ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

‘যৌক্তিক পরিণতিতে’ না পৌঁছালেও আন্দোলনে রণেভঙ্গ

প্রকাশিত: ০৫:৫৬, ৬ এপ্রিল ২০১৫

‘যৌক্তিক পরিণতিতে’  না পৌঁছালেও আন্দোলনে রণেভঙ্গ

শংকর কুমার দে ॥ বিএনপি জামায়েতের নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটের টানা ৮১ দিনের অবরোধ, ৬৭ দিনের হরতাল, ৯২ দিন গুলশানের দলীয় কার্যালয়ে অবস্থানের আন্দোলনে সারাদেশে পেট্রোলবোমার আগুনে পুড়িয়ে ৭৫ জনসহ ১৩৬ জন মানুষকে হত্যা করা হয়েছে, দ্বগ্ধ ও আহত হয়েছে ১ হাজার ২শ’ জন। যারা হতাহত হয়েছে তাদের বেশিরভাগই নিরীহ, নিরপরাধ, দরিদ্র, অসহায় পরিবারের লোকজন। শুধু তাই নয়, ২ হাজারেরও বেশি যানবাহনে আগুন, ভাংচুরে ক্ষতিগ্রস্ত করা হয়েছে বহু সংখ্যক। রেলওয়ের নাশকতা ঘটানো হয়েছে ১শ’ ৩১ স্থানে। আর দেশের আর্থিক ক্ষতি হয়েছে ৪ হাজার ৯শ’ কোটি টাকা। আন্দোলন ‘যৌক্তিক পরিণতিতে’ না পৌঁছা পর্যন্ত অব্যাহত থাকার ঘোষণা দিয়ে, অতঃপর বাড়ি ফেরার মধ্য দিয়ে রণে ভঙ্গ দিলেন বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া। বিএনপি-জামায়াতের নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটের ৯২ দিনের অবরোধ-হরতালের নামে সহিংস সন্ত্রাসের পরিসংখ্যান তুলে ধরেছে পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থা। গত ৫ জানুয়ারি থেকে বিএনপি-জামায়াত জোটের নেতৃত্বে সারাদেশে অনির্দিষ্টকালের অবরোধ-হরতালের ডাক দিয়ে পেট্রোলবোমার আগুনে পুড়িয়ে মারাসহ সহিংস সন্ত্রাসের তা-বলীলা চালানো হয়। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির হিসাব অনুযায়ী, কেবলমাত্র যানবাহনে পেট্রোলবোমা, অগ্নিসংযোগ, সংঘর্ষে ৩০ জন পরিবহন শ্রমিক মারা গেছেন। আগুন ও পেট্রোলবোমায় পুড়েছে ১২শ’ গাড়ি ও ভাংচুর হয়েছে ৮ যানবাহনে। প্রতিদিন ক্ষতি হয়েছে তাদের ৩শ’ কোটি টাকা। পরিবহন ক্ষতির পরিমাণ ১০ হাজার কোটি টাকা দাবি করা হয়েছে। সংবাদ সম্মেলন করে এ তথ্য দিয়েছেন ঢাকা সড়ক পরিবহন সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্লাহ। বাংলাদেশ রেলওয়ের হিসাব অনুযায়ী, সারাদেশে ট্রেনে অগ্নিসংযোগ, রেললাইন উপড়ে ফেলা, ফিসপ্লেট খুলে ফেলাসহ ১৩১টি নাশকতার ঘটনা ঘটানো হয়েছে। এতে রেলওয়ের ৩৩ কোটি টাকার ক্ষতিসহ জনজীবনে দুর্ভোগ ও জিম্মি করাসহ আতঙ্ক, উদ্বেগের মধ্যে রাখা হয়। বেসরকারী গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) প্রকাশিত এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিএনপি-জামায়াতের নেতৃত্বাধীন ২০ দলের টানা ৮১ দিনের অবরোধ ও ৬৭ দিনের হরতালে দেশের অর্থনীতির ৪ হাজার ৯০০ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। এই রাজনৈতিক অস্থিরতায় দেশের অর্থনৈতিক কর্মকা- বাধাগ্রস্ত হয়েছে প্রতিদিন। এছাড়া জিডিপির দশমিক ৫৫ শতাংশ ক্ষতি হয়েছে। গত ১৭ মার্চ পর্যন্ত সময়ের ওপর তৈরি প্রতিবেদনে মোট ১১টি খাতের ক্ষতির চিত্র তুলে ধরা হয়। প্রতিবেদন অনুযায়ী, সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত খাত হলো পোশাকশিল্প। এ খাতে ক্ষতি ১৩১৮ কোটি টাকা। এরপর রয়েছে পর্যটন ও পরিবহন। এ দুই খাতে ক্ষতি যথাক্রমে ৮২৫ কোটি ও ৭৪৪ কোটি টাকা। হিমায়িত খাতে ৭৪১ কোটি টাকা ও পোল্ট্রিতে ক্ষতি ৬০৬ কোটি টাকা ক্ষতি হয়েছে। এছাড়া কৃষি খাতে ৩৯৮ কোটি, প্লাস্টিক খাতে ২৪৪ কোটি, ব্যাংক ও বীমায় ১৫৬ কোটি এবং খুচরা বাজারে ৪৪৮ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। বিএনপির চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া গুলশানের দলীয় কার্যালয়ে ৯২ দিনের স্বেচ্ছায় অবস্থানকালে তার সঙ্গে ছিলেন নেতাকর্মী, স্টাফ ও তার ব্যক্তিগত নিরাপত্তারক্ষী, যার সংখ্যা অর্ধশতাধিক। প্রতিদিনই মিনি পিকনিক হতো দলীয় কার্যালয়ে। এরই মধ্যে বিদেশী কূটনীতিকদের সঙ্গে সাক্ষাতকার দিতেন। খাবার নিয়ে আসতেন নেতাকর্মীরা। আবার হোটেল থেকে আসতো বিরানীর প্যাকেট। এরই মধ্যে ছোট ছেলে আরাফাত রহমান কোকোর অকাল মৃত্যু ঘটে মালয়েশিয়ায়। শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানাতে যাওয়ার পর গুলশানের দলীয় কার্যালয়ে প্রবেশ করতে দেয়া হয়নি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকেও। এ সব ঘটনার কথা উল্লেখ আছে গোয়েন্দা সংস্থার সংরক্ষণ করা দলিল দস্তাবেজে। বিএনপি-জামায়াত জোটের টাকা অনির্দিষ্টকালের অবরোধ-হরতালের নামে নাশকতা ও সহিংসতা বন্ধে পুলিশ, র‌্যাব, বিজিবি, গোয়েন্দা সংস্থা পৃথকভাবে ও যৌথভাবে বিশেষ অভিযান পরিচালনা করতে হয়েছে। নাশকতাকারী দুর্বৃত্ত দলের সঙ্গে বিভিন্নস্থানে বন্দুকযুদ্ধ হয়েছে এবং এতে বেশকিছু দুর্বৃত্ত মারা যাওয়ার ঘটনা ঘটেছে। তবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ব্যাপক অভিযানের মুখে দুর্বৃত্তরা গা ঢাকা দেয়ায় গত এক মাস ধরেই অবরোধ ও হরতাল নামক আন্দোলনের অস্ত্রটি ভোতা হয়ে গিয়ে তামাশায় পরিণত হয়। অবরোধ-আন্দোলনের নামে নাশকতায় নেতাকর্মীরা মাঠে না নামায় বিএনপির চেয়ারপার্সন সংবাদ সম্মেলন করে অসন্তোষ প্রকাশ করে নেতাকর্মীদের মাঠে নামার নির্দেশ দেন। তারপরও নেতাকর্মীরা মাঠে নামেননি। সংবাদ সম্মেলনে বেগম খালেদা জিয়া ঘোষণা দেন, যৌক্তিক পরিণতিতে না পৌঁছা পর্যন্ত আন্দোলন অব্যাহত থাকবে। অতঃপর ৯২ দিন গুলশানের দলীয় কার্যালয়ে স্বেচ্ছায় অবস্থানের পর অবরোধ-হরতালের নামে সহিংস সন্ত্রাসের অবসান ঘটায় মানুষের মধ্যে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফিরে এসেছে। আলাপ হলে অপরাধ বিশেষজ্ঞ ও বিশ্লেষক গোয়েন্দা সংস্থার সাবেক কর্মকর্তা সৈয়দ বজলুল করিম বলেন, বিএনপি-জামায়াত ২০ দলীয় জোটের নেতৃত্বাধীন অবরোধ-হরতালের নামে সহিংস সন্ত্রাস করে এতগুলো নিরীহ, নিরপরাধ, গরিব মানুষজনকে হত্যা ও দেশের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি করে অর্থনীতির মেরুদ- ভেঙ্গে দেয়ার চেষ্টা করেছে। অবরোধ-হরতালের নামে সহিংস সন্ত্রাস মানুষ প্রত্যাখান করেছে। অবরোধ-হরতালের নামে দেশের মানুষের সঙ্গে তামাশা করা হয়েছে। তিনি বলেন, ‘সেই তো নাচ দেখালি, তবে কেন মল খসালি’?
×