ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

অনুশীলন চলবে ১১ এপ্রিল পর্যন্ত ॥ ২১ সালে জঙ্গী হামলার পর এবার আবার যুক্ত হচ্ছে- ‘এসো হে বৈশাখ’ গানটি

বর্ষবরণের প্রস্তুতি নিয়ে সরগরম ছায়ানট ॥ প্রতিদিন চলছে মহড়া

প্রকাশিত: ০৫:২৬, ১০ এপ্রিল ২০১৫

বর্ষবরণের প্রস্তুতি নিয়ে সরগরম ছায়ানট ॥ প্রতিদিন চলছে মহড়া

মনোয়ার হোসেন ॥ ও আলোর পথযাত্রী, এ যে রাত্রি, এখানে থেমো না/এ বালুচরে আশার তরণী তোমার যেন বেঁধো না/আমি শ্রান্ত যে তবু হাল ধর-বুধবার চৈতালী সন্ধ্যায় অর্ধশত শিল্পী তিন সারিতে হাঁটু মুড়ে বসে গাইছিলেন গানটি। ছায়ানট সংস্কৃতি ভবনের শ্রেণীকক্ষে শিক্ষার্থী শিল্পীদের নিয়ে গানটির অনুশীলন করছিলেন সঙ্গীতশিক্ষক ও কণ্ঠশিল্পী লাইসা আহমেদ লিসা। অন্ধকার পেরিয়ে আলোর পথযাত্রার ইঙ্গিতবহ এ গানটি অনুশীলনের হেতু ছায়ানটের নববর্ষ আবাহনের প্রস্তুতি। দরজায় কড়া নাড়ছে নতুন বাংলা সন ১৪২২ বঙ্গাব্দ। আর বাংলা নববর্ষ উদ্্যাপনের সঙ্গে ছায়ানটের সম্পর্কটি জড়িয়ে আছে নিবিড়ভাবে। বাঙালী জাতিসত্তা প্রকাশের অনিন্দ্য উৎসবটির প্রচলন হয়েছিল ১৯৬৭ সালে। বৈরী পরিস্থিতিতে পাকি সরকারের রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে রমনা বটমূলে বর্ষবরণের অনুষ্ঠান করেছিল ঐতিহ্যবাহী এই সাংস্কৃতিক সংগঠনটি। সংস্কৃতির শক্তিতে ভর করে বিজাতীয় শাসকদের বিরুদ্ধে ঘটেছিল আপন জাতিসত্তার বর্ণময় প্রকাশ। সেই ধারাবাহিকতায় একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের বছরটি ছাড়া প্রতিবছর নিয়মিতভাবে হয়ে আসছে বর্ষবরণের এই প্রভাতী অনুষ্ঠানমালা। নববর্ষের আনন্দমাখা রংময়তায় নাগরিক মননের চেতনাকে বরাবরই শাণিত করেছে বাংলা নববর্ষ উদ্্যাপনের এ আয়োজন। এবারের ৪৭তম বর্ষবরণের অনুষ্ঠানে উচ্চারিত হবে শান্তি ও ও মানবতার বাণী। ‘শান্তি, মানবতা ও মানুষের অধিকার’ প্রতিপাদ্যে উদ্্যাপিত হবে ছায়ানটের বর্ষবরণ। এবারের ছায়ানটের নববর্ষ অনুষ্ঠানের ভাবনা প্রসঙ্গে সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক খায়রুল আনাম শাকিল বলেন, দেশজুড়ে বিরাজ করছে সহিংস পরিস্থিতি। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত সোনার বাংলায় এটা কাম্য হতে পারে না। স্বাধীন দেশে মানুষ নিজের মতো করে শান্তি-স্বস্তিতে বাঁচতে চায়। স্বাভাবিকভাবে কাজকর্ম করে জীবিকা নির্বাহ করতে চায়। কিন্তু সাধারণ মানুষের সেই অধিকারটুকু অনাকাক্সিক্ষতভাবে কেড়ে নেয়া হচ্ছে। আন্দোলনের অজুহাতে পেট্রোলবোমা মেরে মানুষকে পোড়ানো ও হত্যা করা হচ্ছে। এই অমানবিক ও সহিংস পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে আসতেই শান্তি ও মানবতাকে ধারণ করে নির্ধারিত হয়েছে এবারের প্রতিপাদ্য। গানে গানে সুরে সুরে প্রতিধ্বনিত হবে মানুষের অধিকারের কথা। নতুন বাংলা বছর ১৪২২ বঙ্গাব্দ আবাহনকে ঘিরে এখন সরব ধানম-ির ছায়ানট সংস্কৃতি ভবন। গত দুই মাস ধরে চলছে প্রস্তুতি। নববর্ষে নগরবাসীর মন রাঙাকে প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী ও শিক্ষার্থীদের চলছে সুরাশ্রিত মহড়া। প্রতিদিন সন্ধ্যায় শ্রেণীকক্ষে অনুষ্ঠিত হচ্ছে এই অনুশীলন পর্ব। বুধবার সন্ধ্যায় তৃতীয় তলার একটি শ্রেণীকক্ষে দেখা গেল নিবিড় মনোযোগে শিক্ষার্থীরা তিন সারিতে বসে সুর তুলেছে কণ্ঠে। আর তবলা ও হারমোনিয়ামের সহযোগে গানের শিক্ষয়িত্রী লাইসা আহমদ লিসা চালিয়ে যাচ্ছেন অনুশীলন। সবাই মিলে গাইছিল ও আলোর পথযাত্রী গানটি। কিছুক্ষণ পরপরই গানের যথার্থ বাণী, অন্তরা, সুর ও তালের ভুল হলে সেই ত্রুটিগুলো ধরিয়ে দিচ্ছেন লিসা। আর নববর্ষ আবাহনে অংশ নেয়া বাছাইকৃত শিক্ষার্থীরা শুধরে নিয়ে পরিপূর্ণভাবে গাইছেন গানটি। ছায়ানটে এই অনুশীলন চলবে ১১ এপ্রিল পর্যন্ত। আর ১২ এপ্রিল রবিবার বিকেলে মূল অনুষ্ঠানস্থল রমনা বটমূলে অনুষ্ঠিত হবে চূড়ান্ত মহড়া। নববর্ষের প্রভাতী অনুষ্ঠানের বৃত্তান্ত ॥ এবারের ছায়ানটের নববর্ষ আবাহন শুরু হবে পহেলা বৈশাখ মঙ্গলবার সকাল সোয়া ছয়টায়। দুই ঘণ্টা ব্যাপ্তির অনুষ্ঠানের সূচনা হবে সেতারের সুর মূর্ছনায়। আলাপ জোড়ে এবাদুল হক সৈকত পরিবেশন করবেন রাগ পরমেশ্বরী। ১৪ মিনিটের এই প্রভাতী রাগটি বিশ্ববরেণ্য কিংবদন্তি সেতারবাদক প-িত রবি শঙ্করের সৃষ্ট। এই পরিবেশনা শেষে গীত হবে সম্মেলক কণ্ঠের গান। অনেকগুলো কণ্ঠ এক সুরে গাইবে ধ্বনিল আহ্বান মধুর গম্ভীর প্রভাত-অম্বর-মাঝে/দিকে দিগন্তরে ভুবন মন্দিরে শান্তি সঙ্গীত বাজে। এ বছরের নববর্ষের অনুষ্ঠানমালায় দীর্ঘদিন পর যুক্ত হয়েছে ‘এসো, এসো, এসো হে বৈশাখ’ গানটি। বৈশাখ নিয়ে বিশ্বকবির বহুল জনপ্রিয় ও আলোচিত এই গানটি সর্বশেষ ২০০০ সালে গাওয়া হয়েছিল ছায়ানটের প্রভাতী আয়োজনে। ২০০১ সালের বর্ষবরণ অনুষ্ঠানে এই গানটি পরিবেশিত হওয়ার কথা ছিল। ওই দিনের গানের তালিকায় সম্মেলক সঙ্গীত হিসেবে শেষ পর্যায়ে রাখা হয়েছিল গানটি। কিন্তু অনুষ্ঠানের মাঝপথে ধর্মান্ধ জঙ্গীদের বোমা হামলায় প- হয়ে যায় ছায়ানটের বর্ষবরণ অনুষ্ঠান। ফলে আর গাওয়া হয়নি নববর্ষ বরণের সেই অনবদ্য গানটি। সেই সূত্রে ১৫ বছর পর এবার নতুন উদ্যমে গীত হবে এই গানটি। এছাড়া এবারের আয়োজনে সম্মেলক কণ্ঠে গাওয়া হবে ‘ও আলোর পথযাত্রী, এ যে রাত্রি, এখানে থেমো না’, ‘সংঘ সরণ তীর্থ যাত্রা পথে এসো মোরা যায়-যায়’, ‘ওরে বিষম দইরার ঢেউ, উথাল পাথাল করে’, ‘আমাদের নানান মতে নানান দলে দলাদলি’, ‘মানুষ ধর মানুষ ভজ, শোন বলি রে পাগল মন’, ‘শুভ্র সমুজ্জ্বল, হে চির-নির্মল’, ‘মোরা সত্যের ’পরে মন আজি করিব সমর্পণ’সহ ১২টি। একক কণ্ঠে গাওয়া হবে এমন কয়েকটি গানের শিরোনাম হলোÑ ‘জাগো অনশন বন্দী’, ‘নিশিদিন মোরা পরানে’ ও ‘জাগো অরুণ ভৈরব’। এবারের ছায়ানটের নববর্ষ আবাহনে পরিবেশিত হবে রবীন্দ্র-নজরুল ছাড়াও সলিল চৌধুরীর গণসঙ্গীত, লালন ফকিরের গান ও রশিদউদ্দীন রচিত সঙ্গীত। একক কণ্ঠে গান শোনাবেন ১৩ জন খ্যাতিমান ও পরিচিত নবীন-প্রবীণ শিল্পী। তাঁরা হলেন খায়রুল আনাম শাকিল, মিতা হক, লাইসা আহমদ লিসা, চন্দনা মজুমদার, বিজন চন্দ্র মিস্ত্রী, নাসিমা শাহীন ফ্যান্সি, সুকান্ত চক্রবর্তী, সিফায়েতউল্লাহ মুকুল, বিমান চন্দ্র বিশ্বাস প্রমুখ। কবিতাপাঠে অংশ নেবেন দুইজন বাকশিল্পী। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের চিরযাত্রী কবিতাটি আবৃত্তি করবেন আবদুস সবুর খান চৌধুরী। একাত্তরের বাংলাদেশের সুহৃদ কাইফি আজমীর বাংলাদেশ শীর্ষক কবিতাপাঠ করবেন লিয়াকত খান। একাত্তরে বাঙালীর ওপর পাকবাহিনীর নির্যাতন ব্যথিত করেছিল কাইফি আজমিকে। কবিতার দোলায়িত ছন্দের আশ্রয়ে সেই ব্যথিত অনুভূতিকে তিনি তুলে ধরেন। এবারের বর্ষবরণের শিক্ষার্থীদের মধ্যে অংশ নেবে চতুর্থ ও পঞ্চাম সমাপনী বর্ষের বাছাইকৃত শিল্পীরা। শিশুদের মধ্যে অংশ নেবে প্রারম্ভিক শিশু প্রথম ও দ্বিতীয় বর্ষের খুদে শিল্পীরা। সব মিলিয়ে অনুষ্ঠানে গাওয়া হবে ২৬টি গান। এর জাতীয় সঙ্গীতসহ পরিবেশিত হবে ১৩টি সম্মেলক গান ও ১৩টি একক কণ্ঠের গান। প্রভাতী বর্ষবরণের আয়োজন শেষ হবে জাতীয় সঙ্গীত পরিবেশনার মাধ্যমে। সঙ্গীত পরিবেশনার মাঝে এবারের প্রতিপাদ্য নিয়ে বক্তব্য রাখবেন ছায়ানট সভাপতি সন্্জীদা খাতুন। বলবেন বর্তমান পরিপ্রেক্ষিতে মানবতা ও মানুষের অধিকার এবং শান্তির কথা। ছায়ানটের বর্ষবরণ অনুষ্ঠানটি সরাসরি সম্প্রচার করবে বাংলাদেশ টেলিভিশন ও বিটিভি ওয়ার্ল্ড। বেসরকারী স্যাটেলাইট চ্যানেলগুলোও বিটিভির লিংক নিয়ে এই অনুষ্ঠানটি সরাসরি সম্প্রচার করবে। মঞ্চে পাঁচটি সারিতে বসে সম্মেলক গানে অংশ নেবেন ৯৫ জন। একক কণ্ঠে গান শোনান ১৩ জন। সব মিলিয়ে পুরো আয়োজনটিতে অংশ নেবেন প্রায় ১২৫ থেকে ১৩০ জন কণ্ঠশিল্পী ও যন্ত্রসঙ্গীতশিল্পী। যন্ত্রসঙ্গীতশিল্পীদের মধ্যে বেহালা বাজাবেন আলমাছ আলী, এস্রাজে থাকবেন অসিত বিশ^াস, ঢোলে দশরথ দাশ, দোতারায় রতন কুমার রায়, তবলায় বোল তুলবেন এনামুল হক ওমর, সুবীর ঘোষ ও স্বরূপ হোসেন এবং মন্দিরা বাজাবেন প্রদীপ কুমার রায়। শিল্পীদের পোশাক ॥ দুই ঘণ্টার বর্ষবরণের আয়োজনে মেয়েরা পরবেন অব হোয়াইট রঙের শাড়ি ও মেরুন রঙে ব্লাউজ। খোঁপায় থাকবে শ্বেতবর্ণের বেলি ফুলের মালা। ছেলেদের পরনে থাকবে ঘিয়ে রঙের পাঞ্জাবি। বড়দের মতো ছোট মেয়েদের পরনেও থাকবে হালকা হলুদের শাড়ি। একইভাবে বড়দের মতো ছেলে শিশুরা পড়বে ঘিয়ে রঙের পাঞ্জাবি।
×