ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

অধিকাংশ সরকারী হাসপাতালেই আইসিইউ নেই

প্রকাশিত: ০৬:০৮, ৪ এপ্রিল ২০১৫

অধিকাংশ সরকারী হাসপাতালেই আইসিইউ নেই

নিখিল মানখিন ॥ দেশে ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিট (আইসিইউ) চিকিৎসা সুবিধা খুবই সীমিত। চারভাগের তিনভাগ সরকারী হাসপাতালে এ সুবিধা নেই। প্রয়োজনের সময় আইসিইউ চিকিৎসা সুবিধা না পেলে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে অনেক রোগী। অনেক প্রাইভেট হাসপাতালে এ চিকিৎসা সুবিধা থাকলেও তা বেশ ব্যয়বহুল। গরিব রোগীর পক্ষে আকাশচুম্বী এ চিকিৎসাব্যয় বহন করা সম্ভব হয়ে ওঠে না। তাছাড়া অধিকাংশ বেসরকারী হাসপাতালের আইসিইউ চিকিৎসাসেবা দীর্ঘদিন ধরে প্রশ্নবিদ্ধ। আইসিইউর নামে উচ্চ চিকিৎসা ফি আদায় করছে অনেক বেসরকারী হাসপাতাল। শুধু তাই নয়, প্রয়োজনীয় চিকিৎসা সুবিধা ও উপকরণ ছাড়াই চলছে রাজধানীর অনেক হাসপাতালের ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিট(আইসিইউ)। রাজধানীর মিরপুরবাসী মোঃ বেলাল দীর্ঘদিন ধরে শ্বাসকষ্টে ভুগছিলেন। তাকে সাড়ে ১১ নম্বর সেকশনের একটি বেসরকারী হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়। চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার স্বাস্থ্যের অবনতি ঘটে। প্রয়োজন পড়ে আইসিইউ। কিন্তু ওই হাসপাতালে আইসিইউ সুবিধা ছিল না। তাকে স্থানান্তর করা হয় মহাখালীর বক্ষব্যাধি হাসপাতালে। সেখানে নেয়ার পথেই তার মৃত্যু ঘটে। শুধু মোঃ বেলাল নন, এভাবে আর্থিক সঙ্গতি না থাকায় আইসিইউ চিকিৎসা না পেয়ে ঝরছে শত শত গরিব মানুষের প্রাণ। আবার আর্থিক সঙ্গতি থাকলেও সময়মতো আইসিইউ না পেয়ে মারা যাচ্ছেন বিত্তবান কিংবা বিশিষ্ট মানুষও। আর উপজেলা ও জেলা পর্যায়ে এ ধরনের সমস্যায় পড়লে বিত্তবানদের পক্ষেও আইসিইউ সুবিধা পাওয়া সম্ভব হয় না। দরিদ্র রোগীর অবস্থা তো আরও কষ্টের। বিশেষজ্ঞরা জানান, আইসিইউ কোন হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র। এতে কৃত্রিম শ্বাস-প্রশ্বাস যন্ত্র, হার্ট মনিটরসহ বিভিন্ন যন্ত্রপাতি থাকে। এখানে মুমূর্ষু রোগীকে চিকিৎসা দেন এনেসথেসিয়া, এনালজেসিয়া ও ইনটেনসিভ কেয়ার বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক। আর ইমার্জেন্সি চিকিৎসা বলতে দুর্ঘটনা বা অপঘাতের রোগীর জীবন রক্ষায় তাৎক্ষণিক চিকিৎসা। এ ক্ষেত্রে অক্সিজেন, ওষুধ, ছোটখাটো অপারেশন, রক্ত ও আইভি স্যালাইনের ব্যবস্থা। আইসিইউ চিকিৎসার ব্যয় অনেক বেশি। এটি চালু করতেও অনেক টাকার প্রয়োজন। ১০ বেডের একটি আইসিইউ চালু করতে কমপক্ষে ২ কোটি টাকা লাগে। অভিজ্ঞ চিকিৎসক, নার্সও নিয়োগ দিতে হয়। তাই ছোটখাটো হাসপাতালে এ ধরনের চিকিৎসাব্যবস্থা থাকে না। বিশেষজ্ঞরা জানান, দুর্ঘটনার রোগীদের চেতনা থাকা অবস্থায় শ্বাসকষ্ট দেখা দিলে পাঁচ থেকে ১০ মিনিটের মধ্যে এবং এ্যাজমা বা অন্য কোন রোগের কারণে এমনটি হলে দু-এক ঘণ্টা বিলম্বে মেডিসিন বা আইসিইউ সেবা পেলেও রোগী বেঁচে যান। সড়ক দুর্ঘটনাসহ যে কোন অপঘাতে জ্ঞান হারানোর পর মানুষের শরীরে মাত্র তিন থেকে পাঁচ মিনিট অক্সিজেন থাকে। কিন্তু এ সময়ের মধ্যে ইমার্জেন্সি মেডিসিনের নাগাল খুব কম মানুষই পান। এদিকে অভিযোগ উঠেছে, ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিট(আইসিইউ) এর নামে উচ্চ চিকিৎসা ফি আদায় করছে অনেক হাসপাতাল। শুধু তাই নয়, প্রয়োজনীয় চিকিৎসা সুবিধা ও উপকরণ ছাড়াই চলছে রাজধানীর কিছু সংখ্যক হাসপাতালের ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিট(আইসিইউ)। অভিযোগ উঠেছে, প্রয়োজনের তুলনায় অতিরিক্ত মেডিক্যাল উপকরণ ও ওষুধের পরিমাণ দেখিয়ে বিল বাড়িয়ে দেয়া হয়। পর্যাপ্ত সংখ্যক বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক রাখা হয় না। দু’তিনটি বিভাগের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক দ্বারা সব রোগের চিকিৎসা করানোর ব্যবসা চালানো হয়। অনেক হাসপাতালে আইসিইউর শতকরা ৭০ ভাগ শয্যার সঙ্গে কৃত্রিম শ্বাস- প্রশ্বাস নিয়ন্ত্রণ যন্ত্র নেই। শতকরা ৬০ ভাগ আইসিইউতে প্রতিটি শয্যার জন্য একজন করে সেবিকা নেই। আর যারা আছেন তাদের শতকরা ৬৪ ভাগের প্রশিক্ষণ নেই। খরচ করেও কিছু হাসপাতালে সেবা পাওয়া যায় না বলে অভিযোগ উঠেছে। এমনিতেই উচ্চ ফি ও সীমিত শয্যার কারণে আইসিইউ সেবা নিতে পারে না অনেক দরিদ্র রোগী। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের এ্যানেসথেসিয়া, এ্যানালজেসিয়া এ্যান্ড ইনটেনসিভ কেয়ার মেডিসিনের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা জানান, আইসিইউতে রোগীকে ওঠা-নামানো, কাত করাসহ বিভিন্ন অবস্থানে রাখার জন্য বিশেষায়িত শয্যার দরকার। প্রত্যেক রোগীর জন্য পৃথক ভেন্টিলেটর(কৃত্রিম শ্বাস-প্রশ্বাস নিয়ন্ত্রণ যন্ত্র) ও কার্ডিয়াক মনিটর (হৃদযন্ত্রের অবস্থা, শরীরে অক্সিজেনের মাত্রা, কার্বন-ডাই অক্সাইড নির্গমনের মাত্রা, শ্বাস-প্রশ্বাসের গতি, রক্তচাপ পরিমাপক), ইনফিউশন পাম্প(স্যালাইনের সুক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম মাত্রা নির্ধারণ যন্ত্র) দরকার। আইসিইউতে শক মেডিশন(হৃদযন্ত্রের গতি হঠাৎ থেমে গেলে তা চালু করার যন্ত্র), সিরিঞ্জ পাম্প (শরীরে ইনজেকশনের মাধ্যমে যে ওষুধ প্রবেশ করানো হয় তার মাত্রা নির্ধারণের যন্ত্র), ব্লাড ওয়ার্মার(রক্ত দেয়ার আগে শরীরের ভেতরকার তাপমাত্রার সমান করার জন্য ব্যবহৃত যন্ত্র) থাকবে। পাশাপাশি কিডনি ডায়ালিসিস মেশিন, আল্ট্রাসনোগ্রাম, এবিজি মেশিন(মুমূর্ষু রোগীর রক্তে বিভিন্ন উপাদানের মাত্রা নির্ধারণ) থাকতে হবে। তারা বলেন, জরুরী পরীক্ষার জন্য আইসিইউসির সঙ্গে একটি পরীক্ষাগার থাকাও আবশ্যক বলে জানা বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা। জটিল রোগের চিকিৎসায় ও জরুরী প্রয়োজনে আইসিইউর সেবা নিতে হয়। চিকিৎসকরাও এই সেবার কথা ব্যবস্থাপনাপত্রে লেখেন। কিন্তু খরচ করেও কিছু হাসপাতালে সেবা পাওয়া যায় না বলে অভিযোগ উঠেছে। অনেক বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক অভিযোগ করেন, বর্তমানে আইসিইউ একটি ব্যবসায় পরিণত হয়েছে। আইসিইউগুলো কে-কীভাবে চালাচ্ছে, তা সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নিয়মিত নজরদারিতে থাকা উচিত। রাজধানীর নামী হাসপাতালগুলোতে আইসিইউর দৈনিক খরচ ২৫ থেকে ৩০ হাজার টাকা এবং মাঝারি হাসপাতালগুলোতে খরচ ১০ থেকে ১২ হাজার টাকা বলা হলেও তার দ্বিগুণ টাকা দিতে হয় রোগীকে। স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক অধ্যাপক দীন মোঃ নূরুল হক জানান, দেশের প্রতিটি মেডিক্যাল কলেজসহ জেলা সদর হাসপাতালে নিবিড় পর্যবেক্ষণ কেন্দ্র (আইসিইউ) স্থাপনের বিষয়টি সরকারী বিবেচনায় রয়েছে। জেলা সদর পর্যায়ের হাসপাতালে দায়িত্বরত চিকিৎসকরা উদ্যোগী হলে দ্রুত সময়ের মধ্যে প্রতিটি হাসপাতালে আইসিইউ স্থাপন করা যাবে। এজন্য প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি সরবরাহে সার্বিক সহযোগিতা করবে সরকার। এ উদ্যোগ সফল হলে সাধারণ মানুষের দুর্ভোগ অনেকাংশে কমে যাবে। উচ্চ ফি নেয়ার প্রতিযোগিতাও বেশি থাকবে না। রোগী ও তাদের অভিভাবকদেরও আরও বেশি সচেতন হওয়া দরকার।
×