ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

ড. আরএম দেবনাথ

‘চুতরা’ গাছে আম ধরে না

প্রকাশিত: ০৫:৪০, ১০ এপ্রিল ২০১৫

‘চুতরা’ গাছে আম ধরে না

এপ্রিল মাসের চার তারিখ খবরের কাগজে ব্যাংকগুলো সম্পর্কে একটি খবর প্রকাশিত হয়েছে। দৃশ্যত খবরটি সাদামাটা। কিন্তু ভেতরে গেলে এর গুরুত্ব অসীম। খবরটিতে বলা হয়েছে চার শতাংশ ঋণগ্রহীতা সর্বমোট ঋণের ৮৮ শতাংশ পাচ্ছে। বাকি বারো শতাংশ ঋণ পায় ৯৬ শতাংশ ঋণগ্রহীতা। এই অভিযোগটি করেছেন অর্থনীতিবিদরা অর্থমন্ত্রীর কাছে। দৃশ্যত খবরটি উদ্বেগজনক। কারণ, এই খবর দুর্লভ ঋণের কেন্দ্রীভূতকরণের কথা বলে। এই খবরের দুদিন পর বাংলাদেশ ব্যাংকের গবর্নর এবং অন্য কর্মকর্তারাও একই কথা বলেন। ‘প্রচলিত ব্যবস্থার পরিবর্তে বেশি সংখ্যক গ্রাহককে ঋণ দেয়ার নির্দেশনা দেয়’ কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এর অর্থও হচ্ছে ব্যাংকঋণ কেন্দ্রীভূত হচ্ছে। এমতাবস্থায় বিষয়টি একটা বিশ্লেষণের দাবি রাখে। ব্যাংকঋণের বিশ্লেষণ বা পর্যালোচনা কয়েকটি দৃষ্টিকোণ থেকে করা যায়। ‘রিকভারি’ নয়, ঋণ কাদেরকে দেয়া হচ্ছে সেই দৃষ্টিকোণ থেকেই দেখব এখন। কারণ অভিযোগটি ঋণ প্রদানের বিষয়ে রিকভারি অথবা সিকিউরিটি অথবা সুদের বিষয়ে নয়। অতএব প্রদানের ক্ষেত্রটিই বিবেচনা করা যাক। যে স্বনামধন্য অর্থনীতিবিদরা অর্থমন্ত্রীর কাছে অভিযোগ করেছেন তাঁরা কোন্্ তারিখের ভিত্তিতে তথ্যটি পরিবেশন করেছেন তা প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়নি। অতএব সেদিকে যাওয়া যাচ্ছে না। আমার হাতের কাছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এ জাতীয় সর্বশেষ তথ্য সংবলিত যে প্রকাশনাটি আছে তাতে ২০১৩ সালের ৩০ জুনের তথ্য আছে। এ তথ্যের দিকে তাকালে ঋণ কিছু সংখ্যক গ্রাহকের কাছে কেন্দ্রীভূত হওয়ার খবর সর্বাংশে সত্য এবং দৃশ্যত সবিশেষ উদ্বেগজনক। যেমন তথ্যে দেখা যাচ্ছে মাত্র ৪৭,২১০ জন গ্রাহক মোট ঋণের প্রায় ৬৯ শতাংশ ঋণ পেয়েছেন। ব্যাংকিং খাতে ঐ তারিখে মোট ঋণ গ্রাহক কতজন ছিলেন? ছিলেন ৯৬ লাখ ৬২ হাজার ৯৫৮ জন। এর মধ্যে মাত্র ৪৭ হাজার ২১০ জন কত শতাংশ হয়? হয় মাত্র শূন্য দশমিক ৪৮ শতাংশ। অর্থাৎ আধা শতাংশ গ্রাহক ব্যাংকিং খাতের মোট ঋণের ৬৯ শতাংশ ঋণ ভোগ করছেন। ঋণ দুর্লভ বস্তু। চাইলেই তা পাওয়া যায় না। ঋণ ছাড়া অর্থনৈতিক উন্নতি সম্ভব নয়। এ কারণে অনেকে বলেন, ঋণ একটি অধিকার। কেউ কেউ তো বলেই ফেলেন ঋণের ব্যবস্থা করতে পারলে সমাজের আমূল পরিবর্তন করা সম্ভব। এ হেন গুরুত্বপূর্ণ ঋণের এই দশা? ভাবতেই অবাক লাগে এমন একটা অবস্থা ঋণের। অনেকে একে অবিচার, বিমাতাসুলভ আচরণও বলেন। উপরোক্ত বক্তব্য না খ-িয়েও বিষয়টাকে কয়েকটা দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা দরকার বলে মনে করি। প্রথমেই অর্থনৈতিক খাতওয়ারী ঋণের বণ্টনকে দেখা যাক। দেখা যাচ্ছে মোট ঋণের (৪ লাখ ২৪ হাজার ৮০৪ কোটি টাকা) মাত্র ৫ দশমিক ৪১ শতাংশ ঋণ পেয়েছে কৃষি খাত অথচ কৃষি খাতে গ্রাহকের সংখ্যা হচ্ছে ৫৯ লাখ ৬১ হাজার ৪৯৪ জন। এর অর্থ প্রত্যেক গ্রাহক পেয়েছেন গড়ে মাত্র ৩৯ হাজার টাকা। সর্বমোট ঋণের পরিমাণ মাত্র ২২ হাজার ৯৭১ কোটি টাকা। জিডিপিতে কৃষি খাতের অবদান সর্বোচ্চ ১৫ শতাংশের মতো। অবশ্য বনজ সম্পদসহ। এই দৃষ্টিতে বিচার করলে কৃষি খাতের প্রতি অবিচার করা হচ্ছে বৈকি! লাখ লাখ গ্রাহক পাচ্ছেন মাত্র মাথাপিছু ৩৯ হাজার টাকার মতো। জিডিপিতে যেখানে কৃষির অবদান ১৫ শতাংশ সেখানে কৃষি খাত পাচ্ছে মোট ঋণের মাত্র সাড়ে পাঁচ শতাংশ। এদিকে শিল্প খাতে মোট ঋণের পরিমাণ ৮৯ হাজার ৮৩৩ কোটি টাকা। শতাংশের হিসাবে তা হচ্ছে ২১ দশমিক ১৫ শতাংশ। অর্থাৎ মোট ঋণের ২১ দশমিক ১৫ শতাংশ ঋণ পেয়েছে মাত্র ১ লাখ ২৫ হাজার ৫৩৯ জন শিল্পপতি। হিসাবপতি দাঁড়াচ্ছে ৭১ লাখ ৫৬ হাজার টাকা। ‘ওয়ার্কিং কেপিট্যাল’ হিসেবে প্রদত্ত ঋণের পরিমাণ ১৩ দশমিক ১৪ শতাংশ। নির্মাণ খাতে বিনিয়োজিত আছে মোট ঋণের ৯ দশমিক ০৪ শতাংশ ঋণ। এভাবে ‘ওয়াটার ওয়ার্কস ও স্যানিটারি সার্ভিসেস’ পরিবহন ও যোগাযোগ খাত, স্টোরেজ খাত, ব্যবসা খাত ও বিবিধ খাত ইত্যাদি পাঁচটি খাতে ব্যাংকিং খাতের মোট ঋণের যথাক্রমে ক. শূন্য দশমিক শূন্য দুই শতাংশ, খ. দুই দশমিক ১৩ শতাংশ, গ. শূন্য দশমিক ১৫ শতাংশ, ঘ. সাঁইত্রিশ দশমিক ৫১ শতাংশ এবং ঙ. এগারো দশমিক ১১ শতাংশ ঋণ প্রদান করা হয়েছে। এখন যদি গ্রাহকের সংখ্যার সঙ্গে তুলনা করা যায় তাহলে দেখা যাবে কৃষির তুলনায় এসব ক্ষেত্রে খুবই কম সংখ্যক গ্রাহক খুব বেশি পরিমাণ ঋণ পেয়েছে। ‘ওয়ার্কিং কেপিট্যাল’ অর্থাৎ শিল্পের জন্য ‘প্রচালন মূলধন’ দেয়া হয়েছে মাত্র ৬৪ হাজার ৬৫৯ জন গ্রাহককে। তারা সবে মিলে পেয়েছেন ৫৭ হাজার ৪৭ কোটি টাকা। মাত্র দশ লাখ ৭৩ হাজার ১২ জন ব্যবসায়ী মোট ঋণ পেয়েছেন এক লাখ ৫৯ হাজার ৩৫৬ কোটি টাকা। মোট প্রাপ্ত ঋণের সঙ্গে গ্রাহকের সংখ্যা তুলনা করলে দেখা যাবে কৃষির তুলনায় শিল্পঋণ, ওয়ার্কিং কেপিট্যাল ঋণ এবং ব্যবসায়ী ঋণের ক্ষেত্রে কম সংখ্যক গ্রাহক ঋণ পেয়েছেন বেশি। শুধু তাই নয়, খাতওয়ারী হিসেবে গ্রাহক প্রতি ঋণের পরিমাণ ভিন্ন ভিন্ন। অতএব যদি বলি সর্বনাশ করা হয়েছে এবং হচ্ছে তাহলে কি ঠিক হবে? শিল্পঋণের কথাই ধরি। একটি প্রমাণ সাইজ স্পিনিং মিল করতে কত টাকা লাগে? এতে বিনিয়োগকারীর কত এবং ব্যাংকঋণ কত লাগে? দেড় শ’- দু’শ’ কোটি টাকার নিচে ছোটখাটো স্পিনিং মিল করা যায় না। একটা ডেনিম কারখানা করতে কত লাগে? ইস্পাত কারখানা, জাহাজ নির্মাণ কারখানা, চিনিকল, অটোরাইস কল, অটো ব্রিকস কারখানা ইত্যাদি করতে কত টাকা ব্যাংকঋণ লাগে? দেখা যাচ্ছে ‘ইকোনমী সাইজ’ একটা শিল্প করতে আজকাল ৫০ কোটি থেকে ১৫০-২০০ কোটি টাকা লাগে। ব্যাংকঋণ যদি ৫০ শতাংশ ধরি তাহলে ২৫ কোটি থেকে ৭৫-১০০ কোটি টাকা একজন গ্রাহককে দিতে হয়। সেই তুলনায় একজন কৃষকের সাধারণ কৃষিকাজের জন্য কত টাকা ঋণ লাগতে পারে? এভাবে অর্থনৈতিক কাজের ভিত্তিতে দেখলে গ্রাহকপ্রতি প্রয়োজনীয় ঋণের বিষয়টি অন্যরকম দাঁড়ায়। ধরা যাক, একটা ‘ওভারপাস’ নির্মিত হবে। আর সেটা হচ্ছে হানিফ ওভারব্রিজ। এখানে কত টাকা লাগতে পারে বলে অনুমান? আমার জানা মতে একেকটি সরকারী ব্যাংক দু’শ’-তিন শ’ কোটি টাকা করে ঋণ দিয়েছে। ধরা যাক, এখানে মোট ঋণ হাজার কোটি টাকা। এই টাকা দেয়া হচ্ছে একজনকে। অথচ এই টাকা এক কোটি করে দিলে ১০০০ জনকে দেয়া যায়। এতে সংখ্যা বাড়ে কিন্তু ওভারব্রিজ নির্মাণটা কিভাবে হবে? ধরা যাক বিদ্যুত তৈরির কারখানা। কুইক রেন্টাল বিদ্যুত। এক মেগাওয়াট বিদ্যুত তৈরি করতে যতদূর জানি তাতে এখন লাগে ৫-৬ কোটি টাকা। এর মধ্যে অর্ধেক টাকা যদি উদ্যোক্তা দেন তাহলে বাকি টাকা হবে ব্যাংকঋণ। বর্তমান সরকার যে দশ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুত উৎপাদন বাড়াল তাতে ব্যাংকঋণ কত লেগেছে এবং পরের প্রশ্নই হচ্ছে এখানে ব্যাংকগ্রাহক কতজন? লাখ লাখ? না, লাখ লাখ নয়? হাজার হাজার? না, হাজার হাজার নয়? শত শত? না, তাও নয়। বিদ্যুতের উৎপাদন বাড়াতে যারা শত শত কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে তাদের সংখ্যা কত? বড়জোর ৬০, ৭০, ১০০ জন। অথচ এই টাকা হাজার হাজার লোককে দেয়া যেত। অতএব শুধু ঋণের পরিমাণের সঙ্গে গ্রাহকের সংখ্যার তুলনা করলে উন্নয়নের কাজ করা যাবে না। বস্তুত বাজার অর্থনীতিতে উন্নয়নের কাজ অর্থাৎ শিল্প-কারখানা তৈরি করা, অবকাঠামো গড়ে তোলা, বিদ্যুত উৎপাদন করার কাজ ইত্যাদি বড় বড় কাজ। লাগে বিশাল পরিমাণের ঋণ। কিন্তু এসব ক্ষেত্রে গ্রাহক সংখ্যা হবে অতি নগণ্য। ধরা যাক আমদানি ব্যবসার কথা। সয়াবিন তেল, লবণ, পেঁয়াজ, ডাল, রসুন এবং মসলা ইত্যাদি নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র আমদানি করে কতজন ব্যবসায়ী? হাজার হাজার ব্যবসায়ী? নিশ্চয় নয়। সিংহভাগ নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যাদি আমদানি করে হাতেগোনা কয়েকজন ব্যবসায়ী। এরাই একেকজন শত শত কোটি টাকার ঋণপত্র খোলে, এরাই আমদানিকৃত পণ্যের বিপরীতে ‘ট্রাস্ট রিসিটের’ (টিআর) মাধ্যমে হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যাংকঋণ নেয়। কতজন ব্যবসায়ী? হাতেগোনা কয়েকজন। বাজার অর্থনীতির কল্যাণে ব্যবসা-বাণিজ্য, শিল্প, আমদানি-রফতানি বাণিজ্য যে গুটিকয়েক ব্যবসায়ী হাউসের কাছে চলে যাচ্ছে তার খবর কি আমরা রাখি? আরও খবর আছে। মোট ব্যাংকঋণের ৪৮ শতাংশ ঋণ দিয়েছে ঢাকা শহরের চারটি থানায় অবস্থিত ব্যাংক শাখাগুলো। চট্টগ্রাম শহরের দুটি থানায় অবস্থিত ব্যাংক শাখাগুলো মোট ঋণের ১৫ শতাংশ ঋণ দিয়েছে। তার অর্থ ঢাকা ও চট্টগ্রাম শহরের শতাধিক থানার মধ্যে মাত্র ছয়টি থানায় অবস্থিত ব্যাংক শাখাগুলো ঋণ দিয়েছে মোট ঋণের ৬৩ শতাংশ। এটা কি অস্বাভাবিক ঘটনা? এটা বাজার অর্থনীতির ফল। চুতরা গাছে আম ধরে না। যে গাছে যে ফল ধরার সেই ফলই ধরবে। তাই নয় কি? বাজার অর্থনীতি ক্ষমতাশালী ও বড় ব্যবসায়ীদের জন্য। এই বাজারে ছোট ও মাঝারিরা হচ্ছে ‘দুয়ারী’। বড়রাই এখানে গান গাইবে। আমরা যাকে বলি বড় বড় প্রকল্প তা তারাই করবে। বড় বড় প্রকল্পে বড় বড় ব্যাংকঋণ লাগবে। এসব পাবে বড় বড় ব্যবসায়ী যারা অর্থনৈতিক উন্নয়নের কাজটা করবে। জাপানের বড় বড় ব্যবসায়ী হাউস, ভারতের বড় বড় ব্যবসায়ী হাউস, ইদানীংকালের বড় বড় চীনা হাউজিং, রাশিয়ার হাউসগুলোই উন্নয়নের কাজ করছে। কারণ সরকার ব্যবসা থেকে হাত গুটিয়ে নিচ্ছে। এ কারণেই বড় বড় ব্যাংকঋণ হচ্ছে এবং তা কেন্দ্রীভূত হচ্ছে। ছোটরা ও মাঝারিরা টিকতে পারছে না। বাজার অর্থনীতিতে তা সম্ভব নয়। এছাড়া একটা কথা আছে। সেটা হচ্ছে বড় ঋণের সংজ্ঞা। সেই সংজ্ঞা কারা ঠিক করে? তা ঠিক আছে কি? এই আলোচনা করে সমাপ্তি টানব আগামী সংখ্যায়। তখন দেখব বিদ্যমান অবস্থায় কিভাবে ঋণের ‘কনসেনট্রেশন’ বন্ধ করা যায়। লেখক : সাবেক প্রফেসর, বিআইবিএম
×