মিথুন আশরাফ ॥ ‘বাংলার মাটি, দুর্জয় ঘাঁটি।’-বলেছিলেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপস্থিতিতে রবিবার মিরপুর শেরেবাংলা স্টেডিয়ামে বাংলাদেশ দলের ক্রিকেটাররা যেন এবার পাকিস্তান ক্রিকেটারদেরও ক্রিকেটীয় ভাষায় সে কথাই বুঝিয়ে দিলেন। প্রথম ওয়ানডেতে জিতে ১৬ বছরের অপেক্ষার প্রহর ঘুচিয়েছেন টাইগাররা। রবিবার দ্বিতীয় ওয়ানডেতে ৭ উইকেটে জিতে সিরিজই জিতে নিল বাংলাদেশ। এক ম্যাচ হাতে রেখেই ২-০ ব্যবধানে সিরিজ জিতে গেল। এবার পাকিস্তানকে বাংলাওয়াশের পালা!
কাজী নজরুল ইসলামের কবিতার মতোই, ‘তোরা সব জয়ধ্বনি কর/তোরা সব জয়ধ্বনি কর’ জয়ধ্বনি করেই ফেলল ক্রিকেটাররা। সেই সঙ্গে পুরো বাংলাদেশ। আর কালবৈশাখীর ঝড় তুললেন তামিম ইকবাল। পাকিস্তান ৫০ ওভার ব্যাট করে কষ্টে ৬ উইকেট হারিয়ে ২৩৯ রান করার পর তামিম ব্যাট হাতে নেমে যে কি মারমুখী ব্যাটিং করতে থাকলেন, এক পলকে ১১৬ বলে ১৭ চার ও ১ ছক্কায় অপরাজিত ১১৬ রান করে ফেললেন। প্রথম ওয়ানডের মতো আবারও মুশফিককে (৬৫) নিয়ে বড় জুটি (১১৮ রানের) গড়লেন তামিম। এ জুটিতে ম্যাচও জিতে গেল বাংলাদেশ। যে দলটি ১৯৯৯ সালের বিশ্বকাপের পর টানা ২৫ ওয়ানডে পাকিস্তানের বিপক্ষে জিততে পারেনি, সেই দল পর পর দুই ওয়ানডে জিতে নিল। প্রথম ওয়ানডেতে ৭৯ রানের বড় জয়ের পর দ্বিতীয় ওয়ানডেতেও হেসে-খেলে ৩৮.১ ওভারে ৩ উইকেট হারিয়ে ২৪০ রান করে বড় জয়ই তুলে নিল।
যেই উইকেটের পেছনে আজমলের বলটি ঠেলে দিয়ে ১ রান নিলেন সাকিব, সঙ্গে সঙ্গে উৎসব শুরু হয়ে যায়। আনন্দে আত্মহারা হয়ে পড়েন ক্রিকেটাররা। প্রথম ওয়ানডেতে জেতার পরও এমন আনন্দ দেখা যায়নি, এবার পাকিস্তানকে সিরিজে হারানো নিশ্চিত হতেই বাঁধভাঙ্গা উৎসব ক্রিকেটারদের মধ্যেও ছড়িয়ে পড়ে। সেই উৎসব যেন ছড়িয়ে পড়ে সকলের মাঝেই। জাতি-ধর্ম-বর্ণ-নির্বিশেষে সবার মধ্যেই একই উৎসবের সঞ্চার হয়। যেন সবাই একই সুরে বলতেও চান, ‘গাহি সাম্যের গান/যেখানে আসিয়া এক হয়ে গেছে সব বাধা-ব্যবধান।’
তামিম-মুশফিক ব্যাট করছেন, ম্যাচের অর্ধেকটাও শেষ হয়ে গেছে। এমন সময় স্টেডিয়ামে হাজির খেলাধুলায় নিবেদিতপ্রাণ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তাঁর স্টেডিয়ামে প্রবেশ করার কিছুক্ষণের মধ্যেই ‘পূর্ব দিগন্তে সূর্য উঠেছে, রক্তলাল, রক্তলাল, রক্তলাল’ যখনই খেলা একটু বন্ধ থাকে তখনই এ রকম দেশাত্মবোধ জাগানো গানগুলো চলতে থাকে। ক্রিকেটারদের মাঝেও সেই গানগুলো যেন আলোড়ন জাগিয়ে তোলে।
পাকিস্তান ক্রিকেটারদের মনে যেন একটি সুরই বাজে, ‘সকাল বেলার আমির রে ভাই, ফকির সন্ধ্যাবেলা।’ দীর্ঘ ১৬ বছর টানা বাংলাদেশের বিপক্ষে রাজত্বের পর যে অবশেষে ফকির হয়ে গেল পাকিস্তান। পাকিস্তান ক্রিকেটারদের এমন ফকির হওয়ার পেছনে বাংলাদেশ ক্রিকেটারদের কৃতিত্বই সবার আগে। তবে সেই কৃতিত্ব শুরুতে পেতেই পারেন সাকিব আল হাসান। শুরু থেকে ‘আমরাই ফেবারিট’ বলে সাহস যে যুগিয়ে দিয়েছেন। ফ্রেঞ্চ মিলিটারি ও রাজনৈতিক নেতা নেপোলিয়ান বোনাপার্ট বলেছিলেন, ‘অসম্ভব শব্দটি মূর্খের অভিধানেই পাওয়া যায়।’ এমন সাহসই ক্রিকেটাররা দেখিয়েছেন, বিশ্বকাপে দুর্দান্ত খেলায় এমনই টগবগে আত্মবিশ্বাস নিয়ে খেলেছেন যে অসম্ভব শব্দটি উধাওই হয়ে গেছে। সেই অসম্ভব এখন পাকিস্তান ক্রিকেটারদের মনে বসতি গড়েছে। পাকিস্তান ক্রিকেটাররা শুধু দেখেই যাচ্ছেন, এ কী করছে বাংলাদেশ!
প্রথম ওয়ানডেতে আগে ব্যাট করে বাংলাদেশ যে ৩২৯ রান করে সেখানেই মূলত খেলা শেষ হয়ে যায়। পাকিস্তান দেখে বাংলাদেশের ব্যাটিং চমক। হারও হয়। রবিবার পাকিরা দেখল বাংলাদেশের বোলিং ঝলকও। ৭৭ রানেই পাকিস্তানের ৫ উইকেটের পতন ঘটে যায়। তখন মনে হয়েছিল সাকিব, নাসির, রুবেল, আরাফাত, মাশরাফি, তাসকিনদের বোলিং তোপে লজ্জার মধ্যেই পড়ে যাবে পাকিস্তান। ১৯৯৯ সালে বাংলাদেশের বিপক্ষে যে সর্বনিম্ন ১৬১ রান করেছিল, এবারও সে রকম কিছুই ঘটবে। কিন্তু সেখান থেকে ষষ্ঠ উইকেটে হারিস সোহেল (৪৪) ও সাদ নাসিমের ৭৭ রানের জুটি ও সপ্তম উইকেটে সাদ (৭৭*) ও ওয়াহাবের (৫১*) বাংলাদেশের বিপক্ষে রেকর্ড গড়া ৮৫ রানের জুটি পাকিস্তানকে সম্মানের একটি জায়গা খুঁজে দেয়। সেই সম্মান আর থাকল কোথায়।
শুরুতে ২২ রানে সৌম্যর (১৭) আউটের পর ১০০ রানে মাহমুদুল্লাহ (১৭) আউট হলেন। এর পর তো আর উইকেটের চেহারাই দেখছিলেন না পাকিস্তান বোলাররা। তামিম-মুশফিক মিলে তো রূপকথার গল্পই তৈরি করে ফেললেন। বাংলাদেশের যখন ২০০ রান হলো, তামিম-মুশফিকের জুটি হলো ১০০ রানের। টানা দুই ম্যাচে দু’জন শতক জুটি গড়লেন। প্রথম ওয়ানডেতে বাংলাদেশের ইতিহাসের সর্বোচ্চ ১৭৮ রানের জুটি গড়েছেন। দু’জনই শতক করেছেন। এবার বিশ্বকাপে মাহমুদুল্লাহ রিয়াদের টানা দুই ম্যাচে শতকের পর কোন টুর্নামেন্ট বা সিরিজে টানা দুই ম্যাচে শতক করলেন ক্যারিয়ারে ষষ্ঠ শতক করা তামিম। আর মুশফিক ৬৫ রান করে আউট হলেন। ততক্ষণে তামিম-মুশফিক মিলে ম্যাচ জয়ী ১১৮ রানের জুটি গড়ে ফেলেছেন। জিততে তখন ২২ রান লাগে। এমন সময় সাকিব ব্যাট হাতে নামেন। শেষ পর্যন্ত ম্যাচ উইনিংস শটটি খেলেন অপরাজিত ৭ রান করা সাকিবই। তামিম ১১৮ রান করে ম্যাচ জিতিয়েই মাঠ ছাড়েন।
নিউইয়র্কের সাবেক গবর্নর মারিও কুওমো বলেছিলেন, ‘মাত্র দুটি পন্থায় সফল হওয়া যায়! একটি হচ্ছে সঠিক লক্ষ্য নির্ধারণ করা, ঠিক যা তুমি করতে চাও। আর দ্বিতীয়টি হচ্ছে সেই লক্ষ্যে কাজ করে যাওয়া।’ মারিওর প্রতিটি কথারই কাজে প্রমাণ দিচ্ছেন বাংলাদেশ ক্রিকেটাররা।
‘ম্যাচ বাই ম্যাচ’ জেতার সঠিক লক্ষ্য নির্ধারণে সাফল্য মিলছে। সেই লক্ষ্যে ব্যাটসম্যান-বোলাররা সমানতালে কাজও করে যাচ্ছেন। এবার বুধবার যে তৃতীয় ওয়ানডে আছে, সেটিতে জিতে গেলেই হয়ে যায়। প্রথমবারের মতো পাকিস্তান বাংলাওয়াশও হবে। টানা দুই ম্যাচ দাপটের সঙ্গে জিতে সিরিজ নির্ধারণের পর সেই প্রত্যাশা মাত্রাতিরিক্তও মনে হচ্ছে না।
স্কোর ॥ বাংলাদেশ-পাকিস্তান দ্বিতীয় ওয়ানডে-মিরপুর
পাকিস্তান ইনিংস ২৩৯/৬; ৫০ ওভার (সাদ ৭৭*, ওয়াহাব ৫১*, হারিস ৪৪; সাকিব ২/৫১, নাসির ১/১৭, রুবেল ১/২৭, আরাফাত ১/৪১, মাশরাফি ১/৫২)।
বাংলাদেশ ইনিংস ২৪০/৩; ৩৮.১ ওভার (তামিম ১১৮*, মুশফিক ৬৫, সাকিব ৭*, সৌম্য ১২, মাহমুদুল্লাহ ১২)।
ফল ॥ বাংলাদেশ ৭ উইকেটে জয়ী।
ম্যাচসেরা ॥ তামিম ইকবাল (বাংলাদেশ)।