ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

সিডনির মেলব্যাগ ॥ অজয় দাশগুপ্ত

মঙ্গল, অমঙ্গল ও খুনে রাঙ্গা দ্বৈতসত্তা

প্রকাশিত: ০৪:৫৭, ২০ এপ্রিল ২০১৫

মঙ্গল, অমঙ্গল ও খুনে রাঙ্গা দ্বৈতসত্তা

পহেলা বৈশাখে জেগে ওঠা বাংলাদেশ দেখে কে জানবে এই ঢাকার রাজপথে খুন হয়ে গেছে মুক্তবুদ্ধি? এই ক’দিন আগে পর পর দুটো অপমৃত্যু আর লাশের ভেতর মুখথুবড়ে পড়েছিল স্বাধীন চিন্তা। এই ক’মাস আগেও ভাবা যায়নি মানুষ নিরাপদে বাড়ি ফিরতে পারবে, কেউ জানত না কখন, কোন্ বাস, ট্রেন বা গাড়িতে বোমা পড়বে। মাঝে এমনও মনে হতো গৃহযুদ্ধ বুঝি সত্যি এলো। দেশে-বিদেশে বাঙালীদের আড্ডাও হয়ে উঠেছিল তর্কময়। যেখানে যেতাম তর্ক-বিতর্কে বাংলাদেশীদের চিত্র দেখে মনে হতো শান্তি বুঝি আর ফিরে আসবে না। সুস্থ, স্বাভাবিক জীবনবোধ সারাজীবনের জন্য হারিয়ে যেতে বসেছে। কী এক অরাজকতা, রাস্তায় যেন লড়াইরত নিরাপত্তা বাহিনী, জ্বলে যাওয়া বাস, ট্রেন আর জ্বলন্ত মানুষের ছবি দেখে মনে হতো জীবন্ত নরকের দিকে টেনে নিচ্ছে বিএনপি-জামায়াত। জীবনে যা যা শুনিনি যার নাম জানা ছিল না সেই সব জিনিস বা বিষয় হয়ে উঠল আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু। পেট্রলবোমা, বার্ন ইউনিট এসবের আমরা নাম জানলেও কালে-ভদ্রে দেখতে পেতাম। বলা উচিত, পেট্রলবোমা কী জিনিস জানাই ছিল না। এবারে গণতন্ত্র ও ধর্মের সোল এজেন্সি নেয়া দল বিএনপি ও জামায়াত জাতিকে তার সঙ্গে এমনভাবে পরিচয় করিয়ে দিয়েছে যা ইতিহাসও কোনদিন ভুলতে পারবে না। এতসব করার পর প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে মদদ দেয়ার পরও কেউ সুস্থ থাকতে পারেনÑ সেটাই বিস্ময়কর। এ কথা বলছি না, বেগম জিয়াই সবকিছুর হোতা বা তিনি একা দায়ী। কিন্তু এটা মানতে হবে তিনি বা তাঁর দল চাইলে নৃশংসতা বন্ধ হতো। সেটা তিনি চাননি, যে কারণে বা যেভাবেই রহস্য ঘনীভূত হোক কেন্দ্রবিন্দু ছিলেন খালেদা জিয়া। আমরা যদি ধরে নেই সরকার দায়ী তারপরও তিনি দায় বা অপরাধবোধ এড়াতে পারবেন না, এই যে সুড় সুড় করে বেরিয়ে ফিরোজায় গেলেন, কই তাঁকে তো কেউ আটকালো না। তিনি যদি গৃহবন্দী বা অফিস বন্দী থাকতেন তবুও সুযোগ ছিল কিছু বলার, বলেননি, বারান্দায় দাঁড়িয়ে ভিডিও বার্তা পাঠিয়ে ফোনে বা যে কোন উপায়ে সেটা করার সুযোগ থাকার পরও করেননি। এখন যখন বাইরে তখনও নীরব। বিস্ময়ের সঙ্গে দেখলাম পহেলা বৈশাখে দারুণ দামী একটি শাড়ি পরে হাসি হাসি মুখে নির্বাচনী প্রচার চালাচ্ছেন। হাত দিয়ে মগ তুলে ধরে থাকা বেগম জিয়া ভাল করে তাকালে দেখতেন সেই মগে হয়ত এখনও রক্তের দাগ লেগে আছে। এ এক আশ্চর্য দেশ আমাদের! জিয়া, এরশাদ ছাত্রলীগ-বিএনপি সবার হাতে রক্তের দাগ কিন্তু রাজনীতিতে এরাই প্রভু। খালেদা জিয়া কি বিগত তিন মাসের দায়িত্ব এড়াতে পারেন? অথচ কোন মিডিয়া সাংবাদিক বা গণমাধ্যম এ প্রশ্ন করল না। কেন এতদিন তিনি অন্তরীণ ছিলেন? উত্তর যেটাই হতো আমরা জানতে পারতাম, শান্তি পেতাম। একটি রাজনৈতিক দলের নেতা কয়েক দফায় প্রধানমন্ত্রী গণতন্ত্রের কথা বলবেন কিন্তু আচরণ বিধি মানবেন না এটা কী ধরনের কথা? কেন তিনি দেশের সবকিছুকে তাচ্ছিল্য করে কাঁচকলা দেখিয়ে গোঁ ধরে যা ইচ্ছে তাই করবেন? বিদেশী দূতরা দেখা করে সহিংসতা বন্ধ হোক বলার সঙ্গে সঙ্গে কেন দৃশ্যপটে পরিবর্তন ঘটবে? বিএনপি ও জামায়াত কি এদেশের মানুষের জন্য রাজনীতি করে, না আমরা কারও করদ রাষ্ট্র? আমি একবারও বলছি না আওয়ামী লীগ একশ’ পার্সেন্ট খাঁটি। আপোসের নামে তারা যেসব কর্মকা- করে সেগুলোও গ্রহণযোগ্য নয়। তবে এটা তো মানতেই হবে শেখ হাসিনা না থাকলে রাজাকারদের দ- দেয়া, ফাঁসিতে ঝোলানো কখনই সম্ভব হতো না। তিনি এ বিষয়ে বিদেশী চাপের কাছেও মাথানত করেননি। এটাও ঠিক জামায়াতের যে সংগঠিত নেটওয়ার্ক আর ধর্মের নামে গড়ে তোলা বলয় তারা এ কারণে আওয়ামী লীগকে কখনও ছেড়ে দেবে না। তারপরও তিনি ইতিহাসের দায় মেটাচ্ছেন অন্যদিকে যাদের ভোট ও সমর্থন ছাড়া বিএনপি অচল, যাদের কাঁধে ভর দিয়ে খালেদা জিয়া শক্তিশালী সেই মিত্রদের নেতারা যখন ফাঁসিতে তখনও তিনি চুপ। এই অপকৌশলের মানে কী? এতে কি প্রমাণ হয় না যে, তিনি ও তাঁর দল আসলেই হৃদয়হীন ও স্বার্থপর? যদি ফাঁসিতে তাদের সম্মতি থাকে সেটাও বলা উচিত। কোনটা না বলে মুখে কুলুপ এঁটে আগের মতো আপোসহীন থাকার দিন এখন নেই। বেগম জিয়া তা বুঝতে পারছেন না। এক সময় তাঁর যে ক্যারিশমা এখন তা গতায়ু। এটা মানা কঠিন করে তুলেছেন গুটিকয় বুদ্ধিজীবী ও সুশীল। হাল আমলে এমাজউদ্দীন আর ডাঃ জাফরুল্লাহরাই তাঁকে ডুবিয়ে ছাড়বেন। আমরা দেশে-বিদেশে এ জাতীয় রাজনীতির বিরুদ্ধে জনমতের সংগঠিত প্রতিবাদ দেখি, কোন দেশে কোন জাতিতে দাঙ্গা-ফ্যাসাদ মৃত্যুর উস্কানি দেয়ার পর এমন বরণ করে নেয়ার কালচার দেখা যায় না। আর কতকাল চলবে এই খেলা? যে মানুষ পহেলা বৈশাখের মঙ্গলযাত্রায় রাজপথ মুখরিত করে সে যদি ধানের শীষ বা মগের প্রতি আকর্ষণ বোধ করে, তাহলে প্রশ্ন থেকেই যায়। কে, কাকে সমর্থন করবে সেটা যেমন ব্যক্তিগত, তেমনি রাষ্ট্রের সকল শুভবোধ ও শক্তির বিরুদ্ধে দাঁড়ানো মৌলবাদের দোসরকে সমর্থন করাটাও ব্যক্তিগত বোধের বাইরে। কারণ এতে হিপোক্রেসির গন্ধ লুকিয়ে থাকে। সে কারণেই প্রশ্নÑ এই আমরাই কি তবে দ্বৈত? না রাজনীতি?
×