ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের নাম সামনে এলেও খুনী চক্রের শিকড় অনেক গভীরে, তাদের আস্তানা এখনও অজানা

ওয়াশিকুরের দুই ঘাতক তথ্য দিচ্ছে গোয়েন্দাদের

প্রকাশিত: ০৬:২৪, ৪ এপ্রিল ২০১৫

ওয়াশিকুরের দুই ঘাতক তথ্য দিচ্ছে  গোয়েন্দাদের

শংকর কুমার দে ॥ জঙ্গী সংগঠন আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের খুনের তালিকায় রয়েছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা থেকে শুরু করে মন্ত্রী, এমপি, প্রগতিশীল রাজনীতিবিদ, বুদ্ধিজীবী, লেখকসহ প্রায় একডজন ব্লগার। আন্তর্জাতিক জঙ্গী সংগঠন আল কায়েদা, তেহরিক-ই-তালেবান ও আইএস’র অনুসারী আনসারুল্লাহ বাংলা টিম। এই জঙ্গী সংগঠনটির অন্যতম আধ্যাত্মিক নেতা জসীম উদ্দিন রাহমানী কারাগারে থাকলেও জুমার খুতবা নামে একটি ওয়েবসাইটে অডিও ভিডির মাধ্যমে তার বয়ান প্রচার করা হয়। জসীম উদ্দিন রাহমানী কারাগারে অন্তরীণ অবস্থায় জঙ্গী সংগঠনটির অপারেশনাল দায়িত্ব পালন করছে পাকিস্তানে অবস্থানরত বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত পাকিস্তানী নাগরিক ইজাজ হোসেন। এই সংগঠনের জঙ্গীরা ড্রোন তৈরি থেকে শুরু করে বিভিন্ন ধরনের ইলেক্ট্রনিক ডিভাইস দিয়ে অত্যাধুনিক প্রযুক্তির ধারক, উন্নত ধরনের বিস্ফোরকদ্রব্য ও আগ্নেয়াস্ত্র তৈরি, পরিচালনায় প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ও পারদর্শী। ওয়াশিকুর রহমান বাবু খুনের সময় হাতেনাতে আটক দুই মাদ্রাসা ছাত্র জিকরুল্লাহ ও আরিফকে রিমান্ডে এনে জিজ্ঞাসাবাদে এই ধরনের গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পেয়েছে গোয়েন্দারা। অপরাধ বিশেষজ্ঞ ও বিশ্লেষকরা জানান, আনসারুল্লাহ বাংলা টিমকে একের পর এক মুক্তমনা প্রগতিশীল ব্লগার ও লেখক খুনের ঘটনাগুলোর জন্য দায়ী করা হলেও খুনী চক্রের শিকর অনেক গভীরে। খুনী চক্রের মাথা কোথায়, তা রহস্যে ঘেরা। খুনীদের কোথায়, কারা, কিভাবে মগজ ধোলাই করে ইমানি দায়িত্ব পালনের জন্য জিহাদী করে তুলছে তার আস্তানা এখনও অজানা। ওয়াশিকুর রহমান বাবু খুনের সময় যদি হাতেনাতে দুই মাদ্রাসা ছাত্র ধরা না পড়ত, তাহলে অভিজিত রায় হত্যাকা-ের খুনীদের মতোই ওয়াশিকুরের খুনীরাও আড়ালে চলে যাওয়ার সম্ভাবনা ছিল বলে মনে করছেন গোয়েন্দারা। ওয়াশিকুরের খুনের সময় ঘটনাস্থল থেকে পালিয়ে যাওয়া খুনী চক্রের অপর দুই সদস্য গ্রেফতার হয়নি এখনও। আর ওয়াশিকুর খুনের তদন্ত সামনে আসার পর অভিজিত খুনের তদন্ত অনেকটাই ধামাচাপা পড়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে বলে মনে করছেন অপরাধ বিশেষজ্ঞ ও বিশ্লেষকরা। ঢাকা মহানগর পুলিশের পুলিশের মুখপাত্র যুগ্ম কমিশনার মনিরুল ইসলাম জানিয়েছেন, হত্যাকা-স্থল থেকে ধরা পড়া দুই মাদ্রাসা ছাত্র জিকরুল্লাহ ও আরিফুলকে জিজ্ঞাসাবাদে পাওয়া তথ্যে গোয়েন্দারা মনে করছেন, জঙ্গী সংগঠন আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের সিøপার সেলের পরিকল্পনায়ই ঢাকার তেজগাঁওয়ের বেগুনবাড়িতে বাড়ির সামনে দিনের বেলায় কুপিয়ে হত্যা করা হয় অনলাইন এ্যাকটিভিস্ট ওয়াশিকুরকে। ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধে ফেসবুকে লেখালেখি করতেন ওয়াশিকুর। একই ধরনের লেখালেখিতে সক্রিয় আহমেদ রাজীব হায়দারকেও খুন করা হয়েছিল একই কায়দায়। ওই হত্যা মামলায় আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের প্রধান মুফতি জসীম উদ্দিন রাহমানীর বিচার চলছে। ওয়াশিকুর হত্যাকা-ের তদন্তের গতি-প্রকৃতি এবং রিমান্ডে থাকা জিকরুল্লাহ ও আরিফুলের দেয়া বিভিন্ন তথ্য নিয়ে বুধবার নিজের কার্যালয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে এসব কথা বলেন তিনি। ডিএমপির মুখপাত্র বলেন, তারা ১৫ দিন আগে ওয়াশিকুরকে হত্যা করতে নির্দেশ পেয়েছিলেন। প্রায় ২ মাস আগে যাত্রাবাড়ীতে এক বাসা ভাড়া নেয় তারা। যাত্রাবাড়ীর এক বাসায় মাসুম নামের এক ব্যক্তি চাপাতি দিয়ে কাউকে কিভাবে কৌশলে কুপিয়ে আহত করে সেখান থেকে পালিয়ে যেতে হবে তার প্রশিক্ষণ দিয়েছিল তাদের । প্রশিক্ষণের অংশ হিসেবে তারা আলাদাভাবে নিজের কাছে চাপাতি রেখে ঢাকায় ৫/৬ দিন চলাফেরাও করেছিল। জিকরুল্লাহ ও আরিফুল এবং প্রত্যক্ষদর্শীদের বক্তব্য অনুযায়ী, তিনজন এই হত্যাকা-ে সরাসরি অংশ নেন। আবু তাহের নামে অন্যজন পালিয়ে যেতে পেরেছেন। গ্রেফতার দুজন যে মাসুমের কথা বলছেন, তিনি ছদ্মনাম ব্যবহার করছেন বলে গোয়েন্দা পুলিশের সন্দেহ। ছদ্মনাম ব্যবহার করেই তারা যাত্রাবাড়ী ও মিরপুরে বাসা ভাড়া নিয়েছিল। সেখানে তারা ইন্টারনেটে নিজেদের মতাদর্শের লোকজনের সঙ্গে যোগাযোগ রাখত। নিজেদের বিভিন্ন কর্মকা- কিভাবে-কাউকে হত্যা করতে হবে, কেন হত্যা করতে হবে তার সপক্ষে যুক্তি দিয়ে নিজেদের সাংগঠনিক কার্যক্রমের বিস্তার ঘটনোর চেষ্টা করত। পলাতক মাসুম পরিচালিত ‘সিøপার সেল’ই ওয়াশিকুর হত্যার দায়িত্বে ছিল। এই সেলে আট সদস্য ছিল বলেও পুলিশ তথ্য পেয়েছে। তিনি জানান, কয়েক মাস আগে যাত্রাবাড়ী থেকে আগ্নেয়াস্ত্রসহ আটক এক যুবকও এই সেলের অন্যতম নেতা। সাহসী বলে তার আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহারের অনুমতি ছিল। এই সেলের অন্য সদস্যরা এখন কী করছে, তা খুঁজে বের করার চেষ্টা চলছে। গোয়েন্দাদের এখনকার অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে, আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের একাধিক সিøপার সেল এখন সক্রিয়। একেকটি সেলের কাজ একেক রকম। উপর থেকে আসা নির্দেশনা বাস্তবায়ন করে সেলগুলো। ফলে এক সেলের সঙ্গে অন্য সেলের যোগাযোগ সেভাবে থাকে না বলে জানান এক গোয়েন্দা কর্মকর্তা। তিনি জানান, জিকরুল্লাহ ও আরিফুল দু’জনই হাটহাজারী মাদ্রাসার ছাত্র। জিকরুল্লাহ এখনও পড়ছেন। কয়েক বছর আগে আরিফুল সেই মাদ্রাসায় পড়াশোনা শেষ করে ঢাকায় মিরপুরের একটি মাদ্রাসায় ভর্তি হন। হেফাজতে ইসলামের আমির শাহ আহমদ শফী পরিচালিত হাটহাজারী মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষ দাবি করেছে, জিকরুল্লাহ তাদের ছাত্র নয়। এই বিষয়ে পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, ভিন্ন নামে তারা সেখানকার ছাত্র থাকতে পারে। এই বিষয়ে মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলবে গোয়েন্দারা। দুজনেরই নিজেদের আয়ের কোন উৎস ছিল না জানিয়ে এই পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, মাদদ্রসায় তারা থাকত ও খাওয়া-দাওয়া করত। তিনি বলেন, আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের প্রধান মুফতি জসীম উদ্দিনের খুতবা শুনে এই দুজন তার মতাদর্শে বিশ্বাসী হয়ে উঠেছিল। যাত্রাবাড়ীতে তার খুতবা শুনতে যেত তারা, তবে পরস্পরকে চিনত না তারা। জসীম উদ্দিন কয়েক বছর আগে কথিত জিহাদে অংশ নিতে নাফ নদী পার হয়ে মিয়ানমার যেতে চেয়েছিলেন। তার সঙ্গে তখন ২০/২৫ অনুসারী ছিল, যাদের মধ্যে আটক হওয়া আরিফুল একজন। অভিজিত হত্যাকা-ের সন্দেহভাজন ॥ রেদোয়ানুল আজাদ রানাকে এখনও খুঁজে পায়নি পুলিশ। পলাতক এই ব্যক্তি ফেব্রুয়ারিতে অভিজিত রায় হত্যাকা-ের সন্দেহভাজন। রাজীব হত্যা মামলার পলাতক আসামি নর্থসাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী রেদোয়ানুল আজাদ রানা একটি সিøপার সেলের প্রধান ছিলেন। ব্লগার রাজীব হায়দার এবং ব্লগার আসিফ মহীউদ্দিনের ওপর হামলায় এই ধরনের সিøপার সেলের সদস্যরাই অংশ নিয়েছিল বলে মনে করছেন গোয়েন্দারা।
×