষ্ট সমস্যা সমাধানে কয়েকটি সংস্থার সমন্বয়ে কোন সমন্বিত তদন্ত কমিটিও গঠন করা হয়নি। সিটি কর্পোরেশন এলাকায় বসবাসরত সকল শ্রেণীর নাগরিকদের সুযোগ-সুবিধা প্রদানের জন্য কর্তৃপক্ষ থাকলেও এক্ষেত্রে তারা সম্পূর্ণ উদাসীনতার পরিচয় দিয়েছে। বসবাসকারী হোল্ডিং ট্যাক্স প্রদান করেন না বিধায় দুর্ঘটনার পরও ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের পক্ষ থেকে কোন প্রকার তদন্ত কমিটিই গঠন করেনি। তাছাড়া ঘটনাস্থলের জমিটি ঢাকা জেলা প্রশাসনের এ বিষয়ে উক্ত কর্তৃপক্ষ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবেন এমন আশায় কর্পোরেশনের নিজ উদ্যোগে কিছু করা হবে না। তবে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ কর্পোরেশন এলাকার কোন স্থানে ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা বা অবৈধ স্থাপনা হিসেবে কর্পোরেশনের কাছে তা উচ্ছেদের জন্য সাহায্য চাইলে সেক্ষেত্রে সিটি কর্পোরেশন সহায়তা করবে। অন্যথায় তারা কোন প্রকার উদ্যোগ গ্রহণে আগ্রহী নয়। অপরদিকে ঢাকা জেলা প্রশাসন কর্তৃপক্ষ দুর্ঘটনার পর কয়েকদিন নামমাত্র তোড়জোড় করলেও সরেজমিনে দেখা যায়, ঘটনাস্থলে ঝুঁকিপূর্ণ স্থাপনা- সর্বসাধারণের প্রবেশ নিষেধ লেখা ঢাকা জেলা প্রশাসনের সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে দেয়া হয়েছে। অথচ এই সাইনবোর্ডের সীমানার ভেতরে প্রতিদিন অসংখ্য লোক প্রবেশ করছে। নামমাত্র সাইনবোর্ড দিয়েই দায়িত্ব সেরে দিয়েছে জেলা প্রশাসন। নির্দেশ কেউ মানছে কি না তা দেখতে ঘটনাস্থলে নেই কোন পুলিশ কিংবা দায়িত্বপ্রাপ্ত কোন কর্মকর্তার উপস্থিতি। স্থানীয়রা জানান, দুর্ঘটনার আগের দিন পর্যন্ত জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে বাড়ির মালিক কিংবা বসবাসকারীদের কোন প্রকার নোটিস পর্যন্ত প্রদান করা হয়নি।। রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) নিয়মানুযায়ী এ ধরনের অস্থায়ী স্থাপনা নির্মাণে রাজউকের কোন প্রকার অনুমোদনের প্রয়োজন হয় না বিধায় তাদের কোন দায় নেই। টংঘর, বস্তি, কাঁচা বা সেমিপাকা, টিনশেড ঘরকে রাজউক কর্তৃপক্ষ অস্থায়ী স্থাপনা হিসেবে বিবেচিত করে, যা নির্মাণ করতে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি বা কর্তৃপক্ষকে কোন প্রকার অনুমোদন নিতে হয় না। তাদের মতে, এরপরও ঘটনা তদন্তে রাজউক কর্তৃপক্ষ ১৬ এপ্রিল আব্দুর রহমান সদস্য পরিকল্পনাকে (বর্তমানে উন্নয়ন নিয়ন্ত্রণ) প্রধান করে একজন পরিচালক ও সংশ্লিষ্ট অথরাইজড অফিসারকে নিয়ে ৩ সদস্যবিশিষ্ট একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। এই কমিটিকে ৭ কর্মদিবসের মধ্যে সরেজমিনে পরিদর্শন করে দুর্ঘটনার কারণ উদঘাটন করে পরবর্তী করণীয় সম্পর্কে মতামতসহ প্রতিবেদনের নির্দেশ দিয়েছে রাজউক কর্তৃপক্ষ। জানা যায়, কমিটি গঠনের পর কমিটির কোন সদস্য দুর্ঘটনাস্থলে অনুসন্ধানের জন্য যাননি। এর বাইরের রাজধানীর অন্য কোন এলাকার এ জাতীয় প্রায় ২৫ হাজার টংঘর নিয়েও তাদের কোন মাথাব্যথা নেই। কোন দুর্ঘটনার পর সরকারী-বেসরকারী সকল সংস্থার চলাচল বেড়ে গেলেও পরবর্তীতে আস্তে আস্তে তা স্তিমিত হয়ে যায়। রাজধানীতে প্রায় ৬০ লাখ বস্তিবাসী তথা ঝুঁকিপূর্ণ স্থাপনায় বসবাসকারীদের প্রকৃত অভিভাবক ও নিয়ন্ত্রক কে তা সরকারকে অতি দ্রুত নির্ধারণ করা জরুরী হয়ে পড়েছে। সমস্যা সমাধানে অস্থায়ী স্থাপনা নির্মাণ ও নিয়ন্ত্রণ নীতিমালা তৈরি করা এখন সময়ের দাবিতে পরিণত হয়েছে। ভবিষ্যতের বড় কোন দুর্ঘটনা এড়াতে এ বিষয়ে সরকারকে এখনই পদক্ষেপ নিতে হবে।
×