ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

এ এফ জি মহিউদ্দিন

জাতীয় পোশাক ও দূষণরোধ

প্রকাশিত: ০৪:৫৮, ২০ এপ্রিল ২০১৫

জাতীয় পোশাক ও দূষণরোধ

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত ৬ এপ্রিল অনুষ্ঠিত মন্ত্রিপরিষদ বৈঠকের শুরুতেই স্যুট পরিহিত মন্ত্রীদের বিজাতীয় পোশাক পরার জন্য বেশ শক্ত ভাষায় ভর্ৎসনা করেন। তিনি বলেছেন, ব্রিটিশের গোলামী করে করে তাদের পোশাক পরায় এতটাই অভ্যস্ত হয়েছেন যে গরমের দিনে শার্টপ্যান্ট পরার সরকারী নির্দেশ অমান্য করে স্যুট পরা ছাড়ছেন না। একজন মন্ত্রী পাজামা-পাঞ্জাবি পরে আসা যাবে কি না জানতে চাইলে প্রধানমন্ত্রী সরকারী আদেশের কথা মনে করিয়ে দেন। সে আদেশে বেসরকারী কর্মচারীদেরও স্যুট পরিহারের উপদেশ দেয়া আছে। তবে বলা আছে, কাজের প্রয়োজনে অত্যাবশ্যক হলে সরকারী/বেসরকারী যে কেউ স্যুট পরতে পারেন। স্যুট বলতে আমাদের দেশে (বিদেশেও) কোট-প্যান্টকে বোঝায়। তাই আজকাল কদাচিৎ কাউকে টাই পরতে দেখা যায়। ভাবখানা এমন যে, টাই যখন পরিনি তখন তো স্যুট পরা হয়নি। কিন্তু সরকারী নির্দেশটি দু’বছরের ব্যবধানে দু’বার জারি করে বলা হয়েছিল, গরমের দিনে (মার্চ-নবেম্বর) হাল্কা পোশাকে অর্থাৎ শার্ট-প্যান্ট পরে অফিসে আসতে হবে যাতে ঘামে শরীর দুর্গদ্ধময় না হয় এবং এসি ব্যবহার করতে চাইলে কম খরচে অর্থাৎ ২৪/২৫ ডিগ্রীতে করা যায়। কিন্তু সমস্যা হয়েছে অমিতব্যয়িতার সংস্কৃতি নিয়ে। চারদিকে দেদার খরচের উৎসবে কেউ হয়ত ভাবতেই পারেন যে, হাল্কা পোশাক পরলে সরকারের এমন কি সাশ্রয় হবে? এমন ভাবাটাই স্বাভাবিক। কারণ তিনি যে বিশাল বিশাল গাড়ি হাঁকান এবং যে চোখ ধাঁধানো কার্পেট বা আসবাব এবং দামী ইলেক্ট্রনিক/ইলেকট্রিক গ্যাজেট (বিশেষ করে অফিসে) ব্যবহার করেন তা এসি ব্যবহারে খরচ বাঁচাবার তুলনায় হাজার গুণ বেশি। আমার মনে হয় আমাদের মতো গরমের দেশে হাল্কা পোশাকে শরীরে ঘামের দুর্গন্ধ কম থাকে এটা তাদের জানা থাকলেও হীনম্মন্যতার কারণে মোটা মোটা কাপড় পরে তারা পশ্চিমা সাহেব সুবোদের মতো স্যুটেডবুটেড থাকাটাই বেশি পছন্দ করেন। আমাদের দেশের ৭০% মানুষ থাকেন গ্রামে। তারা লুঙ্গি গেঞ্জি শাড়ি পরেন, সঙ্গে গামছাও। কিন্তু পহেলা বৈশাখে সারাদেশের সবাই পরেছেন পাজামা-পাঞ্জাবি (মেয়েরা শাড়ি)। ব্যক্তিগতভাবে আমার তাই মনে হয়েছে পাজামা পাঞ্জাবি এবং শাড়ি আমাদের জাতীয় পোশাক হলে ভাল হতো। তবে শীতের দিনে সাদা পাঞ্জাবির ওপর কেউ ইচ্ছে করলে কালো মুজিবকোটও পরতে পারেন। স্বাধীনতা লাভের ৪৪ বছরেও আমাদের জাতীয় পোশাক ঘোষিত হলো না কেন তার কোন গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যা কোথাও পাওয়া যায় না। গরমে বেশি কাপড় পরা তো মোটেই যুক্তিযুক্ত নয়। আমাদের মতো দেশে শীতের দিনেও বেশি কাপড় পরা ঠিক নয়। কারণ কাপড়ের পেছনে মূল্যবান বৈদেশিক মুদ্রা ছাড়াও দেশীয় মুদ্রাও ব্যয় হয়। বাংলাদেশের শীত তো খুবই মৃদু। এ জন্য স্যুট কোট পরার দরকার কি? প্রয়োজনের অতিরিক্ত কাপড় পরা তো অপচয়। ইসলাম ধর্মে অপচয়কারীকে শয়তানের ভাই বলা হয়েছে। তাছাড়া যে কারণ দেখিয়ে অর্থাৎ পরিবেশ দূষণকারী কার্বন পোড়ানো কমানোর জন্য বছরের ৯টি মাস স্যুট পরিহার করে শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্রের ব্যবহার হ্রাস করার যে সরকারী নির্দেশ দেয়া হয়েছে তা তো শুধু দেশের জন্য নয়, বৈশ্বিক প্রেক্ষিতেও সমর্থনযোগ্য। যারা এ নির্দেশ মানছেন না তারা কি তাদের কার্বন ফুটপ্রিন্ট সম্পর্কে অবহিত আছেন? মার্ক লিনাস তার কার্বন কাউন্টার, ক্যালকুলেট ইওর কার্বন ফুটপ্রিন্ট বইতে (পৃঃ ২৯, হার্পার কলিনস, লন্ডন, ২০০৭) লিখেছেন, কার্বন ফুটপ্রিন্ট হচ্ছে বৈশ্বিক উষ্ণায়নে একজন মানুষের দৈনন্দিন অবদান কতটুকু তার পরিমাণ। হাল্কা পোশাক পরে একজন বাংলাদেশী যদি বৈশ্বিক উষ্ণায়নে কম অবদান রাখেন, তবে তাকে প্রধানমন্ত্রী হয়ত বাহবা দেবেন না, কিন্তু দ্রুত ধ্বংস হয়ে যাওয়া বিশ্ব তার কাছে কৃতজ্ঞ থাকবে অবশ্যই। বিশ্ব উষ্ণায়নের ৯৯.৯% কারণই মানুষের তৈরি। মানুষের প্রতিটি কাজ বিশ্ব উষ্ণায়ন কমায় বা বাড়ায়। বেশি কাপড় না পরে যে মানুষ বিশ্ব উষ্ণায়ন কম করছে তাকে তো পরিবেশবান্ধব বলতেই হবে। তবে তিনি যদি লম্বা পাঞ্জাবি না পরে ফতুয়া গায়ে দেন তবে আরও বেশি পরিবেশবান্ধব হবেন। কারণ ফতুয়া বানাতে পাঞ্জাবির চেয়ে কম কাপড় ব্যবহৃত হয়। পয়লা বৈশাখে যারা সুদৃশ্য ফতুয়া পরেছিলেন তাদেরও বেশ সুদর্শন দেখাচ্ছিল। সুতরাং পাঞ্জাবির পরিবর্তে আমাদের অনেকেই অনায়াসে রংবেরঙের ফতুয়া পরতে পারি। বিশ্বব্যাপী ভারি কাপড় পরিহিতদের সমীহের চোখে দেখা হয়। তার কারণ যাই-ই থাক না কেন তা যে নিতান্তই হাস্যকর ব্যাপার, শেখ সাদি তা প্রমাণ করে গেছেন। তিনি রাজদরবারের খাবার নিজে না খেয়ে পকেটে পুরে পোশাককে খাইয়েছিলেন। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি কদিন আগে দিল্লীতে বারাক ওবামার পাশে দাঁড়িয়ে ১০ লাখ ভারতীয় রুপী দামের যে মোটা কাপড় পরে ঘেমে উঠে সমগ্র ভারতবাসীকে বিব্রত করেছিলেন তার ফলে এবার দিল্লীর বিধানসভা নির্বাচনে ৭০টি আসনের মধ্যে মাত্র তিনটি আসন লাভ করে তিনি শুধু ভারত নয়, সারা বিশ্বকে অবাক করে দিয়েছেন। হাল্কা পোশাক পরে থাকলে এই অভূতপূর্ব কেলেঙ্কারির হাত থেকে তিনি তাঁর দল বিজেপিকে আবশ্যই বাঁচাতে পারতেন। আমাদের মুক্তিযুদ্ধেও ভারি পোশাকের অসারতা প্রমাণিত হয়েছে। পৃথিবীর সর্বাপেক্ষ ভয়াবহ এবং অমানবিক পাকিস্তানী সৈন্যরা ভারি পোশাক পরে হাল্কা পোশাকের (এমনকি লুঙ্গি-গামছা পরিহিত) মুক্তিযোদ্ধাদের সামনে দাঁড়াতে পারেনি। পোশাক যতই সহজ এবং আরামদায়কভাবে পরিধেয় হবে ততই ভাল। শুনেছি সিরাজউদ্দৌলার দামী নবাবী জুতা পরতে দেরি হয়ে যাওয়ায় শক্রর হাতে ধরা পড়ে গিয়েছিলেন। সে যাই হোক, জননেত্রী শেখ হাসিনা সব কিছু ভেবেচিন্তে একটা জাতীয় পোশাক নির্ধারণ করে দিন, জাতি এখন তাই-ই চায়। নইলে আমাদের পোশাকবিষয়ক হীনম্মন্যতা যাবে না। আর একটা কথা। পরিবেশ দূষণ কমাতে এবং অর্থ সাশ্রয়ের জন্য আমাদের কিছু পদক্ষেপ এখনই নেয়া দরকার। যেমন : ১৫০০ সিসির বেশি বড় গাড়ি নিষিদ্ধ হতে হবে। দোকানপাট সন্ধ্যা ৬টায় বন্ধ করতে হবে। অত্যাবশ্যক আলো ছাড়া সব আলোই বন্ধ রাখতে হবে। প্রতি ২ বর্গ কিলোমিটারের মধ্যে ঈঘএ স্টেশন থাকতে হবে যাতে গ্যাস ভরতে অনর্থক জ্বালানি পুড়িয়ে গাড়িকে দূরে না যেতে হয়। ঈঘএ স্টেশন ভোর ৬টা থেকে রাত ১২টা পর্যন্ত (বিরতি ছাড়া) খোলা থাকতে হবে। সরকারী কাজ ছাড়া হেলিকপ্টার ব্যবহার করা চলবে না। তাড়াতাড়ি মেট্রো রেল, বাস র‌্যাপিড ট্রাসপোর্ট (বিআরটি) এবং সার্কুলার লঞ্চ সার্ভিস চালু করতে হবে। পর্যাপ্ত পাবলিক ট্রাসপোর্ট সার্ভিস নিশ্চিত হয়ে গেলে শহরের মধ্যে শুধুমাত্র চড়া ফি দিয়ে প্রাইভেট গাড়ি চলতে দেয়া যাবে। সকল যানবাহন রিনিউএবল এনার্জি দিয়ে চালাবার ব্যবস্থা করতে হবে। দেশব্যাপী নতুন নতুন রেললাইন বসাতে হবে এবং আরও স্টিমার/লঞ্চ সার্ভিস চালু করতে হবে। গরিববান্ধব উন্নয়নই হতে হবে বর্তমান সরকারের সাফল্যের চাবিকাঠি। জ্বালানির মূল্য বাড়িয়ে বা বাসায় গ্যাস সরবরাহ বন্ধ করে মধ্যবিত্ত ও নি¤œমধ্যবিত্ত মানুষের দুর্ভোগ সরাসরি বাড়িয়ে দেয়া ঠিক হবে বলে মনে হয় না। ক্লিন এনার্জি ব্যবহার করে এবং কার্বন ব্যবহার কমিয়ে আমরা বিশ্ব উষ্ণায়নরোধী যে কর্মকা- চালিয়ে যাচ্ছি বা যাব তার আর্থিক মূল্য দূষণরত ধনী দেশগুলো থেকে আদায় করে নিতে হবে। লেখক : সাবেক সরকারী কর্মকর্তা সড়যর৪৪@ুধযড়ড়.পড়স
×