ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

আবদুল গাফ্্ফার চৌধুরী

জন্মদিনের শুভেচ্ছার সঙ্গে যুক্ত করলাম বর্বর হত্যাকাণ্ডের নিন্দাবাক্য

প্রকাশিত: ০৫:৫৪, ১ এপ্রিল ২০১৫

জন্মদিনের শুভেচ্ছার সঙ্গে যুক্ত করলাম বর্বর হত্যাকাণ্ডের নিন্দাবাক্য

ত্রিশে মার্চ আমার বন্ধু রাজনীতিক এবং প্রাবন্ধিক মোনায়েম সরকারের ৭০তম জন্মদিন। ডেনমার্কে ছিলাম। তাই তাকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানিয়ে যে লেখাটা লিখব ভেবেছিলাম, তা যথাসময়ে লিখতে পারিনি। সোমবার লন্ডনে ফিরে এসে কোপেনহেগেনে বেড়ানোর স্মৃতিসহ তাকে জন্মদিনের বিলম্বিত শুভেচ্ছা জানিয়ে লিখব যখন ভাবছি তখনই খবর এলো, ঢাকায় আরেকজন মুক্তমনা তরুণ ব্লগারকে হত্যা করা হয়েছে। তার নাম ওয়াশিকুর রহমান। অভিজিত রায়ের মতোই মুক্ত জ্ঞানের আলোয় উদ্ভাসিত প্রাণ। তাকেও অভিজিত রায়ের পথে পাঠিয়ে দেয়া হলো। মোনায়েম সরকারকে তার ৭০তম জন্মদিনের আনন্দঘন শুভেচ্ছা জানানোর পাশাপাশি একজন তরুণ বুদ্ধিজীবীর শোকস্তব্ধ পরিবারকে হৃদয় নিঙরানো সমবেদনা জানাব কি করে তা ভেবে পাচ্ছি না। কেবল নিন্দা ও প্রতিবাদ জানালেই এই বর্বর হত্যাকা- সম্পর্কে আমাদের দায়িত্ব শেষ হয় না। রবীন্দ্রনাথের ভাষায় বলতে হয়, ‘ক্ষমা যেথা ক্ষীণ দুর্বলতা, হে রুদ্র, নিষ্ঠুর যেন হতে পারি তথা।’ এই হত্যাকা-ের একমাত্র প্রতিকার এই হত্যাকারীদের ধরে চরম দ- দেয়া এবং যারা এবং যে দল এই হত্যাকা-ের পেছনে পরামর্শ ও উস্কানিদাতা, তাদেরও ধরে এনে কঠোর শাস্তিদানের ব্যবস্থা করা। সরকার দেশের সেক্যুলার বুদ্ধিজীবী ও মুক্ত জ্ঞানচর্চায় রত ব্লগারদের রক্ষায় ব্যর্থ হচ্ছে এই অভিযোগটি এখন দ্বিধাহীনভাবে বলতে পারি। মোনায়েম সরকারের জন্যও আমার ভয় হয়। সেক্যুলার চিন্তা-চেতনার মানুষ। একটি গবেষণা কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ব্যবস্থাপক। এই গবেষণা কেন্দ্র থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা, বঙ্গবন্ধুর জীবন ও রাজনীতি এবং বাংলাদেশের সভ্যতা-সংস্কৃতি সম্পর্কে অসংখ্য বই বের করেছেন। এখনও নানা বিষয়ে গবেষণা ও বই প্রকাশ চলছে। তার বাড়িতে নিয়মিত আড্ডা হয় ঢাকার মুক্তবুদ্ধির নবীন-প্রবীণ ব্যক্তিদের। ধর্মান্ধ ঘাতকদের তালিকায় মোনায়েম সরকার এবং তার মতো আরও অনেকের নাম থাকলে বিস্মিত হওয়ার কিছু নেই। কারণ, এই বুদ্ধিজীবী হত্যা শুরু হয়েছে ১৯৭১ সালেই। আমাদের প্রথমসারির বহু বুদ্ধিজীবীকে হত্যা করা হয়েছে। এখন দ্বিতীয় সারির বুদ্ধিজীবীরাও ঘাতকের চাপাতি ও ছোরা থেকে রক্ষা পাচ্ছেন না। এই অব্যাহত হত্যাকা-ের একটিমাত্র লক্ষ্য, দেশের সেক্যুলার ও প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবীদের নিশ্চিহ্ন করা। মুক্তবুদ্ধির চর্চা একদম বন্ধ করা এবং দেশটিতে মধ্যযুগীয় তালেবানতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পথ সুগম করা। মোনায়েম সরকারের মতো মানুষদের জন্মদিনে শুভেচ্ছা জানিয়ে লেখালেখি করি এ কারণেই, ধর্মনিরপেক্ষ এবং সমাজবাদী যে বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্নের বাতি বঙ্গবন্ধু জ্বালিয়ে রেখে গেছেন; তার নিভু নিভু শিখা বাঁচিয়ে রাখার জন্য যে মুষ্টিমেয় নবীন ও প্রবীণ বুদ্ধিজীবী এখনও অসম সাহসিকতার সঙ্গে লড়াই করে চলেছেন, মোনায়েম সরকার তাদের একজন। তার সকল রাজনৈতিক অভিমতের সঙ্গে আমি সহমত পোষণ করি তা নয়; কিন্তু একটা ব্যাপারে আমাদের অভিন্ন মত এবং তা হলোÑ বাংলাদেশকে একটি শোষণমুক্ত ধর্মনিরপেক্ষ সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তোলার লক্ষ্যে অবিচল থাকা। বাংলাদেশে হিংস্র মৌলবাদ পরাজিত হবেই এবং একাত্তরের অসমাপ্ত বিপ্লব সমাপ্ত ও সফল হবেই এই বিশ্বাসও আমাদের মনে অটুট। এই বিশ্বাস পোষণ করতে গিয়ে মোনায়েম সরকারকে চড়াদামও দিতে হয়েছে। আওয়ামী লীগ হাইকমান্ড তাকে ভুল বুঝেছেন। দীর্ঘ দশ বছর তাকে থাকতে হয়েছে রাজনৈতিক নির্বাসনে। তার শত্রু ও সমালোচকের সংখ্যা বেড়েছে। কিন্তু তিনি দমেননি। রাগ করে নীতিচ্যুত হননি। ধৈর্য ধরেছেন। সক্রিয় রাজনীতি থেকে গবেষণাধর্মী রাজনীতিতে চলে এসেছেন। বই লিখেছেন, অন্যের দ্বারা লিখিয়েছেন। মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের পতাকা তিনি দৃঢ় হাতে এখনও ধরে রেখেছেন। এখানেই তার চরিত্রের বৈশিষ্ট্য। একজন অতি বড় মাপের মানুষের জন্মদিনেই কেবল শুভেচ্ছা জানাতে হবে বা তার জন্মদিন পালন করতে হবে এই তত্ত্বে রবীন্দ্রনাথও বিশ্বাস করতেন না। তিনি লিখেছেন, “একতারা যাহাদের তারাও সম্মান যেন পায়।” মোনায়েম সরকার যে তার ৭০ বছরের জীবনে শুধু একতারা বাজিয়েছেন তা নয়; বরং দেশের প্রগতিশীল রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক বহুমুখী ধারার প্রতিনিধিত্ব করেছেন। পুরোপুরি বাম ধারার রাজনীতি থেকে তিনি মধ্যবাম ধারায় চলে এসেছেন। বাকশালের রাজনীতি করেছেন। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে পরিচালিত আওয়ামী মধ্যবাম ধারায় অবস্থান নিয়েছেন। সাংস্কৃতিক আন্দোলনে তার অবস্থানটি রয়েছে সব সময় বাম প্রগতিশীল ধারায়। এটিই তার চরিত্রকে একটি বৈশিষ্ট্য দান করেছে এবং কোন বিচ্যুতি ও বিতর্কে না জড়িয়ে প্রগতিশীল আন্দোলনের সকল ধারার সঙ্গে সম্পর্কিত থাকতে পারছেন। এখানেই আমার আশা এবং আশঙ্কা। আশা, মোনায়েম সরকারের মতো মধ্য বামধারার রাজনীতি ও সংস্কৃতিমনা ব্যক্তিরা যতদিন বেঁচে থাকবেন ততদিন ডান ও বাম এই দু’দিকের উগ্রপন্থী অংশের সংঘর্ষ ও হামলা গণতান্ত্রিক বাংলার ভিত্তি ধ্বংস করতে পারবে না। আশঙ্কা এই যে, উগ্র ডানপন্থীরা এখন যেভাবে বাম, মধ্যবাম নির্বিশেষে মুক্তবুদ্ধির মানুষ মাত্রকেই হত্যা করতে শুরু করেছে এবং গণতান্ত্রিক সরকার কঠোরতার সঙ্গে তাদের রক্ষা করতে পারছে না, তখন দেশটির ভবিষ্যত কি? সদ্য নিহত অভিজিত রায়ের বাবা অধ্যাপক অজয় রায় সম্প্রতি সংবাদপত্রে প্রদত্ত একটি সাক্ষাতকারে সঙ্গতভাবেই বলেছেন, “আমি বিশ্বাস করি বাংলাদেশ সরকারের গোয়েন্দা বিভাগ যদি আন্তরিকভাবে চায়, মাটির গভীর থেকেও হত্যাকারীদের ধরে আনতে পারে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে সেই চাওয়া কতটা? যেখানে হত্যাকা- সংঘটিত হয়েছে বইমেলা উপলক্ষে সেই এলাকা তিনস্তর নিরাপত্তা ব্যবস্থার আওতায় ছিল। হাজার হাজার লোক সেখানে চলাচল করছে। মাত্র কয়েক গজ দূরে দাঁড়িয়ে পুলিশ। আক্রান্ত হওয়ার পর আমার বউমা চিৎকার করছে আপনারা আসুন, আমাদের বাঁচান। কেউ এগিয়ে আসেনি। পুলিশ কা- দেখছে। তারা নাকি মনে করেছে ছাত্রলীগ মারামারি করছে। অর্থাৎ সরকারী দলের কেউ মারামারি করলে পুলিশের করার কিছু নেই। দেশ কোথায় গেছে দেখুন!” পুলিশ ঘটনাস্থলে উপস্থিত থেকেও সক্রিয় হয়নি, তার অর্থ সরকারী প্রশাসনের ভেতরেই এই ঘাতকদের দমনে শৈথিল্য রয়েছে। সর্ষের ভেতর ভূত থাকলে সেই ভূত তাড়াবে কে? অভিজিতের রক্ত মাটিতে না শুকাতেই ওয়াশিকুর রহমানের হত্যাকা- কি করে সংঘটিত হয়? দেশ কি তাহলে মগের মুল্লুকে পরিণত হয়েছে? ওয়াশিকুর রহমানের হত্যাকারীদের দু’জন ধরা পড়েছে। তারা মাদ্রাসার ছাত্র। অনেক মাদ্রাসা এখন জঙ্গী রিক্রুট ও জঙ্গী ট্রেনিংদানের আখড়া। এগুলোকে মুক্ত ও সংস্কার করার আগে সরকার আরবী বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের ঘোষণা দিয়েছেন। শঙ্কিত হয়ে ভাবছি, দেশের একশ্রেণীর মাদ্রাসা যদি হয় ঘাতক সংগ্রহ ও তাদের ট্রেনিংদানের সেন্টার, তাহলে প্রস্তাবিত আরবী বিশ্ববিদ্যালয় না আবার জঙ্গী রিক্রুটের হেডকোয়ার্টার হয়ে দাঁড়ায়! অধ্যাপক অজয় রায় বলেছেন, “আমাদের রাজনীতি এবং ধর্মান্ধতার সঙ্গে আপোস করে চলার মানসিকতা, ভোটের রাজনীতি উগ্র মৌলবাদ দমনের প্রধান অন্তরায়। কথাটা সত্য। গণতন্ত্র যখনই তার চরম শত্রু হিংস্র মৌলবাদের সঙ্গে আপোস করে বাঁচতে চেয়েছে তখনই তার পরাজয় ও পতন হয়েছে। মিসরের প্রেসিডেন্ট সাদাত মুসলিম ব্রাদারহুডের সঙ্গে আপোস করে বাঁচতে চেয়েছিলেন। পারেননি। জার্মানিতে হিন্ডেনবার্গ সরকার ফ্যাসিবাদের প্রতি এ্যাপিজমেন্ট নীতি অনুসরণ করে তার দেশে গণতন্ত্রকে রক্ষা করতে চেয়েছিলেন। পারেননি। বাংলাদেশের হিংস্র মৌলবাদের সঙ্গে সহাবস্থান সম্ভব বলে যদি বর্তমান সরকার ভেবে থাকেন তাহলে বিরাট ভুল করছে। একাত্তরের দ-িত যুদ্ধাপরাধীদের দ- কার্যকর করার ব্যাপারে বিলম্ব হেফাজতিদের অর্থবিত্তদান, জঙ্গী ঘাতকদের ধরার ব্যাপারে শৈথিল্য, আরবী বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের পরিকল্পনা সরকারের একটি নীতির দিকেই ইঙ্গিত দিচ্ছে, তা হলো চরম আপোসের নীতি। অভিজিত রায়ের পর পরই ওয়াশিকুর রহমানের হত্যাকা-ে সরকারের চোখ খুলবে, তা মনে হয় না। এই মুহূর্তে মোনায়েম সরকারের মতো সুস্থ ও মুক্তচিন্তার মানুষদের সক্রিয় ভূমিকা একান্ত প্রয়োজন। তারা ঐক্যবদ্ধ হোন। সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করুন। সরকার যেন আপোস ও এ্যাপিজমেন্টের নীতি ত্যাগ করে। বুদ্ধিজীবী ও ব্লগাররা প্রতিরোধ আন্দোলন গড়ে তুলুন ঘাতক ও দুর্বৃত্তদের প্রতিরোধে, গণজাগরণ মঞ্চ আবার সংঘবদ্ধ ও সক্রিয় হোক। আজ জন্মদিনের শুভ কামনা ও হত্যাকা-ের নিন্দাবাক্যের সঙ্গে আমার এই প্রার্থনা যুক্ত হলো।
×