ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

কম্পিউটার বনাম হালখাতা

প্রকাশিত: ০৫:২৭, ১৪ এপ্রিল ২০১৫

কম্পিউটার বনাম হালখাতা

কাওসার রহমান ॥ প্রযুক্তিই এখন ঐতিহ্যবাহী হালখাতার জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। ক্রমেই প্রযুক্তির কাছে হার মানছে হাজার বছরের ঐতিহ্য। কম্পিউটারাইজড হিসাব পদ্ধতি চালু হওয়ায় এখন উঠে যাচ্ছে ঐহিত্যবাহী হালখাতার প্রথা। অধিকাংশ ব্যবসা প্রতিষ্ঠানেই এখন কম্পিউটারাইজড পদ্ধতিতে হিসাব-নিকাশ হয়। ফলে খাতা রাখার খুব একটা প্রয়োজন হয় না। এ কারণেই হালখাতা এখন উঠে যাচ্ছে। শুধু তাই নয়, এক সময় ক্রেতাকে অনেক টাকার বাকিও দেয়া হতো, যার হিসাব থাকত খাতায়। এখন বাকির হিসাব খুব কমই হয়। কম্পিউটারে হিসাব করে ক্রেতাদের সিøপ ধরিয়ে দেয়া হয়। ফলে বাকি জিনিসটাও এখন উঠে যাচ্ছে। নতুন বছর শুরু, নতুন একটি খাতা খোলা, হিসাব-নিকাশ হালনাগাদ করা। দোকানগুলোতে এখন আর আগের সেই চিত্র চোখে পড়ে না। আধুনিক প্রযুক্তি বর্তমানে খাতায় হাতে লেখা থেকে অনেককে নিষ্কৃতি দিয়েছে। হালখাতা শুধু হিসাবের নতুন খাতা খোলা নয়, পাওনা আদায়ের পাশাপাশি ক্রেতাদের আপ্যায়নের বিষয়টিও হাজার বছরের এই ঐতিহ্যের সঙ্গে জড়িয়ে আছে। বাংলা উইকিপিডিয়ার মতে, হালখাতা হলো বঙ্গাব্দ বা বাংলা সনের প্রথম দিনে দোকানপাটের হিসাব আনুষ্ঠানিকভাবে হালনাগাদ করার প্রক্রিয়া। বছরের প্রথম দিনে ব্যবসায়ীরা তাদের দেনা-পাওনার হিসাব সমন্বয় করে এদিন হিসাবের নতুন খাতা খুলেন। এজন্য ক্রেতাদের বিনীতভাবে পাওনা শোধ করার কথা স্মরণ করিয়ে দেয়া হয়। এ উপলক্ষে নববর্ষের দিন ব্যবসায়ীরা তাদের পাইকারি খরিদ্দারদের মিষ্টিমুখ করান। খরিদ্দাররাও তাদের সামর্থ্য অনুযায়ী পুরানো দেনা শোধ করে দেন। আগেকার দিনে ব্যবসায়ীরা একটিমাত্র মোটা খাতায় তাদের যাবতীয় হিসাব লিখে রাখতেন। এই খাতাটি বৈশাখের প্রথম দিনে নতুন করে হালনাগাদ করা হতো। হিসাবের খাতা হালনাগাদ করা থেকে ‘হালখাতা’র উদ্ভব। শুধু বাংলাদেশ নয় ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জেলায় ছোট বড় মাঝারি যে কোন দোকানেই এটি পালন করা হয়ে থাকে। বাংলা বছরের প্রথম দিনে গ্রামগঞ্জের ব্যবসায়ীরা বকেয়া আদায়ের এই প্রথা ধরে রাখলেও নগর জীবনে এ ঐতিহ্যের প্রভাব অনেকখানি কমে গেছে। তবে এখনও পুরনো ঢাকার তাঁতীবাজার, শাঁখারি বাজার, শ্যামবাজার ও ইসলামপুরের ব্যবসায়ীরা হালখাতার ঐতিহ্য ধরে রেখেছেন। তারা এখনও ধুমধাম করে পুরনো হিসাব চুকিয়ে নতুন খাতা খোলেন। আপ্যায়ন করেন খরিদ্দারকে। সনাতন পঞ্জিকার তারিখ অনুযায়ী পহেলা বৈশাখের দিন হালখাতা করা হয়। ওই পঞ্জিকার হিসাবে পহেলা বৈশাখের দিন নির্ধারিত হয়। সে অনুযায়ী পহেলা বৈশাখের দিন সকালে দোকানগুলো ফুলে ফুলে সাজানো হয়। হিন্দু ব্যবসায়ীরা গণেশ পুজোর মধ্য দিয়ে নতুন খাতা খুলেন। নতুন বছরে লাভের আশায় বাণিজ্যের দেবতা গণেশ মূর্তিকে নতুনভাবে সাজিয়ে দোকানে বসান। নতুন হিসাবের খাতাকে মন্দিরে নিয়ে গিয়ে আশীর্বাদও নিয়ে আসেন। বাদ্যবাজনারও আয়োজন থাকে। অন্যদিকে, মুসলমান ব্যবসায়ীরা দোকান সাজিয়ে আগরবাতি জ্বালিয়ে, দোয়া ও মিলাদ মাহফিলের মাধ্যমে বছরের কাজ শুরু করেন। ক্রেতাকে সাধ্যমতো আপ্যায়নের ব্যবস্থাও করে থাকেন। এ রেওয়াজ অবশ্য হিন্দু-মুসলমান সব ব্যবসায়ীর ক্ষেত্রেই হয়ে আসছে যুগ যুগ ধরে। শুধু তাই নয়, আপ্যায়নের পাশাপাশি ক্রেতাকে উপহার দেয়ারও প্রচলন রয়েছে। এক সময় খুব জাঁকজমকভাবে হালখাতা হলেও এখন সেই উৎসাহ-উদ্দীপনা অনেকখানি কমে গেছে। এখন নিয়ম রক্ষার জন্য ব্যবসা প্রতিষ্ঠান পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করা হয়। লাল রঙের নতুন খাতা কেনা হয়। পুরো বছর বিভিন্ন কারণে ক্রেতার সঙ্গে সম্পর্ক অটুট রেখে চলা সম্ভব হয় না ব্যবসায়ীদের। তাই পহেলা বৈশাখে ক্রেতাকে নিমন্ত্রণ করে তার নামে পুরনো বছরের হিসাব বই বন্ধ করে নতুন বই খোলার মাধ্যমেই আবার শুভ সম্পর্কের সূচনা করা হয়। চাঁদনী চক মার্কেটের স্বর্ণ ব্যবসায়ী শ্যামাপদ সরকার ৪৩ বছর ধরে হালখাতা করে আসছেন। তিনি হালখাতা অনুষ্ঠানকে ক্রেতার সঙ্গে সম্পর্কের বন্ধন দৃঢ় করার সুযোগ বলে মনে করেন। পুরানো ঢাকাতেও ব্যবসায়ীরা এখনও ওই রেওয়াজ ধরে রেখেছেন। যারা পুরানো ব্যবসায়ী তারা এখনও ক্রেতাকে এ দিনে নিমন্ত্রণ করতে ভোলেন না। তবে এখন অধিকাংশ ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে কম্পিউটারাইজড পদ্ধতিতে হিসাব-নিকাশ হয়। ফলে খাতা রাখার খুব একটা প্রয়োজন হয় না। ফলে সেই অর্থে এখন হালখাতা উঠেই যাচ্ছে। তাসলিমা খানম ২০ বছর ধরে ইসলামপুরের একটি দোকান থেকে কাপড় কিনে আসছেন। তার ভাষায়, আগে এই দিনে নিমন্ত্রণ অবশ্যই থাকত। বিক্রেতারা আগে থেকেই কার্ড ছাপিয়ে ক্রেতাদের পহেলা বৈশাখের দিনে শুভ হালখাতার দাওয়াত করত। এমনও হতো যে ক্রেতারাও বিক্রেতাদের জন্য উপহার নিয়ে আসত। কিন্তু এখন আর তা হয় না। ঐতিহ্য ধরে রেখে পুরানো ক্রেতাদের এখনও হালখাতার নিমন্ত্রণ করা হয়। তবে আগের মতো এখন আর উপহার দেয়া হয় না। আগে সম্পর্কের ওপর ভিত্তি করেই জিনিস পরিবর্তন করে দেয়া হতো। এমনকি ক্রেতাকে অনেক টাকার বাকিও দেয়া হতো, যার হিসাব থাকত খাতায়। এখন বাকির হিসাব খুব কমই হয়। কম্পিউটারে হিসাব করে ক্রেতাদের সিøপ দেয়া হয়। ফলে বাকি জিনিসটাও এখন উঠে যাচ্ছে। মুঘল সম্রাট আকবরের শাসনামল থেকে নতুন বছরের শুরুতে এ হালখাতার প্রচলন শুরু হয় ভারতবর্ষে। পুরানো হিসাব বন্ধ করে নতুন হিসাব খোলা হয় যে খাতায়, তাই হালখাতা নামে পরিচিত। লাল কাপড়ে বাঁধাই করা মোটা এ খাতাটিই এক সময় ক্রেতার সঙ্গে বিক্রেতার ব্যবসায়িক সম্পর্কের যোগসূত্র স্থাপন করত। যা হালে অত্যাধুনিক প্রযুক্তি পণ্য কম্পিউটারই করছে। তাই এখন আগের মতো হালখাতার জৌলুস নেই বলে অনেকেই মনে করছেন। যারা খাতা তৈরি করেন, তাদেরও একই অভিমত। পুরান ঢাকার চকবাজার এলাকার খাতা বিক্রেতা কমল কান্তি দাস বলেন, ‘আগের মতো এখন আর ব্যবসায়ীরা খাতা কেনেন না। আগে যেখানে একেকজন ব্যবসায়ী একসঙ্গে কয়েক মাসের খাতা কিনতেন এখন সেখানে এটা কমে এসেছে মাত্র পাঁচ-ছয়টিতে। ধীরে ধীরে এ প্রথাটি উঠেই যাচ্ছে। তবে সোনার দোকানগুলোতে খাতার ব্যবহার এখনও রয়েছে। তা সত্ত্বেও ১৪২১ সালের বিদায় আর ১৪২২ সালের আগমনী বার্তায় পুরানো হিসাব-নিকাশ চুকিয়ে ফেলার ধুম আয়োজন চলছে সর্বত্র। ঐতিহ্যগতভাবেই হালখাতা খুলে আর মিষ্টি বিতরণ করে বাংলা নববর্ষ পালন করে আসছে পুরান ঢাকার ব্যাবসায়ীরা। এবারও এর ব্যতিক্রম ঘটছে না। পুরান ঢাকার ব্যবসায়ীরা নতুনভাবে সাজিয়ে তুলছেন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। গ্রাহকদের হালখাতা অনুষ্ঠানের দাওয়াত দিতে শুরু করেছেন। খুচরা ও পাইকারি ক্রেতা সাধারণদের নিয়ে নানা উৎসবের মধ্য দিয়ে বর্ষবরণে প্রস্তুত হচ্ছে পুরান ঢাকার ব্যবসায়ীরা। পুরান ঢাকার চকবাজার, তাঁতীবাজার, শাঁখারিবাজার, বাংলাবাজার, শ্যামবাজারসহ বিভিন্ন এলাকা ঘুরে এমনটাই দেখা গেল। এ জন্য পুরান ঢাকার ব্যবসায়ীরা তাদের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানকে ধুয়ে মুছে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করছেন, অনেকে আবার নানা রঙের বাতি ও ফুল দিয়ে সাজিয়ে তুলছেন। ব্যবসায়ীরা বলছেন, পহেলা বৈশাখের দিন তাঁরা গণেশ পুজো দিয়ে সোনা রূপা ভেজানো পানি ও গোলাপ জল ছিটিয়ে হালখাতার মাধ্যমে লেনদেন শুরু করবেন। মুসলিম ব্যবসায়ীরা ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে মিলাদ ও গোলাপ জল ছিটিয়ে বছরের প্রথম দিনের কাজ শুরু করবেন। পুরান ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় গিয়ে চোখে পড়ল লাল কাপড়ে বাঁধানো নতুন খাতা বোঝাই একটি রিক্সা-ভ্যান। দোকানে দোকানে সরবরাহ করা হচ্ছে সেই খাতা। যা ‘হালখাতা’ নামে পরিচিত। এই খাতা সরবরাহকারীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, লাল খাতা প্রস্তুতকারকরাও এখন বেশ ব্যস্ত সময় পার করছেন। শাঁখারি বাজারে কথা হলো ব্যবসায়ী অজয় দাসের সঙ্গে। তিনি খেলনা, ঝুমকো ও হিন্দু নারী-পুরুষের বিয়ের টোপের বিক্রেতা। যাত্রা এবং বিভিন্ন পৌরাণিক পালা-নাটকের ক্রেতারা এসে তার প্রতিষ্ঠান থেকে শোলার টোপের ফুল, মালা, ঝুমকো বা অর্ডারমতো অন্য কোন জিনিস কিনে নিয়ে যায়। নাটক-পালা বা যাত্রা দলের কাছে প্রধানত শীতকালে বেচাকেনা করেন তিনি। অন্য সময় বিয়ে-শাদির উপকরণ বেচে সংসার চলে তার। তিনি আরও জানান, তার ব্যবসার আওতা সীমিত। ক্রেতারাও থাকেন নিত্যনতুন। অন্য জেলার দু’চারজন ছোট ব্যবসায়ী তার কাছ থেকে পাইকারি দরে মাল কিনে নিয়ে যান। তাদের কাছে সামান্য বাকি পড়ে। এসব পাইকারদের কথা মাথায় রেখে প্রতিবছর মিষ্টি, লুচি অথবা মৌসুমি ফল দিয়ে ক্রেতা ও বন্ধু-বান্ধবদের আপ্যায়ন করেন তিনি। এবারও একই রকম আয়োজন করবেন বলে জানান তিনি।
×