ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

মনোজগতে মুক্তিযুদ্ধের আধিপত্য না থাকলে দেশবোধের সৃষ্টি হবে কিভাবে?

প্রকাশিত: ০৫:২০, ১১ এপ্রিল ২০১৫

মনোজগতে মুক্তিযুদ্ধের আধিপত্য না থাকলে দেশবোধের  সৃষ্টি হবে কিভাবে?

মনোজগতে মুক্তিযুদ্ধের আধিপত্য না থাকলে দেশবোধের সৃষ্টি হবে কিভাবে? মুনতাসীর মামুন (৯ এপ্রিল প্রকাশের পর) এই পটভূমি তৈরি হতে সময় লেগেছে অবশ্য দীর্ঘদিন। ভাষা আন্দোলন সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলন, স্বায়ত্তশাসনের জন্য আন্দোলন, সর্বোপরি নিদারুণ অর্থনৈতিক বঞ্চনা বাঙালীর পাকিস্তানী মানসিকতায় চিড় ধরিয়েছিল। বিকশিত হয়েছে জাতীয়তাবাদ, ১৯৭০ সালের নির্বাচনের পর যা আরও জোরদার হয়েছে। আওয়ামী লীগ বা বঙ্গবন্ধু তখন সেই জাতীয়তাবাদ সংহত করেছেন সোনার বাংলার স্বপ্ন দেখিয়ে যা ছিল বলে ইতিহাসে প্রচলিত, আসলে যা ছিল না। ঐ সময়ের একটি পোস্টার সামাজিক সংগঠিত জনসমাবেশে দারুণ ভূমিকা পালন করেছিল যার শিরোনাম ছিল ‘সোনার বাংলা শ্মশান কেন?’ বাংলাদেশের জাতীয়তাবাদ প্রসঙ্গে লিখতে গিয়ে বোরহানউদ্দিনখান জাহাঙ্গীরও একই মন্তব্য করেছেন। লিখেছেন তিনি“ÒSonar Bangla : a myth emerged out of non-history radicalised the politics of Bangladesh and helped to establish a state. Sonar Bangla, golden Bengal is a myth, is an imaginary, an utopian vision. As a myth its origin lies in a non-dated history, as an imaginary it reconstructs historical past and present, as an utopia it challenges the colonial past an places it in the future.” [বি. কে. জাহাঙ্গীর, ন্যাশনালিজম, ফান্ডামেন্টালিজম এ্যান্ড ডেমোক্রেসি ইন বাংলাদেশ, ঢাকা ২০০২] আওয়ামী লীগ ১৯৭১ সালে প্রবাসী সরকার বা মুজিবনগর বা বাংলাদেশ সরকার গঠন করে এবং তার ত্যাগ ও নেতৃত্বের ইতিহাস দিয়েই পরবর্তীকালে সে ঘটনাবলী/ইতিহাস নিয়ন্ত্রণ করতে চেয়েছে যা সমস্যার সৃষ্টি করেছিল তখনই। মুক্তিযুদ্ধের সময় এবং পরে, এই তত্ত্বই আওয়ামী লীগ প্রচার করেছে যে, বাংলাদেশে জাতীয়তাবাদ সৃষ্টি করেছে আওয়ামী লীগ যার ফলে মুক্তিযুদ্ধ শুরু ও সফল হয়েছে। এ তত্ত্বের কারণে, ১৯৪৭ থেকে ১৯৭১ পর্যন্ত সমস্ত রাজনৈতিক দল, নেতা, বিশেষ করে জনতা এবং বামপন্থী বিশেষ করে কমিউনিস্ট পার্টির ভূমিকা বাদ পড়ে যায়। এই তত্ত্ব মুক্তিযুদ্ধের সময় সোশ্যাল মবিলাইজেশনে এবং আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে জনমত সংগঠনে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেছিল। রণবীর সমাদ্দার এ বিষয়টির প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। এ পরিপ্রেক্ষিতে মুক্তিযুদ্ধের দলিলপত্র থেকে একটি দলিলের প্রতিও দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন তিনি। [রণবীর সমাদ্দার, অন প্রবে-মস অফ রাইটিং এ কম্প্রেহেনসিভ হিস্টরি অফ দি বাংলাদেশ লিবারেশন ওয়ার, কলকাতা, ১৯৭৭] প্রবাসী সরকার একটা সময় উপদেষ্টা কমিটি গঠন করতে বাধ্য হয়েছিল যুদ্ধটিকে জাতীয় যুদ্ধ হিসেবে তুলে ধরতে, আসলেই তা যা ছিল। দলিলে বলা হয়েছে, আওয়ামী লীগের এটি করার দরকার ছিল না, কারণ জননেতৃত্ব তারই হাতে কিন্তু জনস্বার্থে তা করা হয়েছে। দলিল অনুযায়ীÒThe newly formed consultative committee consisting of leaders of major political parties has been a step forward for conducting deliberation [the liberation] struggle as a national war. Awami League, having the overwhelming support of the people’s movement in East Bengal, did not have to go for a committee like this. But was considered necessary for the greater interest of the people. [হাসান হাফিজুর রহমান সম্পাদিত, বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ : দলিলপত্র, চতুর্থ খণ্ড ঢাকা, ১৯৮২] এই বাধ্যবাধকতার কারণ হলো, বিদেশে এ যুদ্ধকে ধ্রুপদী অর্থে মুক্তিযুদ্ধ হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে না। এমনকি বিপ্লবী জাতীয় যুদ্ধ হিসেবেও বিবেচিত হচ্ছে না। যে কারণে, ইউরোপ, আফ্রিকা, লাতিন আমেরিকায় যথেষ্ট সাড়া পাওয়া যাচ্ছে না। ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, জার্মানি এবং আমেরিকার যুবকরাও তেমনভাবে সাড়া দিচ্ছে না। সবাইকে নিয়ে উপদেষ্টা কমিটি গঠন করায় এটি জাতীয় যুদ্ধ হিসেবে পরিগণিত হবে; কিন্তু নেতৃত্ব থাকবে আওয়ামী লীগের হাতে, কারণ উপদেষ্টা কমিটির কোনো ক্ষমতা থাকবে না। রণবীর সমাদ্দারের ভাষায়“ÒThe desperate endeavour to impose a totality on 1971 is very clean from this document.” স্বাধীনতার পরও এ সমস্যা দূর করা যায়নি। ভারত ভাগের পর ঐতিহাসিকরা এই তত্ত্বই প্রচার করেছিলেন বা যে তত্ত্ব প্রাধান্য বিস্তার করেছিল তাহলো ভারত বিভাজনের জন্য মুসলমান বা মুসলিম লীগই দায়ী। এর সমালোচনা যে খানিকটা হয়নি তা নয়। তবে দল হিসেবে কংগ্রেস ও কংগ্রেসের আদর্শে বিশ্বাসীরা এই তত্ত্ব বেশি প্রচার করেছেন যাতে ভারত বিভাগের দায় তাদের ওপর না পড়ে। বাংলা বিভাগের ওপর গবেষণা করতে গিয়ে জয়া চ্যাটার্জী দেখিয়েছেন, এর সবটাই সত্য নয়। তিনি লিখেছেন ১৯৮০ সালে যখন তিনি গবেষণা শুরু করেন, “তখন একটা সাধারণ ও অনুকূল ধারণা প্রচলিত ছিল যে ভারত বাংলার বিভক্তি মুসলমানদের কাজ। হিন্দুরা তাদের মাতৃভূমির অখণ্ডতাকে ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন করতে কোন কিছুই করেনি। ঐ সময়ে প্রচলিত দৃষ্টিভঙ্গি ও ধারণায় প্রকাশ পায় যে, স্বাভাবিক ঐতিহ্যগতভাবে হিন্দুত্বের বৈশিষ্ট্য হলো সহনশীল এবং বহুত্ববাদী তাই হিন্দুত্বে সংকীর্ণ সাম্প্রদায়িকতার সুযোগ নেই। ... ঐ গবেষণায় প্রকাশ পায় যে, বাংলার হিন্দু ভদ্রলোকদের (বষরঃবং) ক্রম-সহিষ্ণু ক্ষমতা, ধনসম্পদ ও মর্যাদা হুমকির সম্মুখীন হওয়ায় তারা সামাজিক অবস্থান অক্ষুণœ রাখার লক্ষ্যে কূট-কৌশল অবলম্বন করে এবং নিজেদের কাজের যৌক্তিকতা হিসেবে বিভিন্ন ভাবাদর্শকে ব্যবহার করে। সত্যিকার অর্থে ঐ কূট-কৌশলকে একমাত্র সাম্প্রদায়িক হিসেবেই আখ্যায়িত করা যায়। [জয়া চ্যাটার্জী, বাংলা ভাগ হলো, ঢাকা ২০০৩] গত শতকের শেষ দশক থেকে ভারতে আবার হিন্দুত্ববাদের বা রাজনীতির প্রবল প্রতাপ, তাতে, জয়া জানাচ্ছেন, তাঁর যুক্তিগুলোই ‘কত বিতর্কিত ও প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠছে।’ গত দুশ’ বছরের ইতিহাস চর্চায় এ ধরনের অসঙ্গতি সব সময় ছিল। ভারতে বা বাংলায় কী ধরনের ইতিহাস লেখা হয়েছে তার ব্যাখ্যা পাওয়া যাবে পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের ‘ইতিহাসের উত্তরাধিকার’ প্রবন্ধে। যে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘বাঙালির ইতিহাস’ প্রবন্ধটি নিত্য আমরা উদ্ধৃত করি আমাদের ইতিহাস রচনার স্বল্পতা ও ‘ব্যর্থতা’র ক্ষেত্রে, সেটি সামগ্রিকভাবে বিচার করলে দেখা যাবে আসলে বঙ্কিম কাদের বাঙালী মনে করতেন এবং কাদের ইতিহাস তিনি চেয়েছিলেন। বাঙালী তাঁর কাছে ছিল হিন্দু বাঙালী, অন্যরা তো নয়ই; এমনকি মুসলমান বাঙালীরাও এই সংজ্ঞার বাইরে ছিল। সেই হিন্দু জাতীয়তাবাদী ধারা অব্যাহত থেকেছে, জোরদার হয়েছে, মাঝে মাঝে রাজনৈতিকভাবে পরাজয়ের কারণে পিছু হটেছে; কিন্তু সব সময়ই ঐ ধারা পুষ্ট ছিল এবং ১৯৯০-এর দিকে তা আবার প্রবল হয়ে ওঠে যা আগে উল্লেখ করেছি। পার্থ চট্টোপাধ্যায় লিখেছেন, “সেক্যুলার ইতিহাস চর্চার সঙ্কট এইখানেই আজকের রাষ্ট্রনীতির সঙ্গে জাতীয়তার ইতিহাসের সামঞ্জস্য আনা। সঙ্কট এইজন্য যে জাতীয়তার যে ইতিহাস গত শতাব্দী থেকে লেখা হয়ে এসেছে, তার রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঢুকে রয়েছে এমন সব কাহিনী, ধারণা, ব্যাখ্যা যা আজকের উগ্রহিন্দু প্রচারের প্রধান উপাদান। সত্যি বলতে কি বিষয়টা একটু তলিয়ে দেখলে একটা সাংঘাতিক সত্য বেরিয়ে আসবে। সেটা হলো যে, হিন্দু সাম্প্রদায়িকতা আসলে ভারতীয় জাতীয়তাবাদেরই প্রতিচ্ছবি, আয়নায় মুখ দেখার মতো তার রূপ। আকৃতি-গড়ন, অবিকল এক।” [পার্থ চট্টোপাধ্যায়, ইতিহাসের উত্তরাধিকার, কলকাতা, ২০০০] স্বল্পমেয়াদি সুবিধার জন্য রাজনৈতিক দলগুলো মাঝে মাঝে এমন পন্থা গ্রহণ করে যা অন্তিমে শুধু তাদেরই নয় দেশেরও মারাত্মক ক্ষতি করে। এবং এ পন্থা তারা গ্রহণ করে ইতিহাসের ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে। অর্থাৎ অনেক ক্ষেত্রে ইতিহাস বিশ্লেষণে বিপরীতমুখী দুটি দল বা ধারার আঁতাত বা সমঝোতা হতে পারে। আশির দশকে ভারতের একটি উদাহরণ দেয়া যেতে পারে। হিন্দুত্ববাদ বিকাশের সময়, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে সংগ্রাম নিয়ে ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির বিরুদ্ধে প্রচারণা শুরু হয়। কমিউনিস্ট পার্টি তখন আবার পুনরুজ্জীবিত হচ্ছে। তাদের ক্রমবর্ধমান প্রাধান্যে কংগ্রেস ও হিন্দু মৌলবাদী দলগুলো শঙ্কিত ছিল। তারা প্রমাণ করতে চাচ্ছিল, ইতিহাসে কমিউনিস্ট পার্টি গাদ্দারের ভূমিকা পালন করেছে। সুতরাং ইঙ্গিতটি হচ্ছে স্বাধীন ভারতে তাহলে কমিউনিস্ট পার্টির বৈধতা কী? অন্যদিকে কংগ্রেস স্বাধীনতার নেতৃত্ব দিয়েছে আর হিন্দু মৌলবাদী দেশগুলো তো হিন্দুরই প্রতিনিধি। প্রখ্যাত সাংবাদিক অরুণ শৌরি [পরে বিজেপির] ‘দি গ্রেট বিট্রেয়াল’ নামে চার কিস্তিতে এক প্রবন্ধ লিখে আক্রমণ পরিচালনা করেন। (চলবে)
×