ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

অজয় দাশগুপ্ত

সিডনির মেলব্যাগ

প্রকাশিত: ০৬:১৩, ৩১ মার্চ ২০১৫

সিডনির মেলব্যাগ

ক্রিকেট হোক হাতিয়ার এক. আমি যখন সিডনি ক্রিকেট গ্রাউন্ডের সামনে গিয়ে পৌঁছালাম তখন দেখি বাইরে লোকে লোকারণ্য। মানুষের আনন্দ-ফুর্তির এমন ঔজ্জ্বল্য দেখিনি অনেকদিন। আমার এক ফেসবুক বন্ধু লিখেছেন, তিনি অজিদের সমর্থন করতেন না, কারণ তাঁর মনে হয় এরা মেশিন। মন্তব্যটা আমার কাছে প্রণিধানযোগ্য মনে হয়েছে। উপমহাদেশে যেমন সবকিছু খুব আবেগতাড়িত এখানে ঠিক তার বিপরীত। আবেগের জায়গাটা এরা এতটা নিয়ন্ত্রণে রাখে মাঝে মাঝে এদের মেশিন মনে হওয়াটাই স্বাভাবিক। ভাল করে খেয়াল করলে বোঝা যাবে হাততালিগুলোও মাপা। এবার বাংলাদেশ শ্রীলঙ্কা ভারত আসাতে এবং একযোগে খেলাগুলো হওয়ায় সে চিত্র পাল্টে যেতে দেখলাম। সে কারণে খেলাগুলো যত উপভোগ্য ততটাই হয়েছিল তর্কমুখর। এটার ভাল-মন্দ দুটো দিক আছে। আবেগ ভাল আবেগে মানুষ ঐক্যবদ্ধ হয়, তাদের ভেতর প্রীতি গড়ে ওঠে, দেশপ্রেম চাঙ্গা হয়। ফের এরও একটা সীমা আছে। যদি সে সীমা পেরিয়ে যায় তখন তার কুফলগুলো বেরুহতে শুরু করে। বাংলাদেশ হারার পর দেশ আর দেশের বাইরে ন্যায্য প্রতিবাদ আর জালিয়াতির জায়গাটা ধরতে গিয়ে আমাদের যুক্তি যেন বাগে থাকছে না। এগুলো বলার ভেতরও বিপদ আছে। সাধারণ মানুষের সহজ আবেগকে বিভ্রান্ত করার রাজনীতি এখন ময়দানে। দেশের রাজনীতি ও আগুন নিয়ে খেলার মানুষগুলোর যখন সময় মেলে তখন সুযোগ পেয়ে সাম্প্রদায়িকতাকে সামনে টেনে আনে। এবারও তার ব্যবহার করতে চাইছে তারা। দেশের জয় যেমন সবার জয়, পরাজয় বা যে কোন কারণে তার অপমান বা লাঞ্ছনাও সবার জন্য সমান মনোবেদনার। এটা কেন মানা হবে না? কারা তা মানতে চায় না? আমরা কি এদের চিনি না? চিনি। কিন্তু আবেগের কারণে তাদের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে পারি না। খেলার ভেতর যে শক্তি বা আনন্দ তাকে নিঃশেষ করে, এরা আমাদের যে লোকসান বা লস করতে সচেষ্ট, সে জায়গাটা আবারও মনোযোগ দাবি করছে। লেখাটা লেখার সময় দেখলাম কোথাও কোথাও সংখ্যালঘুদের ওপর নাকি আক্রমণ হয়েছে। খেলা তো এখন শেষ। এখন আমাদের হিসাব-নিকাশের পালা। ভারত তার যোগ্য শাস্তিও পেয়ে গেছে। সব জায়গায় বা সবার বিরুদ্ধে দাদাগিরি চলে না। দাদাগিরি বন্ধের জন্য আমাদের যে ঐক্য আর ভালবাসার প্রয়োজন সেটা কেবল ঘৃণার ভেতর দিয়ে পারা যাবে না। এর সঙ্গে চাই কৌশল। শক্তি সঞ্চয়ের জায়গাটা যেন কিছুতেই দুর্বল না হয়। তা হলে আমরা ভবিষ্যতেও এমন ষড়যন্ত্রের শিকার হতে পারি। এখন অবধি কেবল কথা আর তর্ক দেখছি। এ জায়গা থেকে ঘুরে দাঁড়ানোর ব্যাপারটা নিয়ে কেউ তেমন কিছু বলছে না। যেভাবে আমরা প্রায় সব কিছুতে হিসসা হারাই বা পেছনের দিকে চলে যাই খেলার বেলায়ও কি তাই করব? বিশ্বের দেশে দেশে বাংলাদেশীদের যে অবস্থান আর শক্তি তাকে সংহত করার কাজটি কোথায়? আমি বিস্ময়ের সঙ্গে দেখছি, বাংলাদেশের মানুষজনকে বোঝানো হচ্ছে বা তারা মানছে ভারত মানে কলকাতা। এটা হাস্যকর। তাদের ভাষা আর আমাদের ভাষা এক বলেই হয়ত তাদের প্রতিক্রিয়ায় আমরা সঙ্গে সঙ্গে জ্বলে উঠছি। কিন্তু মূলত পশ্চিমবঙ্গের বাঙালীরাও অসহায়। ভারতীয় দলে আসলে তাদের কোন প্রতিনিধিও নেই। মোহাম্মদ শামী আধাআধি। বাকিরা ভারতের যে সব জায়গা থেকে এসেছেন সেখানে আমাদের প্রতি মমত্ব না থাকাটাই স্বাভাবিক। মাড়োয়ারী বুদ্ধি বলে যে কথাটা চালু তার কারণে যে জুয়া আর অক্রিকেটীয় আচরণ সেটা বুঝতে হবে এবং সে জায়গাটায় আঘাত করতে হবে। বলছিলাম সেমিফাইনালের কথা। আনন্দ-ফুর্তি আর উল্লাসের জায়গাটা মূলত উপমহাদেশের হাতে। আমাদের বিপুল জনগোষ্ঠী আর ক্রমে বড় হয়ে ওঠা ক্রিকেট শক্তিকে যারা অশ্রদ্ধা করছে তাদের সমুচিত জবাব দেবার কাজটা হবে নিজেদের ঐক্যে। সেটা কিছুতেই বিনষ্ট করা চলবে না। জামায়াত-বিএনপির ভ- দেশপ্রেম আর মায়াকান্নায় বিচলিত হবার পরিবর্তে মানতে হবে এ দেশ স্বাধীন সর্বভৌম বলেই আজ আমরা এই জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছি। বঙ্গবন্ধু জাতীয় পতাকা আর সোনার বাংলার যে শক্তি তাকে যারা মানে না তারা কেন ক্রিকেটের ফ্যান হবে আমাদের? তাদের কথা শুনলে আজ আমরা পাক ভারতের গোলাম হয়ে থাকতাম ।যে দেশ গোলামী পেরিয়ে মাথা উঁচু করে বাঁচতে জানে সে তার অধিকার বা হকও আদায় করতে পারবে। ক্রিকেট যেন তার হাতিয়ার হয়ে ওঠে। দুই. আমার মা খুব ধার্মিক ছিলেন অথচ আমার মায়ের পুজোর বাসন কোসন সাফ করা আর আমৃত্যু নিত্যসঙ্গী ছিল জরিনা। এই সেদিনও জরিনা মাকে স্বপ্ন দেখে সারাদিন মন খারাপ করে ছিল। আমি একমাত্র ছেলে হবার পরও মাকে অতবার স্বপ্নে দেখিনি সে যতবার দেখেছে। ধার্মিক মা স্বর্গ না অন্য কোথাও আছেন আমি জানি না, জানতে চাইও না। কিন্তু এটা জানি মা তাঁর জীবনে কোন স্নানকে স্বর্গে যাবার রাস্তা মনে করে পদদলিত হয়ে মারা যায়নি। লাঙ্গলবন্দের যে নদীতে স্নান করতে গিয়ে আজ কিছু মানুষ পদদলিত হয়ে মারা গেলেন তাঁরা কি জানতেন না এই নদের পাশে আরেক নদীতে বস্তাবন্দী মানুষের লাশ ভেসে ওঠে? এসব নদ-নদী পানি দূষণের বড় হাতিয়ার। মানুষ কি ভুলে গেছে আমাদের দেশের কোটি কোটি ভাল হিন্দু এসব নোংরা জলে স্নান করা ছাড়াই স্বর্গে যাবার পথ তৈরি করে নিয়েছিল? ধর্ম এখন এত নোংরা জলে সীমাবদ্ধ হয়ে গেছে? যে ধর্মবোধ পদদলিত করে মানুষের জীবন কেড়ে নেয় তার নাম পুণ্যস্নান? এর চেয়ে অনেক ভাল পাপের স্বচ্ছ জলে নির্মল অবগাহনে সাঁতার কাটা। দুঃখবোধ থাকলেও আহাম্মক বিশ্বাসীদের জন্য আমার মায়া হয় না। ঈশ্বর কি তার সফেদ শুভ্র সোনায় মোড়ানো জায়গায় নোংরা দূষিত পানিতে স্নান সারা মানুষদের আসলেই ঠাঁই দেবেন? [email protected]
×