ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

আদিবাসীদের দেহমনে দিনবদলের আনন্দ

বর্ণাঢ্য আয়োজনে পাহাড়ে তিন দিনের বৈসাবি উৎসব শুরু

প্রকাশিত: ০৬:৩৭, ১১ এপ্রিল ২০১৫

বর্ণাঢ্য আয়োজনে পাহাড়ে তিন দিনের বৈসাবি উৎসব শুরু

জনকণ্ঠ ডেস্ক ॥ বর্ণাঢ্য আয়োজনের মধ্য দিয়ে তিন পার্বত্য জেলায় বাংলা নববর্ষের বৈসাবি উৎসব পালনের প্রস্তুতি চলছে। ইতোমধ্যে শুক্রবার রাঙ্গামাটিতে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর প্রধান সামাজিক উৎসব শুরু হয়েছে। খাগড়াছড়িতে শুক্রবার বের করা হয়েছে ত্রিপুরা জনগোষ্ঠীর বর্ণাঢ্য র্যালি। আর বান্দরবান জেলায় এই উৎসব চূড়ান্তরূপ নেবে চৈত্রসংক্রান্তির দিন অর্থাৎ ১৩ এপ্রিল সোমবার। চলবে নববর্ষের দিন পর্যন্ত। খবর পার্বত্যাঞ্চল প্রতিনিধি এবং রাঙ্গামাটি ও বান্দরবানের নিজস্ব সংবাদদাতাদের। উৎসব মুখর পরিবেশে এবং বর্ণাঢ্য নানা আয়োজনের মধ্য দিয়ে শুক্রবার থেকে রাঙ্গামাটিতে শুরু হয়েছে পার্বত্যাঞ্চলে বসবাসরত ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীসমূহের প্রধান সামাজিক উৎসব বিজু, বৈসুক, সাংগ্রাই, বিষু ও বিহু। উৎসব উপলক্ষে ওইদিন রাঙ্গামাটি পৌরসভা চত্বরে উৎসব কমিটির আহ্বায়ক বিজয় কেতন চাকমার সভাপতিত্বে এক আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। এতে প্রধান অতিথি ছিলেন রাঙ্গামাটির সাংসদ উষাতন তালুকদার এমপি। এতে বক্তব্য রেখেছেন রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান জগৎ জ্যোতি চাকমা, গৌতম দেওয়ান ও ড. মানিক লাল দেওয়ান এবং মহিলা নেত্রী মাধবীলতা প্রমুখ। উৎসবের উদ্বোধন করেন ড. মানিক লাল দেওয়ান। অনুষ্ঠান শেষে শহরে একটি বর্ণাঢ্য র্যালি বের করা হয়েছে। পাহাড়ে এই উৎসব বৈসাবি নামে সর্বাধিক পরিচিত। তিন দিনব্যাপী এই উৎসব চলবে। নানা রংবেরংয়ের পোশাক পড়ে র্যালিতে তাদের মহিলারা যোগ দেয়। ব্যানার ফেস্টুন হাতে নিয়ে শহর প্রদক্ষিণ শেষে র্যালিটি রাঙ্গামাটি স্টেডিয়ামে গিয়ে শেষ হয়েছে। খাগড়াছড়িতে ত্রিপুরা জনগোষ্ঠীর র্যালি ॥ পাহাড়ী জনগোষ্ঠীর প্রাণের উৎসব বৈ-সা-বি উৎসবকে স্মরণীয় করে রাখতে শুক্রবার খাগড়াছড়িতে ত্রিপুরা জনগোষ্ঠীর উদ্যোগে বিশাল বর্ণাঢ্য র্যালি বের করা হয়েছে। খাগড়াছড়ি টাউন হল প্রাঙ্গণ থেকে সকাল ১০টায় র্যালিটি বের হয়। বেলুন উড়িয়ে র্যালির উদ্বোধন করেন, খাগড়াছড়ি আসনের সংসদ সদস্য কুজেন্দ্র লাল ত্রিপুরা। খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান কংজরী চৌধুরী, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার এনায়েত হোসেন মান্নান, জেলা পরিষদ সদস্য মোঃ জাহেদুল আলম, এম আবদুল জব্বার, নির্মলেন্দু চৌধুরী, খগেশ্বর ত্রিপুরা, খোকনেশ্বর ত্রিপুরা, মংক্যচিং চৌধুরী, মংসুইপ্রু চৌধুরী অপু, জুয়েল চাকমা ও শতীষ চাকমাসহ বর্ণিল পোশাকে ত্রিপুরা জনগোষ্ঠীর তরুণ-তরুণী ছাড়াও বিভিন্ন বয়সের হাজারো নারী-পুরুষ অংশ গ্রহণে র্যালিটি শহরের প্রধান সড়ক ঘুরে টাউন হলের সামনে এসে শেষ হয়। ১৯৮৫ সাল থেকে খাগড়াছড়িসহ পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত তিন সম্প্রদায়ের বিভিন্ন সংগঠনের সম্মিলিত উদ্যোগে ‘বৈসাবি’ নামে এ উৎসব পালন করে আসছে, যা সময়ের ব্যবধানে নিজ নিজ সম্প্রদায়ের লোকদের কাছে ‘বৈসাবি’ শব্দটি জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। ত্রিপুরা, মারমা ও চাকমা সম্প্রদায় তাদের নিজস্ব নামে ‘ত্রিপুরা ভাষায় বৈসু, মারমা ভাষায় সাংগ্রাই এবং চাকমা ভাষায় বিজু’ নামে এ উৎসব পালন হয়ে থাকে। এ তিন সম্প্রদায়ের নিজস্ব ভাষার নামের প্রথম অক্ষর নিয়ে ‘বৈসাবি’ নামকরণ করা হয়। আজ শনিবার নদীতে ফুল ভাসানোর মধ্য দিয়ে খাগড়াছড়িতে শুরু হবে পাহাড়ী জনগোষ্ঠীর প্রধান সামাজিক উৎসব। ঐদিন চাকমা সম্প্রদায় মূল বিজু আর পহেলা বৈশাখ বা গজ্জাপয্যা পালন করবে। ঐদিন ঘরে ঘরে চলবে অতিথি আপ্যায়ন। সেই সঙ্গে সব বয়সী মানুষ নদী খাল অথবা ঝর্ণায় গঙ্গা দেবীর পূজা আরাধনা করবেন। রবিবার ত্রিপুরা সম্প্রদায়ের গড়িয়া ও সাঁওতাল নৃত্য। ১৪ এপ্রিল জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে বর্ষবরণ ও মারমা সম্প্রদায়ের সাংগ্রাই উৎসবে ঐতিহ্যবাহী ওয়াটার ফেস্টটিবল বা পানি খেলা উৎসব। পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ীদের ঐতিহ্যবাহী উৎসব হচ্ছে বৈসাবি। যাকে বাংলায় চৈত্রসংক্রান্তি হিসেবে ধরা হয়। পুরনো বর্ষকে বিদায় এবং নববর্ষকে স্বাগত জানানোর মধ্য দিয়ে ঐতিহ্যবাহী এই বৈসাবি উৎসব পাহাড়ী জাতিসত্তাসমূহের পারস্পরিক সম্প্রতি ও ঐক্যের প্রতীক। বৈসাবি পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ীদের হাজার বছরের ঐতিহ্য। এটি পাহাড়ীদের সবচেয়ে বড় পার্বণ। চৈত্রের শেষ দিন ও তার আগের দিন এবং নববর্ষের দিন নিয়ে মোট তিন দিন পর্যন্ত পাহাড়ীদের ঘরে ঘরে এ উৎসব চলে। প্রতিবছর বৈসাবি আসে পাহাড়ীদের মাঝে আনন্দের বার্তা আর নবজীবনের সোনালি স্বপ্ন নিয়ে। বৈসাবিকে কেন্দ্র করে ফুটে ওঠে পাহাড়ী জনগোষ্ঠীর বৈচিত্র্যম-িত সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য। তাই এটি পাহাড়ীদের সাংস্কৃতিক চেতনার উৎসস্থল সামাজিক সাম্যবাদের প্রতিফলন। বৈসাবি উৎসবের মধ্য দিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের উপজাতীয় লোকজন বছরের শেষ দিন এবং নতুন বছরের প্রথম দিন পারস্পরিক সান্নিধ্য লাভ করে। পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতীয়দের বিভিন্ন ভাষায় এ উৎসবের ধরন ভিন্ন ভিন্ন হলেও উৎসবের লক্ষ্য ও রীতি প্রায় এক। বৈসাবিতে পার্বত্য অঞ্চলের তেরোটি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জাতিসত্তা সকল ভেদাভেদ ভুলে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ও ঐক্যের বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে শান্তির পৃথিবী গড়ে তোলার শপথ নেয়। চাকমা সম্প্রদায় এ উৎসবকে বলে ‘বিজু’, ত্রিপুরা উপজাতিরা বলে ‘বৈসু’ আর মারমা উপজাতিরা বলে সাংগ্রাই। ত্রিপুরাদের বৈসু, মারমাদের সাংগ্রাই ও চাকমাদের বিজু মিলে সংক্ষেপে এ উৎসবটির নামকরণ করা হয়েছে বৈসাবি। মূল বিজু ॥ ৩০ চৈত্র এ উৎসবটি পালিত হয়। এ দিনটি মূলত চৈত্রসংক্রান্তি দিন। পার্বত্য অঞ্চলের চাকমা সম্প্রদায় এ দিনকে মূল বিজু বলে থাকে। এ দিনে পাহাড়ীদের ঘরে ঘরে বিভিন্ন ধরনের খাবার তৈরি করা হয়। যে খাবারটি প্রায় ঘরে ঘরে তৈরি করা হয় তা হলো অতি পরিচিত ‘পাচন’। এটি বিশটির অধিক তরকারি দিয়ে রান্না করা হয়। এই দিনে ঘরে তৈরি মদও অতিথিদের পরিবেশন করা হয়ে থাকে। গয্যা পয্যা দিন ॥ এদিনটি হলো মূল বিজুর পরের দিন। অর্থাৎ ১ বৈশাখে এটি পালিত হয়। এই দিনে ভাল ভাল খাবার তৈরি করে বয়োজ্যেষ্ঠদের নিমন্ত্রণ করে খাওয়ানো হয়, যাতে গুরুজনদের আশীর্বাদ পেয়ে আজীবন সুখী, সুন্দর ও সমৃদ্ধশালী জীবনযাপন করা যায়। প্যেইং ছায়াই ॥ মারমা উপজাতি চাকমাদের মতো ফুল বিজুর মতোই দিনটি পালন করে। চাকমা সম্প্রদায়ের মতো মারমারাও এ দিনে গৃহপালিত পশু গরু-মহিষের গলায় ফুলের মালা পরিয়ে দেয়। দুপুরে গ্রামের পুরুষ-মহিলা সবাই মিলে চলে যায় বনে নানান ধরনের তরিতরকারি, ফলমূল সংগ্রহ করতে। আক্যা ॥ মূল সাংগ্রাইকে মারমা উপজাতীয় সম্প্রদায় আক্যা বা আক্যাই বলে। এদিন সকালে তরুণ-তরুণীরা পরস্পরকে পানি ছিটিয়ে আনন্দ উপভোগ করে এবং গ্রামে ঘুরে বুড়োবুড়ি এবং ক্যাং অর্থাৎ বৌদ্ধমন্দিরের উপাসক-উপাসিকাগণকে গায়ে সাবান মেখে ¯œান করিয়ে দেয়। পরে ছেলেরা ধান বা চাল নিয়ে প্রত্যেকের বাড়িতে গিয়ে মোরগ-মুরগিকে তা ছিটিয়ে দেয়। আপ্যাইং বা আতাদা ॥ এদিন মারমাদের ঘরে ঘরে সাধ্যমতো বিভিন্ন ধরনের পিঠা, বিরানি, পোলাও আর অতি পরিচিত পাচন রান্না করা হয়। এদিনে হিংসা-বিদ্বেষ, ক্লেশ, ধনি-গরিব, জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবাই মিলে দলে দলে একে অপরের বাড়ি ঘুরে বেড়ায়। এদিনে খাওয়ার চেয়ে ঘুরে বেড়ানোর আনন্দটাই বেশি হয়ে থাকে। চাকমা, মারমা উপজাতীয় সম্প্রদায়ের মতো ত্রিপুরা উপজাতিরাও বৈসু উৎসব পালন করে তিনটি পর্যায়ে। হার বৈসু, বৈসুমা এবং বিসি কাতাল। হার বৈসু ॥ চৈত্রসংক্রান্তির আগে দিনকে বলা হয় হার বৈসু। চাকমাদের ফুল বিজুর মতোই এ দিনটি পালন করা হয়। ত্রিপুরা সম্প্রদায় এ দিন থেকে কীর্তন এবং কয়েক দিন আগে থেকে ‘গারয়া নাচ’ শুরু করে। বৈসুমা ॥ চৈত্রসংক্রান্তির দিনকে বলা হয় বৈসুমা। এদিন সকালে ত্রিপুরা উপজাতিরা ঘুম থেকে উঠেই ‘কুচাই পানির’ ফোঁটা ফোঁটা জলে নিজেদের সিক্ত করে। অর্থাৎ সোনা, রুপা ও তুলসী পাতা মিশ্রিত পানি ছিটিয়ে শুদ্ধ করে নেয়। মূল বিজুর মতোই এরা দিনটি পালন করে। বিসি কাতাল ॥ ১ বৈশাখকে বিসি কাতাল বলা হয়। এদিন গুরুজনদের পায়ে ফুল দিয়ে প্রণাম করে গোসল করানো হয় এবং তাদের আমন্ত্রণ করে খাওয়ানো হয়। এদিনেও ত্রিপুরারা বিভিন্ন স্থানে ঘুরে বেড়ায়। জলকেলিতে মেতেছে পাহাড়ী তরুণ-তরুণীরা ॥ চট্টগ্রাম থেকে স্টাফ রিপোর্টার জানান, বৈশাখের আগমনী বার্তাকে ঘিরেই তিন পার্বত্যাঞ্চলে শুরু হয় বৈসাবি উৎসব। এ বৈসাবি উৎসবের একটি অংশ হচ্ছে জলকেলি খেলা। পাহাড়ীদের অকৃত্রিম এ উৎসব দেখতে শহর থেকে পাহাড়ে ছুটে যেতে হয় প্রতিবছর। বাংলা নববর্ষকে বরণ করতে ও অতীতের গ্লানি মুছে দিতে এ জলকেলি খেলা খেলে পাহাড়ীরা। তরুণ-তরুণীরা এ আয়োজনের অন্যতম উপসর্গ। বিশেষ করে পাহাড়ী মেয়ে-ছেলেদের মধ্যে যারা একটু চটপটে ও আনন্দ উৎসবে মেতে উঠতে আগ্রহী, তাদের মধ্যেই এ ধরনের উৎসাহ জেগে ওঠে। এ উৎসাহের বহির্প্রকাশ চলে জলকেলির মাধ্যমে। এবার নতুন আয়োজন হলো নগরীতেই। পাহাড়ী তরুণ-তরুণীদের জলকেলি খেলা জমে উঠল শহরের মাঝে। শত বছরের হিসেবে নেই এ আয়োজন শহুরে হওয়ার। প্রথমবারের মতো রঙিন কাপড়ে নন্দিত হয়ে জলকেলি খেলায় অংশ নিয়েছে আদিবাসী তরুণ-তরুণীরা। নগরীর প্রাণকেন্দ্রে এ আয়োজন প্রথমবারের মতো হলেও বুঝে ওঠার উপায় নেই। তিন পার্বত্যাঞ্চলের আদিবাসীদের সমন্বয়ে টিনেজ তরুণ-তরুণীদের এ আয়োজন আনন্দঘন পরিবেশ সৃষ্টি করেছে নগরীর কাতালগঞ্জস্থ চট্টগ্রাম নবপ-িত বিহারে। বাংলাদেশ রাখাইন স্টুডেন্টস এ্যাসোসিয়েশনের উদ্যোগে শুক্রবার বিকেলে এ আয়োজনের উদ্বোধন করেন নবপ-িত বিহারের অধ্যক্ষ ও সভাপতি অধ্যাপক উপানন্দ মহাথের।
×